কাননবালা পর্বঃ৭

0
914

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৭

নীতু হক টাওয়ারে সেলসগার্লের কাজে যোগ দিলো দুদিন পরই।জায়েদের নিষেধ শুনলো না।কালো জিন্স, হাটুর একটু উপরে কুর্তি আর তার উপরের হক টাওয়ারের লোগো দেয়া শার্ট পড়ে নীতু কাজে যোগ দিলো।লম্বা চুলগুলো ঝুটি করে পিঠে ছড়িয়ে পড়তো। সে এক অন্য নীতু!ভেঙে চুড়ে গড়ে ওঠা অন্য নীতু!
মহিমা বেগম ফোন দিয়ে অনেক গালাগালি করলো নীতুকে।একেতো গায়ের রঙের জন্য বিয়ে হয় না তারউপর কাজ নিয়েছে ছেলেদের এখন তো এই মেয়েকে পার করা কঠিন হয়ে যাবে!সেই ক্ষোবে চিল্লাপাল্লা করলো।নীতু চুপচাপ শুনলো কোন প্রতিত্তোর করলো না। কারো কোন কথা নীতু পরোয়া করলো না। যে বড় ভাই দিনের পর দিন নীতুকে অপমানিত হতে দেখেছে কখনো প্রতিবাদ করেনি,কখনো পাশে বসে জিজ্ঞেস করেনি কি প্রয়োজন নীতুর সেই ভাই আজ কল করে নীতুকে বেয়াদব,অসভ্য বলে আখ্যায়িত করলো।বড় আপা কল করে কাঁদল! কোন কিছুই নীতুকে ফিরাতে পারলো না!নীতু অটুট তার কথায় চিন্তায় চেতনায়! তাজ রোজ কল করে নীতু কখনো কল ধরে আবার কখনো ধরে না।নীতু কল রিসিভ করলে তাজ কিছুই বলে না।শুধু চুপ থাকে।কখনো বা তপ্ত নিঃশ্বাসে মুঠোফোন ভারি হয়ে ওঠে!

আর এক সপ্তাহ পরে সেতুর বিয়ে।সেতু খুশিতে আটখানা!পড়াশোনা কোন কালেই সেতুর ততটা ভালো লাগতো না। বর দেখতে ভালো, পরিবারও ছোট,কোন ঝামেলা নেই। তারউপর ঢাকা নিয়ে রাখবে।সেতু সেই খুশিতে উড়তে লাগলো।নীতুর এই পরিবারে না থাকা নিয়ে একটু মন খারাপ হলেও তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালো না। সে ফুলফর্মে বিয়ের মার্কেটে মন দিলো, বান্ধবীদের দাওয়াত দিলো।

তাজ অফিস থেকে ফিরেই দেখে মা রুমে বসে আছে, সামনে অনেক গুলো শপিং ব্যাগ।তাজ কোন কথা বললো না।চুপচাপ ওয়াশরুমে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে ট্রাউজার আর টিশার্ট পড়ে বের হলো।তোয়ালেটা বারান্দায় মেলে দিয়ে নিজের ভেজা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করলো।রাবেয়া বেগম এক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা উজ্জ্বল শ্যামলা গাত্রের!চোখ দুটো বড় না হলেও ভীষণ চঞ্চল চোখের দৃষ্টি।আজ সেই চোখে বিষন্নতা।নাক মুখ লাল!ছেলেটা কি কেঁদেছে?ভাবতেই বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠলো রাবেয়া বেগমের।
তাজ মোবাইল হাতে নিয়ে বেডে বসে বললো,”কিছু বলবে মা?”
রাবেয়া বেগম নিজেকে সামলে নিলেন।ছেলের মায়ায় পড়লে ঐ কালী তাড়িনীকে আনতে হবে।তারপর নাতি পুতি সব কালো হোক।তা হবে না কিছুতেই।তাই শক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,”তোর কি সমস্যা? মার্কেটে যেতে বললাম গেলি না।নিজের শেরওয়ানীটা পর্যন্ত কিনলি না।সেটাও আমাকে কিনতে হলো।তারউপর যার সাথে দুদিন পর বিয়ে তাকে একটা কল করিস নি।কি চাস তুই?দেবদাস হতে?আর তোর পাগলামো দেখে আমি ঐ কালিকে ঘরে তুলি।এটাই চাস তুই? আমার ঘরে বসে তুমি কালীর তপস্যা করবে তা আমাকে দেখতে হবে।”

তাজ বিস্মিত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।এই মাকে তার অচেনা লাগছে। যে মা ছোট বেলা থেকে শিক্ষা দিয়েছে।টাকা পয়সা,রঙ, বংশ কোন কিছু মানুষকে বড় করে তুলে না।মানুষ বড় হয় তার মানসিকতায়! সেই মা আজ এসব কথা বলছে।তাজ গুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে!মুখে অনেক কিছুই বলা যায় কিন্তু কাজের বেলা তার মাহাত্ম্য দেখা যায় না।
তাজ নিজের রাগ চেপে রাখতে চাইলেও তা পারলো না।রুক্ষ স্বরে বলে উঠলো,” স্টপ মা।তুমি বিয়ে করতো বলেছো আমি করছি।আমি কোন কিছুতেই বাধা দেয় নি।এখন আমাকে হাসতে বলছো হাসবো।যেভাবে বলবে সেভাবেই করবো কিন্তু নীতুকে নিয়ে একটা খারাপ কথাও বলবে না। নীতুকে নিয়ে কিছু বলার রাইট তোমার নাই!”

“একটা দুদিনের পরিচিত মেয়ের জন্য তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস?সেই মেয়ে তোর কাছে বড় হয়ে গেলো।আমাদের এত বছরের ভালোবাসা কিছুই না।একমাত্র ছেলের জন্য বউ পছন্দ করার অধিকার আমার নেই?বল নেই? ”

“আছে মা।কিন্তু সংসারটা তো আমাকেই করতে হবে।”…. এই পর্যন্ত বলেই তাজ মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে।দুহাতে পা আঁকড়ে ধরে বলে,” মা নীতু খুবই ভালো মেয়ে।দেখো ওকে নিয়ে আমি ভালো থাকবো।তুমি একবার হ্যা বলো মা।তোমার ছেলেটা নীতু নামের মেয়েটিকে ভীষণ ভালোবাসে মা!ভীষণ ভালোবাসে! ঐ রঙে আমার কোন সমস্যা নেই মা তবে তোমাদের এত আপত্তি কিসে?”…..তাজের চোখ ছলছল করে ওঠে,কন্ঠে ভেজা ভাব!

“কখনো না।আজ তুমি মোহে পড়ে এমন করছো যখন দেখবে তোমার বন্ধুরা সুন্দর বউ নিয়ে ঘুরছে তখন তোমার কষ্ট হবেই।যখন দেখবে নিজের সন্তানটা কালো তখন তোমার মন খারাপ হবেই।একটা মেয়ের বাচ্চা হলেই শরীর ভেঙে যায়।তখন তোমার নীতুর সাথে সংসার করতে ঝামেলা হবে।তাই তোমার কথা আমি শুনছি না।হয় নীতু না হয় মা।একটা তুমি বেছে নাও?….রাবেয়া বেগম অতি রাগ হলে ছেলেকে তুমি করে বলেন।

তাজ হেসে উঠলো।বড় ব্যথিত সে হাসি! পায়ের কাছ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,” মা আজ মনে হচ্ছে একমাত্র সন্তান হওয়া পাপ!বড় পাপ!একমাত্র সন্তান হলে মা বাবার ইচ্ছার বলি হতে হয়! প্রতিমুহূর্তে সবার ইচ্ছার দাম দিতে হয়,কখনো মা-বাবার কখনো স্ত্রীর। নিজের ইচ্ছা বলতে কিচ্ছু থাকে না তাদের!”

রাবেয়া বেগম আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। তাজ ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সময় খাটের উপরে রাখা শপিং ব্যাগ গুলো ফ্লোরে ছুড়ে মারলো।লাল টুকটুকে বেনারসিটা ছিটকে পরলো সাদা টাইলসের মেঝেতে!সাদার উপরে লাল রংটা যেন মুহুর্তেই আরো সুন্দর করে ফুটে উঠলো চোখের সামনে। সেদিকে তাকিয়ে তাজ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।যে রং নীতুর জন্য নয় সে রংয়ের কোন স্থান নেই তাজের জীবনে!

************
ইতু মুখ অন্ধকার করে বসে আছে।পাশে বসে তুতুন কাঁদছে সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই।মিলন অফিস থেকে ফিরে এ দৃশ্য দেখে অনেকটা অবাক হলো কিন্তু ইতুকে কিচ্ছু বললো না।তুতুনের কান্না থামিয়ে মায়ের কাছে রেখে এসে ইতুর পাশে বসলো।ইতু তখনও নির্বিকার। চোখ মুখ বসে গেছে। মিলন বাহিরের পোশাক চেঞ্জ করলো না।ঘর্মাক্ত শরীরেই স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে।চেনা স্পর্শ পেয়েই ইতু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,”নীতু আপার কি হবে মিলন?নীতু আপার কি হবে?আপার ছোট হয়েও আমাদের দু’বোনের বিয়ে হয়ে হচ্ছে অথচ আপা সবার লাথি গুঁতো খাচ্ছে। কেন আপার সাথেই এমনটা হয়?”

মিলন স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে থাকে।ইতু অনবরত কাঁদছে। একসময় মিলন বলে,”শোনো ইতু সবসময় মনে রাখবে যা হয় ভালোর জন্যই হয়!”

মিলনের কথায় ইতুর কান্না থামে না বরং আরো বাড়তে থাকে!

**********
রোজ সকালে আটটার মধ্যে নীতুকে হক টাওয়ারে পৌঁছাতে হয়।শপিং মল খোলার আগে অনেক কাজ থাকে সেগুলো সবাইকে করতে হয় তারপর রাত দশটা পর্যন্ত ডিউটি। মাঝে মাঝে রাত এগারোটা বেজে যায় আনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করতে করতে।একটু পরিশ্রম হয় বেশি এই আরকি।দুপুরে লাঞ্চ ব্রেক আর বিকেলে চা-নাস্তা খাওয়ার ব্রেক পায়।এছাড়া সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়।কাস্টমারদের সাথে কথা বলতে হয় অনবরত! বাহিরের দেশ থেকে যে প্রোডাক্ট গুলো আসে সেগুলো আলাদা করে রাখতে হয়, দেশীয় পন্যে নতুন করে প্রাইস ট্যাগ বসাতে হয়।অনেক কাজ।কিন্তু নিরলস ভাবে নীতু কাজ করে যায়।সবসময় মুখে এক চিলতে হাসি থাকে নীতুর।নীতু যতক্ষণ কাজে থাকে ততক্ষণ নীতু ভালো থাকে কিন্তু রাত গুলো নীতুর পার হতে চায় না।বড় দীর্ঘ মনে হয় প্রতিটা রাত।তবুও নীতু ভালো আছে।কারো কটু কথা শুনতে হয় না।শপিংমলের সবার সাথেই নীতুর ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।হক টাওয়ারের দায়িত্বে যে আছে শরীফুল কাকা। সেও নীতুর কাজে সন্তুষ্ট।মেয়েটা কাজে ফাঁকি দেয় না।অযথা গল্প করে না।বরং কাস্টমারের সাথে এমন ভাবে কথা বলে তারা পোশাক বা অর্নামেন্টস কিনতে বাধ্য হয়!

নীতুর যেদিন বেশি রাত হয় সেদিনই ঝামেলা বাজে।নীতুর হোস্টেলে ফিরতে যে গলিটা পড়ে সেটা বড় অন্ধকার আর নিরব!তাই রিকশাও বেশি যেতে চায় না।তবুও নীতু সাহস করে এগিয়ে যায়।কিন্তু দু’দিন ধরে কাকতালীয় ভাবে রিশার সাথে দেখা হয়ে যায় হক টাওয়ারের সামনে।রিশার একটা স্কুটি আছে! দেখা হলেই বলে,”চলো নীতু ডার্লিং। একসাথে ফেরা যাক।যেহুতো গন্তব্য একটাই!”
নীতু যখনই জিজ্ঞেস করে,”তুমি এখানে কেন?”
তখনই রিশা হেসে বলে,”একটা কাজে এসেছিলাম।” এর বাহিরে কোন কথা রিশা বলে না। আজও রিশার সাথে দেখা হয়ে গেলো।নীতুর কেন জানি মনে হলো,রিশা ইচ্ছা করেই এখানে দাঁড়িয়ে থাকে।তাকে নিয়ে ফিরবার জন্য। আজও নীতুকে দেখেই রিশা হেসে বলে,”কাম ডার্লিং।”
নীতু চোখা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “আজও কি কাজ ছিল এদিকে?”
“এত প্যাচাল পারো কেন?গেলে চলো না হলে দাঁড়িয়ে থাকো।”….. বলেই রিশা জিন্সের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়।নীতুর মেজাজ খারাপ হয়।মেয়েটা এত সিগারেট কিভাবে খায়?স্কুটি চালানো অবস্থায় রিশার ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট থাকে। কিসের এত দুঃখ মেয়েটার?

নীতু রিশার ঠোঁট থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দেয়।এরপর স্কুটিতে উঠে বসে।রিশা কতক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীতুর দিকে।তারপর স্কুটিতে স্টার্ট দেয়।রিশার ছোট ছোট চুলগুলো উড়ছে।সাথে উড়ছে নীতুর ঝুটির করা লম্বা চুলও। চারপাশ থেকে শো শো করে গাড়ি যাচ্ছে। নীতুর ভীষণ ভালো লাগছে। একসময় নীতু বলে ওঠে, ” রিশা আমাকে স্কুটি চালানো শিখাবে?”
রিশা কোন জবাব দেয় না।কিন্তু লুকিং গ্লাসে নীতুর শান্ত মুখখানা দেখে। আবার নীতু বলে ওঠে, “রিশা রোজ তুমি হক টাওয়ারের সামনে আমাকেই নিতে আসো,তাই না? এদিকে তোমার কোন কাজ থাকে না।”

রিশা শান্ত স্বরে বলে,”রাতের শহর বড় ভয়ংকর হয় ডার্লিং! কখন যে কাকে খুবলে খাবলে খাবে বুঝতেই পারবে না!”

নীতুর হুট করে মনে হলো রিশা মেয়েটা যতটা খারাপ ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে ততটা খারাপ সে নয়!

চলবে,
বাসায় ছোট বোন আসছে।সে আসলে আমার সম্পূর্ণ এটেনশন তাকে দিতে হয়।ওর সামনে মোবাইল হাতে ধরলেই রেগে যায়।বলে,”অনেকদিন পর এসেছি এখন আমাকে সময় দাও” তারউপর প্লাস পয়েন্ট হিসেবে বোনের মেয়েটা মোবাইল ধরতেই দিবে না।তাহলে সে মোবাইল ধরবে!কিছু বলতেও পারি না।আজ সারাদিন বসে একটু একটু করে এই পর্বটা লিখেছি।জানি না কি লিখেছি।মনোযোগ ছাড়া লিখা যায় না।রাত দুটো ছাড়া ঘুমাতে যেতে পারি না তাদের রেখে তাই রাতেও বসতে পারি না।আমি চেষ্টা করবো ছোট করে হলেও গল্প দিতে বাকিটা আল্লাহ জানে! আর ইরাবতী গল্পটার তো অর্ধেক পর্ব লিখে বসে আছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here