হৃৎপিণ্ড_২ ( দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ) পর্ব ২৫

0
385

#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২৫
#জান্নাতুল_নাঈমা
____________________
বাড়ির সবাই ব্রেকফাস্ট করে যে যার মতো রেষ্ট নিচ্ছে। ইরাবতী খেতে বসবে বসবে করেও বসতে পারছে না। কারণ ইমন পুরান বাড়ি থেকে এখনো আসেনি। তাই মুসকান খাচ্ছে না, মুসকানকে রেখে তারও খেতে ইচ্ছে করছে না। শাশুড়ি, বউয়ের এমন কাণ্ড দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো সায়রীর। সোফায় বসে ছিলো মুসকান, ইরাবতী ছেলেকে ফোন করে যাচ্ছে। এমন সময় সায়রী গিয়ে মুসকানের পাশে বসলো। বললো,

“তুই অনেক ভাগ্যবতীরে মুসু ইরা আন্টির মতো শাশুড়ি পেয়েছিস। দোয়া করি সারাজীবন এই সম্পর্ক অটুট থাকুক। ”

মুসকান মৃদু হাসলো তারপর ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,

“হুম উপরওয়ালার কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া আপু আমি এমন একটা শাশুড়ি মা পেয়েছি। ”

মুসকান, সায়রী টুকটাক কথা বলছিলো এমন সময় ইরাবতীর ফোন রিসিভ করলো ইমন এবং জানালো তার আসতে আরো আধাঘন্টা দেরি হবে। তাই সে আর মুসকান যেনো খেয়ে নেয় নয়তো ভীষণ রাগ করবে। সকালের ওষুধটাও খাওয়া হয়নি ইরাবতীর। এখন যদি সে না খায় ছেলে তার সত্যি ভীষণ রিয়্যাক্ট করবে। তাই ফোন রেখে মুসকানকে তাগাদা দিলো খাওয়ার জন্য। মুসকান ইরাবতী’কে বোঝানোর জন্য বললো,

” তুমি খেয়ে নাও প্লিজ আমার খিদে পায়নি আমি নানাভাই এলেই খাবোনি। ”

সায়রী বউ শাশুড়ির কাণ্ড দেখতে থাকলো আর মিটিমিটি হাসতে লাগলো। কিন্তু ইমনের দাদি এসে ফোঁড়ন দিয়ে বললো,

“নানাভাই মানে কি বউ মা তোমার ছেলের বউ এসব কি কয়? শরম, লজ্জা কি কিছুই নাই,স্বামীরে কয় নানাভাই! ”

ইরাবতী আঁতকে ওঠে ফুপু শাশুড়ির দিকে তাকালেন। বললেন,

“ফুপু ছেলেমানুষ তো আগে থেকেই নানাভাই বলে ডাকে বুঝতে পারেনি। কিছু মনে করবেন না। ”

দাদি সে কোথায় কান দিলো না। নানারকম ভাবে মুসকানকে দোষারোপ দিতে শুরু করলো। বললো,

“এই হয়, এই মেয়ে যদি এতোই ছেলে মানুষ হয় স্বামী কি জিনিস তাই যদি না বুঝে তাহলে ভালোবাসা বাসি করতে কে বলছিলো বিয়েই বা বসতে কে বলছিলো? ”

দাদির প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো ইরাবতী। সায়রী বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে রইলো। আর মুসকান মুখে সুন্দরতম হাসি বজায় রেখে সুবোধ্য গলায় উত্তর দিলো,

“আপনার নাতিই বলেছিলো দাদি। ”

বড়ো বড়ো করে তাকালো দাদি। ইরাবতী ইশারায় চুপ করতে বললো, সায়রীও মুসুর বাহুতে চিমটি কাটলো। কিন্তু মুসকান চুপ রইলো না মিষ্টি ভাষায় তীক্ষ্ণ করে বললো,

“স্বামী কি জিনিস খুব ভালো করেই জানি দাদি। কিন্তু কি বলুন তো আর সবার থেকে আমাদের সম্পর্ক টা তো ভিন্ন তাই সব কিছুতেই ভিন্নতা দেখতে পাচ্ছেন। এই ধরুন বর্তমানে সব স্ত্রীরাই কিন্তু স্বামীদের নাম ধরে ডাকে। তারা বয়সে যতোই সিনিয়র হোক না কেন। আমিও কিন্তু চাইলে আমার বর’কে নাম ধরে ডাকতে পারবো কিন্তু বয়সে সে আমার থেকে বেশ বড়ো, তার থেকে বড়ো কথা তাকে আমি সীমাহীন সম্মান করি তাই নাম উচ্চারণ না করে কিছু একটা সম্বোধন করি ‘নানাভাই’ কি মধুর না সম্বোধন টা?? ”

দাদি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে ইরাবতীর দিকে তাকালো। ইরাবতী এক ঢোক গিললো, জোর পূর্বক হেসে দাদি’কে কিছু বোঝাতে যাবে তার পূর্বেই দাদি বললো,

“থাক বউ মা আর কিছু বোঝাতে হবে না। আজকালকার মেয়েদের ঢের চেনা আছে। ভাবছিলাম ইমন দাদু ভাই যখন পছন্দ করছে তাহলে মেয়েটা সিজিলের আছে। কিন্তু আমিতো দেখছি এই মেয়েটা পুরা বেয়াদব! ”

সকলের মুখই ছোট হয়ে গেলো। মুসকানের চোখদুটোও জলে পূর্ণ হলো। সে বেয়াদব এই কথাটা তার বুকে গিয়ে বিঁধল তবুও নিজেকে সংযত করে কাঁপা কন্ঠে বললো,

“আপনি কি আপনার নাতির নাম ধরে ডাকলে খুব খুশি হবেন? নাকি মা’কে বলবো তোমার ছেলে এটা করেছে আপনাকে বলবো আপনার নাতি ওটা করেছে এভাবে সম্বোধন করলে খুশি হবেন? কোনটা বেশি সম্মানের একটু চিন্তা করুন তো? ”

“চুপ আর একটা কথাও বলবে না। তোমার মতো বেয়াদবের থেকে একটা কথাও শুনবো না। এই শিখছো পরিবার থেকে? তোমার মা, চাচিরা এইগুলা শিখিয়ে পাঠাইছে যে শ্বশুর ঘরে গিয়ে কিভাবে মুরুব্বিদের মুখে মুখে তর্ক করতে হয়? বাপ তো নাই বাপের শিক্ষা পাও নাই, ভাই তো দরদে দরদে মাথা বিগরাইছে আর মহিলাগোর শিক্ষা পাইয়া আজ এই অবস্থা হইছে তাইনা? ”

দুচোখ ভর্তি অশ্রুকণাগুলো এবার ঝড়তে শুরু করলো মুসকানের। এভাবে ধমক আর কড়া কড়া কথা শুনে তার আপনাআপনিই কান্না চলে এলো। নিজেকে শক্ত রাখতে চেয়েও পারলো না। এদিকে সায়রীর মাথা এমন গরম হলো যে সে বললো,

“দাদি কিছু মনে করবেন না মহিলা শিক্ষা মানে আপনি কি বোঝাতে চাইলেন? নারী হয়ে নারীদের এতো ছোট করে দেখছেন বিষয়টা বুঝলাম না। আর মুসকান স্পষ্টভাষী বলে ওকে বেয়াদব উপাধি দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা তো ওর ভুল খুঁজে পাচ্ছি না। ”

ইরাবতী পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বললো,

“মুসকান আমার খুব খিদে পেয়েছে তুমি কি আমাকে খাবার বেড়ে দেবে? ”

ক্রন্দনরত মুখশ্রীতে ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে চোখ মুছলো মুসকান। মাথা নাড়িয়ে ওঠে চলেও গেলো। কিন্তু দাদি ঠাঁই বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ইমনের জন্য। সায়রীর কথারও একটি উত্তর দিলো না সে। সায়রীও বিরক্ত হয়ে ওঠে চলে গেলো।
.
ইরাবতী খেতে বসেছে মুসকান তার পাশেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। মুসকানের রাগ,জেদ সম্পর্কে মোটামুটি সকলেরই ধারণা রয়েছে। তাই ইরাবতী মুসকান’কে অনেক কিছু বোঝালো। বললো,

“ইমনের বংশের একমাত্র মুরুব্বি সেই। আগের মানুষ তো চিন্তা ভাবনাও আগের মতো। আর কি জানো বাড়ির মুরুব্বিরা ভুল করলে শাসন করা যায় না। ভুল ধরিয়ে দিতে হয় তবুও যদি তারা ভুল করে তাহলে সেগুলো এড়িয়ে চলতে হয়। উনার কথায় কিছু মনে করো না মা। ইমনকেও এসব নিয়ে কিছু বলো না। অশান্তি হবে খুব রাগ করেনা মা মাথা ঠান্ডা করো। এইতো আর কটা দিন তারপর তো ফুপু চলেই যাবে। ”

নাক টেনে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলো মুসকান। সায়রী আর আলিয়া এসে মুসকানের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। কিছুক্ষণ পর ইমনের ফুপুও এলো। সেও অনেক কিছু বোঝালো স্বান্তনা দিলো। সকলেরই একটা ভয় হচ্ছে মুসকান যদি ইমন’কে কিছু বলে না জানি ইমন কি কাণ্ড ঘটায়। কিন্তু সায়রী যে সমস্ত কথাই ইয়া বড়ো করে ম্যাসেজের মাধ্যমে ইমনকে জানিয়েছে তা কেউই জানতে পারলো না৷ মুসকান নিজেও না।
.
ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো ইমন। তখনি দাদি সটান হয়ে ওঠে দাঁড়ালো। চোখ,মুখে কাতরতা ফুটিয়ে তুলে ইমনকে বললো,

“দাদু ভাই এসেছিস তোর জন্যই অপেক্ষা করছি। ”

ইমন ধীরপায়ে এগিয়ে এসে সোফায় গা এলিয়ে বসলো। তারপর দাদিকে ইশারা করলো তার পাশে বসতে। দাদি বিনাবাক্যে খুশি মনে বসে পড়লো। ইমন গলা উঁচিয়ে পারুলকে পানি আনতে বলে দাদির দিকে রহস্যময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বললো,

“আমার সদ্য বিবাহিত পিচ্চি বউ’টা তোমার কোন পাকা ধানে মই দিছে দাদি? ”

“হায় হায় রে এরই মধ্যে নালিশ করাও শেষ? তোর বউ যে তোর বয়স নিয়া ঠাট্টা করে সেই খবর কি তুই জানোস? ”

পারুল এসে পানি দিতেই ইমন পানিটা নিয়ে ঢকঢক করে গিললো। তারপর গ্লাস ফেরত দিয়ে ইশারায় চলে যেতেও বললো। পারুল চলে যেতেই ইমন লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় দাদিকে বললো,

“আমার বউ আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করুক মশকরা করুক যাই করুক তোমার এতো জ্বলে কেন? নাকি আমাদের দাম্পত্য জীবনের সুখ তোমার সহ্য হচ্ছে না? ”

“তোর বউ যে আমার মুখে মুখে তর্ক করছে তা তুই জানোস? নতুন বউ তার মুখে যেনো খই ফুটে । ”

“বাহ তাই নাকি তাহলে খই কেনার টাকা টা আমার বেঁচে গেলো বলছো? ”

“তুই আমার সাথে ঠাট্টা করস। ”

“আরে দাদি ক্ষেপছো কেন তোমার কি ঠাট্টা রোগে ধরলো নাকি? আমার বউ আমাকে ভালোবেসে আহ্লাদ করে, সম্মান দিয়ে নানাভাই ডাকে তুমি বলো ঠাট্টা। আমার বউয়ের মুখে খই ফুটে জানতাম না তুমি জানালে ভাবলাম যাক টাকা বেঁচে গেলো এটাকেও বলছো ঠাট্টা। তোমাকে কি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে দাদি? মানে মানসিক ব্যাধিতে ভুগছো না তো? ”

প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো দাদি৷ চোখ,মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,

“আমি বাপু তোদের সংসারে দু’দিনের অতিথি মাত্র। তোর বউ যা ইচ্ছা করুক তাতে আমার কি। ভালো মন্দ শেখাতে আসলে যদি দোষ হয় আমি কিছুই বলবো না। তোর বউ যে বেয়াদবি করছে এই কথাও তোরে বলবো না। আমার আগেই মনে রাখা উচিৎ ছিলো তুই কচি বউ বিয়ে করছোস। তাই তার জন্য সাতখুন মাপ। ”

হেসে ফেললো ইমন দাদির হাত টেনে পাশে বসিয়ে বললো,

” সঠিক বলছো দাদি বউটা আমার একেবারেই কচি। কিন্তু বেঠিকও বলছো তা হলো আমার বউ বেয়াদব। দুনিয়া উলটপালট হয়ে গেলেও এই কথা আমি বিশ্বাস করতে পারবো না। ইমন চৌধুরী এতো কাঁচা কাজ করে না দাদি যে বেয়াদব বউ ঘরে তুলবে। ”

“তাহলে আমার হাত ছাড় আমারে ধরস কেন বউ ধর গা যা। ”

“বউ ধরার সময় হোক তোমার বলার অপেক্ষা রাখবো না। এখন যা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনো। মুসকানের পিছে লাগা একদম ছেড়ে দাও। যে কটা দিন আছো নিজে শান্তিতে থাকো সবাইকে শান্তিতে থাকতে দাও তোমার কোন অসম্মান হবে না। কিন্তু অশান্তি করে যদি আর একবার আমার কচি বউয়ের চোখে পানি এনেছো তো চৌধুরী বাড়ির একমাত্র বংশধরের মাথা কতোখানি বিগরে যাবে তখন টের পাবে। ”

দাদি থতমত খেয়ে ইমনের থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। ইমন মুচকি হেসে দাদির হাত ছেড়ে বললো,

“বংশের একমাত্র মুরুব্বি সাহেবা কথা কি মাথায় ঢুকেছে? ”

দাদি এক ঢোক গিললো আশেপাশে তাকিয়ে মনে মনে বিরবির করে বললো,

“আকরামের পোলাডা এক্কেরে বদমাইশ হইছে। আজই আকরামের সাথে কথা বলতে হবে। নয়তো শেষ বয়সে ছেলে,ছেলের বউ না খাওয়াই মারবো আকরাম আর আকরামের বউরে। এই পোলা এখনি যা বউ ভক্ত না জানি আর কয়দিন পর বাপ,মা ত্যাগ করে! ”
.
পারুল প্লেটে কিছু ফল কেটে রুমে এসে ইমন’কে দিয়ে গেলো। ইমন প্লেট হাতে নিয়ে বিছানায় মুসকানের পাশে গিয়ে বসলো। অপেক্ষা করত লাগলো কখন মুসকানের কথা বলা শেষ হয়। মায়ের সাথে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে কথা বলছে মুসকান। তার অভিযোগ সবাই দুপুরে আসবে তাহলে তার মা কেন আসবে না? মরিয়ম আক্তার যতোই বোঝাচ্ছে সে তোতোই বলছে,

” সবাই যা করবে তোমারও তাই কেন করতে হবে? তুমি দাদাভাই কে দাও আমি দাদাভাই কে বলবো যেনো তোমাকে নিয়ে আসে। ”

মরিয়ম আক্তার মেয়েকে বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে গেলো। মুসকান দাদির বলা কথাটির জন্য তখন শান্তিপূর্ণ ভাবে কাঁদতে পারেনি তাই এই সুযোগে এই ইস্যু ধরেই কাঁদতে শুরু করলো। ইমন বেশ বুঝলো মুসকান আসলে কেন কাঁদছে? তাই সে পিছন থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে টুশ করে ফোনটা কেটে দিলো। মুসকান একহাতে চোখের পানি মুছে ইমনের দিকে অভিমানী চোখে তাকালো। বললো,

“ফোন কেন কাটলে আমি আম্মুর সাথে কথা বলবো।”

“সন্ধ্যায় তো যাবেই এখন কসের কথা এগুলো খেয়ে নাও। তারপর শাওয়ার নাও একটু পরই রিক্তা আসবে তোমাকে সাজাতে। ”

ইমনের হাতের দিকে তাকিয়ে মুসকান বললো,

“আমার খিদে নেই। ”

“মুসু আমি কিন্তু রেগে যাবো তখন বমি পায় বলে খেলে না এখন এটুকু না খেলে এই শরীর নিয়ে অনুষ্ঠানে ঠিক থাকতে পারবে না। ”

“আমি বললাম না খাবো না? বিরক্ত করছো কেন? ”

হঠাৎ চিৎকার করে ওঠলো মুসকান। পরোক্ষণেই চমকে ওঠে শান্ত হয়ে মাথা নিচু করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে শুরু করলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেলো ইমনেরও চোখ,মুখ শক্ত হয়ে গেলো তার। চোয়ালজোড়া দৃঢ় করে দৃঢ় কন্ঠে প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো,

” এটা তুমি খাবে, খাবে মানে খাবে আর একটা টু শব্দ যদি এখানে হয় তাহলে আজ বাড়ি ফেরার কথা, মায়ের কাছে ফেরার কথা ভুলে যাও। ”

কথাগুলো বলেই ফলের প্লেটটি মুসকানের সম্মুখে রেখে চলে গেলো ইমন। মুসকানের দুচোখ ভরে আবারও অশ্রুপাত হতে শুরু করলো। অভিমানে আড়ষ্ট হয়ে একহাত বাড়িয়ে একটি আপেলের টুকরো মুখে দিলো। জোর পূর্বক কিছুক্ষণ চিবিয়ে আবরো মুখ বুজে বসে অশ্রু ফেলতে লাগলো। ইমন বাইরে গিয়ে নিজের রাগটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে আবারও রুমে ঢুকলো। মুসকান বেশ অনিহা নিয়েই ফল মুখে দিচ্ছে দেখে কিছু টা স্বস্তি নিয়ে দরজা আঁটকে দিলো তারপর আবারও বিছানায় এসে বসলো। বললো,

“দাদি’কে যা বলার বলে দিয়েছি আমি এরপর আর পিছু লাগবে না মুসু। ”

“আমি কোন বেয়াদবি করিনি নানাভাই”

বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো মুসকান ইমনের দিকে ফিরে আচমকাই ইমনকে জড়িয়েও ধরলো। বুকে মুখ গুঁজে শার্ট খামচে ধরে অনেকটা সময় কাঁদলো। বললো,

“দাদাভাই কখন আসবে? ”

ইমন বুঝলো মুসকানের মন খারাপ লাগছে। মা আর ভাইয়ের জন্য মনটা তার খুব কাঁদছে। তাই মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো চুমু খেলো। তারপর দু’হাতের আঁজলে মুখ ওঠিয়ে কপালে চুমু খেলো। গাল দু’টো মুছে দুগালেও চুমু খেলো। তারপর শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওষ্ঠজোড়ায় আঙুল বুলাতে বুলাতে শান্ত কন্ঠে বললো,

“এইতো কিছুক্ষণ পরই এসে যাবে তুমি রেডি হতে হতেই সবাই এসে পড়বে। সে অবদি তুমি নানি আর সায়রীর সাথে সময় কাটাও কেমন? ”

“এ্যাহ নানি ভাবির নানি সকালে একবার দেখা দিয়ে নাস্তা করে আবার ঘুমাচ্ছে। আমার সাথে তাকে পাঠানো হয়েছে কই আমার সাথে সাথে থাকবে তা না৷ তোমার দাদি কতোগুলো কথা শোনালো সে থাকলে একটু কিছু বললে কি আমি বেয়াদব উপাধি পেতাম বলো? ”

স্মিথ হাসলো ইমন মুসকানের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে বোঝালো না। মুসকান ইমনের চোখের ভাষা বুঝতেই চুপ হয়ে গেলো। ইমনের দৃষ্টি জোড়া যে এখন তার ওষ্ঠজোড়ায় আঁটকে আছে তা বুঝতেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে বললো,

“তাহলে আমি শাওয়ার নিয়ে আসি নাকি তুমি আগে যাবে? ”

“দু’জন একসাথে যাবো। ”

চটপট উত্তর ইমনের। মুসকান লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো। ইমন মুচকি হেসে ফলের প্লেট সামনে ধরে নিজ হাতে পুরো ফলটাই ওকে খাওয়ালো। খাওয়া শেষে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কোলে তুলে সোজা বাথরুমে ঢুকে পড়লো।
__________________
কনেপক্ষের সকলেই বউভাতের অনুষ্ঠানে হাজির। তারা উপস্থিত হওয়ার মিনিট কয়েকের মধ্যে ইমন মুসকানও হাজির হলো। মুরাদ বোন আর বোন জামাইকে দেখে খুশিতে আত্মহারাই হয়ে গেলো। নজরকারা সাজে বর বউ’কে দেখা মাত্রই রিমি সহ মুসকানের কাজিন ব্রাদার্স, সিস্টার্সরা চিল্লিয়ে ওঠলো। পারপেল কালারের বেনারসি শাড়ি বাঙালি ভাবে পরেছে মুসকান। সাথে গা ভর্তি গহনা…ব্রাইডাল লুকে একদমই অন্যরকম লাগছে আজ মুসকানকে। বিয়ের দিন থেকে আজ যেনো তার রূপ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ইমনও কিন্তু কম নয় পারপেল কালারের শার্টের ওপর সাদা স্যুট, প্যান্ট,কালো সুজ’তে অসাধারণ লাগছে তাকে। এ মূহুর্তে ওদের দু’জনকে দেখলে যে কারোরি মনে হবে এরা কেবল একে অপরের জন্যই তৈরি৷ ইমন ছাড়া মুসকানের পাশে যেমন ভিন্ন কোন পুরুষ’কে একটুও মানাবে না তেমনি ইমনের পাশেও অন্য কোন নারী’কে প্রচন্ড বিদঘুটে লাগবে!
.
স্টেজে বর কনে নিজ আসনে বসে আছে। কনে পক্ষের সকল আত্মীয় স্বজনরা বর পক্ষের সকল আত্মীয় স্বজনদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বরপক্ষের দূরান্তের আত্মীয় স্বজন এসে মুসকানের হাতে উপহার স্বরূপ কিছু দিচ্ছে যা অভ্র আর আলিয়া দায়িত্ব সহকারে মুসকানের থেকে নিয়ে পিছনের একটি ঘরে রেখে আসছে। সময় বেশ গড়িয়ে যায়। কনে পক্ষের সকলেই তখন খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। মুসকান চুপচাপ বসে আছে টুকটাক কথা বলছে ইমনের বন্ধু বান্ধব দের সাথে। যাদের সঙ্গে ইতিপূর্বে তার পরিচয় ছিলো না। এক পর্যায়ে হঠাৎই ইমন বলে কেউ ডেকে ওঠলো। মুসকান সহ ইমনও তাকালো সিঁড়ির দিকে। সাদা ল্যাহেঙ্গা পরিহিতা একটি মেয়ে এক গাল হাসি নিয়ে হাত উঁচিয়ে ইশারা করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। মুসকান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েই রইলো। মৃদু হেসে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো ইমন। মেয়েটি প্রায় দৌড়ে এসেই ইমন’কে জড়িয়ে ধরলো। গালে গাল ছুঁইয়ে ঠোঁট চৌকা করে চুমুর ভঙ্গিও করলো। আচমকাই এমন কাণ্ড ঘটাবে পৃথা একটুর জন্যও টের পায়নি ইমন। মস্তিষ্কে কেবল মুসকান মুসকান স্মরণ হতেই দুহাতে কিছুটা কঠোরতা এনেই পৃথার হাত ছাড়িয়ে দিলো। ঘাড় বাঁকিয়ে মুসকানের দৃষ্টিজোড়া পরখ করতেই “ড্যাম ইট!” বলেই পৃথার দিকে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। পৃথাও ঘাড় বাঁকিয়ে মুসকান’কে এক পলক দেখে “সরি ” বললো। তারপর মুচকি হেসে ইমনকে বললো,

“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? ”

“অনেক বেশিই সারপ্রাইজ দিয়ে ফেলেছিস এবার কিভাবে এই সারপ্রাইজের ধকল সামলাবো! ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here