একান্নবর্তী পর্ব-৪

0
414

#একান্নবর্তী
#বড়_গল্প
#শম্পাশম্পি চক্রবর্তী
#চতুর্থ
@copyright protected

” আচ্ছা রাই তোমাদের যে একান্নবর্তী পরিবার ছিল আম্মার পর কার কাঁধে এসে এতোবড়ো পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়েছিল ? আসলে একান্নবর্তী ই বলো বা যৌথ আমি আবার এই সব পরিবার তত্ত্ব সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ তা তো তুমি জানো। বাবা’র দিকে বাবা একটি মাত্র সন্তান আর মা’র দিকে মা ও। তবে শুনেছি পরিবারের সব চাইতে বড় যিনি তিনিই সব দায় দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতেন একান্নবর্তী পরিবারে। এমন কী আত্মীয় স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশীদের থেকে আমন্ত্রণ পত্র এলে সেই বয়ঃজ্যেষ্ঠ ‘র নামেই আসতো। তোমাদের ক্ষেত্রেও তাই হতো নিশ্চয়ই ?”

” হ্যা আম্মা মারা যাওয়ার পর বাবার নামেই আসতো আমন্ত্রণ পত্র। আর আমরা বাড়ি শুদ্ধ আমন্ত্রিত হলে তো কথাই ছিলো না মা,কাকিমনিরা, ভাই বোনেরা, দাদা’রা সকলে যেতাম। খুব সেজেগুজে যাওয়া হতো। শিউলি কে আর আমাকে মা সাজিয়ে দিয়ে বলতো যা সকলকে দেখিয়ে আয় কেমন লাগছে তোদের ? আমি দৌড়ে চলে যেতাম। বাড়ির মধ্যে সব চাইতে সুন্দর আমিই ছিলাম। তাই আমার সাজে সবাই মুগ্ধ । শিউলি অবশ্য যেতো না। মা বল্ তো যা দেখিয়ে আয়। তাতে শিউলির জবাব ছিল ” কী হবে দেখিয়ে সেই তো সবাই বলবে কালী,পেত্নি তোকে আর কী এতো সাজ মানায়। মা বুঝতো শিউলির মনের কথা। কিন্তু তার কিছুই করার ছিলো না। একটি মেয়ে অসম্ভব সুন্দরী অপর মেয়ে অসম্ভব কুৎসিত একজন মায়ের কাছে কতোটা বেদনার তা আজ এই মধ্য বয়সে এসে বুঝেছি সৌরভ। ” রাইয়ের কথাগুলির মধ্যে বিষাদের সুর যা সৌরভ কেও মর্মাহত করলো।

পরিবেশ কে হাল্কা করতেই সৌরভ মুহূর্তের মধ্যে বলে উঠল ” তোমাদের তো অতো বড় বড় উনুন দেখলাম । তা কী রান্না হতো। এখনকার মতো তো নয়। ” রাই মৃদু হাসলো। বলে উঠল ” হতো তখনকার সাবেকি নানা পদের রান্না মোচার ঘন্ট,থোর ছেঁচকি,ইলিশ পাতুরি, ধোঁকার ডালনা, চিংড়ি মালাইকারি, এঁচর চিংড়ি, পুঁইশাকের চচ্চড়ি, পালং শাক ঘন্ট, আরো অনেক আমিষ ও নিরামিষ পদ । আম্মা খুব ভালো রান্না করতে জানতো। আম্মার হাতের রান্না খেতে একজন সাহেব ও আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন তা বাবা,কাকাদের মুখে শুনেছি। আসলে ঠাকুরদা একটি বিদেশী কোম্পানিতে কাজ করতেন। নিজের চাকরিতে প্রমোশন পেতে একদিন অফিসের সাহেব বস কে নিমন্ত্রণ করে আনেন আমাদের বাড়িতে । বস তো আম্মার হাতের রান্না খেয়ে এতো টাই তৃপ্ত হয়েছিলেন যাবার সময় আম্মা কে উপহার স্বরূপ তার হাতঘড়ি টা দিয়ে যান। বলে যান এই হাতঘড়ি সাহেবের না কী বাবার দেওয়া । তিনি কোনোদিন এই হাতঘড়ি তার নিজের থেকে আলাদা করেন নি। কিন্তু করতে বাধ্য হলেন এমন সুন্দর তৃপ্তি দায়ক রান্না খেয়ে । আম্মা সযত্নে ঘড়ি টি তুলে রেখে দিয়ে ছিলো। অদ্ভুত ভাবে শিউলি যখন মাধ্যমিক পাশ করলো যদিও থার্ড ডিভিশনে আম্মা তাতেই খুশী হয়ে ঘড়িটা শিউলি কে দিয়ে দিয়েছিল।
আমাদের তো ছাড়ো আমাদের ওপরে দুই দাদা মানে মেজো কাকার ছেলেরা তাদের কারো কেও দিলো না।”

‘তোমাদের রাগ হয় নি?” সৌরভের প্রশ্নে পুনরায় মৃদু হেসে রাই বলে ওঠে ” রাগ করে লাভ নেই। কারণ আম্মা যে শিউলি ছাড়া আর কারো কে নিজের কাছে টেনে নেন নি কখনো।”

” এই রাই দেখো দেখো ওই ঘরের ভেতরে কেমন একটা খোপ আকৃতির তাক। সত্যি তোমাদের এই পুরনো বাড়িটাতে না আসলে জানতেই পারতাম না পুরনো বাড়ি কী? এক সময় কেমন ছিল পুরনো বাড়ির অন্দরমহল। কেমন ছিল সেই বাড়ির মানুষ জনদের আদপ কায়দা যা তোমার মুখে আগে এভাবে কোনোদিন শুনিনি”। সৌরভের চোখেমুখে অদ্ভুত আনন্দ ।

” ওটা কোনো খোপ নয় ওটা কুলুঙ্গি সৌরভ। আর এই যে ঘরটা দেখছো এটা আমার বাবা মায়ের ঘর। এই ঘরের মাঝখানে একটা মস্তবড় পালঙ্ক ছিল। শুনেছি ওই পালঙ্কে আমার আম্মা আর ঠাকুরদার ফুলশয্যা হয়। বলতে পারো ওই পালঙ্কে আম্মা আর ঠাকুরদা কাটিয়েছিলেন তাদের জীবনের চল্লিশ টা বছর। তারপর ঠাকুরদা মারা গেলে ওই পালঙ্ক টা আম্মা বাবাকে দিয়ে বলেন তোর ঘরে ওটা রাখ। বিয়ের পর বৌ নিয়ে ওই পালঙ্কেই শুবি। তুই বড় ছেলে । পালঙ্ক টা তাই তোর ই প্রাপ্য। দামী সেগুন কাঠের তৈরি পালঙ্ক টাতে ছিল অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজ । যে ই আসতো আমাদের বাড়িতে সে ই পালঙ্ক টা দেখে মুগ্ধ হতো। আসলে আম্মার বাপের বাড়ি ছিল মস্ত বড়লোক। তাই তারা দামী কাঠ দিয়ে অমন সুন্দর পালঙ্ক বানিয়ে দিয়ে ছিল মেয়ে জামাইয়ের জন্য।”

” কিন্তু সে পালঙ্ক গেল কোথায় রাই? তোমাদের ব্যারাকপুরের বাড়িতে তো তা দেখিনি।” সৌরভের প্রশ্নে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রাই বলে ওঠে ” শিউলির মৃত্যুর পর ওর স্মৃতি বিজড়িত কোনো কিছুই বাবা রাখে নি। কারণ ওই পালঙ্কে দিবারাত্র শুয়ে বসে কাটাতো শিউলি । পড়াশোনা ও করত ওই পালঙ্কে শুয়ে। শুধু রাতে শুতে যেত আমার আর ওর নিজস্ব ঘরটিতে।”

” শিউলির মৃত্যুটা সত্যিই মর্মান্তিক রাই। বলতে পারো তোমাদের এতো সুন্দর একটা পরিবারের অপমৃত্যু ঘটে ছিল শিউলির অপমৃত্যুর সাথে সাথে। ”

” ভুল বললে সৌরভ। শিউলির অপমৃত্যু ঘটেনি। ওকে খুন করা হয়েছিল। ওর নারীত্ব কে চরম অপমান করে ওকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়ে ছিল ওই মানুষ টা। একটা মেয়েকে ভালোবাসায় ভুলিয়ে তার শরীরটা ভোগ করে তারপর তাকে ফেলে রেখে বিদেশ চলে যাওয়া এ কোন্ মনুষ্যত্বের কাজ ছিল সঞ্জীবদা র ? শিউলি তো বেহায়া ছিল না। হ্যা বলতে পারো ভালোবাসার কাঙাল ছিল । তাই তাকে ভালোবাসার অভিনয়ে ভুলিয়ে চক্রবর্তী বাড়ির মুখে চুনকালি লেপে দিয়ে বিদেশ চলে গেল সঞ্জীব দা । যাবার আগে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলো ওর আর শিউলির সম্পর্ক। বলে গেল “কৈ সে তো কোনো দিন শিউলি কে ভালোবাসে নি। আর বাসবেই বা কেন পৃথিবীতে কী মেয়ের অভাব রয়েছে যে ওই পেত্নি টা কে ভালো বাসতে যাবে ও?”
#ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here