#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
পরপর টানা দুইটা ক্লাস করে ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ করে নেয়। মধ্য দুপুর এখন। লাঞ্চ শেষে ক্যাম্পাসে এসে বসে। প্রথমদিন হিসেবে ওরা বিন্দাস। আজকে তিনটাই ক্লাস। সপ্তাহে চারদিন ক্লাস নিয়েছে চারটা সাবজেক্টের। প্রতি সাবজেক্টের ক্লাস সপ্তাহে দুইটা করে হয়। রাদ অর্ষাকে ডেকে করিডোরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখায়,
“ওই দেখ তোর দুই ক্রাশ একসাথে যাচ্ছে! জারিফ স্যার আর শারদ ভাইয়া।”
অর্ষা মিমের সাথে ফোনে কিছু একটা দেখছিল। এখন সেখান থেকে চোখ তুলে সামনে রাদের দেখানো দিকে তাকালো। জারিফ নবম সেমিস্টারের ছাত্র শারদের সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। এখন জারিফ ভার্সিটি থেকে বেরোবে। অর্ষা গালে হাত দিয়ে সামনের দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এদিকে প্রিয়া রাদের কথায় চমকে গিয়ে হুড়মুড় করে মাস্কটা মুখের উপর তুলে দেয় আর নিশির পিছোনে মুখ লুকানোর চেষ্টাতে আছে। নিশি মোঁ*চড়া মুঁ*চড়ি করে প্রিয়াকে সামনে এনে বলে,
“তুই এমন করছিস কেন ভাই? স্যার তো চলেই যাচ্ছেন। স্যার কি তাকাচ্ছে?”
“যদি তাকায়?”
প্রিয়ার বিচলিত কন্ঠস্বরে নিশি কপাল কুঁচকে বলে,
“মাস্ক তো পরছিস। সে কি এখন ওখান থেকে এখানে তোর মাস্কের ভিতর দিয়ে চেহারা দেখবে! হুদাই ভয় পাস!”
প্রিয়া তাও উুঁকি দিয়ে দেখল জারিফ বেরিয়ে গেছে। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“তোরা বুঝবি নারে। আমি কোনোমতে টিকে থাকা স্টুডেন্ট। আমার এই সেমিস্টারের রেজাল্টে আরও ধস নামবে বুঝে গেছি আমি। এই শ*য়*তা*ন মার্কা স্যার আমারে ফেল করাবে!”
সাদ মাঝ থেকে বলে,
“কেন! তুই কী স্যারের টাকা চু*রি করছিস? বাসের মধ্যে তোর ভাল্লাগে নাই তুই তাই বলছিস।”
অর্ষা ঘোর থেকে বের হয়ে বলল,
“তোরা এমন করিস কেন? আমি একটু ক্রাশ খাচ্ছিলাম! আর প্রিয়া তুইও! স্যারটা কতো কিউট, সুইট, হ্যান্ডসাম দেখছিস? স্যার ক্লাসে কতো সুন্দর করে কথা বলল আজ। তুই পরছিস তোর ওসব নিয়ে। চিল বেব। স্যার খুব কিউট। কিছু বলবে না।”
প্রিয়া অর্ষাকে ধ*মকে বলে,
“চুপ কর তুই। বাসের কাহিনী না ঘটলে আমিও একটু ক্রাশ খেতাম কিন্তু! ধ্যাত! বাসে উঠলে যেনো আমি রাণী হয়ে যাই! আমি ভাবতেছি সাবজেক্টটা ড্রপ দিবো। তার সামনে গেলে তারে দেখলে আমার হাঁটু কাঁপে।”
আয়ান প্রিয়াকে ধমকে বলে,
“বেশি বুঝিস তুই? দরকার পরলে কালকে স্যারের অফিস রুমে গিয়ে সরি বলে আসবি। আর বাসের ভিতরেই তো। বাসে তো কতো লোকেরা মেয়েদের পাশে বসলে বাজে ভাবে নড়াচড়া করে। তাই না? সেই হিসেবে তোর বিহেভ অতোটাও বাজে না। যদিও স্যারের আজ প্রথম ক্লাস বলে নার্ভাস ছিলেন হয়তো।”
বাকিরাও আয়ানের কথায় সায় দেয়। প্রিয়া চুপ করে মুখ ভাড় করে বসে আছে।
______________
জারিফ ভার্সিটির বাহিরে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। সকালেও সে নিজেদের গাড়ি দিয়ে আসতো তবে ওর ভাই জানালো গাড়িতে প্রবলেম হচ্ছে তাই সার্ভিসিংয়ে দিয়েছে। ওর ভাই আজকে ছুটিতে তাই সে আজ বাসায় থাকছে। হুট করে অতো সকালে সঠিক সময়ে উবার পাওয়া যাবে না বলে বাসে করেই ভার্সিটিতে এসেছে। সকালের ঘটনাটা তাকে খুবই বিরক্ত করেছে। এমনিতে বিদেশ যাওয়ার আগে বাসে চলাচলের অভ্যাস থাকলেও বিদেশে গিয়ে এতো ভীড়সহ বাসে চলাচল করতে হয়নি আর দেশে ফিরে তো নিজেদের গাড়িই আছে। আনকম্ফোর্টেবল লাগছিল। মেয়েটার দিকে সে তাকায়নি একবারও যতক্ষণ বসে ছিল কিন্তু নামার সময় মেয়েটার আচরণ তার ভালো লাগেনি। মেয়েটা ওকে অন্যসব যারা বাসে মেয়েদের হ্যারাস করে তেমন ভেবেছিল ভাবতেই বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করে। জারিফ এখন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। উবার কল করেছে ভার্সিটির থেকে বেরোনোর দশ মিনিট আগে আর এখনও প্রায় দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরও আগে যে উবার ডাকবে তা তার মনেই ছিল না। এখন দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বাসে করে যেতেও বিতৃষ্ণা হচ্ছে তার। আরও দশ মিনিট লাগবে বলল উবারের ড্রাইভার। শীতকাল বলে দাঁড়ানো যাচ্ছে। রোদের তেজ খুবই স্বল্প। বিকেল নামবে এখনই। ঘড়ির কাঁটায় পোনে চারটা বাজে। আসরে আজান পরছে। বিকেল নামলেই আস্তে আস্তে শীতলতা আবার প্রকৃতিতে ভর করবে।
এদিকে প্রিয়া হাসতে হাসতে ভার্সিটির গেটের কাছে এসে সামনে জারিফকে দেখে পেছোন দিকে দৌঁড় দিয়েছে। জারিফ সবে উবার গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকছে। প্রিয়াকে পেছোন দিকে দৌঁড় দিতে দেখে বাকিরা হকচকিয়ে গেলো। একটু আড়ালে গিয়ে প্রিয়া উুঁকি দিয়ে বিড়বিড় করে বলছে,
“গাড়িতে উঠেন আর চলে যান শ্রদ্ধেয় স্যার। আমাকে ভুলেও দেখবেন না। কিছুতেই না। ভাববেন আমি এই দুনিয়াতে এক্সসিস্ট করিনা। অদৃশ্য মানবী আমি! যারে অনুবিক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যায় না।”
নিশি, মিমরা ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। মিম প্রিয়ার মাথায় চা*টা মে*রে বলে,
“তুই কি তাহলে অতিআণুবীক্ষণিক ব্যাকটেরিয়া! যে তোকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যাবে না? এত বড়ো দা*ম*রা মেয়েরে দেখা যাবে না কেন?”
প্রিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“তুই নিজে কী? বে*দ্দ*প মাইয়া।”
জারিফকে চলে যেতে দেখে প্রিয়া গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ভাব নিয়ে বলল,
“হুহ্! আমি এখন দৃশ্যমান।”
নিশি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
“ডরপোক কাহিকা!”
বিনিময়ে প্রিয়া মুখ ভেঙ*চি দিলো। তারপর আবার ওরা হাসতে হাসতে যেতে থাকে।
___________
বাড়িতে গিয়ে জুতা-মোজা খুলে জারিফ সোফায় বসেছে। ওর মা ওর জন্য শরবত এনে দেয়। জারিফ মুচকি হেসে শরবতের গ্লাসটা নেয়। জারিফের বড়ো ভাবি তামান্না এসে পাশের সোফায় বসে উচ্ছাসের সাথো জিজ্ঞেস করে,
“ভার্সিটিতে কোনো মেয়েকে পছন্দ হলো?”
কথাটা শোনামাত্র জারিফ বিষম খেলো। জারিফের মা তরুণিমা বেগম জারিফের মাথায় আলতো করে হাত দিয়ে বলেন,
“কি করো বৌমা! এমন সময় কথাটা বলতে হলো? ছেলেটা বিষম খেলো তো।”
“সরি মা। আসলে সারাদিনে আমি অনেক কিছু ভেবে বসেছি। দেবর আমার কম তো সুন্দর না! তার ওপরই ইয়াং লেকচারার। ওর ভার্সিটির মেয়েরা তো ওর উপর ক্রাশ খাবেই। এটা ন্যাচারাল! তারপর…আহা!”
তরুণীমা বেগম বিরক্ত হলেন বড়ো ছেলের বউয়ের দূরদর্শী কল্পনায়। তিনি বলেন,
“এসব চিন্তা করতে কে বলে তোমাকে? জারিফ ভার্সিটিতে ক্লাস করাতে যায়। সেখানে কী সে প্রেম করতে যায়?”
তামান্না শাশুড়িকে বুঝাতে বলে,
“আরে মা! আপনি তো জানেন না। আজকালকার মেয়েরা স্যারদের উপর ক্রাশ খায়। আর ভার্সিটিতে কতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে। জারিফকে তো আমরা বিয়ে দিবো। তাই মেয়ে খোঁজাটা যদি ও ওর পছন্দে করে তাই আর কী!”
তরুণীমা বেগম তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় তা দেখে তামান্না চুপ মে*রে যায়। তরুণীমা বেগম বলেন,
“যে আসার সে এমনিতেই আসবে। জারিফ ভার্সিটিত। ক্লাস নিতে যায়। স্টুডেন্টদের পড়াতে যায়।”
তিনি এবার জারিফকে জিজ্ঞেস করেন,
“হ্যাঁ রে, কেমন গেলো প্রথমদিন? সব ঠিক ছিল তো?”
জারিফ আলতো হেসে বলে,
“হ্যাঁ মা। সব ঠিক ছিল। প্রথমদিন তো ইন্ট্রোডাক্টরি ক্লাস। ভালোই গিয়েছে। বাবা কই মা? ভাইয়া আর তুতুল?”
জারিফের মা হেসে বলেন,
“তোর বাবা, ভাই, ভাইপো সবাই হাঁটতে বেরিয়েছে। বাবা-ছেলে-নাতি সব একসাথে গেছে। তুতুল দুইজনের হাত ধরে গেছে।”
তামান্না বলে,
“আমি তো মাকেও বলেছিলাম। শীতের বেলা হাঁটতেই তো মজা। কিন্তু মায়ের আবার হাঁটুতে ব্যাথা। দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ তেল মালিশ করলাম।”
জারিফ চিন্তিত হয়ে বলে,
“শীতকালে হাঁটুর ব্যাথা ঠান্ডার কারণে আরও বাড়বে। ঘরের ভিতর মোজা পরে থাকবে কতোবার বলবো তোমায়? ঔষুধ গুলোও তো ভাবি মনে না করালে ঠিক মতো নেও না।”
জারিফের মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“নেই তো। তোর বউ এলে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। তখন দুই ছেলের বউ আমার খেয়াল রাখবে।”
তামান্না মাঝ থেকে বলে উঠে,
“মা আপনার নিরামিষ মা*র্কা ছেলের সাথে কথা বলে যেকোনো মেয়ে বোর হয়ে যাবে। আমার তো কস্ট হচ্ছে বেচারা স্টুডেন্টগুলোর জন্য! কি যে বোরিং কা*টবে ওদের ক্লাসগুলো! আল্লাহ জানে।”
জারিফ তার ভাবির দিকে তাকালে তার ভাবি মেকি হেসে বলে,
“যাই নাস্তা বানাই।”
তামান্না মানে মানে করে সরে যায়। জারিফ একটু কম কথা বলা টাইপ। কাজের বাহিরে খুব একটা কথা বলে না মানে তামান্না এই কয়দিনে দেখেনি। জারিফ বিদেশ থাকাকালীন তামান্না জারিফের বড়ো ভাই জায়ানের বউ হয়ে এসেছে। জারিফ সারাক্ষণ নিজ ঘরে লাইব্রেরিতেই থাকে।
জারিফ ওর মাকে বলে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,