হেথায় সেথায় সর্বত্রই রিক্ত (পর্ব:-৩)

0
612

গল্প:- #হেথায়_সেথায়_সর্বত্রই_রিক্ত (পর্ব:-৩)
লেখা:-
মোঃ শাহরিয়ার ইফতেখায়রুল হক সরকার।

মাঝখানে আমি পড়ে গেলাম, অপ্রীতিকর অবস্থায়। আপনার বাবা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একমাত্র ছেলে ইমন অর্থাৎ অনিন্দিতার এক্স বয়ফ্রেন্ডকে কেনো খুন করালো সেটা ওনার নিজের মুখ থেকে জানা হলো না।

অনিন্দিতার ভাই চমকে উঠলো। মুখে আর কোনো কথা ফুটছে না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পা দুটো তার একটু একটু কাঁপছে। এতো কিছু হবে মোটেও আশা করেনি সে। হতভম্ব হয়ে অনিন্দিতা এহসানুল সরকারকে বলল,
– আপনি ভুল বলছেন। আমি কিছু বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। আমি জাস্ট আর কিছু নিতে পারছি না।আমার বাবাকে সেরু ভাই নামক লোকটা কেনো খু*ন করলো সেটাই তো এখন পর্যন্ত জানতে পারলাম না। এরপর আপনি বলছেন, ভাইয়ারও আজ বাবাকে খু*ন করার কথা ছিল কিন্তু কেনো? আর সবশেষে বললেন, ইমনের মৃ*ত্যু*র পিছনেও আমার বাবা জড়িত! কি এসব! কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

এহসানুল সরকার প্রত্যুত্তরে বলল,
– সেরু ভাই হলো একজন খুনি। জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া একজন আসামি। যার গল্প শুরু হয় প্রায়ই দু’বছর আগে। নিখুঁত ভাবে খু*ন, কালো রঙের খাম দিয়ে কাউকে সতর্ক করা, কারো খু*ন হওয়ার কারণ লেখা, সুন্দর হ্যান্ড রাইটিং, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা সবকিছুই দুর্দান্ত।

এমনকি ওর ফাঁসির রায়ও বের হয়ে গেছিল। ফাঁসির দিন আমি ওখানে উপস্থিত ছিলাম না। সেটাই আমার জীবনে এই পর্যন্ত করা সবচেয়ে বড় একটা ভুল। ওই দিন ওর ফাঁসিটা হয়নি। সবকিছু যেন নাটকীয় ছিল। আগে থেকে করা সাজানো-গোছানো পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, মহাচক্রান্ত ছিল। সে অনেক কাহিনি। আমার আগের কেসটাতেও ও আচমকা এসে এভাবেই হস্তক্ষেপ করেছিল। দেখা পেয়েছিলাম প্রায় দু’বছর পর। শেষে দিনাজপুর থেকে গ্রেফতারও হয়েছিল কিন্তু সেই পূর্বের ন্যায়েই যেন জেল থেকে বের হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত ওর হাতে খু*ন হওয়া কেউই নিরপরাধ ছিল না। তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো অন্যায়, অনাচার, অপরাধ করেছিল বা সেই সবের সাথে যুক্ত ছিল। ও কখন কোথায় কিভাবে কার সাথে জড়িয়ে পরবে সেটা কেউ জানে না। সে নিজেও বোধ হয় জানে না। আপনার বাবার কিছু অবৈধ ব্যবসা আছে। যেই ব্যবসা শুরু করেছিলেন একজনের প্রাণ কেড়ে। শেষও একজনের প্রাণ কেড়েই করতে চাইছিলেন। কিন্তু হলো না। তাছাড়া বিভিন্ন খারাপ চক্রের সাথে জড়িত তো আছেনই।

অনিন্দিতা বলল,
– আমি কিছু মানতে পারছি না। সহ্যও করতে পারছি না। আমার বাবা কিসের অবৈধ ব্যবসা করতো? সেই ব্যবস্যা কাকে খুন করে শুরু করেছিল আর কাকেই বা খুন করে শেষ করতে চাইছিল?

– কিছু সত্য মেনে নিতে হবে আর কিছু জিনিস না চাইলেও সহ্য করতে হবে। আপনার বাবার অবৈধ ব্যবসার কোনো অভাব নেই। তবে উনি কাকে খু*ন করে শুরু করেছিল আর কাকেই বা খু*ন করে শেষ করতে চেয়েছিল সেটা আমার অজনা। তাছাড়া আপনার বাবা কেনো আপনার এক্স বয়ফ্রেন্ড ইমনকে খু*ন করিয়েছে সেটাও আমার অজনা। তবে আরেকটা কথা জেনে নিতে পারেন, আজ থেকে অনেক বছর আগে আপনার মামার গুম হওয়ার বিষয়ে। গুম হওয়ার ৮দিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। তাকে খু*ন করা হয়। সেটাতো জানেনই। কিন্তু সেই খু*নের পিছনে কে আছে তা আজও আপনারা কেউ জানেন না। আপনার মামার খু*ন হওয়ার একটাই কারণ ছিল, ওনার দোষ ছিল, উনি আপনার বাবাকে পরনারীর সাথে অ*ন্ত*র*ঙ্গ মুহূর্তে দেখে ফেলে ছিলেন। আশা করছি বুঝতে পারছেন, আপনার বাবা এতোটাও ভালো মানুষ ছিলেন না।

অনিন্দিতা স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছু বলার মতো মুখে কোনো শব্দই তৈরি হচ্ছে না এখন। তবুও আমতা-আমতা করে কোনো মতে বলে ফেললো,
– আর ভাইয়া কেনো তাহলে বাবাকে খু*ন করতে চাইলো?

– জানিনা।এটা সহ আরও অনেক বিষয়ই এখনো ক্লিয়ার হয়নি।তবে শীঘ্রই সবকিছু ঝাপসা থেকে পরিষ্কার হবে। আপনার ভাই আর ভাবীকে জিজ্ঞাসা করলেই সব জানা যাবে। আপনার ভাইতো এখন মুখে কুলু এঁটেছে। চুপ করে আছে। কিছুই বলছে না। অবশ্য এখন আর কিছু বলবেনও না বোধ হয়। ওসি সাহেব একে গাড়িতে তুলুন । সাথে ওনার স্ত্রী’কেও থানায় নিয়ে গিয়ে যেমনই হোক কথা বের করুন।

ঠিক সেই মুহূর্তে অনিন্দিতার ভাবী বাসার ভেতর থেকে বাইরে আসতে আসতে বললেন,
– গাড়িতে তুলুন মানে? আমরা কেনো থানায় যাবো?

এহসানুল সরকার গম্ভীর ভাবে জবাব দিলো,
– সেটা থানায় গেলেই বুঝবেন৷ আপনাদেরকে থানায় কেনো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটাও আপনারা ভালোই জানেন। এতো অভিনয়ের কোনো দরকার নেই। দুপুর ১২টা পর্যন্ত আপনাদের স্বামী-স্ত্রীকে কোনো রকম টর্চার করা হবেনা। সে পর্যন্ত সময় দেওয়া হলো, সবকিছু স্বীকার করে নেওয়ার।

কথাগুলো বলার পরপরই থামলো এহসানুল সরকার। একটু নিরব ভূমিকা পালন করে কি যেন ভাবতে লাগলেন তিনি।অনিন্দিতার ভাবীকে আর কিছু বলতে দিলো না কনস্টেবল। ওসির নির্দেশে তাদের উভয়কেই গাড়িতে তোলা হলো। যার একটু পরই অনিন্দিতার বাবার লাশ মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এহসানুল সরকার এখনো নিরব। নিরব হয়ে কি ভাবছে কে জানে। অনিন্দিতা তো কথাবলারই উৎস খুঁজে পাচ্ছে না। কোনোকিছুর হিসেবও মিলাতে পারছে না। অতঃপর এহসানুল সরকার বলে উঠলো,

– আচ্ছা, এতো কিছু হয়ে গেল আপনার মা’কে তো দেখতে পেলাম না। আমার তো খেয়ালই ছিল না।

অনিন্দিতা সাথে সাথে জবাব দিলো,
– মা সেন্সলেস হয়ে গেছিল। ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এহসানুল সরকার আর কিছু না বলে কাকে যেন কল করে ৫’মিনিট কথা বলে। তারপর অনিন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,
– রাত ৪টা বেজে ৮মিনিট। সকাল হতেই বা আর কতক্ষণ। আমি দুপুর ১২টার পরে আপনাদের বাসায় আসবো। বাকি সব কথা তখন হবে। আপনি নিজেকে একটু শান্ত করে এখন বাসার ভেতর চলে যান। আপনার মায়ের কাছে যান। তাছাড়া আপনার ছেলেও তো রুমে একা!

অনিন্দিতা আর কিছু বলল না। তার কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না। চোখের জল মুছে বাসার ভেতরে চলে গেল। এহসানুল সরকারও, সকল সকাল থানায় আসবে ওসিকে কথাটা বলেই তাড়াহুড়ো করে নিজ গাড়ি করে চলে গেল।

দুপুর ২’টা বাজতে আর দু’মিনিট বাকি।
এহসানুল সরকার মাত্রই অনিন্দিতাদের বাড়ি এসে পৌঁছিল। অনিন্দিতার মায়ের করুণ অবস্থা। অনিন্দিতার থেকে সবকিছু শুনেছেন তিনি। কোনো কিছু মেনে নিতে পারছেন না। মানতে কষ্ট হচ্ছে। যে কষ্ট অনেক তীব্র। এহসানুল সরকার সান্ত্বনা প্রকাশ করে অনিন্দিতার মা’কে উদ্দেশ্য করে বলে,
– আপনার ছেলে ও তার স্ত্রী সবকিছু স্বীকার করে নিয়েছে। তারা জানিয়েছে, সম্পত্তির লোভে এমন কিছু করার চিন্তাভাবনা করেছিল। অনিন্দিতাকে তার অংশ থেকে বঞ্চিত করাই তাদের মূল লক্ষ ছিল। তাই প্রথমে গয়না চুরি ও বিক্রি করার মিথ্যা অভিযোগ লাগিয়ে অনিন্দিতাকে সবার সামনে চোর ও ছোট করার চেষ্টা করলো। তারপর বিভিন্ন ভাবে বাবার কান ভাঙাতে লাগলো কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছিল না দেখে শেষ-মেষ কিছুটা স্ত্রীর প্ররোচনায় নিজ বাবাকে হ*ত্যা*র পরিকল্পনা করে। কোনোমতে ওনাকে বাসার বাইরে নিয়ে আসে। এরপর প্লান অনুযায়ী ওনাকে বাসার সামনে থেকে তিন জনের একটা গ্রুপের কিডন্যাপ করার কথা ছিল। তারপর ভয়ভীতি দেখিয়ে সবকিছু লিখে নেওয়ার পর খু*ন।

এখন আসছি মেইন পয়েন্টে,
অনিন্দিতার বাবা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলে ইমন অর্থাৎ অনিন্দিতার এক্স বয়ফ্রেন্ডকে খু*ন করার জন্য যাদেরকে কন্ট্রাক্ট দিয়েছিল, তাদেরকেই অনিন্দিতার ভাইও নিজের বাবাকে কিডন্যাপ করার পর সম্পত্তির একটা কাগজে সাইন করিয়ে খু*ন করার কন্ট্রাক্ট করেছিল।

কুখ্যাত কন্ট্রাক্ট কিলার। মাত্র তিন জনের একটা গ্রুপ। এমন কোনো কাজ নেই যে তারা করে না। তাদের সাথে দেখা করার কোনো সুযোগ নেই। একে অপরের মুখোমুখির তো প্রশ্নই আসে না। এক কথায় তারাও আপনাকে কখনো দেখবে না, দেখতে চাইবেও না, আপনিও তাদের কখনো দেখতে পারবেন না। এমনই ভাবে তাদের কাজকর্ম চলে আসছিল। যেহেতু দু’টো কন্ট্রাক্ট একই দিনে ছিল। তাই একই দিনেই তারা দু’টো কাজ একসাথে শেষ করতে চেয়েছিল। ইমনকে খু*ন করার পরই অনিন্দিতার বাবাকে কিডন্যাপ করার কথাছিল তাদের। কিন্তু দূরভাগ্যবশত তারা আমার কবলে পরে যায়। নিজ বাড়িতেই ইমনকে খু*ন করার পর চলে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে। অনিন্দিতার বয়ফ্রেন্ড আছে জেনে অতো রাতেই আমি ইমনদের বাড়ি গিয়েছিলাম কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্যে। অনিন্দিতা যদি আগে থেকে আমাকে জানাতো তার আগে একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল। তাহলে আমাকে নির্ঘুমে রাত-বিরেতে এতোটাও ছুটাছুটিও বোধ হয় করতে হতো না। অনেক আগেই অনেক কিছু জেনে যেতাম।

গতকাল রাত ২টার সময় অনিন্দিতাকে ফোন করে ইমনের ব্যাপারে বেশ কিছু কথা বলার পর সাথে সাথে কল কেটে দিয়েছিলাম। সবকিছুর পরেও কেনো যেন আমি সংকোচ মুক্ত না হতে পেরে ৫মিনিট পর আবার কল করে অনিন্দিতাকে বলেছিলাম, তার বাবার প্রাণ সংশয়ে আছে। দু’জনের মধ্যে একজন অন্তত বেঁচে থাকলে, না জানা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতাম। অনেক রহস্যের সমাধান পেতাম।

এতক্ষণ যাবৎ চুপচাপ এহসানুল সরকারের কথাগুলো শুনছিল অনিন্দিতা ও তার মা।
অনিন্দিতা বলল,
– আমি ওর মতো একজন বেইমান, প্রতারকের কথা আপনাকে জানাতে চাইনি। তাই বারবার বলতে চেয়েও সেদিন বলতে পারিনি। ও একজন ঠক। ভালোবাসার নামে আমাকে ঠকিয়েছে।

– ইমনের সারা ডায়েরি জুড়েও এমনই কিছু লেখা ছিল। লেখাটা তার নিজের হাতের লেখাই। কে কাকে ঠকিয়েছে সেটা আমি এখন জানি না। জানতেও তেমন একটা সময় লাগবে না। আমি আপনাকে সেদিন রেস্টুরেন্টে বারবার বলেছিলাম, আমাদের মধ্যকার কথাবার্তা যেন আর কেউ না জানে কিন্তু আমি শিওর আপনিই সেগুলো পাঁচকান করেছেন।

– আমি শুধু আমার পরিবারের সবাইকে জানিয়ে ছিলাম। সবাই অনেক বাজে কথা, কটুকথা শোনাচ্ছিল তাই সহ্য করতে না পেরে রাগের বশে বলে দিয়েছিলাম।

– ভুল করেছেন। আপনার পরিবার থেকেই সেটা আরও পাঁচকান হয়েছে। তাৎক্ষণিক তার কান অবধিও চলে যায়। যেটা আমি ঘুণাক্ষরেও চাইনি। জানিনা সেরু ভাই এরপর কোথায় কখন কী কী করবে। মাসের পর মাস তারপর বছর ওর পিছে হায়নার মতো পড়ে আছি। ওকে গ্রেফতার করার আরও একটা সুযোগ পাওয়া গেল। এখন আসছি ইমতিয়াজের ব্যাপারটায়। ইমতিয়াজের কেসটা তিন মাস পর এমনি এমনি বন্ধ হয়ে যায়নি। যথেষ্ট টাকা খাইয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যার পিছনে আছে আপনার এক্স বয়ফ্রেন্ড ইমন। তাছাড়া ইমতিয়াজ মা*রা যাওয়ার ১৩ঘন্টা আগে নিজের মায়ের হাতে বানানো ঠান্ডা শরবত খেয়েছিল। শরবতেই ওই বিষটা মেশানো ছিল।

এহসানুল সরকারকে আর কিছু বলতে না দিয়ে অনিন্দিতা সঙ্গে সঙ্গে বলল,
– তারমানে ইমতিয়াজের মা-ই ইমতিয়াজকে…….!

– না।

– তাহলে?

– আপনার বাবার অবৈধ কিছু ব্যবসার মধ্যে একটা হলো, ফার্মেসি। যতসব অবৈধ ওষুধের কারসাজি। সেই ফার্মেসিতেই ইমতিয়াজের মৃত্যু যে বিষের জন্য হয়েছে তার একটা সিসি পাওয়া গেছে।

– তারমানে আপনি বলতে চাইছেন ইমতিয়াজের মৃত্যুর পিছনে আমার বাবা আছে?

– এখনো সঠিক জানিনা। তবে এটা শিওর ভাবে বলছি, আপনার আর ইমতিয়াজের ডিভোর্সই হয়নি। আপনারা আইন অনুযায়ী এখনো স্বামী-স্ত্রী।

#চলবে____________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here