হৈমন্তীকা
৩১.
দু’টো মাসে নিজের হিংস্রতা দিয়ে অতিষ্ঠ করে দেওয়া নিষ্ঠুর, পাষাণ গ্রীষ্ম বিদায় নিয়েছে আজ প্রায় অনেকদিন। পৃথিবীতে আষাঢ় নেমেছে। নেমেছে বর্ষা। ঘন কালো মেঘের ভেলায় ঢেকে আছে বিশাল নভস্থল। এ সময় ফাঁকফোঁকর দিয়ে সোনালী রোদ্দুরের দেখা পাওয়া যে বড্ড কষ্টকর। বাজ পরছে। হুটহাট বৃষ্টিতে অপ্রস্তুত হচ্ছে মানুষ। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ কানে বাজছে। ব্যাঙেদের ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘ্যাঙরঘ্যাঙ, ঘ্যাঙরঘ্যাঙ। তুষার বাইক সাইড করে হৈমন্তীকে নিয়ে বাসস্টপের ছাউনিতে দাঁড়ালো। একহাতে নিজের ভেঁজা চুল ঝারতে লাগলো। পকেট থেকে মানিব্যাগ আর মোবাইল বের করে বললো, “এগুলো আপনার ব্যাগে রাখুন হৈমন্তীকা। পানিতে নষ্ট হয়ে যাবে।”
হৈমন্তী মাথা দুলালো। মানিব্যাগ আর মোবাইল রাখতে গিয়ে হঠাৎ-ই মানিব্যাগের ক্ষীণ ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট মেয়েলি ছবির অস্তিত্ব টের পেল। কৌতুহল বশত পুরো মানিব্যাগ খুললো সে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাসোজ্জল ছবি ভেসে উঠল আঁখিজোড়ার সামনে। হৈমন্তী একহাত গালে ঠেকিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে তাকিয়ে হাসছে। পরনে হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি।
তার মনে পরে গেল, নবীন বরণের দিন ঠিক এই শাড়িটি পরেই এভাবে অনমনা হয়ে বসে ছিল সে। মাঝে মাঝে পারুর কথায় হাসছিল। তারপর তো এ শাড়ি পরার আর সুযোগই পায় নি সে। তুষার কখন তার এ ছবি তুললো? হৈমন্তী বুঝলো না কেন?
হঠাৎ তুষারের গম্ভীর গলায় ঘোর কাটলো তার, “আমি আমার বউ ছাড়া ব্যক্তিগত জিনিস কাউকে ধরার অধিকার দেই নি, হৈমন্তীকা। ওগুলো ব্যাগে রাখুন।”
শুনে ভ্রু কুঁচকাল হৈমন্তী। ব্যাগের চেন আটকালো। বিমূঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
— “আমি আপনার বউ নই?”
— “হ্যাঁ। তবে পঞ্চাশ ভাগ। শতভাগ বউ করে নেই, তারপর এই আমিকেই দিয়ে দেবো আপনাকে।”
হৈমন্তী পিটপিট নয়নে এদিক-ওদিক তাকালো। নিশ্বাসের গতি অল্প কমলো। ইদানিং তুষার আশেপাশে থাকলে হৈমন্তীর লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতি অনুভূত হয়। উপরন্তু তুষারের এহেন কথায় লজ্জা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। নাকের দু’পাশ সামান্য কেঁপে উঠে। তুষার আপাদমস্তক দেখলো তাকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। আলতো করে নাক টেনে বললো,
— “মুখ তো লাল হয়ে টমেটো দেখাচ্ছে। এত লজ্জা কোথা থেকে পান হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী জবাব দেয় না। মনে ভয়াবহ জোড় লাগিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাফল শুণ্যই রয়ে যায়। তুষার দু’কদম এগিয়ে আসে। মাথার ঘোমটা-টি সাবধানে ফেলে দেয়। ওড়নার কোণাংশের বেশ খানিকটা হাতে পেঁচিয়ে স্বস্নেহে হৈমন্তীর কালো ঘন কেশ মুছে দিতে থাকে। হৈমন্তী নিশ্চুপ, চুপচাপ হতজানু হয়ে আছে। প্রখর অনুভূতিতে নিজেকে কেমন অনুভূতি শূণ্য মনে হচ্ছে। মৃদু, মৃদু কেঁপে উঠছে শরীর।
মাথায় আবারও ঘোমটা টেনে সরে এলো তুষার। পরনের ভেঁজা শার্ট-টা গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। কলারটা একটু টেনে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে সটান হয়ে দাঁড়ালো সে। অবিরাম বৃষ্টিধারার দিকে তাকিয়ে একমনে বলতে লাগলো,
— “বৃষ্টি বেড়ে যাক, আপনি থেকে যান আরেকটু সময়।”
_____
সন্ধ্যার দিকে নাওয়াজ আর তার পরিবার এলো আসরাফ সাহেবের বাসায়। সঙ্গে করে চার-পাঁচেক মিষ্টির প্যাকেট, ফল-মূল আর কেকও এনেছেন। হৈমন্তী জানতো না ওরা এসেছে। নিজ রুমে মনোযোগ সহকারে বই পড়ছিল সে। হঠাৎ রাবেয়ার আগমন ঘটলো সেখানে। কোনোরুপ কথা না বলে তিনি আলমারির কাছে এগোলেন। একে একে গোছানো কাপড়গুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন। সর্বশেষে তুষারের দেওয়া সেই নীল রঙা শাড়িটি হাতে নিয়ে হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে এলেন। চিন্তিত সুরে বললেন,
— “শাড়িটা পড়ে দ্রুত রেডি হয়ে নেয় হৈমন্তী। দেড়ি করিস না। উঠ!”
হৈমন্তী উঠে দাঁড়ালো। শাড়ি হাতে নিলো। প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “হঠাৎ রেডি কেন? কোথাও যাবে?”
— “হ্যাঁ।”
— “কিন্তু তাই বলে শাড়ি পড়তে হবে কেন? একটা কামিজ বের করে দাও।”
রাবেয়া চোখ রাঙালেন,
— “এত কথা বলিস কেন? এক কথায় হয় না? যা তাড়াতাড়ি রেডি হ!”
বলে চলে গেলেন রাবেয়া। হৈমন্তী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল মায়ের যাওয়ার পানে। অতঃপর বাধ্য মেয়ের মতো তৈরি হয়ে নিলো।
কিছুক্ষণ পর রাবেয়া আবার এলেন। মেয়ের অল্প সাজসজ্জা দেখে রেগে গেলেও পরক্ষণে কি ভেবে মন গলে গেল উনার। এগিয়ে এসে হৈমন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পরম মমতাময় কণ্ঠে বললেন,
— “আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে! মাশাল্লাহ।”
তারপর একটু থেমে হেমন্তকে বললেন,
— “রুম থেকে বের হবি না। চুপচাপ পড়ালেখা কর।”
মায়ের ব্যবহার কেমন অস্বাভাবিক ঠেকলো হৈমন্তীর কাছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারলো না সে। তার কিছু মুহুর্ত পর ড্রইংরুমে পা রাখতেই সবকিছু ঠাওর হলো মস্তিষ্কে। শরীর অবশ হয়ে গেল। নাওয়াজের পরিবার দেখতে এসেছে তাকে। আসরাফ সাহেব কি দারুণ প্রফুল্লতার সঙ্গে নাওয়াজের বাবার সঙ্গে কথা বলছেন! হাসি যেন সরতেই চাইছে না ঠোঁট হতে। হৈমন্তীর গলা শুকিয়ে গেল। পা এগাতে চাইলো না। রাবেয়া জোড় করে টেনে নিয়ে গেলেন তাকে। নাওয়াজের সামনা-সামনি বসানোর পূর্বে মৃদু স্বরে কানে ফিসফিসিয়ে বললেন, “উলটাপালটা কিছু করবি না হৈমন্তী। তোর বাবার এই হাসিটা আবারও হারাতে দিস না।”
এই এইটুকু বাক্যে আর কোনো মতবাদ প্রকাশের ইচ্ছেটুকু তৎক্ষণাৎ মিইয়ে গেল হৈমন্তীর। সে চুপচাপ সব হজম করে নিলো। নাওয়াজ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ণ হাসি লেগে আছে। বড়দের আলোচনায় একবারও চোখ তুলে তাকালো না হৈমন্তী। তুষারের দেওয়া শাড়ি পরে যেখানে তার তুষারের সঙ্গে থাকার কথা ছিল, সেখানে নাওয়াজের দেওয়া আংটি অনামিকা আঙুলে পরিধান করতে হলো তাকে। সে সময়টা ছিল হৈমন্তীর জন্য সবচেয়ে করুণ, মর্মান্তিক মুহুর্ত। নেত্রকোণে জমা হয়েছিল ক্ষীণ বিন্দু কণার জল।
আংটি পড়ানো শেষে নাওয়াজ আর হৈমন্তীকে আলাদা কথা বলতে পাঠানো হয় তার রুমের বারান্দায়। হৈমন্তী কথা বলছে না। নাওয়াজ বরাবরই নিষ্পলক চেয়ে আছে তার মুখপানে। অস্বস্থিতে, ঘৃণায় আর রাগে শক্ত হয়ে আছে হৈমন্তী। নাওয়াজ কিছু বলছে না দেখে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠে,
— “আপনি এমন কেন করেছেন, নাওয়াজ ভাইয়া?”
নাওয়াজ যেন বুঝলো না,
— “কি করেছি?”
হৈমন্তী অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো,
— “কি করেছেন জানেন না? আপনাকে বলেছিলাম আমার আর তুষারের বিয়ে হয়ে গেছে। তবুও কোন মনমানসিকতায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন আপনি?”
নাওয়াজ অবুজ চোখে তাকালো। হেসে বললো, “তুমি মিথ্যা বলছো। এমন কখনোই হতে পারে না। দেখ হৈমন্তী, আমি জানি তুমি আমাকে তেমন পছন্দ করো না। তাই বলে যে একদম অপছন্দ করো তা কিন্তু না। একটু বোঝার চেষ্টা করো আমাকে। আমি তোমাকে সুখে রাখবো।”
হৈমন্তীর অধৈর্য গলা,
— “আপনি কি বাংলা কথা বুঝেন না? কোনো কালেই আপনাকে পছন্দ নয় আমার। বিরক্তিকর লাগে আপনাকে। আমি শুধু তুষারকে ভালোবাসি। আর ওর সাথে আমার আইনত বিয়েও হয়েছে।”
নাওয়াজের মুখশ্রী করুণতায় ভরে গেল। হাসার চেষ্টা করে বললো,
— “আমি বিশ্বাস করি না। তুমি মিথ্যে বলছো।”
— “আপনাকে মিথ্যে বলে আমার কি লাভ? তবুও আপনার বিশ্বাস না হলে আপনাকে রেজেস্ট্রি পেপারের ছবি দেখাতে পারি। দেখতে চান?”
নাওয়াজের চোয়াল শক্ত। চোখে জলের স্বতঃস্ফূর্ত আভাস। কাঁপা স্বরে সে বললো,
— “তুমি সত্যিই তৈমুরকে ভালোবাসো?”
— “হ্যাঁ।”
— “আঙ্কেলকে কিছু জানিয়েছ এ ব্যাপারে? আঙ্কেলকে কিভাবে মানাবে?”
হৈমন্তীর কঠিন গলার উত্তর,
— “তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু বিয়েটা ভেঙ্গে দিন। আমি উপকৃত হবো।”
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলল নাওয়াজ। নিদারুণ কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে উঠলো,
— “আমার ভালোবাসা একপাক্ষিক রয়ে গেল, হৈমন্তী। আমি তোমায় আমার করে পেলাম না।”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
হৈমন্তীকা
৩২.
বাতাসের এলোমেলো ঝাপটায় ঘুমন্ত তুষারের ঝাঁকড়া চুলগুলো বিরতিহীন ভাবে উড়ছে। স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। নবজাত শিশুর ন্যায় আদুরে ভঙ্গিতে ঠোঁট হালকা উঁচিয়ে রেখেছে সে। হৈমন্তী দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। কোলে থাকা তুষারের মাথাটা সাবধানে নামিয়ে দিতে চাইলো সে। কিন্তু ব্যর্থ হলো। তুষার কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে পরেছে। আরেকটু নিবিড় হয়েছে হৈমন্তীর সঙ্গে। হাতের বাঁধনও আগের চেয়ে শক্ত, সূগভীর। হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাল ছেড়ে দেয়। একপাশে পরে থাকা কর্মহীন হাতটা উঠিয়ে তুষারের ঝাঁকড়া চুলের ভাঁজে নিয়ে যায়। কিছু পলক মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রয় সুদর্শন মুখপানে। হাত বাড়ায়। ঘন পাঁপড়ি গুচ্ছ ছুঁয়ে দেয় আনমনে। ভাবে, তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। যেন ভাঁজা মাছটাও উলটে খেতে পারে না। অথচ কে বলবে, এই ছেলেটাই একটু আগে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিল। মাঝরাতে কোত্থেকে বারান্দায় এসে চমকে দিয়েছিল হৈমন্তীকে। হৈমন্তী ভড়কানো গলায় প্রশ্ন করেছিল, “আপনি এত রাতে এখানে কি করছেন তুষার?”
ওপাশ থেকে তার ক্রোধে ভরা উত্তর ছিল, “আপনাকে নাকি নাওয়াজের পরিবার দেখতে এসেছিল? আংটি পরিয়েছে? দেখি! হাত বাড়ান।”
হতভম্ব হৈমন্তী আকস্মিক প্রশ্নের রেশ ধরতে পারলো না। বিমূঢ়, বিহ্বল, বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো তুষারের মুখশ্রীর দিকে। জবাব না পেয়ে রাগ যেন ক্ষীণ বাড়লো তার। নিজেই হাত টেনে নিলো। ডান হাতের অনামিকা আঙুলে সোনার আংটিটি নজরে আসতেই ধমকের সুরে বললো,
— “আংটি এখনো খুলেন নি কেন? নাকি বিয়েতে রাজী আছেন আপনি?”
হৈমন্তী থতমত গলায় বললো,
— “ম—মনে ছিল না। এক্ষুণি খুলতাম।”
তুষার প্রতুত্তর হীন এবার। একপলক হৈমন্তীর পানে চাইলো মাত্র। হৈমন্তীর বক্ষস্থল ভারি হয়ে উঠল। তুষারের চোখের সাদা অংশ লাল শিরা-উপশিরায় ভর্তি। নাক, ঠোঁট, গাল, কান কেমন ভয়ংকর রক্তিম লাল। অগোছালো চুলে অস্বাভাবিক লাগছে তাকে। আঙুল থেকে আংটিটা বের করতে করতে তুষারের গম্ভীর গলা শোনা গেল,
— “বিয়ে করেও শান্তি নেই। বউ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। আপনাকে আমি কোথায় রেখে শান্তি পাবো হৈমন্তীকা? বুকের ভেতরটায় থাকতে পারবেন না আপনি?”
বলতে বলতে আংটিটা ছুঁড়ে মারলো বারান্দার বাহিরে। হৈমন্তী আঁতকে উঠলো। বড় বড় চোখে তাকালো। কঠর গলায় কিছু বলবে, তার পূর্বেই তাকে বারান্দার মেঝেতে বসিয়ে দিলো তুষার। নিজে শুলো হৈমন্তীর কোলে মাথা রেখে। চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
— “ঘুমাবো হৈমন্তীকা। বিরক্ত করবেন না।”
তুষারের ক্লান্ত মুখমণ্ডল দেখে হৈমন্তীর মনও সায় দিলো না কিছু বলতে। সে চেয়ে রইলো, বসে রইলো, নির্ঘুম রাত্রির নিশাচর হয়ে।
_____
নিকষকৃষ্ণ আঁধার ডিঙ্গিয়ে পূর্ব দিক থেকে জেগে উঠছে সূর্য। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে তীব্র মাত্রায়। আঁখিপল্লবে তেজি কিরণের ছোঁয়া লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল হৈমন্তীর। পিটপিট দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো সে। চোখ কচলাল। উদরে ভারি কিছুর অস্তিত্ব টের পেতেই সেদিকে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে তুষারের গভীর তন্দ্রায় লেপ্টে থাকা মুখখানি ভেসে উঠল সামনে। হৈমন্তী আনমনে মুচকি হাসলো। কপালের মসৃণ চুলগুলো আলতো করে স্পর্শ করলো। নড়েচড়ে উঠল তুষার। ঘুমে কাতর চোখ জোড়া মেলে প্রথমেই তাকালো হৈমন্তীর দিকে। ঢিমে যাওয়া স্বরে শুধালো, “শুভ সকাল হৈমন্তীকা।”
ঠোঁটের হাসিটুকু আরেকটু বাড়ালো হৈমন্তী, “শুভ সকাল।”
হৈমন্তীর উত্তর শুনে আবারও চোখ বুজে নিলো তুষার। ছোট্ট একটা হামি দিলো। বলা যায়, আবারও ঘুমানোর পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে সে। হৈমন্তী হকচকালো, ভড়কালো। রুমে উঁকি দিতেই দেখল, ঘড়িতে পাঁচটা বেজে বাইশ মিনিট।
তুষারের বুকে আলতো ধাক্কা দিলো সে। তাড়া দিয়ে বললো,
— “ঘুমাচ্ছেন কেন তুষার? উঠুন। উঠছেন না কেন?”
তুষার জবাব দিলো না। শুনলোই না যেন। হৈমন্তী আবারও বললো,
— “পাঁচটা বাজছে তুষার। একটু পর মা,বাবা জেগে যাবেন। কেন এমন করছেন? উঠুন না!”
তুষার চোখ মেলল। রোষপূর্ণ চাহনিতে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললো,
— “আমার শান্তি কি আপনার সহ্য হয় না হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তীর চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “বাজে বকছেন কেন? উঠুন জলদি।”
একঝাঁক অনিচ্ছা নিয়ে উঠে বসলো তুষার। হৈমন্তীর ওড়না দিয়ে নিজের তৈলাক্ত মুখশ্রী মুছলো। কিছুসময় নির্নিমেষ, নিভৃতে চেয়ে রইলো হৈমন্তীর দিকে। হিম শীতল কণ্ঠে বললো,
— “আপনি দিন দিন সুন্দর হয়ে উঠছেন হৈমন্তীকা। আমার ঘুম হারাম করে দিচ্ছেন।”
এটুকু বলে আর বসলো না তুষার। তৎক্ষণাৎ উঠে বারান্দা বেয়ে নিচে নেমে গেল। হৈমন্তী রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। নিষ্পলক দেখতে লাগল কৌশলে নিচে নেমে যাওয়া তুষারকে।
_____
দিন গড়ালো। আকাশে নেমে এলো অন্ধকার। রাবেয়া রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে উঁচু গলায় হাঁক ছেড়ে উঠলেন,
— “হেমন্ত? বাপ দেখ তো কে এসেছে।”
হেমন্ত সোফায় বসে আলু ভাঁজা খাচ্ছিলো। মায়ের কথায় প্লেট-টা সোফায় রাখলো। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই গম্ভীর মুখো আসরাফ সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। হেমন্ত দৌঁড়ে চলে গেল আবার। জুতো খুলে ভেতরে ঢুকলেন আসরাফ সাহেব। মনে মনে প্রচন্ড রাগে ফুঁসছেন তিনি। কোনোমতে ড্রইংরুমে এসে জোড়ে জোড়ে চেঁচিয়ে হৈমন্তীকে ডাকলেন।
হৈমন্তী বিছানা গুছাচ্ছিল। বাবার এহেন ডাকে ভড়কে গেল সে। ভয় পেল। দ্রুত ওড়না মাথায় টেনে ড্রইংরুমের দিকে এগোলো। ততক্ষণে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে রাবেয়াও চলে এসেছেন সেখানে। হৈমন্তী বাবার দিকে ভীতু নয়নে চেয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে বাবা?”
তিনি ক্ষিপ্ত চোখে হৈমন্তীর হাতের দিকে তাকালেন। ধমকের সুরে বললেন,
— “তোর হাতের আংটি কোথায়?”
ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল হৈমন্তীর। দৃষ্টি এলোমেলো হলো। কণ্ঠ কাঁপতে লাগলো। কি জবাব দেবে হৈমন্তী? কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোড়ালো গলায় মিথ্যে বললো সে,
— “খুলে রেখে দিয়েছি বাবা।”
— “কেন খুলে রেখেছিস? বিয়েটাকে কি ছেলেখেলা মনে হচ্ছে তোর? ইয়ারকি মনে হচ্ছে? নাওয়াজকে কি বলেছিস তুই? বিয়ে ভেঙ্গে দিতে? আর কত অসম্মান করবি আমার? একটু শান্তি দেয় আমাকে! একটু শান্তি দেয়!”
আসরাফ সাহেব থামলেন। বাবার সঙ্গে চোখে চোখ মেলানোর সাহস পেল না হৈমন্তী। স্বচ্ছ আঁখির কোটর হতে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরল মেঝেতে। থেকে থেকে শরীর কেঁপে উঠল। একটু পরেই হয়তো হিচকি সমেত কান্না উঠবে।
আসরাফ সাহেব রাবেয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। নিদারুণ কঠিন গলায় বললেন,
— “তোমার এই আত্মসম্মানহীন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেও বাঁধছে আমার। ওকে বলে দাও, ওই ছেলেকে যেন ফোন করে বলে বাসায় আসতে। এর একটা বিবিধ আমি করেই ছাড়বো। কি পেয়েছে ওই বাপ-ছেলে? আমাকে প্রতিনিয়ত ফোন করে অপমান করবে আর আমি চুপ থাকবো?”
__________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা