#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৩২
#জান্নাতুল_নাঈমা
____________________
সকাল থেকে চিল্লাতে চিল্লাতে গলা বসে গেছে সায়রীর। মুসকানের আটমাস চলছে। বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। দু’দিন আগে ডক্টর দেখানোও হয়েছে। রিপোর্ট কি এসেছে জানেনা সায়রী তবে ভালো কিছু না তা বেশ বুঝতে পেরেছে। গতকাল রাতে ইমন আবার কল করে জানিয়েছে আজ দুপুরে তাদের বাড়িতে ছোটখাটো আয়োজন করা হবে। মুসকান আবদার করেছে এই আয়োজন করার। আবার শর্তও দিয়েছে রান্নাবান্না সব ছেলেদের করতে হবে। ইমন একাহাতে সব পারবেনা বলেই দিহান আর মুরাদকে তার ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু দিহান ঘুম থেকে ওঠতে দেরি করেছে৷ এদিকে একবার মুরাদ আরেকবার ইমন ফোন দিতে দিতে সায়রীর ফোন এবং কান দু’টোই উত্তপ্ত করে ফেলেছে। খাবার রেডি করে দিহান’কে বারকয়েক ডেকে ছেলে’কে খিচুরি খাওয়ানোতে মনোযোগ দিলো সায়রী। ছেলে রিহান দু’বার খিচুরি মুখে নিলেও তৃতীয় বার নিতে অনিহা প্রকাশ করলো। সায়রী আহ্লাদ করে ছেলে’কে বুঝিয়ে জোর পূর্বক খিচুরি মুখে দিলে রিহান উগ্রে ফেলে দিলো। মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হলো সায়রীর। গতকালই ইমন ফোন করে কড়াভাবে জানিয়েছে সকাল সকাল যেনো তাদের বাড়ি চলে যায়। অথচ দশটা বেজে গেলো এখন অবদি তাদের সকালের খাবারই খাওয়া হলো না৷ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে রিহানের পিঠে মৃদু কিল বসিয়ে সোফায় বসালো। রিহান ঠোঁট ফুলিয়ে বা,বা বলে কাঁদতে শুরু করলো। দিহান গোসল সেরে পুরো রেডি হয়েই খাবার ঘরে এলো। এসেই সায়রী’কে ফোঁস ফোঁস করতে দেখে এবং রিহানকে কাঁদতে দেখে বিরবির করে বললো,
“এই মহিলার মেজাজ সব সময় চারশো ডিগ্রি হয়ে থাকে কেন? ”
রিহানকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে ডায়নিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসলো দিহান। সায়রী’কে বললো,
“বার বার বলছি খাওয়ানোর সময় ওকে মারবানা কথা কি কানে যায় না? ”
সায়রী আরেক লোকমা খিচুড়ি রিহানকে সাধলে সে বাবার দিকে গুটিশুটি হয়ে বসে রইলো। চোখ কটমট করে খিচুড়ির প্লেট ঠাশ করে টেবিলে রেখে সায়রী বললো,
“তোর ছেলেকে তুই খাওয়া আমি চললাম। ”
“এই না ঐ না সায়ু জান প্লিজ এতোবড়ো শাস্তি দিওনা। ”
সায়রী তেলেবেগুনে জ্বলতে জ্বলতে নিজ রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। বের হলো এলদম রেডি হয়ে। বেরিয়েই দেখতে পেলো রিহানের সম্মুখে ফোন রেখে ডি.জে গান বাজাচ্ছে। রিহান একধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে আছে আর দিহান ওর মুখে খিচুড়ি ঢোকাচ্ছে। ছেলেও দিব্যি ফোনের নেশায় খাবার গিলছে। কপাল চাপড়ে সায়রী এগিয়ে গিয়ে রিহানের থেকে ফোন কেড়ে নিলো। অমনি রিহান ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। সায়রী ধমকে বললো,
“চুপপপ!” রিহান তবুও থামলো না। সায়রী এই অবুঝ শিশুকে আর কিছু না বলে বোঝ শিশুর কলার চেপে ধরলো। চিৎকার করে বললো,
” এই শিক্ষা দিচ্ছিস ছেলেকে? আমার ছেলেকে তুই তোর মতো বানাতে চাচ্ছিস? ”
“ঐ তুই তুই করবি না হাজব্যান্ড আমি তোর সম্মান দিবি। ”
“শালা রাখ তোর সম্মান বাপ হওয়ার এতো শখ এগুলা কি বাপের কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে? ”
“আরে তুই বুঝোস না ক্যান ও যেভাবে খেতে চায় সেভাবেই খাওয়াইতাছি। ”
কলার ছেড়ে চেয়ার টেনে বসলো সায়রী। রিহানকে কোলে বসিয়ে নিজে খাওয়ানোর চেষ্টা করলো আর বললো,
“ভালো কিছু দেখাতি একটা কার্টুন বের করতি। কোরানতেলাওয়াত শোনাতি এসব কি? ”
দিহান মাথা চুলকে বললো,
“সরি জান আর হবে না। ”
সায়রী গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ওকে এবার চুপচাপ খাওয়া শেষ করো তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। ”
“আহা এইতো এখন বউ বউ লাগছে। ”
আড়চোখে চেয়ে ভেঙচি কাটলো সায়রী বললো,
“এবার জামাই + বাবা হওয়ার ট্রাই করেন মহাশয়। ”
“করছিতো জান শুধুমাত্র বউ,বাচ্চাকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে চাই বলে বাবা,মা পরিবার ছেড়ে আলাদা থাকছি। অশান্তি যতোটুকু আমাদের স্পর্শ করেছে করেছেই ভবিষ্যতে যেনো না করতে পারে আমার সন্তান যেনো কোন জটিলতার সম্মুখীন না হয় তাই তো এই পথ বেছে নেওয়া। চোখদুটো চিকচিক করছে সায়রীর। দিহান মাথা নিচু করে খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। সায়রী নিচু স্বরে বললো,
” থ্যাংকস দিহান। ”
“চুপ নিজ বাচ্চার বাবাকে থ্যাংস বলতে লজ্জা করেনা? ”
হেসে ফেললো সায়রী মায়ের হাসি দেখে হাসলো রিহানও। ছেলের মাথা বুলিয়ে হাসলো দিহানও।
.
চেয়ারে বসে পিছন দিক চুলগুলো মেলে দিয়েছে মুসকান। ইমন নিপুণ হাতে চুলগুলো আঁচড়ে বেণি করে দিচ্ছে। ইদানীং একা একা কিছুই করতে পারেনা মুসকান। যতোটুকু পারে আহ্লাদে আটখানা হয়ে ততোটুকুও করেনা সে। প্রকাশ্যে অবশ্য ইমনকে বলেও, ” মা ডাক শোনা যে সহজ কথা নয় তা আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। আর বাবা ডাক এতো সহজেই শুনে ফেলবে তুমি? কিঞ্চিৎ ভোগান্তি তো পোহাতেই হবে মি.। ”
ইমন তখন ওষ্ঠকোণে দুর্বৃত্ত হাসি ফুটিয়ে বলেছিলো,
“একটুও ভোগান্তি হবে না বরং সুবিধাই হলো আমার। ”
.
চুল বেণি করে মুসকান পাঁজা কোল করে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো ইমন৷ ওকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে ইরাবতীকে গিয়ে বললো উপরে গিয়ে রেষ্ট করতে বাকিটা সে বুঝে নেবে। ইরাবতী সম্মতি দিয়ে বয়াম থেকে বাটিতে আচার বেড়ে মুসকানকে দিয়ে উপরে চলে গেলো। মুসকান রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে ধীরে সুস্থে ওঠে দাঁড়ালো। পেট হাত দিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো ইমনের পিছনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বললো,
“দাদাভাই আসছে না কেন? ”
ইমন সবজি গুলো ধোয়া শেষ করে পিছন ঘুরে বললো,
“কাছাকাছিই এসে গেছে তুমি ওখানে গিয়ে বসো যাও। ”
“না যাব না আমি রান্না দেখবো। ”
ইমন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“বাবু আচার খাবে যাও খাওয়াও ওকে। ”
“না খাওয়াবো না আজ বাবু’কে না খাওয়িয়ে রাখবো। ”
এক পা এগিয়ে এলো ইমন এক হাত মুসকানের কানের পিছনে দিয়ে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
” আটটা মাস না খাওয়িয়ে রেখে শান্তি হয়নি সবার গুলুমুলু বাচ্চা আর আমাদের চুনোপুঁটি বাচ্চা হবে? ”
“তা হবে কেন? ”
“হবে না আট মাস চলছে অথচ বাচ্চার ওজন মাত্র দেড় কেজি! যদি ও এখানে না থেকে বাইরে থাকতো তোমাকে পিটিয়ে পিটিয়ে খাওয়াতাম আমি। ”
খিলখিল করে হেসে ওঠলো মুসকান পরোক্ষণেই শান্ত হয়ে পেটে চেপে ধরলো। ধীরগতিতে সরে যেতে যেতে বললো,
“আমি গিয়ে বসছি তুমি কাজ করো। ”
ইমন বুঝলো পেইন হচ্ছে তাই নিজেও সাথে গিয়ে বসিয়ে দিলো সোফায় আচারের বাটি হাতে দিয়ে মাথায় বুলাতে বুলাতে বললো,
“প্লিজ মুসু আর যে কয়েকটা দিন আছে কষ্ট হলেও খাওয়া দাওয়া করো বাচ্চামি করো না। এতোগুলো মাস এতোটা কষ্ট করে পুষ্টিহীন সন্তান দেখতে তোমার ভালো লাগবে বলো? ”
“কি করবো আমিতো চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা বমি হয়ে যায়। ”
“হবে না তুমি এটা শেষ করো আমি পাস্তা বানিয়ে আনছি ওরা আসতে আসতে কমপ্লিট হয়ে যাবে। ”
.
মুরাদ আর দিহান উপস্থিত হয়েছে অনেকক্ষণ। সায়রী রিহানকে ঘুম পাড়ানোর জন্য উপরে ওঠে গেলো। মুসকান চুপচাপ বসে টিভি দেখছে। ইমন কাজের ফাঁকে কখনো কখনো এসে মুসকানকে সঙ্গ দিচ্ছে। দুপুর পড়ে গেছে ওদের রান্না-বান্নাও শেষ। ইরাবতী সায়রী মিলে সকলের জন্য খাবার বাড়ছে৷ ইমন তখন একটি প্লেটে মুসকানের জন্য খাবার নিয়ে সোফায় গিয়ে মুসকানের পাশে বসলো। নিজ হাতে মেখে ওর সামনে খাবার ধরতেই টিভি দেখতে দেখতে খেতেও শুরু করলো। প্রশান্তিতে ভরে গেলো ইমনের বুকটা। সেই সাথে অনুভূতও হলো আজ অফিস নেই বলে মুসকানকে সে বেশ সময় দিতে পারছে। ঠিকমতো কেয়ার নিতে পারছে৷ এমনটা রোজ করলে হয়তো আজ এই অবস্থা হতো না। নিজেকে বড্ড দোষী মনে হতে লাগলো পরোক্ষণেই ভাবলো তার দোষটা কোথায়?
চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস ছাড়লো ইমন। মনে পড়ে গেলো ডক্টরের বলা কথা গুলো। মুসকান ইমনের বাহুতে হাত চেপে ধরে বললো,
“আবার টেনশন করছো আমি কিন্তু খাব না। ”
স্মিথ হাসলো ইমন বললো,
“একটুও টেনশন করছিনা বরং দিন গুনছি আমার সোনামুনিটার জন্য। ”
ইমন মুসকানকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো মুরাদের। আল্লাহ তায়া’লার নিকট কেবল প্রার্থনা করলো সব যেনো ঠিক থাকে। অন্তত পক্ষে তার বোনটা যেনো ঠিক থাকে। নয়তো বন্ধু বোন দু’টোকেই হারাতে হবে।
_________________
সকাল সকাল অফিস বেরিয়ে গেছে ইমন। নানারকম টেনশনে অফিস করাটা তার জন্য বড়ো কষ্টকরই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি আর করার কিছুদিন পর ছুটি নেবে যেহেতু একদিন নিয়মিত অফিস করতেই হবে।
অফিসে ঢোকার ঠিক পনেরো মিনিট পরই ইমনের ফোনে কল এলো। ইরাবতী জানালো মুসকানের প্রচন্ড পেইন হচ্ছে এ মূহুর্তেই হসপিটাল নিতে হবে। মায়ের ফোন পাওয়া মাত্রই অফিস থেকে ছুটে বের হয় ইমন। যতোক্ষণ সে রাস্তায় থাকে ততোক্ষণই মুরাদকে ফোন দিতে থাকে। মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে কেবল একটি বাক্যই তার স্ত্রীর শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুবই কম। ডেলিভারির পর ইমিডিয়েট রক্ত প্রয়োজন পড়তে পারে।
.
মুসকানকে ধরে ধরে আকরাম চৌধুরী আর ইরাবতী সিঁড়ি বেয়ে নিচ অবদি নামিয়েছে তখনি ছুটে এলো ইমন৷ দ্রুত বাবা মা’কে সরিয়ে পাঁজা কোল করে আবারও ছুটে বেরিয়ে পড়লো। পিছন পিছন গেলো ইরাবতী আর আকরাম চৌধুরীও। কিন্তু পথিমধ্যেই মুসকানের রাপচার্ড মেমব্রেন হয়৷ সঙ্গে সঙ্গেই মুসকান ভয়ে চিৎকার করে সেন্সলেস হয়ে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে ইমন৷ ইরাবতী মুসকানের গালে হাত দিয়ে সমানে ডাকতে থাকে। ইমন সম্বিত ফিরে পাওয়া মাত্র বাবা মায়ের সামনে মুসকান’কে জড়িয়ে ধরে। দু-চোখ বেয়ে অঝড়ে পানি ঝড়তে থাকে। ইরাবতী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“বাবা কিছু হবেনা বাচ্চা হওয়ার সময় হয়ে গেছে তাই এমন টা হচ্ছে। ”
ইমন বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে মুসকান’কে বুকে জড়িয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে,
“মা একটু পানি দেবে? ”
.
হসপিটালের সামনে মুরাদ,মরিয়ম আক্তার, দিহান দাঁড়িয়েই ছিলো। ইমনের গাড়ি থামতেই মুরাদ ছুটে এলো। ইমন মুসকানকে কোলে করেই গাড়ি থেকে বের হলো। মুরাদ মুসকানের মাথায় হাত দিয়ে বললো,
“বোন কিছু হবে না তুই ভয় পাস না আমরা আছি। ”
ইমনের শার্ট খামচে ধরে মুসকান চিৎকার করে ওঠলো বললো,
“আমি আর পারছি না হয় আমাকে মেরে ফেলো নয় আমাকে এই অসহনীয় ব্যাথা থেকে মুক্ত করো। আমি পারছিনা, পারছিনা আমি। ”
রুদ্ধ শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হসপিটালের ভিতর ঢুকলো সকলে। সব কিছু রেডিই ছিলো কেবল মুসকান’কে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করারও সময় নেই তাই বাচ্চা টা কি হালে আছে সেভাবে কারো বোধগম্য হলো না। কিন্তু ডক্টর, নার্স সকলেরই ধারণা বাচ্চা বাঁচবে না৷ ইতিমধ্যে মুসকানের থেকে যতোদূর জেনেছে বাচ্চা রেসপন্স করছে না। মুসকানের সম্মুখে সব বলা সম্ভব নয় তাই তার বাড়ির লোকদের জানানো হলো – বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। ইমন হতভম্ব হয়ে নিচু স্বরে বললো,
“আমার স্ত্রী ঠিক থাকলেই চলবে আপনারা প্লিজ ওকে বাঁচান। ”
এ সময় একপাশে দিহান অপর পাশে সায়রী দাঁড়িয়ে ছিলো। মুরাদ মরিয়ম আক্তারকে সামলাচ্ছেন। তখনি কিছু কাগজপত্র ইমনের সম্মুখে দেওয়া হলো। যেখানে লেখা ছিলো তার সন্তানের প্রতি তার কোন দাবি নেই। ইমন কোন কিছু না ভেবে সাইন করে দিলো। কিন্তু সাইন করার কিছু সেকেন্ডের মাঝেই ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। বিরবির করে কেবল একটি বাক্যই উচ্চারণ করলো,
” হে আল্লাহ আমি কখনো বাবা ডাক শুনবো কিনা জানিনা কিন্তু আমার স্ত্রী’কে তুমি ভিক্ষা সরূপ দান করো। ”
চলবে…