হৈমন্তীকা
৭.
বারান্দায় শনশন আওয়াজে বাতাসের আনাগোনা চলছে। কপালের চুলগুলো উড়ে এসে চোখে পরছে হৈমন্তীর। বিরক্ত করছে খুব। হৈমন্তী চোখ পিটপিট করে তাকালো। বিরক্ত সহিত কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে নিলো। হেমন্ত তখন ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— “আপু? কি বলেছি তোমায়?”
— “কি বলেছিস?” গাছে পানি দিতে দিতে জবাব দিলো হৈমন্তী।
— “তুষার ভাইয়ার জ্বর হয়েছে। দেখতে যাবা না?”
— “না।”
— “কেন যাবা না?”
হৈমন্তী রোষপূর্ণ নয়নে চাইলো। ধমক দিয়ে উঠল,
— “তোর যাওয়ার হলে যা হেমন্ত। আমাকে বিরক্ত করছিস কেন? বলেছি না যাবো না?”
বোনের কর্কশ ব্যবহারে ভীষণ মন খারাপ হলো হেমন্তর। ঠোঁট উলটে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সে। এরপর চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল হৈমন্তী। কিছু জিনিস চাইলেও করা যায় না। আবার কিছু জিনিসে বেশি লাই দিতে নেই।
_____
তুষার আধশোয়া হয়ে বসে আছে বিছানায়। আড়চোখে একবার ডানদিকের ছোট্ট টি-টেবিলটির দিকে তাকালো সে। প্লেটে ঢাকনা দেওয়া বিরিয়ানি পরে আছে সেখানে। হেনা অনেক চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারেন নি তুষারকে। সারাদিনে একটুখানি জ্যুস আর নাপা খেয়েছে সে। জ্বর এখন কিছুটা কমেছে। এক’শত এক ডিগ্রী। ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না কিছু। জ্বরের পাশাপাশি মনটাও বিষিয়ে আছে বড্ড। আজ বিকালে হেমন্তকে দিয়ে তার জ্বরের খবর হৈমন্তীর কাছে পাঠিয়েছিল সে। ভেবেছিল হৈমন্তী ক্ষণিকের জন্য হলেও তাকে দেখতে আসবে। কিন্তু কই? বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত! প্রিয়তমার দেখা যে এখনো মিললো না!
তুষার উঠে বসলো। টি-টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে দু’ঢোক পানি পান করতেই তিক্ত স্বাদে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তার। পানি খাওয়ার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সশব্দে গ্লাসটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগোলো।
নিস্তব্ধ পরিবেশ। মানুষ তো দূর, চারিদিকে কোনো কাকপক্ষীরও দেখা নেই। শীতল বাতাসে মৃদুভাবে কাঁপছে তুষারের শরীর। শীত করছে ভীষণ। কিন্তু রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। হৈমন্তীকে একপলক দেখতে ইচ্ছে করছে। একদম কাছ থেকে। নিবিড় ভাবে। তুষারের চোখ মুদে এলো। অস্পষ্ট কণ্ঠে বিড়বিড় করে ডাকল সে, “হৈ-ম-ন্তী-কা!”
এর পরপরই হৈমন্তীর রিনঝিনে কণ্ঠ কানে এলো তার, “তুষার? আপনি এখানে?”
তুষার খুব করে চমকালো। কণ্ঠের উৎসের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, তার দু,তিন হাত নিচে বারান্দায় দাঁড়ানো হৈমন্তী বিচলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাকে কিছু বলতে না দেখে সে আবার বললো,
— “তুষার? আপনার না জ্বর? না ঘুমিয়ে এই বাতাসে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
তুষার বার দুয়েক ঘন পলক ফেলল। অবুঝ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনি সত্যিই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, হৈমন্তীকা?”
— “মানে?” ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো হৈমন্তী।
তুষার ঢোক গিললো। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে ভিঁজিয়ে নিয়ে, হৈমন্তীর দিকে গভীর চাহনি মেলে ধরল। এলোমেলো কণ্ঠে আবার আওড়ালো,
— “আপনি এত সুন্দর কেন হৈমন্তীকা? আমার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আপনাকে। ছুঁয়ে দেই?”
হৈমন্তী ভড়কালো। আর্তনাদ করে উঠল,
— “কিসব বলছেন তুষার! মাথা ঠিক আছে?”
তুষার বাচ্চাদের মতো মাথা দুলিয়ে বললো,
— “আমার মাথা সত্যিই ঠিক নেই হৈমন্তীকা। পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু আপনিই বিরাজমান। আপনাকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না আমি। এমন কেন হয়?”
তুষার একটু থামলো। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে উগ্রতার সঙ্গে আবার বলে উঠল,
— “এত দূরত্ব আমার ভালো লাগছে না হৈমন্তীকা। আপনাকে যখন ইচ্ছে ছুঁতে পারছি না আমি। আপনার কোলে মাথা রেখে ঘুমুতে পারছি না। আপনার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে পারছি না। সব! সব কিছু অসহ্য লাগছে আমার। আমরা… আমরা কালকেই বিয়ে করে ফেলবো হৈমন্তীকা। আপনি বিয়ে করতে না চাইলে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো।”
হৈমন্তী বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে আছে। তুষারের ফ্যাকাসে মুখশ্রী দেখে তার যেমন মায়া হচ্ছে, তেমনি তুষারের উদ্ভট কথায় আশ্চর্যও হচ্ছে খুব। তার বুঝতে বাকি রইলো না, তুষার জ্বরের ঘোরে এমন করছে।
— “তুষার, আপনি অসুস্থ। রুমে গিয়ে রেস্ট নিন।”
— “না। আমি তোমাকে ছুঁবো।”
একমুহুর্তের জন্য বিমূঢ়তায় বাক হারা হয়ে গেল হৈমন্তী। তুষার এই প্রথম ‘তুমি’ বলে ডেকেছে তাকে। ডাকটা প্রচন্ড মিষ্টি লাগল তার। খানিক জড়তা কিংবা অস্বস্থিতে আড়ষ্ট হয়ে গেল সে। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠকে কঠিন করে বললো,
— “বাজে কথা বাদ দিয়ে রুমে যান তুষার।”
— “যাবো না।” একরোখা উত্তর দিলো তুষার।
হৈমন্তী আরও বেশ কয়েকবার বলার পরও তুষার শুনলো না। হৈমন্তী খেয়াল করল, তুষারের শরীর আগের চেয়েও বেশি কাঁপছে এখন। তিরতির করছে ওষ্ঠ জোড়া। হৈমন্তী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। অনুরোধের সুরে বললো,
— “আপনি ঠান্ডায় কাঁপছেন তুষার। প্লিজ, রুমে যান। নতুবা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পরবেন।”
— “একা একা রুমে ভালো লাগছে না আমার হৈমন্তীকা। আপনিও আসুন।”
শুনে হৈমন্তীর নেত্রজোড়া কোটর থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইলো যেন। তীব্র ঝংকার তুলে ধমক দিয়ে উঠল সে, “তুষার!”
দূর্বোধ্য হাসলো তুষার। ঠোঁটটা খানিক বাঁকিয়ে। হৈমন্তী রেগে চলে যেতে নিলে দ্রুততার সঙ্গে বলে উঠল,
— “আমি সকাল থেকে কিচ্ছু খাই নি হৈমন্তীকা।”
হৈমন্তী না চাইতেও দাঁড়ালো। একবার নিজের রুমে উঁকি দিয়ে দেখল, বিছানার অর্ধেক জায়গা দখলে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে হেমন্ত। একটু পরপরই নাক ডাকছে। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। একটু নরম হয়ে বললো,
— “কেন খান নি?”
— “ভালো লাগে না। তিতা, তিতা লাগে।”
একপলক তুষারের দিকে তাকালো হৈমন্তী। তুষারের মাদক মেশানো চাউনির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নতজানু হয়ে গেল আবার। তুষারের জন্য তার মায়া হচ্ছে নাকি অন্যকিছু হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারলো না। কোনোমতে মিনমিনিয়ে বললো,
— “খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন তুষার। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।”
বলে অনেকটা পালিয়েই চলে গেল সে। আর একবারও ফিরে তাকালো না তুষারের পানে।
_____
বিকালের আগমন ঘটেছে কিছুক্ষণ।
ভার্সিটি শেষে মাত্রই বিল্ডিংয়ের কাছে এসেছে হৈমন্তী। রিকশা থেকে নেমে টাকা দিতে গিয়ে দেখল, তার পার্সে শুধু পাঁচশত টাকার একটা নোট আছে। রিকশা চালকের কাছে ভাংটি নেই। ওদিকে দারোয়ান চাচার কাছেও নেই। বহু খুঁজে ব্যাগের এককোণে শত ভাঁজ পড়া এক পুরোনো বিশ টাকার নোট পেল সে। কিন্তু মাঝখানে একটুখানি ফাঁটা। রিকশা চালক নিবে না সেই টাকা। হৈমন্তী অনুরোধ করে বললো,
— “আমার কাছে আর টাকা নেই মামা। এটাই নিন না প্লিজ।”
রিকশা চালক আগের মতোই নাকচ করে উঠল। তিনি নিবেনই না ছেঁড়া টাকা। সেই মুহুর্তে তুষারের আগমন ঘটলো সেখানে। পরনে তার কুঁচকানো গাঢ় নীল শার্ট। চোখ ঘুমে বুজে আসছে। অদ্ভুদ গম্ভীরতা নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী কিছু বলার আগে আগেই দারোয়ান চাচা বলে উঠলেন,
— “হৈমন্তী মামণির কাছে ভাংটি নাই। আমার কাছেও নাই। তোমার কাছে ভাংটি হইবো তুষার বাপজান?”
তুষার কিছু না বলে রিকশা চালকের দিকে তাকালো। আগের গাম্ভীর্য ধরে রেখে প্রশ্ন করলো,
— “কত টাকা?”
রিকশা চালক জবাব দিলো,
— “জিহ্ বিশ।”
তুষার বিনা বাক্য ব্যয়ে পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে দিলো। হৈমন্তীর ভালো লাগলো না সেটা। বললো,
— “সমস্যা কি? আপনাকে বলেছি আমার হয়ে টাকা দিতে? দিলেন কেন?”
— “হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি হৈমন্তীকা?”
তুষারের ভীষণ শীতল কণ্ঠ। হৈমন্তী কেন যেন মানা করতে পারলো না। তুষারের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। তবে মনে মনে ভেবে নিলো, সে এখনই তুষারের টাকা ফেরত দিয়ে দিবে। তার মতে বড় বোন হিসেবে ছোট ভাইয়ের কাছে ঋণী থাকাটা মোটেও শোভনীয় নয়। হাতে থাকা আধছেঁড়া বিশ টাকাটা তুষারের দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বললো,
— “এটা আপাতত রাখুন। ভাঙ্গটি পেলে নতুন বিশ টাকা পরে দিয়ে দিবো।”
তুষার আধবোজা চোখে তাকালো,
— “এটা আমাকে দিচ্ছেন কেন?”
— “আমি কারো কাছে ঋণী থাকি না। বিশেষ করে আপনার কাছে তো একদমই না।”
তুষার মুচকি হাসলো। টাকাটা নিতে নিতে বললো,
— “আচ্ছা, দিন। পরবর্তীতে আমাদের বিয়ের সময় এই বিশটাকা দিয়েই আপনার জন্য চুড়ি কিনা যাবে। চুড়ির টাকা বাঁচিয়ে দিলেন আপনি।”
শুনে হৈমন্তী শক্ত চোখে তাকালো। এতে খানিক ঝুঁকে আবারও হাসলো তুষার। নিজের মাথার পেছনের চুলে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— “কালকে রাতে কি আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল হৈমন্তীকা? আমার ঠিক মনে পরছে না।”
হৈমন্তীর দৃষ্টি আরও শক্ত হলো এবার। মনে মনে ভয়ংকর একখানা উপাধি দিয়ে দিলো তুষারকে। ভীষণ ভয়ংকর!
__________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
হৈমন্তীকা
৮.
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে মাঠের একপাশে ইভানকে যেতে দেখা যাচ্ছে। কপালে, হাতে বেন্ডেজ তার। ডান চোখটাও কেমন ফুলে বড় হয়ে আছে। সাথে রয়েছে কিছু বন্ধুবান্ধব। হৈমন্তী গভীর নজরে ইভানের যাওয়া দেখল কিছুক্ষণ। সেদিক থেকে চোখ ফেরানোর আগ মুহুর্তে হঠাৎ তুষার গম্ভীর আওয়াজে আদেশ দিয়ে উঠলো,
— “এভাবে কোনো ছেলেকে দেখবেন না হৈমন্তীকা। আমার হিংসে হয়।”
হৈমন্তী আড়চোখে তাকালো তুষারের দিকে। ছেলেটার জ্বর এখনো কমেনি। শরীর অল্প গরম হয়ে আছে। গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে সে। পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের তেজস্বী কিরণ আধো আধো ভাবে পরছে তার মুখপানে। আচমকা তুষার চোখ মেলে তাকালো। হৈমন্তী হকচকিয়ে গেল এতে। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই তুষার খানিক হেসে বললো,
— “আমার দিকে তাকাতে পারেন হৈমন্তীকা। এতে আমার হিংসে হয় না।”
হৈমন্তী লজ্জায় পরে গেল। গাল দু’টো কেমন ভারি হতে লাগল যেন। নিজের এই লজ্জা ঢাকতে ধমক দিয়ে উঠল সে,
— “চুপ থাকুন! ছোট ছোটর মতো থাকবেন। নইলে দেবো একটা!”
হৈমন্তীর বাঘিনী রুপ দেখে আরেকদফা হেসে দিলো তুষার। পরক্ষণেই মন খারাপ করে বললো,
— “আমি অসুস্থ হৈমন্তীকা। আপনি আমাকে অসুস্থ অবস্থায় মারবেন?”
হৈমন্তীর চাহনি করুন হলো এবার। ছেলেটার সঙ্গে কথায় পেরে উঠে না সে। তখন নিজের ওপরই রাগ হয় তার। তারওপর পারু মেয়েটাও আজকাল ভার্সিটি দেড়ি করে আসছে। ৯টা ৩০বাজছে এখন! তবুও এর আসার নাম নেই। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল হৈমন্তী। তুষারকে একদম পাত্তা না দিয়ে আবারো বইয়ে মনোযোগ দিলো।
তুষারও চুপ হয়ে গেল এবার। আরেকটু এগিয়ে হৈমন্তীর কাছ ঘেঁষে বসলো। হৈমন্তী শক্ত চোখে তাকাতেই দূর্বল হাসলো সে। হৈমন্তী সরে বসলো। তুষারও সরে এলো ওর দিকে। হৈমন্তী রেগে কিছু বলবে, তার আগেই কোত্থেকে একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেয়েটাকে দেখে বয়সে কিংবা উচ্চতায় বেশ ছোটই মনে হচ্ছে। ইন্টারে পড়ে সম্ভবত। তবে দেখতে বেশ রুপবতী। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে, কোনো কথা ছাড়াই একটা লাল কাগজের চিঠি তুষারের এগিয়ে দিলো মেয়েটি। এরপর লাজুক হেসে মিনমিনিয়ে বলতে লাগল,
— “ইয়ে,মানে… আসলে, এটা আপনার জন্য।”
তুষার ভ্রু উঁচালো,
— “এটা কি?”
— “আপনিই পড়ে দেখুন।”
মেয়েটা তার স্বভাবসুলভ লাজুকতা বজায় রাখলো। তুষার চিঠিটা নিতেই এক দৌঁড়ে গেল সেখান থেকে। তা দেখে মুখ বাঁকিয়ে হাসলো তুষার। কোলে রাখা হৈমন্তীর হাত দু’টোয় গুঁজে দিলো চিঠিটা। অতঃপর আবারও গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে চোখে বুজে বললো,
— “পড়ে দেখুন তো হৈমন্তীকা, চিঠিতে কি লিখা আছে।”
— “আমি কেন পড়ব? আপনাকে দিয়েছে আপনি পড়ুন।”
— “ইচ্ছে করছে না।”
তুষারের কণ্ঠে বিশাল ক্লান্তি। হৈমন্তী বিরক্ত হলো ভীষণ। একবার চিঠিটা রেখে দিতে গিয়েও আবার রাখলো না। অজানা কৌতূহল বশত বিড়িবিড়িয়ে পুরো চিঠিটা পড়লো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তীর কপালের ভাঁজও দৃঢ় হতে লাগল। পড়া শেষে মহাবিরক্তি নিয়ে সে বললো,
— “আপনাকে ভালোবাসে মেয়েটা। আপনিও ভালোবাসুন। আর আমার পিছু ছাড়ুন।”
— “আপনার পিছু ছাড়া অত সহজ হলে আমি ছেড়ে দিতাম, হৈমন্তীকা। কিন্তু তা অসম্ভব। মৃত্যুর পরও আমি আপনার পেছনেই পরে থাকব।”
প্রতিবারের মতো তুষারের এরুপ কথায় আজ রাগ হলো না হৈমন্তীর। আবার ভালোও লাগল না। মাঝামাঝিতে আটকে গেছে সে। অনুভূতি একদম শূণ্য। ওভাবেই চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে তুষারের দিকে। মলিন মুখটা দেখে বড্ড মায়া হচ্ছে তার। লাল চোখজোড়া দেখে খারাপ লাগছে। হৈমন্তী ব্যাগ হাতড়ে একটা নাপা ঔষধের পাতা বের করল। পুরো ঔষধের পাতাই তুষারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “মাথা ব্যথা করছে?”
— “অনেক।”
— “ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে ঔষুধ খেয়ে নেবেন। মাথা ব্যথা চলে যাবে।”
তুষার মাথা দুলালো। হৈমন্তী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেও তুষার তাকিয়েই রইলো। তাকিয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। সেই চিরচেনা দৃষ্টিতে, নির্নিমেষ, নিমেষহীন ভাবে। খানিক অস্বস্তি হতে লাগল হৈমন্তীর। তেজি গলায় বললো,
— “অন্যদিকে তাকান তুষার। নয়তো আপনার এই বেহায়াপনার জন্য আবারও চড় খাবেন আমার হাতে।”
— “আপনি যে দিন দিন পুরুষ নির্যাতনে লিপ্ত হচ্ছেন, তা কি জানেন হৈমন্তীকা?”
বিস্ফোরিত নয়নে চাইলো হৈমন্তী। বিমূঢ় হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কিহ্!”
— “কিছু না।” হাসতে হাসতে জবাব দিলো তুষার।
কি ভেবে সে আবারও বললো,
— “একটু আগের মেয়েটা সুন্দর, তাই না হৈমন্তীকা? ভাবছি, মেয়েটাকে আমার প্রেমিকা বানাবো আর আপনাকে বউ। দারুণ হবে না?”
হৈমন্তী জবাব দিলো না। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো মাত্র। যেই দৃষ্টি অদৃশ্য ভাবে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিচ্ছে তুষারকে।
_____
ভার্সিটি থেকে ফেরার পর বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ল তুষার। সকালে জ্বর অল্প কমলেও এখন যেন সেটা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। সোফায় ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো তুষার। উঁচু গলায় হেনাকে ডাকল,
— “মা? পানি আনো।”
রান্নাঘর থেকে হেনার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “আনছি।”
তুষারের সামনের সোফায়ই বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন আফতাব সাহেব। ছেলের দিকে তাকিয়ে পত্রিকার কাগজ রেখে দিলেন টেবিলে। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়লেন,
— “তোমার না জ্বর? এই জ্বর নিয়ে ভার্সিটি গিয়েছ কেন?”
— “কিছু নোটের প্রয়োজন ছিল।”
সহজ উত্তর দিয়ে সোফার সঙ্গে আরও এলিয়ে বসলো তুষার। ততক্ষণে হেনাও এসে গেছেন। আফতাব সাহেব আবার বললেন,
— “তোমাকে আমি হৈমন্তী না কি যেন? ওই মেয়েটা থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। কথাটা মনে আছে তোমার?”
তুষার হেনার থেকে পানির গ্লাসটা নিলো। এক চুমুকে পুরোটা পানি পান করে গ্লাসটা সশব্দে রেখে দিলো টেবিলে। অতঃপর বললো,
— “মনে আছে।”
— “মেয়েটার পিছু ছেড়েছ তুমি?”
নির্ভয় এবং স্বাভাবিক কণ্ঠে তুষারের ছোট্ট জবাব, “না।”
সঙ্গে সঙ্গে তেঁতে উঠলেন আফতাব সাহেব। ঝাঁঝালো গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “না, মানে? তাহলে আমার কথা মনে রেখে কি লাভ? তুমি কি আমার মানসম্মান খোয়ানোর ফন্দি করছো তুষার? নিজের চেয়ে ছোট মেয়ে ভালোবাসতে, আমি কিছু বলতাম না। কিন্তু নিজের চেয়ে বড় মেয়ে! সমাজ কি বলবে তার কোনো চিন্তা নেই তোমার? সমাজ বাদ দাও, আমার তো ভাবতেই জঘন্য লাগছে।”
তুষার কোনোরূপ জবাব দিলো না। শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে রইল। ভাবলো, টেবিল থেকে রিমোট নিয়ে টেলিভিশন চালু করলে কি বাবা একটু বেশিই রেগে যাবেন তার ওপর? পরক্ষণেই ভাবলো, না থাক! রুমে গিয়েই টেলিভিশন দেখা যাবে।
চেঁচানোতে হেনা দিরুক্তি করে উঠলেন,
— “ছেলেটাকে অত বকো না তো। ওর কি দোষ?”
— “তুমি এ বিষয়ে একদম কথা বলো না হেনা। তোমার লাই পেয়েই ছেলেটা এমন বিগড়ে গেছে।”
স্বামীর ধমকে হেনা চুপসে গেলেন। তুষার ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবার। সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললো,
— “মা? রাতে খিঁচুড়ি খাবো গরু ভুনা দিয়ে। এখন একটু বিরিয়ানি দাও তো!”
ছেলের এহেন অভিব্যক্তি দেখে আফতাব সাহেব রেগে তাকালেন নিজ স্ত্রীর দিকে। মনে মনে ভেবে নিলেন তাকে কি করতে হবে।
__________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা