#একান্নবর্তী
#অন্তিম
#শম্পাশম্পি চক্রবর্তী
@copyright protected
চিৎকার করে শিউলি ডেকে উঠল “মেজো কাকিমনি, সেজো, ছোট কাকিমনি, কাকু,দাদা,বনু ,ভাইরা সকলে একবার আমাদের ঘরে এসো । আমি তোমাদের একটা একটা করে সকলকে প্রশ্ন করবো। ” মা যথাসম্ভব শিউলির মুখটা চেপে ধরার চেষ্টা করতে লাগল ” ওরে চুপ্ কর হতভাগী । চুপ্ কর। কেউ এখনো কিছু জানে না। এই পাপ কথা কারো কানে পৌঁছলে তা দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। তখন আমার বা তোর বাবার মুখ দেখানো দায় হয়ে যাবে। ওরে রাই একে বোঝা।” আমি নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করবো। শিউলি কেন এমন করছে ? তবে কী ও সত্যি বলছে? সঞ্জীব দা র সাথে ওর শারীরিক সম্পর্ক ঘটেছে? কিন্তু ও এমন করছে কেন? বাড়ির সকলকে ডেকে ও কী বলতে চায়? সঞ্জীব দা র সাথে ওর সম্পর্কের কথা? কেউ কী তা বিশ্বাস করবে ?”
একান্নবর্তী পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষ শিউলির ডাকে এসে দাঁড়িয়েছে তখন আমাদের ঘরে। সকলের চোখে মুখে বিস্ময় । শিউলি খানিক সকলের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে নিয়ে বলে উঠল ” আচ্ছা তোমরা সকলেই একটা সত্য কথা বলতো আমি কতোটা কুৎসিত? এই তো মেজো কাকা দাঁড়িয়ে আছো মনে আছে সেদিন আমি যখন চা করে নিয়ে তোমার সামনে এগিয়ে দিয়ে ছিলাম তুমি কী বলেছিলে ” এই রে শিউলি তুই চা এনেছিস ? তাই ভাবি চা টা এতো কালো রঙের হলো কী করে ? আচ্ছা মেজো কাকিমনি, সেজো কাকিমনি তোমাদের মনে আছে সেবার কোনো একটা বিয়ে বাড়িতে যাবো আমি মায়ের লাল রঙের বেনারসি শাড়ি টা পরে তোমাদের দেখাতে গিয়েছিলাম। তোমরা আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলে উঠেছিলে ” এই রে শিউলি কী পরেছিস? এ যে রক্ষেকালী লাগছে রে। ভয়ে তোর ধারে কাছে কেউ আসবে না। আর ওই যে কোণে দাঁড়িয়ে আছো সেজো কাকা তোমার মনে আছে তুমি সেদিন কী বলেছিলে ? “তোর বাবা তোকে বিয়ে দিতে গিয়ে ফুতুর হয়ে যাবে রে শিউলি অবশ্য তোর যদি বিয়ে হয়?” আর ভাইবোন দাদাদের আর আমার নিজের দিদির কথা তো ছেড়েই দিলাম কেউ তোমরা আমার সাথে ভালো করে কথাই বলোনা কারণ আমি তোমাদের কারো মতো সুন্দর নই। তবে তোমাদের থেকে একটু আলাদা ছোট কাকা আর কাকিমনি । ছোট কাকা বলে ফর্সা ‘র চাইতে কালো অনেক বেশি সুন্দর, কালো রূপের কদর সকলে দেবার মতো যোগ্যতা রাখে না শিউলি তাই কষ্ট পেও না বলে ছোট কাকিমনি । আর বাবা ? সে তো তার রাই সুন্দরী ছাড়া আর কারোকে মেয়ে বলেই স্বীকার করতে পারলোনা। শিউলি বলে যে তার একটা কালো,কুৎসিত, পেত্নি ‘র মতো মেয়ে আছে সে তো কোনোদিন খবরই রাখেনা। আর মা সে তো লজ্জায় সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে যেন একটা কালো মেয়ে কে জন্ম দিয়ে সে কী ভুল না করে ফেলেছে। আর এই সকলকে নিয়ে আমার পরিবার। যেখানে আমি ছাড়া সকলেই এই একান্নবর্তী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত । তাই না মা,কাকিমনি, বাবা,কাকু ঠিক বলেছি তো?” প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে শিউলি তাকালো মায়ের সাথে সাথে সকলের দিকে। আমি বেশ চাপা কন্ঠস্বরে বলে উঠলাম ” চুপ্ কর এবার। সঞ্জীব দা র কথা কারোকে কিছু বলিস না “।
” কেন বলবো না দিদি ?
সঞ্জীব দা আমাকে ভালোবাসে সেটা আমার পরিবারের সকলকে বলবো না? সে ই একমাত্র মানুষ যে এই পরিবারের মানুষ গুলোর মতো আমাকে কালো,কুৎসিত, পেত্নি এই রকম নানা নামে ডাকে না। সে আমাকে সুন্দর মনে করে। ওর চোখে আমি পৃথিবীর সেরা সুন্দরী তা বলবো না। ”
পরিবারের সকলে হতবাক ।
এ সব কী কথা বলছে শিউলি? সঞ্জীব ওকে ভালোবাসে? সকলেই একবার এ ওর মুখের দিকে তাকালো। ছোট কাকা ই হঠাত্ বলে উঠল ” তোকে সঞ্জীব ভালোবাসে আমাদের আগে বলিস নি তো? কিন্তু শুনলাম ও আমেরিকা চলে যাচ্ছে । যদি তাই হয় তোদের দু’জনের সম্পর্কের কথা আমাদের পরিবার যেমন জানলো ওদের পরিবার ও জানুক। তাহলে পরের বার ও যখন ফিরবে তখন তোদের দু’জনের সম্পর্ক টা নিয়ে ভাবা যাবে। কী বলো বড় বৌদি?” ছোট কাকার প্রশ্নে মা নীরব থেকে গেল কারণ মা নিশ্চিত ছিল সঞ্জীব আজ যখন এ বাড়িতে এসে নিজের আমেরিকা যাওয়ার কথা জানিয়ে গেছে অথচ তার আর শিউলির মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা যখন একবারও জানালো না তাহলে সে কী কখনো শিউলির সাথে সম্পর্কের কথা স্বীকার করবে ? শিউলি বোকা তাই সঞ্জীবের ডাকে সাড়া দিয়েছে।”
ছোট কাকার কথাগুলিতে অনেকেই সমর্থন জানালো কারণ যদি সত্যিই সঞ্জীব শিউলি কে ভালোবাসে তাহলে ওদের যাতে সম্পর্কটা পরিণতি পায় তা দেখতে হবে।
তবে সেদিন ছোট কাকা যে ধারণা নিয়ে সঞ্জীব দা কে বিচার করেছিল মা তার বিপরীত। এবং পরের দিন যখন সঞ্জীব দা কে ডেকে আনানো হলো তখন সঞ্জীব দা র যা বক্তব্য ছিলো তা মা আগেই অনুমান করে ফেলেছিল। ফল স্বরূপ মায়ের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল শিউলির কী পরিণতি হতে পারে তা ভেবে।
মা যে সঠিক ছিলো তা তখনি বুঝেছিলাম যখন সঞ্জীব দা আমাদের বাড়িতে এসে কাকিমনি দের প্রশ্নে সরাসরি বলে উঠেছিল ” আমি ! শিউলি কে ভালোবাসি ! এ কথা আপনাদের মাথায় এলো কী করে। ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে বলে তাই কথা বলি তা বলে এই নয় যে ওকে ভালোবাসি?”
” সত্যি কথা বলো সঞ্জীব আমার শিউলি কে তুমি ভালোবাসো কী না ?
আমি সত্যি টা জানতে চাই?
ওর সাথে তুমি ,,,, “মা আর পরবর্তী কথা গুলি বলে উঠতে পারেনি তার আগেই সঞ্জীব দা অদ্ভুত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে ওঠে ” কাকিমা আমি রাই কে অঙ্ক করাতে আসি। আপনি যদি রাইয়ের কথা বলতেন বলতাম হ্যাঁ আমি রাই কে পছন্দ করি। কিন্তু শিউলি ? কিছু মনে করবেন না আপনার মেয়ে ও তবুও বলছি ওর মতো কুৎসিত ,কদাকার, কালো মেয়ে কে আমি ভালোবাসবো ? অসম্ভব? মিথ্যা অভিযোগ আনছেন আপনি আমার ওপর। কাল আমি আমেরিকায় চলে যাচ্ছি । চলে যাওয়ার আগে আপনি আমাকে এমন মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করবেন ভাবলে আমি কখনোই অপমানিত হওয়ার জন্য এ বাড়িতে আসতাম না। ”
মা ,আমি দুজনেই শিউলির দিকে তাকিয়ে ছিলাম সেই মুহূর্তে । ও নীরব। কোনো প্রতিবাদ টুকু ওর কন্ঠস্বর থেকে বের হলো না সঞ্জীব দা র বিরুদ্ধে । শুধু দুটি চোখ দিয়ে নেমে আসছে জল টুকু।
সঞ্জীব দা চলে গেলে মেজো, সেজো কাকিমনি বলেই উঠলো ” জানতাম সঞ্জীব কখনোই শিউলি কে ভালোবাসতে পারে না।
কোথায় সঞ্জীব আর কোথায় শিউলি ?”
মা আর কথা বাড়ায় নি শিউলির হাত টা ধরে এক প্রকার টানতে টানতে নিজেদের ঘরে চলে গেল। এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছিল। সঞ্জীব দা কে আমাদের পরিবার বিশ্বাস করলো শিউলি কে নয়। আর তার কিছুদিন পর যখন আমাদের পরিবার জানলো শিউলি অন্তঃসত্ত্বা তখন সকলেই প্রায় একবাক্যে বলে উঠল ” কার সাথে কী করেছে যার ফল এই। বেচারা সঞ্জীব কে অপমানিত হতে হলো। অমন ভালো ছেলে শিউলির সাথে এমন অন্যায় কখনোই করতে পারে না। শিউলিই জানে কার সাথে কী করেছে। এখন যার ফলভোগ চক্রবর্তী বাড়িকে করতে হবে। চক্রবর্তী বাড়ির মুখে চুনকালি পড়ল। ” শিউলি উঠতে বসতে কথাগুলি শোনে আর নীরবে চলে যায়। না কোনো প্রতিবাদ করেনা ।
বরং সবটুকু দোষ নিজের ওপর নিয়ে ও চলে যায়।
এর পরের ঘটনা সেই ভয়ঙ্কর দিন। দুপুর বেলা। সকলেই যে যার ঘরে। আমি কলেজে। শিউলি কিছুদিন ধরে কলেজ যাচ্ছে না। মা ও কিছু বলে না। ছোট কাকার সাথে কথা হয়েছে। ছোট কাকাই চেনাজানা একটি নার্সিংহোম থেকে ওর পেটের টাকে নষ্ট করে দিতে হবে তেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।” কিন্তু না তার সুযোগ দেয় নি শিউলি। সেদিন দুপুরেই চরম সিদ্ধান্ত টা নিয়ে নিয়েছিল । আমার আর ওর নিজস্ব ঘরটার কড়িকাঠ থেকে নিজেকে ঝুলিয়ে দিলো। যখন আমরা ওর ঝুলন্ত মৃতদেহ দেখেছিলাম তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। ”
রাই থামতেই সৌরভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল ” তোমরা সত্যিই খুব অবিবেচকের কাজ করেছিলে সেদিন। ও সঞ্জীবের কথা যখন বলেই ছিলো তোমাদের, সঞ্জীবের মুখ দিয়ে তোমাদের সত্যটা বার করানো উচিত ছিলো। একটা ছেলে এতো বড় অন্যায় করে এতো সহজে ছাড়া পেয়ে গেল? না মানতে পারলাম না। সঞ্জীবের থেকেও তোমরা শিউলির ওপর অবিচার করেছিলে বেশি। ওকে তোমরা কেউ বিশ্বাস করলে না যারা কী না ওর নিজের পরিবারের লোকজন। ও আর কী করে। নিজেকে অপমানের হাত থেকে,পরিবার কে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে এমন চরম সিদ্ধান্ত নেয় । আসলে তুমি বললে না তোমরাই শিউলির মৃত্যুর জন্য দায়ী । একদম ঠিক বলেছ। বিশেষ করে তুমি,তোমার মা,আর বাবা। যারা অন্তত শিউলি কে বিশ্বাস করে ওর পাশে দাঁড়াতে পারতে। তাহলে এমন করুণ পরিণতি কখনোই শিউলির হতো না। ”
রাত কেটে গিয়ে সকাল হলো। ব্রেকফাস্ট টেবিলে রাই সৌরভের থেকে জানতে চায় বাক্সটা কী সে এনেছিল ? সৌরভ জানায় এনেছে। এবং তা রাখা আছে তাদের শোবার ঘরেই। পুরনো আমলের তালা আটকানো। তাই খোলা সম্ভব হয় নি। রাই দ্রুত নিজেদের শোবার ঘরে গেল। সত্যিই সৌরভ সেটি ঘরের এক কোণে রেখে দিয়েছে। রাই একটি লোহার মোটা ছোট আকারের রড মতো জোগাড় করে তা দিয়ে তালাটির ওপর দু’ চারবার আঘাত করতেই খুলে যায় তালাটি। বাক্স থেকে তালাটি টান মেরে খুলে বাক্সের ডালাটা তুলতেই চমকে ওঠে রাই। তাতে রয়েছে তাদের চারজনের একত্রে পুরীতে গিয়ে তোলা ফটো, একটা সাদা মুক্তোর হার ছোট কাকা কেবলমাত্র শিউলির জন্য এনেছিল হায়দ্রাবাদ থেকে এবং সকলের আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে দিয়ে ছিল যা পরে জানতে পেরে রাগে রাই সেটা ছিঁড়ে দিয়ে ছিল শিউলি যাতে পরতে না পারে, আর রয়েছে মায়ের বিয়ের লাল বেনারসি যেটা মা শিউলিকেই দিয়ে ছিল ,আর কয়েকটা ভাঙা কাঁচের চুড়ি, টিপের পাতা, লিপস্টিক, আর একটি বাদামি হয়ে যাওয়া ভাঁজ করা কাগজ। সেটা ধীরে ধীরে খুলে চোখের সামনে মেলতেই চমকে ওঠে রাই। একটি দু লাইনের চিঠি। বড্ড চেনা হাতের লেখা তার অঙ্ক মাস্টারের।
শিউলি,
রাইয়ের কাছে শুনলাম তোমাদের পরিবারের সকলে আগামী কাল বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে । তুমি কিন্তু যেও না। কোনো অজুহাতে থেকে যেও।
আমি আসবো শুধু তোমার কাছে।
তোমার সঞ্জীব দা।
মোবাইল ফোনটা হঠাত্ বেজে উঠতেই বাক্সের ডালাটা বন্ধ করে রাই দেখল বড় দাদা ‘র ফোন।
” হ্যালো রাই। তুই গ্রামের বাড়ি ঘুরে এলি তা কী বুঝলি ওখানে ফ্ল্যাট করলে ভালো হবে তো ? গ্রাম হলেও এখন অনেক ফ্ল্যাট হচ্ছে ওখানে।
কী বলিস তুই?”
” বড় দা, সঞ্জীব দা মানে তোমার সেই বন্ধু এখন কোথায় আছেন বলতে পারো?”
” সঞ্জীব মানে যাকে শিউলি কে নিয়ে তা হঠাত্ তার খোঁজ করছিস?”
“বলো না বড় দা?”
” ও হো সঞ্জীব সে তো আর বেঁচে নেই রে। দীর্ঘ দিন ক্যান্সারে ভুগে গত বছর মারা গিয়েছে। স্ত্রী আছে। ছেলেপুলেও হয়নি। বেচারা। হতভাগ্য জীবন। অমন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে জীবনটা বড় খারাপ ভাবে কাটলো।”
” ও আচ্ছা “। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাই পুনরায় বলে ওঠে “বড় দাদা গ্রামের বাড়ি ভেঙে ওখানে ফ্ল্যাট বাড়ি হবে না। আমি ওই বাড়িটা পুরোপুরি কিনে নেবো তোমাদের সকলের থেকে। আমি ওই বাড়ির ধ্বংস দেখতে পারবো না।”
” কিন্তু রাই তা কী তোর পক্ষে সম্ভব হবে”!
” কোনো কিন্তু নয়। ওই বাড়ি থাকবে বড় দা। আমি ওটাকে আগের মতো সুন্দর করে গড়ে দেবো দেখো।
নাম রাখবো—“একান্নবর্তী C/o শিউলি চক্রবর্তী “।
#সমাপ্ত