হৈমন্তীকা
৩৫.
বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুপঝুপ শব্দ তীব্র কোলাহল সৃষ্টি করছে কর্ণকুহুরে। বাতাসে এক আলাদাই মিষ্টি, মিষ্টি ঘ্রাণ। ঠান্ডা মৌসুমে সামান্য উষ্ণতার আভাস পেতেই আরও চেপে শুলো হৈমন্তী। প্রশস্ত বুকে লেপ্টে থেকে বুকে মুখ গুঁজলো। পরপরই ভারিক্কি আওয়াজে ফোনের অসহনীয় রিংটোন কানে বাজলো তার। না চাইতেও ঘুম ভেঙ্গে গেল। পিটপিট নয়নে চোখ মেলল সে। নিজেকে আবিষ্কার করলো অন্ধকারে ভরপুর বদ্ধ কাঁথার নিচে। মাথা অব্দি কাঁথা টেনে দেওয়া তার। মুখ থেকে কাঁথা সরালো হৈমন্তী। বালিশের নিচ হাতড়ে ফোন বের করলো। তখনো বিরক্তিকর এলার্ম বেজেই চলছে। স্ক্রীনে গুটিগুটি অক্ষরে এর শিরোনাম লিখা,
—“ঘুম থেকে উঠে পর তুষার। বউকে জাগাতে হবে, খাওয়াতে হবে। কত কাজ তোর! এখন কি তুই আর যুবসমাজের অবিবাহিত ছাত্র আছিস?”
চার বাক্যের এটুকু লিখা পড়ে আনমনেই হাসলো হৈমন্তী। তুষারের ঘুমন্ত মুখপানে তাকালো। কথায় কথায় তাকে শাসন করা ছেলেটা ভেতরে ভেতরে এখনো বাচ্চা রয়ে গেছে। যা শুধু হৈমন্তীর কাছেই প্রকাশ পায়। একান্তই তার সামনে। হাত বাড়িয়ে তুষারের গাল আলতো স্পর্শ করলো সে। ছোট্ট ছোট্ট দাঁড়ি ক্ষীণ বিঁধছে আঙুলের ডগায়। সে হাত সরিয়ে নিলো। কপালে পরে থাকা এলোমেলো চুলগুলো উপরে ঠেলে দিতেই হঠাৎ জেগে উঠলো তুষার। আধবোজা চোখে কিছুপলক চেয়ে রইলো হৈমন্তীর দিকে। কাছে টেনে নিলো। অতি সন্তপর্ণে গলায় মুখ গুঁজে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
—“আরেকটু ঘুমান হৈমন্তীকা। এখনো এলার্ম বাজে নি।”
হৈমন্তী সরতে চাইলো,
—“এলার্ম বেজেছে। আমি বন্ধ করে দিয়েছি। উঠুন। একটু পর মাগরিবের আযান দিবে।”
তুষার ছাড়লো না। জড়িয়ে ধরার শক্তি আরও দৃঢ় করে বললো,
—“আরেকটু ঘুমান। ঘুম শেষ হয় নি আমার।”
—“কেন? আপনার না অনেক কাজ? বউকে জাগাতে হবে, খাওয়াতে হবে। আপনি কি আর যুবসমাজের অবিবাহিত ছাত্র আছেন? তাড়াতাড়ি উঠুন। কাজ রেখে ঘুমাচ্ছেন কেন?”
তুষার নেত্র মেলল। তীক্ষ্ণ চাহনি নিয়ে তাকালো। কপালের ভাঁজ গাঢ় হতেই সশব্দে হেসে দিলো হৈমন্তী। খিলখিল শব্দ কানে প্রবল ঝংকার তুললো যেন। তুষার পলক ফেলছে না। নিমেষহীন দেখছে। চোখের গভীর, অশান্ত দৃষ্টি নজরে আসতেই হাসি থামিয়ে দিলো সে। ক্ষীণ লজ্জায় জড়োসড়ো হলো। তুষার যেন প্রশ্রয় পেল এতে। নিমগ্ন চেয়ে ভয়ংকর গলায় প্রশ্ন করলো,
—“আমি যদি আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেই, আপনি কি রাগ করবেন হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তীর গাল রক্তিম আভায় ফুটে উঠলো। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না। থুতনি গলার সঙ্গে একদম লাগিয়ে নতজানু হয়ে রইল সে। তুষার দূর্বোধ্য হাসলো। এগিয়ে এলো। কপাল থেকে চুল সরিয়ে গভীর ভাবে অধর ছোঁয়ালো। কোমল স্বরে বললো,
—“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি হৈমন্তীকা। আপনি শাড়ি ঠিক করে নিন।”
হৈমন্তী এবারও কিছু বলে না। আগের ন্যায়ই চুপচাপ শুয়ে থাকে। ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর শব্দ কানে যেতেই তুষারের শেষাক্ত কথা মনে পরে যায় তার। তড়িৎ গতিতে নিজের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় হৈমন্তীর। পরনের শাড়ি ঠিক নেই। বিছানার অপর পাশটায় পুরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শাড়ির আঁচল। অস্বস্থিতে মুখ চুপসে গেল হৈমন্তীর। মনে মনে বিড়বিড়িয়ে উঠলো, “পাজি ছেলে।”
_____
আফতাব সাহেব প্রচন্ড ক্রোধে ফুঁসছেন। চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছেন তুষারের দিকে। চোয়াল শক্ত উনার। সরব উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠলেন,
—“তোমার সাহস কি করে হয় আমার কথার বিরুদ্ধে গিয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করার? আবার নাকি এ বাড়িতেও নিয়ে এসেছো। কোথায় ওই মেয়ে? ডাকো ওকে। নির্লজ্জার সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে ওই পরিবার। এত বেজাত পরিবার আমি দু’টো দেখিনি।”
হেনা কাতর চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। দৃষ্টি ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন আবার। নরম সুরে অনুরোধ করলেন,
—“আস্তে বলো। মেয়েটা শুনতে পাবে।”
আফতাব সাহেব হুংকার ছাড়লেন,
—“শুনুক। ওই মেয়ের জানা উচিত ওরা কতটা নির্লজ্জ, বেহায়া, লোভী।”
তুষারের মুখশ্রী কেমন ভয়ংকর লাল দেখালো। চোখে-মুখে অনঢ় শক্ত আবরণ। কঠিন গলায় সে বললো,
—“মুখ সামলে বাবা। আমার স্ত্রী হয় উনি।”
আফতাব সাহেব তেঁতে উঠলেন,
—“মানি না আমি। বিয়ে করেছ এখন তালাক দেবে। ওই মেয়েকে নিজের বউমা কক্ষনো মানবো না আমি।”
তুষার গলার আওয়াজ বাড়লো। সেও প্রবল তেজের সঙ্গে উত্তর দিলো,
—“মানতে হবে না। আমিও চাই না উনি তোমার বউমা হোক। হৈমন্তীকাকে নিয়ে আমি এখনই চলে যাবো এখান থেকে।”
ছেলের চলে যাবার কথা শুনে অল্প ভড়কালেন আফতাব সাহেব। যত যাই হোক, নিজের ছেলের চলে যাওয়া কখনোই সহ্য করবেন না তিনি। উনার রাগ মিশ্রিত মুখশ্রী ক্ষীণ স্বাভাবিক হলো। তবে তখনো গম্ভীরতা, কঠোরতা সুস্পষ্ট। থমথমে গলায় তিনি বললেন,
—“তোমাকে চলে যাওয়ার কথা একবারও বলেছি আমি?”
—“তোমার কথা দিয়ে তো তা-ই বোঝাচ্ছ। যেখানে হৈমন্তীকার থাকতে কষ্ট হয়, সেখানে অবশ্যই আমি থাকবো না।”
মাঝখান দিয়ে হেনা থামাতে চাইলেন তুষারকে, “থাম না তুষার। বাবার সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? রুমে যা।”
তুষারের দু’কান সেকথা শুনলোই না যেন। উত্তরের অপেক্ষায় বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। আফতাব সাহেব বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। হেনার উদ্দেশ্যে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে চেঁচালেন,
—“তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে হেনা। ওই মেয়ে পাগল করে দিয়েছে তোমার ছেলেকে।”
তুষার প্রতিউত্তরে কিছু বলতে নিলেই তার হাত চেপে ধরলেন হেনা। অনুনয়ের সুরে কথা বাড়াতে মানা করলেন।
_____
দরজা খোলার শব্দ পেতেই সেদিকে দৌঁড়ে এগোলো হৈমন্তী। তাকে রুমে আটকে রেখেছিল তুষার। তবুও কিছুক্ষণ আগের হওয়া ঝড়ের একেকটা কথা শুনতে পেয়েছিল সে।
তুষারের এলোমেলো, রাগে অস্বাভাবিক চেহারা দেখে থমকে দাঁড়ালো হৈমন্তী। আঁখিজোড়া জলে পরিপূর্ণ তার। তুষারকে দেখতেই তা গড়গড় করে গাল বেয়ে নিচে নেমে পরল। ফুঁফিয়ে উঠল সে। পা গুলো যেন শিরশির করে কাঁপছে। শরীর দুলছে। কম্পয়মান কণ্ঠে হৈমন্তী জিজ্ঞেস করে উঠল,
—“কেন বিয়ে করেছেন আমায় তুষায়? কেন ভালোবাসেন?”
তুষার উত্তর দেয় না। শক্ত চোখে তাকিয়ে তাকে। হৈমন্তী নিজ থেকেই আবার বলা শুরু করে,
—“বলুন, কেন বিয়ে করেছেন? কেন ভালোবেসেছেন? আমি তো লোভী। আমার পরিবার লোভী। আমাকে আমার বাবার কাছে দিয়ে আসুন তুষার। আমি এখানে থাকবো না। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। একদমই ভালোবাসি না।”
তুষার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। দ্রুত হৈমন্তীর কাছাকাছি এসে তাকে কোলে তুলে নিলো। হৈমন্তী পা ছোড়াছুড়ি করছে। বারবার আঘাত করছে বুকে। নামিয়ে দিতে বলছে। তুষার পরোয়া করলো না। ধীর স্থির হয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ছুঁলো। চোখ বুজে বললো,
—“আপনি আমাকে ভালোবাসেন হৈমন্তীকা।”
সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তীর কান্না ভেঁজা গলা,
—“মিথ্যে কথা।”
তুষার হাসলো। বিস্তর হাসি। সিক্ত চোখের পাতায় অধর ছুঁইয়ে বললো,
—“কাঁদবেন না হৈমন্তীকা। আমার ভালো লাগে না।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
হৈমন্তীকা
৩৬.
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। অস্বাভাবিক শান্ত বাতাসে শরীর শিরশির করে উঠছে। রেলিং গলিয়ে একবার নিচে উঁকি দিলো হৈমন্তী। চোখ থমকে গেল সেখানেই। কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আছে তার প্রাক্তন বারান্দাটা। ধূলোয় স্তুপ হওয়া জায়গা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ বৃষ্টির পানিতে। মনে মনে বৃষ্টিকে কৃতজ্ঞ জানালো হৈমন্তী। ইচ্ছে হলো, ছুটে গিয়ে প্রাণপ্রিয় বারান্দা একটুখানি ছুঁয়ে দিতে। হৈমন্তী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দৃষ্টি সরিয়ে গহীন কালো আঁধারে স্থির করতেই কোমরে পুরুষালী স্পর্শ পেল সে। যা তার কোমড় ছুঁয়ে দু’হাতের দু’পাশে এসে স্থান পেল। পিঠ ঠেকে গেল প্রশস্ত বুকে। হৈমন্তী ভড়কালো। চমকে উঠলো ভীষণ। ধাতস্ত হতেই বললো,
—“কি করছেন তুষার?”
তুষার উত্তর দেয় না। উলটো গমগমে স্বরে বলে,
—“বৃষ্টি হচ্ছে না? দাঁড়িয়ে আছেন কেন? জ্বর বাঁধানোর ইচ্ছে হয়েছে?”
হৈমন্তীর মিনমিনিয়ে উত্তর,
—“রুমে ভালো লাগছে না।”
পরপরই আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিচের বারান্দাটির দিকে তাকালো সে। জিজ্ঞেস করলো,
—“আমাদের ফ্ল্যাটে কি কেউ থাকে না? কেমন বদ্ধ বদ্ধ যে?”
—“থাকে। শুধু আপনার বারান্দা আর রুমে থাকার অনুমতি নেই।”
হৈমন্তী যেন ভীষণ অবাক হলো। বললো,
—“কেন?”
—“কারণ আমি চাই না ওখানে কেউ থাকুক। ওই বারান্দাটা আমার হৃদয়খননের একমাত্র স্বাক্ষী, সূচনা আর ভালোবাসা।”
তুষার ক্ষীণ গভীর হলো। গলায় মুখ এগিয়ে স্পর্শের প্রগাঢ়তা বাড়ালো। নাকে ঠেকলো শ্যাম্পুর মিষ্টি ঘ্রাণ। শুধু কি শ্যাম্পুর ঘ্রাণ? হৈমন্তীর নিজস্বতাও মিশে আছে এতে। হৈমন্তী থেমে থেমে কেঁপে উঠলো। আড়চোখে তাকালো তুষারের মুখপানে। কম্পয়মান গলায় বলতে চাইলো,
—“আমার ঠান্ডা লাগছে তুষার। রুমে চলুন।”
তুষার শুনলো না। আরও কিছু সময় নীরবে, নিভৃতে কাটিয়ে দিলো তারা। হৈমন্তীও দিরুক্তি করতে পারেনি। তার কি সাধ্য আছে মানা করবার?
সরব খট খট শব্দে কে যেন কারাঘাত করলো দরজার পিঠে। হৈমন্তী ছিটকে সরে গেল প্রায়। তুষারের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, সে ভ্রু কুঁচকে দৃঢ় চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। হৈমন্তী আবার নতজানু হলো। মৃদু স্বরে তাগাদা দিলো,
—“দরজায় কেউ আছে। খুলুন, যান।”
তুষার শুনলো। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললো,
—“শাড়ি ভিঁজে গেছে। চেঞ্জ করে নিন। ঠান্ডা লাগবে।”
পেছন থেকে হৈমন্তী উঁচু গলায় বললো,
—“আমার কাছে আর শাড়ি নেই তো। সবগুলো ধুঁয়ে দিয়েছিলাম। শুকোয় নি এখনো।”
সেকথার আর উত্তর পাওয়া গেল না। ধীর স্থির হয়ে দরজার কাছে গিয়ে নব ঘোরালো তুষার। হেনাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুঁচকানো ভ্রু স্বাভাবিক করলো। হেনা খুবই শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
—“ভাত খাবি না? নিচে আয়। ভাত বাড়ছি।”
তুষার মায়ের মতো করেই বললো,
—“নিচে খাবো না। রহিমা আন্টিকে বলো রুমে খাবার আনতে।”
হেনা জোড় করলেন,
—“রাগ মনে পুষে রাখিস না বাপ। হৈমন্তীকে নিয়ে নিচে আয়।”
—“আমরা এখানেই খাবো মা।”
হেনা হতাশায় ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছোট্ট করে “আচ্ছা।” বলে চলে যেতে নিলেই পিছু ডাকলো তুষার। হেনা পেছনে ফিরে তাকালেন। তুষার নরম গলায় প্রশ্ন করলো,
—“তুমি ভাত খেয়েছ মা?”
প্রশ্নটায় কি যেন ছিল। মন ভরে উঠলো উনার। ঠোঁটে অল্প হাসি ফুটিয়ে তিনি জবাব দিলেন,
—“খাবো। একটু পর।”
—“তোমার কয়েকটা শাড়ি পাঠিয়ে দিও মা। হৈমন্তীকার পরার কাপড় আনা হয় নি।”
ওমনি হেনা যেন ব্যস্ত হয়ে পরলেন। তুষারকে ক্ষীণ ধমক দিয়ে বললেন,
—“একি! আগে বলবি না? আমি আনছি। দ্বারা।”
হেনা যেতেই দরজা লাগিয়ে দিলো তুষার। হৈমন্তীকে আগের মতোই ভেঁজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
—“ঠান্ডা লাগছে হৈমন্তীকা? আপাতত আমার একটা টি-শার্ট পরে নিন। আমি এসি বন্ধ করে দিচ্ছি।”
_____
দুপুর গড়াতেই রুমে বসে থাকতে আর ভালো লাগলো না হৈমন্তীর। কতক্ষণ আর শুয়ে, বসে কাটানো যায়? তুষার মানা করা সত্ত্বেও তা অবজ্ঞা করে নিচে নেমে এলো সে। রান্নাঘরে তাকে দেখে অনেকটা অবাকই হলেন হেনা। বিস্মিত স্বরে বললেন,
—“হৈমন্তী, তুমি এখানে যে? কিছু দরকার ছিল?”
হৈমন্তী নিচু গলায় বললো,
—“এমনি। আপনার কাছে আসতে ইচ্ছে হলো। কি বানাচ্ছেন আন্টি?”
হেনা হাসলেন। চুলার মাছগুলো উল্টিয়ে দিতে দিতে বললেন,
—“বোকা মেয়ে। আন্টি বলছো কাকে? মা ডাকবে।”
কথার পিঠে হৈমন্তীও হাসলো। কিছু বলার আগেই আফতাব সাহেবের হাঁক শোনা গেল হঠাৎ। হেনা দ্রুত হাত চালিয়ে অন্য চুলা থেকে চায়ের কেতলি নামালেন। এক চামচ চিনি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা চা ঢাললেন কাপে। তারপর হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে অনুরোধের সুরে বললেন,
—“উনাকে একটু চা-টা দিয়ে আসতে পারবে হৈমন্তী? আমার হাতে কাজ তো! নয়তো আমিই যেতাম।”
হৈমন্তী করুণ চোখে তাকালো। তাকে যেতে হবে চা দিতে? হেনা তার সংশয় দেখে একটু হাসলেন। আবারও বললেন,
—“ভয় নেই। বকবে না। আমি কাল রাতে বুঝিয়েছি উনাকে।”
হৈমন্তী যেন একটু সাহস পেল। চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল ড্রইংরুমে। আফতাব সাহেব টিভি দেখছিলেন। তখনো হৈমন্তীকে খেয়াল করেননি তিনি। হৈমন্তী আমতা আমতা স্বরে বললো,
—“আপনার চা আঙ্কেল।”
টিভি দেখার মাঝেই ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। পাশ ফিরে হৈমন্তীকে দেখে তা যেন আরও গাঢ় হলো। গাম্ভীর্যের গভীরতা বাড়লো সেই সঙ্গে। তবে অবাক বিষয়, সত্যিই তাকে কিছু বললেন না আফতাব সাহেব। গমগমে মুখশ্রী নিয়ে একবার তাকালেন মাত্র। পরপরই বিরক্ত ভঙ্গিতে চলে গেলেন সেখান থেকে।
তুষারের দেখা মিললো এর কিছুক্ষণ পরই। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে উঁচু গলায় হৈমন্তীকে ডাকলো সে। রান্নাঘর থেকে গুটিগুটি পায়ে হৈমন্তী কাছাকাছি আসতেই বললো,
—“আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি হৈমন্তীকা। আপনি আর কতক্ষণ এখানে থাকবেন? মায়ের রান্না শেষ হয়েছে?”
হৈমন্তী মাথা দুলিয়ে বললো,
—“হ্যাঁ। কোথায় যাচ্ছেন?”
—“টিউশন আছে। আপনি রুমে চলে চান। আমি না আসা অব্দি বের হবেন না। ঠিকাছে?”
হৈমন্তী এবারও মাথা দুলালো। বিস্তর হাসলো তুষার। হৈমন্তীকে কাছে টেনে কপালে অধর ছোঁয়ালো। কোমল স্বরে বললো,
—“নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো।”
বলে সে আর দাঁড়ালো না। ব্যস্ত পায়ে বেড়িয়ে গেল ড্রইংরুম হতে।
_____
কোলাহলে পূর্ণ এলাকা বৃষ্টির কারণে বড্ড নিস্তব্ধ। দৌঁড়ে যে যার গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কেউ কেউ ছাতা হাতে ধীর পায়ে হাঁটছে রাস্তায়। উপভোগ করছে বৃষ্টিমূখর পরিবেশ। বারান্দার দরজা আটকে দিয়েছে হৈমন্তী। পানির ছিঁটায় ফ্লোর ভিঁজে যাচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে আছে আধখোলা জানালার একপাশে। পরনে হলুদ রঙের জামদানি শাড়ি। শাড়িটা হেনা দিয়েছেন। ভীষণ সুন্দর দেখতে।
চিন্তায় মগ্ন হৈমন্তী তুষারের আগমন টের পেল না। তুষার নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো। মৃদু স্বরে ডাকলো,
—“হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী ক্ষীণ চমকে পেছনে তাকালো। কাকভেঁজা তুষারকে দেখতেই আঁতকে উঠে বললো,
—“আল্লাহ! পুরো ভিঁজে গেলেন তো। ছাতা নিয়ে যান নি সাথে?”
তুষার হাতের ব্যাগগুলো ফ্লোরে রেখে বললো,
—“না। ভুলে গিয়েছিলাম।”
বলে হাতের ঘড়িটা খুলে রাখলো ড্রেসিংটেবিলে। শার্টের বোতাম খুলতে নিলেই ধমক দিয়ে উঠলো হৈমন্তী,
—“এখানে খুলছেন কোন আক্কেলে? ওয়াশরুমে যান।”
তুষার হাসলো। এক কদম হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে প্রথম তিনটে বোতাম খুলতেই উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠলো হৈমন্তী। তুষারের হাসির শব্দ বাড়লো। হাসির দমকে নেত্র কোণে গুটিকয়েক ভাঁজ পরলো, নাক লাল হলো ভীষণ। হৈমন্তী মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর স্বরে আবার বললো,
—“ফাজলামি না করে ওয়াশরুমে যান।”
তুষার পাত্তা দিলো না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো,
—“আপনাকে রাগলে মারাত্বক লাগে হৈমন্তীকা। আসুন, কাছে আসুন। একটু ছুঁয়ে দেই।”
সঙ্গে সঙ্গে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল হৈমন্তী। ক্ষীণ লজ্জায় মিইয়ে গেল। উঁচু গলায় বললো,
—“আপনি যাবেন?”
হাসতে হাসতে তুষারের জবাব,
—“যাচ্ছি। ব্যাগে আপনার জন্য শাড়ি এনেছিলাম। ভিঁজে গেছে সম্ভবত। একটু দেখুন তো।”
_________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা