#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৫
দেখতে দেখতে আরও অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। প্রিয়াদের মিড২ পরীক্ষাও শেষ। জারিফ ও প্রিয়ার আনুষ্ঠানিক বিয়ের লগ্নও নিকটবর্তী। মাস খানেকের মত সময় অবশিষ্ট আছে। বিয়ের তোরজোরও চলছে সমানতালে। ইতোমধ্যে ভার্সিটিতে জারিফের কলিগরা সবাই জেনে গেছে প্রিয়া ও জারিফের সম্পর্কে। তারা জারিফকে এই নিয়ে কুমন্তব্য করেনি। অভিনন্দন জানিয়েছে। জারিফ প্রিয়ার পরীক্ষার খাতাও নিজে দেখেনি। দেখিয়েছে চেয়ারপার্সন স্যারকে দিয়ে। জারিফের এইসব কাজে অন্য কলিগরা মুগ্ধ হয়েছেন যদিও এসব কাজের কোনো প্রয়োজন ছিল না।
গতকাল রাতে প্রিয়া জারিফের কাছে একটা আবদার করেছে, তাকে নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে ঘুরতে যেতে হবে। তার রিলেশনশিপে থাকা বান্ধুবীরা কতো ছবি স্টোরি দেয় আর সে বিবাহিতা হয়েও পারেনা। অভিমান নিয়েই জারিফকে বলেছিল কিন্তু জারিফ সেই অভিমান ভাঙাতে রাজী হলেও ছবি স্টোরি দেওয়াটা সমর্থন করলো না কারণ এখনও সবাই জানেনা প্রিয়া ও জারিফ স্বামী-স্ত্রী। প্রিয়া সেই থেকে মুখ গোমড়া করে আছে। জারিফ সকালে ভার্সিটিতে এসে প্রিয়াকে তার অফিসরুমে আসতে বলেছে আর প্রিয়া এখনও যাচ্ছে না। মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। নিশি, মিম, অর্ষারা বুঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
“যা দোস্ত। স্যার তো ঠিকই বলেছে তাই না? বুঝ একটু।”
“তোদের স্যার ভুলটা কখন বলে সেটা বল! এখন বান্ধুবী পর হয়ে গেলাম! আর এদিকে দেখ, শিফা রূপারা আমার একমাত্র বরের উপর ক্রা*শের উপর ক্রা*শ খেয়েই চলেছে। ওদের ব*দ নজরে আমার বরের যদি কিছু হয়! কালকেও রূপাকে ওসব বলতে শুনেছি। কতো কল্পনা ঝল্পনা তাদের আমার বর নিয়ে!”
প্রিয়ার দুঃখ ভরা বচন শুনেও ওদের মনে দুঃখের লেশমাত্র পরিলক্ষিত হলো না। তার বদলে সমস্বরে হাসির রেশ উঠলো। প্রিয়া ওদের হাসতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
“তোরা হাসছিস! কেমন ফ্রেন্ডরে তোরা! ধ্যাত! কেউ আমাকে পাত্তাই দেয় না।”
মিম বলে উঠে,
“ক্রা*শ যত ইচ্ছা ততো খাক! একমাস পরে সেই ক্রা*শ বাঁ*শে পরিণত হবে ওদের। তুই শুধু শুধু ইনসিকিউর হচ্ছিস। এখন যা স্যার কখন ডেকে পাঠিয়েছে।”
প্রিয়া উঠেই যাচ্ছিলো হুট করে আয়ানের দিকে নজর গেলো। কেমন নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে ছেলেটা। দৃষ্টি নিচের দিকে। প্রিয়া আয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আর আয়ান তুইও! সাজেক থেকে আসার পর থেকে আমার সাথে তোর একটা শব্দ বিনিময় হয়েছে বলে মনে পরছে না। মানলাম তুই কম কথা বলিস কিন্তু এতো কম! ভাই তুই কি ছ্যাঁ*কা খেয়েছিস নাকি? সাজেকে কোনো হৃদয়হরণীর দেখা পেয়েছিলি? তো কে সে? যার বিরহে তুই একদম মিইয়ে গেছিস! আমাদেরও বল।”
আয়ান প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো অতঃপর স্বল্প শব্দে বলল,
“সেরকম কিছু না। স্যার ডেকেছেন তুই যা।”
প্রিয়া কিছু সেকেন্ড আয়ানের দিকে তাকিয়েও ব্যাপারটা বুঝে উঠলো না। হাঠাৎ ফোন ভাইব্রেট করে উঠলে প্রিয়া ফোনে জারিফের মেসেজ “তুমি কি আসছ?” দেখে জলদি করে ওদেরকে হাতের ইশারাতে বলে করিডোরের দিকে দৌঁড় দিলো। প্রিয়া যেতেই আয়ানের হুট করে এতোদিন পর পিহুর কথা মনে পরে গেলো। মেয়েটার কথা মনে পরার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ও অর্থ নিজের মনে খুঁজে পেলো না সে। কারণ ছাড়াই হেসে উঠলো। রাদ ও সাদ আয়ানকে হাসতে দেখে মলিন হাসলো।
______
“তোমার অভিমান কি কিছুটা হলেও কমেছে? কমে থাকলে আমি তোমায় কিছু বলতাম।”
জারিফের আদুরে স্বরে প্রিয়া আঁড়নজরে তাকালো। জারিফের অফিসরুমে এসে সে কয়েকমিনিট মুখ ঘুরিয়ে গালে হাত দিয়ে বসেছিল। এবার জারিফের কথাতে সে চোখের ইশারায় সায় দেয়। জারিফ বলে,
“এখন আমরা যেখানেই ঘুরব তার সব ছবি একমাস পরে সুন্দর একটা ভিডিও বানিয়ে স্টোরি দিতে পারো। রিক্রিয়েট দ্যা মোমোরি। আইডিয়াটা কেমন?”
প্রিয়া কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর বলে,
“আচ্ছা। কিন্তু আমার কিছু বলার আছে।”
“বলো।”
“আপনি কাল থেকে শিফা, রূপাদেরকে ক্লাসে একদম পাত্তা দিবেন না। ওদের সাথে রুডলি কথা বলবেন। ওদের সামনে হাসবেন না। চুলে হাত বুলাবেন না। পকেটে হাত গুঁজবেন না।”
জারিফ ভ্যাবলার মতো প্রিয়ার মুখপানে চেয়ে আছে আর প্রিয়া খুব সুন্দর করে মুচকি হাসিতে তাকিয়ে আছে। কিয়ৎক্ষণ পর জারিফ হালকা কেশে বলে,
“স্টুডেন্ট হিসেবে তারা প্রশ্ন করে আমি উত্তর দেই। এইতো!”
“না এইতো না। ওরা আপনাকে নিয়ে কী ভাবে আমি জানি। ওই চু*রা*য়েল গুলোকে আমি নর্দ*মাতে চু*বাবো! ওদের আমি রুফটপে নিয়ে ফেলে দিবো!”
জারিফ চোখ বড়ো বড়ো করে আতর্কিত হয়ে বলে,
“হেই রিল্যাক্স! যে যা খুশি ভাবুক। ওদিকে তোমার ভাবার দরকার নেই। ক্রা*শ এখন অহরহ মানুষ খায়। সো রিল্যাক্স।”
প্রিয়া আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিলো। জারিফ হতাশ কন্ঠে বলে,
“আমাকে আমার প্রফেশনের জন্য রুডনেসটা আনা যাবে না। ইউ হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড। ক্লাসের পর ওয়েট করবে। রবীন্দ্র সরোবরে যাবো। এখন তোমার ক্লাস আছে না?”
প্রিয়া জবাব না দিয়ে জারিফের দিকে অভিমানী নজরে তাকিয়ে চলে গেলো। প্রিয়া রুম থেকে বেরিয়ে গেলে জারিফ ঘার নুইয়ে হাসে। বাহিরে গিয়ে প্রিয়াও মুখে হাত দিয়ে হাসে। সে তো এতক্ষণ জারিফের সাথে অভিমান করার অভিনয় করছিল। জারিফকে এই সামান্য পেরেশান হতে দেখে প্রিয়ার কেনো জানি জারিফের কেয়ারিং ভাবটা অনুভব হচ্ছিলো।
————-
ক্লাস শেষে প্রিয়াকে নিয়ে জারিফ রবীন্দ্র সরোবরে যায়। সেখানে গিয়ে প্রিয়া নিজে জারিফের হাত ধরে হাঁটছিল। জারিফের হাতের দিকে তাকালে প্রিয়া ফিসফিস করে বলে,
“এখানে সব কাপলরা হাত ধরেই হাঁটছে দেখেছেন? আমরা হাত ধরে না হাঁটলে কেমন দেখায় না?”
চলতে চলতে জারিফ আলতো হেসে বলে,
“দুইদিন ধরে তুমি উইয়ার্ড বিহেভ করছো না? জাস্ট আস্কিং। নাকি জেলাসির কারণে?”
প্রিয়া জারিফের হাত ছেড়ে দিয়ে কোমড়ে হাত গুঁজে জারিফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে সতর্ক স্বরে বলে,
“কী বললেন আপনি? যান যাবোই না আপনার সাথে। হুহ্!”
প্রিয়া এই বলে একা একাই সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জারিফ কপাল চাঁ*পড়ে প্রিয়ার পেছোনে ছুটতে থাকে। শেষে এক ফুল বিক্রেতাকে দেখে তার কাছ থেকে টকটকে লাল গোলাপ ও একটা কাঠগোলাপের গাজরা নিয়ে প্রিয়ার অভিমান ভাঙাতে উদ্ধত হলো।
“কাঠগোলাপের স্নিগ্ধ শুভ্রতায় আকর্ষিত হয়ে,
আমার ভালোবাসার রঙে রাঙানো
গোলাপ তোমার জন্য হৃদপ্রিয়া!”
জারিফের বলা ছন্দে প্রিয়ার অধরে ব্রীড়া মিশ্রিত হাসির ঝিলিক ফুটলো। প্রিয়া গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে জারিফের দিকে পেছোন ঘুরে ঘার ঘুরিয়ে বলে,
“পরিয়ে দিন।”
জারিফ হালকা হেসে প্রিয়া খোলা চুলে ক্লিপের সাহায্যে কাঠগোলাপের গাজরাটা পরিয়ে দেয়। প্রিয়া এবার জারিফের দিকে ঘুরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি দিনদিন অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছেন জানেন স্যার? ভাইয়া বলেছিল, আপনি প্রেম-ভালোবাসা বুঝেন না। তবে আপনার প্রেমিক হৃদয়ের সাথে সাক্ষাত আমার হয়েছে।”
জারিফ বিনিময়ে হাসলো। এবার নিজেই প্রিয়ার হাত মুঠোবন্ধি করে গোধূলি উপভোগ করছে। প্রিয়া লাজুকলতার ন্যায় লাজরাঙা হয়।
_______
আঁধার অম্বরে একফালি বাঁকা চাঁদের দিকে আয়ান হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। আজ তার পিহুর কথা মনে পরছে। সাজেকে ঘটা প্রতিটা ঘটনাচক্র অক্ষিপটে ভেসে উঠছে। আচ্ছা! মেয়েটা কী তার জন্য অপেক্ষা করেছিল? জানিয়ে আসা হয়নি তো। ছটফটে মেয়েটার কী মন খারাপ হয়েছিল? ভেবেই আয়ান আরেকদফা নিরব হাসে। আয়ান ভেবেছে সে সেমিস্টার ফাইনালের পর খাগড়াছড়ি যাবে। তন্নতন্ন করে হলেও খুঁজে বের করবে উড়নচ*ণ্ডীকে! তারপর বলবে,
“সরি না বলে চলে যাওয়ার জন্য। তাই বলতে এলাম!”
আপনমনেই হাসে আয়ান। কীসব ভাবছে সে! মেয়েটার কথাবার্তাগুলো চমৎকার। আয়ানের মন ভালো করে দিয়েছিল।
এদিকে পিহু সেদিনের পর থেকে মুখ ভাড় করে থাকে প্রায় সময়। ওর বাবা ওকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল কারণ তখন পিহু এইচএসসির পর ঢাকা গিয়ে কোচিং করার ইচ্ছা পোষণ করে। পিহু মোটামোটি লেভেলের স্টুডেন্ট। তাই সে পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার আশাও রাখেনা। প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়লে আয়ান যেখানে পড়ে সেটাতে পড়তে চায়। তার বাবাকে সেই ভার্সিটির নামটাও বলেছে। একমাত্র আদুরে কন্যার আবদার ফেলতে পারেননি পিহুর বাবা। এমনেতেও তিনি পিহুকে প্রাইভেট ভার্সিটিতেই পড়াতেন কিন্তু অতোদূরে মেয়েকে ছেড়ে থাকতে তাদেরও কস্ট হবে। পিহু সেই থেকে আয়ানের সাথে আবারও এক নতুন শহরে নতুন করে দেখা হওয়ার আশায় বুক বাঁধে। তার হৃদয়ে লুকানো প্রেমের মঞ্জিল সে হাসিল করবেই।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,