কাননবালা পর্বঃ২৫

0
846

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৫

জানালা গলে ভোরের পেলব রোদ এসে তাজের মুখে পড়লো, তাজ কপাল কুঁচকে চোখের উপর হাত রাখলো।পাশ ফিরতে গিয়ে অনুভব করলো শরীরের উপর ভারি কিছু।ভালো করে তাকাতেই তাজের দৃষ্টিতে বিস্ফোরণ ঘটলো যেন।সেতু লেপ্টে আছে তার শরীরের সাথে!দু’জনের পরিস্থিতি বিধ্বস্ত। তাজ বড় করে দম ফেললো। এটা না হলেই পারতো? বুক ভার হয়ে আসলো।আস্তে করে সেতুকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে পরলো।সারা রাতের জ্বরের কারণে মাথা ভার হয়ে আছে।তাজ ধীর পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে কটাক্ষ করে বললো,”তুমি এরপরও নিজেকে মানুষ বলে দাবী করো?এতটা অধপতন কবে হলো তোমার!”

ফ্রেশ হয়ে শার্ট প্যান্ট পরে তাজ বেড়িয়ে পরলো।শনিবার অফিস নেই। তবুও বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো।একরকম পালিয়ে বেড়ানো যাকে বলে!নিজেকে চোর চোর মনে হতে লাগলো তাজের!এর থেকে মৃত্যুও বরং ভালো!
তাজ চলে যেতেই সেতু চোখ মেললো।চোখের কার্নিশে জল জমেছে! তাজের প্রস্থানে সেতুর মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটালো না!

বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল করলো একটা নম্বরে।
নীতু চা করছিল।এই সময়ে সেতুর কল দেখে গ্যাসের আঁচটা কমিয়ে কল রিসিভ করে বললো,”হ্যা বল!এতো ভোরে কি মনে করে?”
সেতু শীতল কন্ঠে বললো,”আপা, একটা জীবন কাটিয়ে দিতে ভালোবাসা থাকা কতটা জরুরী? ”

নীতুর কপাল কুঁচকে গেলো।এরকম উদ্ভট প্রশ্ন শুনে।তবুও বললো,”সেতু, একটা জীবন কাটিয়ে দিতে ভালোবাসার থেকেও ভালো থাকাটা জরুরী! ”

“আপা রাখছি।”….. বলে সেতু কট করে লাইন কেটে দিলো।নীতু কিছুই বুঝলো না সেতুর আগামাথা হীন বক্তব্যের! ফ্যালফ্যাল করে করে তাকিয়ে রইলো টগবগ করে ফুটতে থাকা চায়ের পানির দিকে।

তাজ সারাদিনে বাসায় ফিরলো না।রাতে ফিরলো ক্লান্ত শরীরে! সিগারেট আর চা ছাড়া সারাদিন কিছুই খায়নি।পেটের ভিতর মোচড় দিচ্ছে। সেতু পড়ছিল।তাজকে দেখে খুবই স্বাভাবিক স্বরে বললো,” ভাত দিবো আপনাকে?”
তাজ একবার চাইলো সেতুর দিকে।অভিযোগ বিহীন স্বাভাবিক ব্যবহার। মনে হচ্ছে নিত্য নৈমেত্তিক ঘটনা।এতটা স্বাভাবিকতা কি আদৌও আছে এই সম্পর্কে? তাজ নিজেও স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,”দাও।”

দুটো মানুষ টেবিলের দুপাশে বসে আছে।রুম জুড়ে পিনপন নিরবতা। সামনে খাবার।খিদে থাকা স্বত্বেও দুজনের কেউই খেতে পারছে না।একজন চাচ্ছে অপরপক্ষ আত্মসমর্পণ করুক,দুটো কৈফিয়ত দিক!আর একজন চাইছে কিছু না বলুক অপর পাশের মানুষটা! সবকিছু থেকে পালাতে ইচ্ছে করছে।
খাবার নাড়াচাড়া করে গেলো দুজনেই।কেউই খেতে পারলো না।একটা সময়ে সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।কান্নার দমকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে! তাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। দুচোখের পাতা বন্ধ করে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।এর শেষ কোথায়?চেয়ার ঠেলে তাজ উঠে পরলো।সদর দরজা পেরিয়ে নেমে পরলো রাস্তায়! সারারাত বাহিরে কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।দমবন্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো!

************
নীতু নিখিলের কাছে ভিডিও কল দিয়ে বললো,” ভাইয়া বাবার সাথে কথা বলিয়ে দাও।বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

বাবা ছলছল চোখে তাকিয়ে নীতুকে দেখছে।ঘড়ঘড় করে আওয়াজ বের হচ্ছে কন্ঠ থেকে।কিছুই বলতে পারছে না। নীতু বাবার কষ্ট দেখে কেঁদে ফেললো। মহিমা বেগমও পাশে বসে মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে।বাবার চোখের মিনতি বলছে,”কবে আসবি মা?”
“আসবো বাবা।একদিন এসে তোমাকে চমকে দিবো।”
মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নীতু কল কেটে দিলো।নীতুর ফিরতে ইচ্ছা করলেও মন সায় দেয় না।বাড়িতে গেলেই সবার এক প্রশ্ন,”বয়স তো পেড়িয়ে যাচ্ছে, বিয়ে করবি কবে?”
আত্মীয়রা মাকে নানান কথা বলে অতিষ্ট করে ফেলবে তখন মা নামক মানুষটা বিষন্ন চোখে নীতুর দিকে তাকিয়ে থাকবে।কান্নাকাটি করবে।তার থেকে দূরে থাকাই ভালো!

**********
রাত দশটা।জায়েদ বাসার নিচে নেমেছিল ফ্লেক্সিলড করতে।অভীক তখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরছিল।জায়েদকে হাঁটতে দেখে পিছন থেকে অভীক বলে উঠলো,” দাদাভাই,একটু দাঁড়াবেন। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

জায়েদ থমকে দাঁড়ালো।অভীক বড় বড় পা ফেলে জায়েদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,”কেমন আছেন দাদাভাই? ”
জায়েদের শান্ত মেজাজ গরম হয়ে গেলো। গতকাল মেহমান ছিল বলে কিছু না বললেও আজ মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না।কিড়মিড়িয়ে বললো,”আমাকে দাদাভাই ডাকার অধিকার কেবল একজন মানুষের।আর সেই মানুষটা এবং তার দাদাভাই ডাক দুটোই আমার প্রিয়। বাহিরের কেউ আমাকে দাদাভাই বলে ডাকুক তা আমার একদমই পছন্দ নয়।”
অভীক জায়েদের থমথমে মুখ দেখে হাসলো।এরপর বললো,”আজ থেকে না হয় সেই একজন মানুষের সংখ্যা বেড়ে দুজন হলো।মন্দ কি দাদাভাই? ”
জায়েদ মনে মনে বেয়াদব বলে গালি দিয়ে বসলো অভীককে।
অভীক এবার সিরিয়াস কন্ঠে বললো,”দাদাভাই আপনার আমার সাথে রাগ করা যৌক্তিক। কিন্তু আমাকে আমার বিষয়টা কনফেস করতে দিন।”
জায়েদ অভীকের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো,”তুমি নীতুকে পছন্দ করো?”
অভীক এমন সোজাসাপটা প্রশ্নে খানিক চমকালো কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই জায়েদ আবার বললো,”উত্তরটা আমি বলছি শুনো,তুমি নীতুকে পছন্দ করো। এবং তুমিই নীতুকে অযোগ্য বলেছিলে।সেই অযোগ্য মেয়েটাকে আজ তুমি পছন্দ করো,কি হাস্যকর তাইনা?”
চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসলো অভীকের।করুণ নেত্রে বললো,”দাদাভাই আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন! ”

জায়েদ মৃদু হেসে অভীকের কাঁধে নিজের ডান হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে বললো,”নীতু সবাইকে খুব সহজে মাফ করে দিতে পারে।নীতুর প্রিয় জিনিস কেউ কেড়ে নিলেও নীতু তাকে ক্ষমা করে দিবে।কিন্তু আমি নই!আমার নীতুকে আবার কেউ দ্বিতীয়বার ভেঙে গুড়িয়ে দিতে আসুক আমি তা চাই না।অনেক কষ্টে নীতু নিজেকে সামলিয়েছে,গাঢ় আধারে ডুবে যেতে যেতে নতুন ভোরের আলোয় নিজেকে রাঙিয়েছে!এবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে আমি তাকে খুন করতে দু’বার ভাববো না!”…..বলে জায়েদ হনহন করে হেঁটে চলে গেলো।

অভীক এমন শান্ত কন্ঠের থ্রেট প্রথমবার শুনলো। মুখটা চুপসানো বেলুনের মত হয়ে আসলো। বাসায় প্রবেশ করতেই অনীক বললো,”কিরে কি হয়েছে তোর?কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে। ”

অভীক সোফায় ধপ করে বসে বললো,”বড়ো, খুব কঠিন হবে নীতুকে পাওয়া! ”

অভীকের কন্ঠে হালছাড়া ভাব! অনীক ভাইয়ের পাশে বসে বলে,”আমিও চাই পথটা কঠিন হোক!”
অভীক কপাল কুঁচকে বলে,”বড়ো, তুমি কি ভাই নাকি শত্রু?”
“খুব সহজে অনেক আকাঙ্খিত কিছু পেয়ে গেলে আমরা তার মূল্যায়ন করতে জানি না! তাই নীতুকে জয় করতে না হয় খানিক কষ্টই করলি?”

অভীক সোফায় শরীর এলিয়ে বলে,”বড়ো,পথটা কঠিন হোক তবুও নীতু আমার হোক।কঠিন পথটা পাড়ি দিয়ে যদি আমায় শূন্য হাতে ফিরতে হয় তবে আমি শেষ হয়ে যাবো!স্রেফ মরে যাবো ভাই!মেয়েটা কখন আমায় এতটা কাবু করলো?আমার অজান্তে কখন এতটা কাছে আসলো?”

অনীক ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলো মায়া মায়া চোখে! অভীক ফের বললো,”আজ নীতুর দাদাভাই একটা ভয়ংকর কথা বলেছে বড়ো!অনেক কিছুই আমার অজানা!কেন দ্বিতীয়বার শব্দটা উচ্চরিত হলো জানি না?তবে এতটুকু জানি, নীতুকে আমার পেতে হবে!”

ঠিক সেই সময় রুমি সোফায় এসে বসলো।দুজনের দিকে তাকিয়ে আশাহত কন্ঠে বললো,”কালো একটা মেয়ের মাঝে তোমরা কি পেলে বলতো?যার জন্য এতটা মরিয়া হলে?অভীকের মত সুদর্শন পুরুষের পাশে নীতু নামের মেয়েটি বড্ড বেমানান!”

অনীক গরম চোখে চাইলো বউয়ের দিকে!অভীক শীতল কন্ঠে বললো,”ভাবি আমার অনুরোধ থাকবে দ্বিতীয়বার আর তুমি এমন কোন কথা বলবে না।না হলে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হবো, তুমি আমার ভাইয়ের বউ।”…….বলে অভীক হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

***************
দিন রবিবার। সবাই ব্যস্ত যার যার কাজে।নীতু নিজের ডেস্কে কাজ করছিল।অভীক নিজের কেবিনে প্রবেশ করার সময় আড়চোখে একবার লক্ষ্য করেছে নীতুকে।নীতুর মুখটা থমথমে!কিছু হয়েছে কি?প্রশ্ন জাগলো অভীকের মনে। মেরুন রঙের থ্রি পিস পরা নীতু। লস্বা চুলে এলানো বেণী।অলংকার বিহীন চোখের কাজলটুকুই অভীককে ঘায়েল করতে যথেষ্ট! অভীক দ্রুত পায়ে নিজের কেবিনে প্রবেশ করলো। কেবিনে বসতেই মানিক নামে একটা আঠারো উনিশ বছরের ছেলে অভীকের কেবিনে নক করলো।অভীক তাকে আসতে বলে নিজের কোটটা খুলে চেয়ারে রাখলো।পানি পান করলো। মানিক এই অফিসে ফাইল এক টেবিল থেকে আর এক টেবিলে আনা নেয়ার কাজ করে আর সবাইকে চা বানিয়ে দেয়।ছেলেটা খুবই চটপটে স্বভাবের! অভীক হাসি মুখে বললো,”কিছু বলবে মানিক?”
মানিক ঘটনা হুবহু বলতে প্রস্তুতি নিল।হাত নেড়ে নেড়ে বলতে শুরু করলো, “স্যার ঘটনা প্রথম থেইকাই বলি।হইলো কি নীতু আফায় অফিসে এসে বসলো।ওয়ার্কিং আওয়ার তখনো শুরু হয়নি।তখনি পলাশ ভাই এসে হাজির।নীতু আফারে হাসিমুখে কইলো,” নীতু আজ আমার জন্মদিন। ”
আপনেই বলেন হের জন্মদিন তা দিয়ে আফায় কি করবো?
অভীক বললো,”মূলটুকু বলো।কাহিনী পড়ে শুনবো।”

মানিক বলতে লাগলো, “এরপর নীতু আফায় হাসি মুখে বললো,শুভ জন্মদিন পলাশ ভাই। পলাশ ভাইয়ে তো খুশিতে গদগদ।এরপর বললো, নীতু জন্মদিনের ট্রিট চাই।
নীতু আফায় বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো।পলাশ ভাই ফের কইলো,বেশি কিছু না।কফি খাওয়াতে হবে। নীতু আফায় মুখে জোর করে হেসে কইলো, আজ তো সম্ভব না পলাশ ভাই।আমার পরিবার এসেছে।তারা আজ সন্ধ্যায় চলে যাবে।আমার সেখানে থাকাটা জরুরী।
আপনে বিশ্বাস করেবন না স্যার, এরপরও পলাশ ভাই কইলো, ঠিক আছে নীতু।আজ না হলেও হবে।আমরা না হয় আগামীকাল বসবো।
নীতু আফায় খাবি খাওয়া মাছের মত হাসফাস করতে করতে রাজি হলো।

পলাশের কান্ডে অভীকের মেজাজ গরম হলেও মানিকের বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললো।মানিব্যাগ থেকে দুটো দু’শ টাকার নোট মানিকের হাতে দিয়ে বললো,” গুড জব।চোখ কান এভাবেই খোলা রাখবে।”
মানিক কচকচা টাকার দিকের তাকিয়ে হাসি মুখে বললো,”আপনার কথার নড়চড় হবে না।”
মানিক চলে যেতে যেতে ভাবতে থাকলো, স্যারে নীতু আফার কাছে কি পাইছে আল্লাহ জানে?তবে আমার জন্য যে আফায় লক্ষী তা নিশ্চিত!

অফিসে বসে অভীকের নীতুর দিকে লক্ষ্য রাখা মুশকিল।তাই মানিককে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।অভীকও দেখতে চায় নীতু কি করে পলাশের সাথে কফি খেতে যায়!
যাকে নিয়ে এই দ্বন্দ সে কি আদৌও এই খবর রাখে?

চলবে,
লেখার স্বাধীনতা চাইবো আপনাদের কাছে।কাননবালা গল্পটা আগে থেকেই আমার মস্তিষ্কে সেট করা।এখন যদি আপনাদের মনমতন লিখতে চাই আমি সন্তুষ্ট হবো না। তবে এতটুকুই বলবো অসন্তোষ হবেন না আশাকরি।শেষ পর্যন্ত পড়ুন ইনশাআল্লাহ ভালো লাগবে। আজ ছোট হয়েছে জানি কিন্তু সামনে আমার পরিক্ষা পড়তে হচ্ছে। তাই দেরিও হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here