কাননবালা পর্বঃ১২

0
912

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১২

পলাশ হাসান বসে আছে কোম্পানির চেয়ারম্যান তথা বড় স্যারের রুমে।কাঁচা পাকা ভ্রুর নিচে মোটা নাকের উপর হাই পাওয়ারের চশমা পরা বড় স্যার!টেবিলের উপর রাখা ফাইলে মনোযোগী দৃষ্টি! পলাশ ফাইলের ইন্সট্রাকশন বুঝিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষন আগে।বড় স্যার ফাইলটা পুনরায় রিচেক করলো।তারপর কিছুটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,” পলাশ নতুন এন্ট্রি নেয়া মেয়েটার কি খবর?পারফরম্যান্স কেমন?অভিজ্ঞতাহীন কর্মী কোম্পানির জন্য হুমকি।তবুও নিতে হলো অনুরোধ রক্ষাত্রে।তোমার আন্ডারেই তো মেয়েটির গ্রুমিং চলছে।পারফরম্যান্স ভালো না হলে জবে তো রাখা যাবে না।”
বত্রিশ বছর বয়সী অত্যান্ত যোগ্যতা সম্পন্ন পুরুষ পলাশ।বর্তমানে কোম্পানির মিড টার্মে প্রোগ্রামিং সেকশনে আছে। সাথে নতুনদের গ্রুমিংটাও সে শিখিয়ে থাকে।পলাশ শিরদাঁড়া সোজা করে কন্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে,” স্যার মিস নীতু এক আশ্চর্যজনক মেয়ে! সবকিছু এতটা পারফেক্টলি করে তা একদম অবিশ্বাস্য! মাত্র দেড় মাসেই অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে কোম্পানির। আমার আন্ডারে যত নতুন এন্ট্রি এসেছে তার মধ্যে মিস নীতু অন্যরকম।ভীষণ কর্মোঠ আর মনোযোগী!সাধারণ ডিপ্লোমা করা একজনের থেকে এটা আমি আশা করিনি।স্যার আপনাকে আমি শিওর করতে পারি মিস নীতু আমাদের কোম্পানির জন্য একদম পার্ফেক্ট!”
বড় স্যার মাথা নাড়িয়ে বলেন,”আই সি।তুমি এখন আসো পলাশ।আর ডাটা সেকশনের প্রজেক্ট গুলো একবার চেক করো।”
পলাশ বড় স্যারের কেবিন থেকে বেড়িয়ে পরে।নীতুকে নিয়ে সে যা এতক্ষণ বলেছে তা একটুও বাড়িয়ে বলেনি।মিস নীতুর কর্মদক্ষতা পলাশকে সত্যিই অবাক করেছে।

পলাশ অন্যান্য এন্ট্রির মত নীতুকেও সেই ভাবে ট্রিট করছিল।ওয়ার্ক স্পৃহা ভালো দেখে কাজ বাড়িয়ে দিত।দিন কয়েক আগ পর্যন্ত নীতু তার কাছে একজন সাধারন মেয়ে হিসেবেই গন্য হয়েছে কিন্তু পাঁচ দিন আগে নীতু সার্ভার প্রজেক্টে মারাত্মক রকম ভুল করে ফেলে।তা দেখে পলাশের মাথা গরম হয়ে।ভীষণ রাগারাগি করে। নীতু চুপচাপ রাগ হজম করে নেয়।পলাশ একটা ফাইল আনতে যেই না উঠে গেলো পাশের ডেস্কের মেয়েটা নীতুর সাথে পলাশের সম্বন্ধে আজেবাজে কথা বললো।মেন্টর হিসেবে পলাশ অযোগ্য তাও বুঝাতে চাইলো।পলাশ আড়ালে থেকেই শুনতে পেলো নীতু মেয়েটিকে হাসিমুখে বলছে,” আপু মেন্টর হিসেবে তিনি আমাকে বকা দিতেই পারেন।তাছাড়া এই সেকশনটা তিনি আমাকে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন তারপরও আমি ভুল করেছি।তাই আমি মনে করিনা পলাশ স্যার এখানে কোন অন্যায় করেছেন।”

নীতুর এমন মন্তব্যই পলাশকে নীতু সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছে।তার পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারে মেন্টর হিসেবে অনেকের কাছ থেকেই অনেক তিক্ত মন্তব্য শুনেছেন।কাজ শিখে অমূল্যায়ন করতে দেখেছে।নীতু তার বিপরীত। মেয়েটা শ্যামবর্ণের।এভারেজ বাঙালি রুপ।নাক ঠোঁট সবকিছুই সাধারণ কেবল চোখ দুটো ভীষণ মায়াকারা।পলাশ সেদিনের পর থেকে নীতুকে পর্যবেক্ষণ করেছে।নীতুর বিহেভিয়ার সত্যিই তাকে মুগ্ধ করেছে।

লাঞ্চ টাইমে নীতু কেন্টিন এড়িয়ায় বসে খাবার খেতে শুরু করলো।একটু পরই পলাশ এসে নীতুর সামনের চেয়ারে বসলো।নীতু পলাশকে দেখে আড়ষ্টভাবে চেয়ে মৃদু হাসলো। পলাশ পাল্টা হাসি দিয়ে বললো,”রিল্যাক্স মিস নীতু।আমি এখনে তোমার বস নই তাই এমন ভয়ে জড়সড় হওয়া বন্ধ করো।নিজেকে কেমন স্কুলের রাগী মাস্টার মনে হচ্ছে। ”
নীতু পলাশের কথায় মাথা নত করে হেসে ফেললো।পরক্ষণেই বললো,”স্যার মাটন বিরিয়ানি খাবেন?”
পলাশ চেয়ে দেখলো নীতুর টেবিলের পাশে একটা বাটিতে অর্ধেক বিরিয়ানি রাখা। বাকিটা নীতু নিজে খাচ্ছে। পলাশ বললো,”আরে তোমার কম পড়ে যাবে।”

“মোটেই না।আমি এর বেশি এমনিতেই খেতাম না।”

“তুমি রেঁধোছো?”….কৌতুহলী কন্ঠে বলে পলাশ।

নীতু প্রতিত্তোরে মিষ্টি হেসে পলাশকে বাকি খাবার টুকু সার্ভ করে দেয়।পলাশ বুঝে যায় নীতুই রান্না করেছে।তাই খাওয়ার আগ্রহটা যেন মন ছেঁয়ে পাকস্থলীর সীমানা ছুঁয়ে হু হু করে বেড়ে গেলো!

**************
সেতু এলোমেলো ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে।চোখের দৃষ্টি জানালা গলে দূর আকাশে নিবদ্ধ! সদ্য বিবাহিত সেতুর মনে কালো গমগমে মেঘের ভেলা! কোথাও এক ফোটা ঝলমলে রোদ্দুর নেই।সেতু প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে! ঠিক সেই মুহুর্তে রাবেয়া বেগম রুমে প্রবেশ করে।সেতু শাশুড়ীকে দেখেও উঠে বসে না।ওভাবেই পড়ে থাকে।রাবেয়া বেগম কপাল কুঁচকে বলেন,” বউ মা এই ভরদুপুরে না খেয়ে এভাবে শুয়ে আছো কেন?শরীর খারাপ নাকি?”… বলে সেতুর কপালে হাত রাখে।
সেতু কিছু বলে না।তার আসলে এই মহিলাকে ভালো লাগছে না সেদিনের পর থেকে।রাবেয়া বেগম আবার বলেন,”শরীর তো ভালোই আছে তবে এভাবে পড়ে আছো কেন?”
সেতু এবার উঠে বসে।নিজের কুঁচাকানো পড়নের কাপড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “মা আপনি কেন এই কাজটা করলেন?নিজ হাতে তিনটে জীবন ধ্বংস করে দিলেন।কি হতো উনার পছন্দের মানুষটাকে মেনে নিলে?মাঝখান থেকে আমার জীবনটাও তছনছ করে দিলেন।”

রাবেয়া বেগমের চোখের দৃষ্টি মুহুর্তেই কঠিন হয়ে গেলো।ঝামটা মেরে বলে উঠলো, “মুখ সামলে কথা বলো।বিয়ের আগে ওমন দু চারটা সম্পর্ক সব ছেলেদেরই থাকে।কেমন বউ তুমি? নিজের বরকে নিজের দিকে ফিরাতে পারো না।তিন কবুল পড়া বউ তুমি।তোমার অধিকার ওই কালীর থেকে বেশি।বরের মন থেকে কেমন করে অন্য মেয়ের ছবি মুছাইয়া ফেলতে হয় তাও তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে।”

সেতুর শরীর রাগে হিসহিসিয়ে ওঠে।নিজের ক্রোধ সামলে বলে,”মা কি করে বরকে নিজের দিকে ফিরাতে হয়? এই যৌবন ভরপুর শরীর দিয়ে? সব পুরুষ কি আকৃষ্ট হয় শরীরে? একই ঘরে একই বিছানায় থেকেও আপনার ছেলের মনে জায়গা করতে পারছিনা। আপনি কি তবুও বুঝতে পারছেন না সেই মেয়েটি আপনার ছেলের কতটা জুড়ে থেকে গেছে?”

রাবেয়া বেগম কি বলবেন ভেবে পেল না।সেতুর দু’চোখে জল টইটম্বুর হয়।শাশুড়ীর হাত খপ করে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “মা আপনি জানেন?আপনার ছেলে রাত হলে ঘুমায় না।ঘুমাতে পারে না মানুষটা!সারারাত ছটফট করে!বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের অন্ধকার দেখে।আপনি তো মা!আপনি কেমন করে এতটা কঠোর হলেন?আপনার ছেলের চোখের কোলে নির্ঘুম রাতের ছাপ পড়েছে।তা দেখে আপনার বুক কাঁপে না?সেই মেয়েটা এই ঘরে না এসেও আপনার ছেলেকে ঠিক জয় করে ফেলেছে।আপনি, আমি দুজনেই উনার ভালোবাসার কাছে হেরে গেছি!”

রাবেয়া বেগম বিস্মিত দৃষ্টিতে ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।বুকের উপর কেমন চাপ অনুভব করলেন ধীর পায়ে উঠে নিজের রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকে দিলেন।সেতু সেই শব্দে কেঁপে উঠলো।পরক্ষণেই দু হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেললো।

*************
সাথি অনবরত বকবক করে যাচ্ছে মোবাইলে রিপনের সাথে। নীতু তা দেখে আলতো হাসে।মেয়েটা এত কথা বলতে পারে?নীতু একটা বোলে আমড়ার আচার বানিয়ে সাথির সামনে রাখে। সাথি আচার দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠে নীতুর গালে চুমু দেয়। নীতু নিজেও কিছুটা আচার একটা পিরিজে নিয়ে বসে খাটে। সাথি কল কেটে আচার খাওয়ায় মনোনিবেশ করেছে।নীতু খেতে খেতেই বলে,”সাথি সবসময় দেখি আমাদের সামনের ফ্লাটটা তালা দেওয়া। ওখানে কেউ থাকে না?”

“আপু ওখানে একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ থাকে।যাকে বলে চোখ ঝলসানো হ্যান্ডসাম!তিনি আপাতত বাসায় নেই।”

নীতু আচারের বাটি হাতে নিয়েই বারান্দায় গিয়ে বসে।যতদুর চোখ যায় সবখানে উঁচু উঁচু দালান । যেন এক একটা দালান ঐ আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে!
নীতু ভালো আছে।সারাদিন অফিস করে।রাতে টুকটাক রান্না করে।ইদানীং নিজের যত্ন অনেকটা নেয়া হয়।সাথি তো জোর করেই পার্লারে নিয়ে গিয়েছিল।মেনিকিওর,পেডিকিওর, ফেসিয়াল সব করে এসেছে।সকাল হলে কতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা নীতুর রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে পুরোটা গুছিয়ে নেয়ার পরও কোথাও যেন একটা কিছুর শূন্যতা থেকে যায় নীতুর !চোখজুড়ে একজনকে দেখার তীব্র হাহাকার!একই শহরে বাস করা সেই মানুষটার জন্য বুকের কোণে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়!

চলবে,
জানি পর্ব ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু লেখার সময় পাই না।এখন লিখতে বসে ঘুমের তড়নায় চোখ মেলতে পারছিনা।তাই যা লিখলাম তাই পোস্ট করে দিয়েছি।প্লিজ সবাই রেসপন্স করবেন আর ভুল ত্রুটি হলে তা আমাকে জানাবেন।আমি শুধরে নিবো। আর কেউ নেক্সট লিখবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here