হৈমন্তীকা
৩৩.
সিলিং ফ্যানের ভনভন শব্দ কাঁপিয়ে তুলছে পুরো রুম। ভ্যাপসা গরমের দরুণ শরীরে বাতাসের ছিটেফোটাও লাগছে না। রাবেয়াকে ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দিতে বললেন আসরাফ সাহেব। কপালের ঘামটুকু মুছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তুষারের দিকে। কেমন অভদ্র ছেলেটা। জড়তাহীন। ভয়, ভীতি ছাড়া কিভাবে বসে আছে উনার সামনে। তিনি গলা ঝেড়ে খুক খুক করে কাঁশলেন। গমগমে গলায় বললেন,
—“তোমাকে আমি কি জন্যে ডেকেছি সেটা নিশ্চই জানো?”
তুষার নম্র স্বরে ছোট্ট জবাব দিলো,
—“জি।”
আসরাফ সাহেব আবারও কেঁশে গলা পরিষ্কার করলেন। মেয়ের সম্পর্কে কথা বলতে কেমন জড়তা কাজ করছে উনার। চোখে মুখে তবুও কাঠিন্যতা বজায় রেখে তিনি বললেন,
—“তুমি আসলে চাচ্ছোটা কি? আমার মেয়ের পেছনে পরে আছো কেন?”
—“কারন আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি।”
নিঃসঙ্কোচ কথার জোড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আসরাফ সাহেব। তিনি হকচকালেন, ভড়কালেন, চমকে উঠলেন। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তুষারের দিকে চেয়ে অবাক স্বরে বললেন,
—“ভারি নির্লজ্জ ছেলে তো তুমি! নিজের চেয়ে বড় মেয়েকে এসব বলতে লজ্জা করছে না তোমার? ভয় লাগছে না আমার সামনে এসব বলতে?”
তুষারের ভাব-ভঙ্গি অস্বাভাবিক শান্ত। কণ্ঠস্বর ভীষণ শীতল,
—“ভয় পেলে তো আপনার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখতাম না আঙ্কেল।”
সাথে সাথে উত্তর দেওয়ায় একটু অসন্তুষ্ট হলেন আসরাফ সাহেব। তুষারকে যথেষ্ট ঘাড়ত্যাড়া মনে হচ্ছে উনার। অন্তত তুষারের অভিব্যক্তি তো তা-ই জানান দিচ্ছে। টেবিলে থাকা মিষ্টির প্যাকেটগুলোর দিকে একবার তাকালেন আসরাফ সাহেব। কি ভেবে হাসলেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন,
—“আমার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তোমার এমনিতেও নেই। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের হতে পারি। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ। এভাবে বাবার টাকা উড়িয়ে খাই না। আগে নিজ উপার্জ দিয়ে কিছু করো। তারপর যোগ্যতার কথা বলবে।”
আসরাফ সাহেব ভাবলেন, তুষার হয়তো চুপসে যাবে। কিংবা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলবে। তবে তেমন কিছুই ঘটলো না। বরং তুষারকে আগের মতোই স্বাভাবিক দেখালো। গাঢ় স্বরে সে বললো,
—“মিষ্টিগুলো আমার বাবার টাকায় কেনা নয় আঙ্কেল। আমার টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে কিনেছি। নিজের উপার্জনের টাকায়।”
আসরাফ সাহেব একটু থমকালেন। তুষারের মুখপানে গভীর পর্যবেক্ষণ নিয়ে তাকালেন। ছেলেটা দেখতে, শুনতে খারাপ না। সুদর্শনই বলা চলে। আত্মবিশ্বাসও প্রখর। কিন্তু তাই বলে এমন ছোট ছেলেকে প্রশ্রয় দিতে পারছেন না তিনি। বিষয়টা এখানেই ধামাচাপা দিতে চাইছেন। কোনোরুপ ভণিতা ছাড়া আসরাফ সাহেব বললেন,
—“দেখ ছেলে, আমার মেয়ের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। কয়েকদিন পর বিয়ে। ভালো হবে তুমি আমার মেয়ের পিছু ছেড়ে দাও। তোমার বয়স কম। আবেগে বশে কি করছ বুঝতে পারছ না। আমার মেয়েকে বিরক্ত করা বন্ধ করো।”
তুষারের মুখশ্রী গাম্ভীর্যে ভরে গেল। নাওয়াজের কথা মনে পরতেই মস্তিষ্ক গরম হয়ে উঠল। আসরাফ সাহেবের চোখে চোখ রাখলো সে। গম্ভীর আওয়াজে ভীষণ ভয়ংকর কথা বলে ফেলল, “হৈমন্তীকা আমার বিয়ে করা বউ আঙ্কেল। উনার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার। সুতরাং আপনার কথায় উনাকে ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে।”
আসরাফ সাহেবের চোখে বিস্ময় স্পষ্ট। বিমূঢ়তায় কুঁচকে গেছে ভ্রু যুগল। কিঞ্চিৎ রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি,
—“কি বলছো বুঝে শুনে বলছো তো? এমন কথা মুখে আনার সাহস কোথা থেকে পেলে তুমি?”
প্রতিউত্তরে তার একরোখা জবাব,
— “বিশ্বাস না হলে হৈমন্তীকাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
আসরাফ সাহেব মিনিট পাঁচেক কিছুই বলতে পারলেন না। থম মেরে রইলেন। কি যেন গভীর মনোযোগে ভাবলেন। চুপচাপ, নিশ্চুপ হয়ে। হঠাৎ চেঁচিয়ে ডাকলেন,
—“হৈমন্তী! এদিকে আয়।”
হৈমন্তী হন্তদন্ত পায়ে উপস্থিত হলো। এক পলক ভীতু নয়নে তুষারের দিকে তাকিয়ে আবারও নতজানু হলো।
আসরাফ সাহেব আক্রোশে ফেটে উঠলেন। ক্রোধে জড়জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
—“এই ছেলে কি বলছে হৈমন্তী? তুই বিয়ে করেছিস ওকে?”
হৈমন্তীর আত্মা কেঁপে উঠল যেন। পা অসাড় হতে শুরু করল। জবাবে চুপ থাকা ছাড়া কিছুই বলতে পারলো না সে। আসরাফ সাহেব আরও তেঁতে উঠলেন। প্রচন্ড ঝংকার তুলে ধমক দিয়ে বললেন,
—“তোকে কি জিজ্ঞেস করেছি হৈমন্তী? কথা বলছিস না কেন?”
হৈমন্তী ফুঁফিয়ে উঠল এবার। কণ্ঠ গলিয়ে একটা টু শব্দও বের করতে পারলো না। আসরাফ সাহেব পীড়াদায়ক এক দম ছাড়লেন। উঁচু কণ্ঠস্বরটা হঠাৎ-ই মিলিয়ে গিয়ে একদম শান্ত শোনালো,
—“এমনটা কিভাবে করলি হৈমন্তী? বাবা মায়ের কথা একটুও ভাবলি না?”
হৈমন্তীর ফুঁফানোর শব্দ বাড়লো। চোখে যেন কেউ মরিচ ডলে দিয়েছে। খুব জ্বলছে। কাঁপা স্বরে হৈমন্তী বলতে চাইল, “বাবা আমি–!”
আসরাফ সাহেব থামিয়ে দিলেন ওকে। রাগ না দেখিয়ে ম্লান স্বরে বললেন,
—“আমার বাসা থেকে বেড়িয়ে যা হৈমন্তী। এখানে তোর আর জায়গা হবে না।”
হৈমন্তী অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো। দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো অবিরাম নোনাজল। সে ডাকলো, “বাবা।”
আসরাফ সাহেব শুনলেন না। হেঁটে চলে গেলেন রুমে। যাওয়ার আগে রাবেয়াকে বললেন,
—“তোমার মেয়েকে যেন আমি আমার বাসায় আর না দেখি রাবেয়া।”
_____
কাজী অফিসে তেমন ভীড় নেই। সাধারণ কর্মরত কিছু সহকর্মীদের আনাগোনা ছোট্ট অফিসটায়। এক কি দু’জন বিয়ে করতে এসেছে। হৈমন্তী আর তুষার এক কোণের ক্ষীণ ভাঙ্গাচোরা চেয়ারে বসে আছে। হৈমন্তীর আঙুলগুলো তুষারের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে স্থির হয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। তার দৃষ্টি কালসিটে মেঝের পানে। হঠাৎ একটা ছেলে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। হৈমন্তীর উদ্দেশ্যে ঠোঁট ভরে বিস্তর হাসলো,
—“আসসালামু আলাইকুম ভাবী। আমি রওনক। তুষারের বন্ধু। কেমন আছেন?”
হৈমন্তী জবাব দেয় না। মাথা তুলে প্রাণহীন হাসে মাত্র। রওনকও কথা বাড়ায় না। তুষারকে বলে,
—“তোদের পালা এসেছে। কাজী ডাকছে। আয়।”
তুষার চোখে ইশারায় কি যেন বললো। ঠিক বোধগম্য হলো না হৈমন্তীর।
কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। হৈমন্তী ক্লান্ত চোখে একবার আশপাশটা দেখল। তুষারের কিছু বন্ধু-বান্ধব সাক্ষী দিতে দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের পাশটায়। হৈ-হুল্লোড় করছে। মৃদু চেঁচামেচির শব্দে মেতে উঠছে কাজী অসিফ। অথচ হৈমন্তী নির্বিকার হয়ে বসে আছে। আজ তার বিয়ে। কিন্তু তার বাবাটাই যে ডান পাশটায় দাঁড়িয়ে তাকে আশ্বস্ত করতে এখানে নেই। হৈমন্তীর মনে হচ্ছে, তার ভেতরটা নিদারুণ কষ্টে জ্বলছে, পুড়ে যাচ্ছে। অথচ সেটা অনুভব করতে পারছে না সে। মস্তিষ্ক বারবার জানান দিচ্ছে, হৈমন্তীর কষ্ট হচ্ছে, কান্না আসছে। কিন্তু কোথায়? সে তো ভাবশূণ্য হয়ে বসে আছে। কান্না আসছে না একদমই। জোড় করেও না। তবে?
কাজীর ডাকে সম্বিৎ ফিরলো তার। কাজী তাকে বারবার কবুল বলতে বলছেন। সবার উৎসুক দৃষ্টি তার দিকেই। হৈমন্তী পিটপিট নয়নে পাশে তাকালো। গভীর চোখের চাহনিতে আটকে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তুষার গাঢ় স্বরে প্রশ্ন করলো,
—“কবুল বলবেন না হৈমন্তীকা?”
জবাবে আর সময় নিলো না হৈমন্তী। কাঁপা গলায় থেকে থেকে বললো,
—“কবুল, কবুল, কবুল।”
এতক্ষণে যেন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কাজী তুষারকে কবুল বলতে বললেই তুষার এক নিশ্বাসে তিনবার কবুল বলে ফেলল। মুহুর্তেই একদফা হাসাহাসি চললো সবার মাঝে। শুধু হাসলো না হৈমন্তীই। তুষার ব্যাপারটা খেয়াল করেও কিছু বললো না। সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাইকের কাছাকাছি এলো।
আকস্মিক হৈমন্তীর কোমড় জড়িয়ে তাকে উঁচু করে ধরল তুষার। মাটি থেকে পা দু’এক ইঞ্চি উপরে উঠে গেল হৈমন্তীর। চমকে গিয়ে তুষারের কাঁধের শার্টটুকু খামচে ধরল সে। তুষার বাইকে বসিয়ে দিলো তাকে। হুট করে অধরে অধর ছুঁয়ালো অতি অধৈর্য ভঙ্গিতে। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে অনুরোধের সুরে বললো,
—“আপনি কাঁদুন হৈমন্তীকা। আমি অভিযোগ করবো না।”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
হৈমন্তীকা
৩৪.
দরজা খুলে তুষার আর হৈমন্তীকে একসঙ্গে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হেনা। বিস্ময়ে চোখ দু’টো স্বাভাবিকের চেয়েও বড় দেখাচ্ছে। কপাল কুঁচকে গেছে। কণ্ঠ নড়বড়ে। কিছুক্ষণ চুপচাপ ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ-ই কাঁপা গলায় ডাকলেন, “তুষার।”
তুষার মায়ের দিকে তাকালো। কণ্ঠে দৃঢ়তা এঁটে বললো,
—“ভেতরে ঢুকতে দেবে না মা?”
হেনা সরে দাঁড়ালেন। অত্যাধিক বিমূঢ়তায় কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। অজানা আশঙ্কায় ভেতরটা নিদারুণ কেঁপে উঠছে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভয় লাগছে। হেনার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে তুষারের হাতের মুঠোয় শক্ত করে থাকা হৈমন্তীর নিস্তেজ হাত পানে। তিনি ছেলের দিকে একপা এগোলেন। কম্পয়মান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
—“এসব কি তুষার? হৈমন্তী.. তোর সাথে এখানে..?”
তুষার স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
—“আমি আর হৈমন্তীকা বিয়ে করেছি মা।”
যেন বজ্রপাতের তীব্র শব্দে কেঁপে উঠলেন হেনা। কথাটা কানে ঝংকার তুলতেই উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠলেন,
—“কি বলছিস এসব তুষার? মাথা ঠিক আছে তোর? মজা করছিস?”
তুষার ভাবলেশহীন, নিশ্চুপ। নজরকাড়া শীতল চাহনি ছুঁড়ে দিলো মাত্র। যা বোঝার বুঝে গেলেন তিনি। মস্তিষ্ক সচল হয়েও আবার নিভে গেল যেন। হতবুদ্ধি হেনা ভারসম্য হীন হয়ে বসে পরলেন সোফায়। হাহাকার করে উঠলেন,
—“এমন কিভাবে করলি তুষার? একটাবারও ভবিষ্যতের কথা ভাবলি না? বাবা মায়ের কেমন লাগতে পারে, তা ভাবলি না?”
—“তোমরাও তো ভাবো নি মা।”
ছেলের অভিমানে ভরা উত্তর শুনে কাতর নয়নে তাকালেন তিনি। কান্না ভেঁজা স্বরে বললেন,
—“তোর বাবাকে আমি কি জবাব দেব? হুট করে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিস তুষার?”
তুষারের অনড় জবাব,
—“তোমরা না চাইলে আমি আমার বউকে নিয়ে এখানে থাকবো না। চলে যাবো।”
—“কোথায় যাবি?” হেনার অবাক কণ্ঠের প্রশ্ন।
তুষার অকপটে বললো,
—“এটা ছাড়াও আমার থাকার অনেক জায়গা আছে।”
হেনা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ইতিমধ্যে মাথা যন্ত্রণা শুরু করে দিয়েছে তার। চিন্তায় মাথা ফেটে যাবে যাবে ভাব। চোখ তুলে একবার হৈমন্তীর দিকে তাকালেন তিনি। মেয়েটা যে তার অপছন্দ তা নয়। স্নিগ্ধ, মায়াময় চেহারাটি দেখতেই ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। শান্তি লাগে। কিন্তু স্বামীর মতের বিরুদ্ধে ছেলের পক্ষ নিতে পারছেন না তিনি। কিন্তু এখন? ছেলের পক্ষ নেওয়া ছাড়া কি অন্য কোনো উপায় আছে তার? আরেক দফা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে হৈমন্তীর দিকে এগোলেন হেনা। নরম গলায় বললেন,
—“চলো। তোমাকে রুমে নিয়ে যাই।”
হৈমন্তী একপলক তুষারের পানে চাইলো। পরক্ষণেই ক্লান্ত আঁখিজোড়া নামিয়ে নিয়ে বাধ্য মেয়ের মতো চলল হেনার সাথে সাথে।
_____
দুপুর হচ্ছে। ঘড়িতে ২টা বেজে ৫০মিনিট।
বিছানার মধ্যিখানে পা গুটিয়ে বসে আছে হৈমন্তী। পেটে এখনো একটা দানাও দেওয়া হয়নি। জামার অভাবে গোসলটাও হচ্ছে না। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। অস্থিরতা আর ক্ষুধায় হাত, পা কাঁপছে। পাশ থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে শুকনো গলা ক্ষীণ ভিঁজিয়ে নিলো হৈমন্তী। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিলো পুরো রুম। তুষারের রুমে আগে কখনো আসা হয় নি তার। রুমটা বড্ড গোছালো। দু’পাশে দু’টো বিশাল বড় জানালা, পড়ার টেবিল, আলমারি, বুকশেল্ফ। বিছানা বরাবর সাদা রঙের খালি দেওয়ালটায় তুষারের বিশাল ছবির ফ্রেম। রোদের মাঝে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঘমার্ক্ত মুখশ্রীতে কি দারুণ ভাবে হাসছে। সুন্দর লাগছে। হৃদয় কাঁপানো সুন্দর।
কিছু পলক একমনে চেয়ে থেকে হৈমন্তী তার দৃষ্টি সরালো। বারান্দায় চোখ যেতেই কিঞ্চিৎ থমকে গেল যেন। মনে নাড়া দিলো, এ বারান্দায় দাঁড়িয়েই কত শত কথার ঝুড়ি নিয়ে বসত তুষার। মাঝে মাঝে হাসাত, রাগাতো কিংবা বিরক্ত করতো। হৈমন্তী কখনো ভাবে নি, সে আবারও এখানে আসবে। আদৌ তুষারকে মন দিয়ে বসবে।
সরব খট শব্দে খুলে গেল দরজা। সেদিকে তাকালো হৈমন্তী। তুষার এসেছে। হাতে পাঁচ-ছয়টা শপিং ব্যাগ। তুষারকে দেখে কেমন অস্বস্থি হতে লাগলো তার। অস্বস্থি কাটাতে মৃদু হাসলো। তবে তুষার হাসলো না। সে সকাল থেকেই অস্বাভাবিক শান্ত। কারণে, অকারণে একদমই হাসছে না। তুষার এগিয়ে এলো। বিছানায় শপিং ব্যাগগুলো রেখে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
—“ক্ষুধা লেগেছে?”
উত্তরে মাথা উপর নিচ নাড়ালো সে। অস্বস্থির বদলে এবার প্রচন্ড লজ্জা লাগছে তার। তুষার বললো,
—“এখান থেকে যে কোনো একটা নিয়ে গোসল সেরে আসুন। ভালো লাগবে। আমি খাবার আনছি।”
হৈমন্তী এবারও মাথা নাড়ালো। কণ্ঠনালি থেকে কথা যেন বেরতেই চাচ্ছে না। টের পেল, তার গাল ভারি হতে শুরু করেছে। গরম অনুভূত হচ্ছে। উফফ, তার এত লজ্জা লাগছে কেন?
_____
ভেঁজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এলো হৈমন্তী। দৃষ্টি সামনে যেতেই ভীষণ ভাবে চমকালো। বড় ফ্রেমে তুষারের ছবির পাশাপাশি আরো গুটিকয়েক ফ্রেমের ছড়াছড়ি দেওয়ালটায়। সবগুলোতেই হৈমন্তীর হাসোজ্জল প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান। কিন্তু একটু আগেও তো এসব ছিল না। বড্ড ফাঁকা ছিল জায়গাটা। এতটুকু সময়ের ব্যবধানে কিভাবে এলো? হৈমন্তীর অবাক চাহনির ক্ষীণ গভীরতা বাড়লো। প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে আপন মনে বিড়বিড়ালো, “আমার এতগুলো ছবি কোত্থেকে এলো?”
পাশ হতে উত্তর এলো, “ম্যাজিক।”
হৈমন্তী হকচকালো। দ্রুত পাশ ফিরে তাকালো। তুষার মাত্র ঢুকেছে রুমে। হাতে খাবার ভর্তি প্লেট। কাছাকাছি আসতেই হৈমন্তী জিজ্ঞেস করলো,
—“আমার এতগুলো ছবি কোথায় পেলেন আপনি?”
তুষার প্লেটটা ছোট্ট টি-টেবিলে রাখলো। হৈমন্তীর দিকে চেয়ে এতক্ষণ পর ঠোঁটে অল্প হাসির রেখা টেনে জবাব দিলো,
—“বললাম না ম্যাজিক? বিছানায় বসুন। আমি চুল মুছে দেই।”
হৈমন্তী বিছানায় বসলো। চুল থেকে তোয়ালি নিয়ে নিজেই চুল মোছার প্রস্তুতি নিয়ে বললো,
—“আমি পারব মুছতে।”
তুষার শুনলো না। রুষ্ট চাহনি দ্বারা নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। হৈমন্তীকে কাছে টেনে স্বস্নেহে চুল মুছে দিতে লাগলো। দিরুক্তি করার সুযোগ, সাহস কোনোটাই আর পেল না হৈমন্তী। চুল মোছা শেষে তোয়ালে চেয়ারের ওপর ছুঁড়ে মারলো তুষার। হৈমন্তী ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“তোয়ালি চেয়ারে রাখলেন কেন? ভেঁজা তো! বারান্দায় দিয়ে আসি?”
তার একরোখা উত্তর, “লাগবে না।”
হৈমন্তী মুখ ফুলালো। রোষপূর্ণ নয়নে তুষারের মুখপানে চেয়ে রইল। তুষারের আচরণে মনে হচ্ছে, তুষার হৈমন্তীর চেয়ে কত বছরের বড়! শাসনের ওপর শাসনে রাখছে তাকে।
হঠাৎ এক লোকমা ভাত মুখে ঠেলে দিলো তুষার। তার সবচেয়ে অপছন্দের খাবার, মাংসের স্বাদ জিহ্বায় লাগতেই নাক-মুখ কুঁচকে ফেললো হৈমন্তী। তুষার ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“কি হয়েছে?”
হৈমন্তী অকপটে বললো,
—“মাংস খাবো না।”
—“তবে কি খাবেন?”
—“করলা দিয়ে ভাত।”
তুষারের কপালের ভাঁজ যেন আরও সুক্ষ্ণ হলো। তীক্ষ্ণ গলায় সে আবারও প্রশ্ন করলো,
—“করলা খাবেন? করলাও আবার খেতে ইচ্ছে করে নাকি?”
—“আমার করে। আমার প্রিয় খাবার।”
হৈমন্তীর কথা থামিয়ে আরও এক লোকমা খাবার খাইয়ে দিলো তুষার। আদেশের সুরে বললো,
—“আপনি করলা খেতে পারবেন না। এই করলা খাওয়ার কারণেই আমার সঙ্গে আপনার এমন তেঁত আচরণ।”
হৈমন্তী চোখ রাঙালো,
—“আমি কখন তেঁত আচরণ করেছি? সব আপনার বানোয়াট কথা। করলার মতো মাজাদার খাবার আর আছে?”
তুষার উত্তর দিলো না এবার। হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে বিস্তর হাসতে লাগলো। নিঃশব্দে, একাধারে।
_____
তুষার প্লেট রাখতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো হৈমন্তী। রাজ্যের ঘুম যেন বাতাসের বেগে ছুটে এসে তার আঁখিপল্লবে নিজের স্থান গড়ে তুলেছে। চোখ মেলে থাকা যেন দায় হয়ে উঠছে। হৈমন্তী অন্যপাশে ফিরে কাত হয়ে শুলো। বারান্দা গলিয়ে আসা তেজস্বী রোদের আলোও ভীষণ জ্বালাচ্ছে তাকে।
তীব্র আরামে চোখ বুজলো সে। নেত্রে ঘুম ভর করতেই হঠাৎ নিজের কোমড়ে আলতো স্পর্শ পেল। ভড়কালো। বিদ্যুৎপৃষ্টের ন্যায় কেঁপে উঠলো। কাঁধে উষ্ণ নিশ্বাসের আভাস পেতেই চোখ মেলল সে। তুষারকে আবিষ্কার করলো নিজের অতি নিকটে। বক্ষস্থল যেন সর্বোচ্চ গতিতে কেঁপে উঠলো আবারও। শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হলো। নেশাময় চাহনির কোমলতায় চোখাচোখি হতেই আড়ষ্ট ভঙ্গিতে চোখ খিঁচে বন্ধ করলো হৈমন্তী। পরপরই কানের কাছে তুষারের নিমগ্ন কণ্ঠের স্বর শুনতে পেল,
—“ভয় পাচ্ছেন হৈমন্তীকা? ভয় পাবেন না। আমি কিচ্ছু করবো না। শুধু একটু ঘুমাবো।”
বলে আরও কাছে এগিয়ে আসলো তুষার। কাঁধে নিজের কপাল ঠেকিয়ে অধর ছোয়ালো। আরেকটু নিবিড় হয়ে নিভৃতে বললো, “আপনি প্রাণনাশিনী হৈমন্তীকা। সর্ব বিধ্বংসী।”
কেটে গেল অনেকটা সময়। হৈমন্তীকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পরেছে তুষার। অথচ হৈমন্তীর চোখ তন্দ্রা বিহীন। সেই যে ঘুম উবে গেল আর ধরাই দিলো না।
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা