হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব ২৪

0
668

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৪
লজ্জায় আড়ষ্ট হলো প্রিয়া। নিরবতায় বারবার জারিফের বলা কথাটা কানে বাজছে। জারিফ প্রিয়ার গুটানো হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। হঠাৎ করে হাত রাখায় প্রিয়া হালকা কেঁপে উঠলো। হাত ধরা অবস্থায় জারিফ কম্পন অনুভব করলে নিঃশব্দে হাসে। জারিফ উদাসী কন্ঠে বলে উঠে,

“আচ্ছা? মানুষ কেনো ভালোবাসে? যদি তাতে কস্টের পরিমানটাই বেশি থাকে! ভালোবাসুক এমন কাউকে যাকে ভালোবাসলে কস্টের পরিমানটা সামান্য থাকবে। আমার ভাষ্যমতে, মানুষ ভালো থাকার জন্য ভালোবাসে। নিজের জন্য ভালোবাসে। নিজে কস্টে থাকবে এমন কাউকে ভালোবাসাটা আমার কাছে কেমন যেনো লাগে। অবশ্য আমার প্রেম-ভালোবাসার পূর্ব অভিঙ্গতা নেই তাই জানিনা সঠিক।”

প্রিয়া জারিফের হাতটা আগলে বলে,
“এটা ঠিক যে মানুষ নিজের জন্য ভালোবাসে। নাহলে একজনের জন্য অনেকেই দিওয়ানা থাকে কিন্তু সে তো সবার ভালোবাসাকে গ্রহণ করতে পারে না। যাকে তার ভালো লাগে তাকেই সে ভালোবাসে। আর ভালোবাসলে কস্ট থাকবেই।”

জারিফ হতাশ স্বরে বলে,
“জীবনে অনেক ব্রেকআপ দেখেছি। কানাডাতে দেখেছি ওরা মিউচুয়ালি ব্রেকআপ করে নিচ্ছে। কেউ কাউকে ফোর্স করছে না। সম্পর্ক আর ভালো লাগছে না তাই ব্রেকআপ। আমাদের এখানে ব্রেকআপ হলে একজন আরেকজনের মুখ দর্শণও করেনা কিন্তু কানাডাতে এমন না। ওরা একে অপরের সাথে নরমালি কথাও বলে। কিছু এক্সেপশনালও ছিল।”

প্রিয়া হুট করে বলে বসে,
“আপনার মুন্নির জন্য খারাপ লাগছে? আর এখানে আজকে আসার কারণও মুন্নি তাই না?”

জারিফ নিশ্চুপ রইল। প্রিয়ার প্রশ্নের জবাব প্রিয়া সরাসরি না পেলেও নিরবতাই জবাব দিয়ে দিয়েছে। প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“সে যখন থেকে আপনাকে ভালোবাসে তখন আপনার জীবনে আমার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আপনার কারও সাথে মন দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কও ছিল না। এখন তার মন ভাঙার ব্যাথা আমি, আপনি বুঝব না কারণ তার স্থানে আমরা নেই। আমরা আছি বিপরীত স্থানে। চাইবো, মুন্নি জীবনে কাউকে পাক যে ওকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোবেসে সযত্নে রাখবে।”

আকাশের রূপালি থালার মতো চাঁদটা বড্ড সুন্দর। চন্দ্রমা জ্বলমল করে তার টিমটিম জোৎসনায় ধরিত্রীর অন্ধকারকে কাটানোর প্রয়াসে ব্যাস্ত। বারান্দায় থাকা তিন রকমের গোলাপ গাছে দুটোতে ফুল ফুটেছে। গোলাপি ও সাদা গোলাপ। গোলাপের সুবাসে মোহিত চারিপাশ। আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে প্রিয়া বলে,

“ঘরে চলুন। রাত বাড়লে শীত শীত লাগবে।”

“আজ রাতটা বারান্দায় কাটালে মন্দ হয় না। আমার ভালোই লাগছে।”

প্রিয়া হালকা হেসে বলল,
“ভালো লাগলেও এখানে কম্ফর্টেবল ভাবে তো থাকার জন্য যোগাড় নেই। তাছাড়া আমার কিছু প্রবলেমও আছে।”

জারিফ জিজ্ঞেস করে,
“কী প্রবলেম?”

“ঠান্ডা লেগেছে!”

“তুমি অনেক কেয়ারলেস। ঠান্ডা লেগেছে তা এতক্ষণ পর বললে। রুমে চলো।”

রুমে প্রবেশ করে জারিফ বিছানার একপাশে বসলো। প্রিয়ার কেমন অস্বস্থি হচ্ছে। এক বিছানায় ঘুমাবে ভেবেই বিছানার কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তারউপর শাড়ি এদিক সেদিক হলে লজ্জায় শেষ হওয়ার মতো অবস্থা হবে। জারিফ ল্যাপটপ খুলে বসে প্রিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে ল্যাপটপে মনোনিবেশ করে বলল,

“তুমি শাড়িটা চেঞ্জ করে আসতে পারো। অ্যাই থিংক ইউ আর নট কম্ফর্টেবল। নার্ভাসও দেখতে লাগছে তোমাকে।”

প্রিয়া জারিফের আচানক কথায় হকচকিয়ে উঠে। লোকটা তার মনের অবস্থাও বুঝে ফেলেছে। অবশ্য তার নার্ভাসনেস চেহারাতে পরিলক্ষিত। প্রিয়া দ্রুত শাড়ি বদলাতে চলে যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে ভাবলো গোসল করবে! সকালে গোসল করে গেছে তাছাড়া এখন অস্থীরতা কমানোর উপায় হিসেবে প্রিয়ার মা*থায় গোসলের চিন্তাই আসছে। তাই একেবারে গোসল করেই বেরোয়। জারিফ এদিকে কাজে ডুবে আছে। পরবর্তী ক্লাসের লেকচার তৈরী করছে। প্রায় পনেরো মিনিট পর প্রিয়া চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরোয়। তারপর জারিফের সামনে দিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে চুল ঝাড়া দিলে জারিফের চোখে মুখে পানির ছিঁটা যায়। জারিফ পাশে তাকালে দেখে প্রিয়া চুল ঝাড়ছে। জারিফ স্বিয় স্ত্রীর এই দৃশ্য মুগ্ধ চিত্তে অবলোকন করে। সদ্য স্নানে হালকা গোলাপি থ্রিপিসে প্রিয়াকে জারিফের কাছে সদ্য পরিষ্ফুটিত গোলাপের ন্যায় লাগছে। প্রিয়ার চুল ঝাড়া শেষ হলে মুখে ও হাতে-পায়ে ক্রিম ও লোশন লাগিয়ে নেয়। সব কাজ শেষে আয়নার মাধ্যমে জারিফের দিকে নজর গেলে জারিফকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখলে প্রিয়া আবারও লজ্জা পায়। আজ যেনো ওর লজ্জা দিবস! প্রিয়ার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলে জারিফ হালকা কেশে জিজ্ঞেস করে,

“এই রাতের বেলা শাওয়ার নিলে যে? তোমার না ঠান্ডার প্রবলেম?”

প্রিয়া কী জবাব দিবে ভেবে ভেবে একটু দেরী করে আমতা আমতা করে বলে,

“ওই আসলে অনেক সকালে শাওয়ার নিয়েছিলাম আর সারাদিনের ক্লান্তি তাই। একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য আরকি!”

“ওহ আচ্ছা। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পরো। আমার আরেকটু কাজ বাকি।”

প্রিয়া চটপট বিছানায় কম্বল গায়ে দিয়ে ভেজা চুলেই শুয়ে পরলো। প্রিয়ার এই তৎপরতা দেখে জারিফ আনমনে হাসলো। মেয়েটা যে কী কারণে নার্ভাস তা জারিফ প্রথমেই বুঝে গিয়েছিল।

_________

রাতের খাবারের সময় সবাইকে অবাক করে মুন্নি সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে,

“আমি কালকেই দিনাজপুর ফিরতে চাই।”

মুন্নির ফোলা ফোলা র*ক্তলাল আঁখিজোড়া দেখে যেকেউ বলে দিতে পারবে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেঁদেছে। মুন্নির মা জমিলা বেগম উঠে মেয়ের কাছে গিয়ে মেয়ের গা*লে দুই হাত দিয়ে আগলে বলেন,

“তুই ঠিক আছিস মা? চোখের কী বাজে অবস্থা। তোর উপর কী যাচ্ছে তা মা হিসেবে কিছুটা হলেও আমি উপলব্ধি করতে পারি।”

“আমি আগামীকালই বাড়ি ফিরতে চাই মা। সকাল সকাল বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবো।”

জায়েদ সাহেব ভাগনির বেদনাতুর নয়নযুগল দেখে ও শক্ত কন্ঠস্বর শুনে বলেন,

“কালই তো এলে। আরও কয়েকদিন থেকে যাও। তুমি যেহেতু বুঝতে পেরেছ তাতেই আলহামদুলিল্লাহ্‌। ”

“আমার এই বুঝ কতক্ষণ স্থায়ী হবে তার সময়সীমা আমি বলতে পারিনা। তোমার ছেলেকে দেখলেই হয়তো আমার সব বুঝ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। আমি আবারও তার জন্য পা*গলামী করব। তার থেকে ভালো, আমি চলে যাই। দূরে থাকি। শুধু শুধু তার বিরক্তির কারণ নাহয় না হলাম। আমার কারণেই যে সে আজ বাড়ি ফিরল না তাও আমি বুঝি। দোষটা আমার কারণ আমি ভালোবেসেছি। তোমাদের ছেলের কোনো দোষ নেই। আমি আগামীকাল দিনাজপুর ফিরে যাবো। সামনে আমার পরীক্ষাও আছে।”

তরুণীমা বেগম ও তামান্না কিছু বলল না। তরুণীমা বেগম ছেলের মনের বিরুদ্ধে যেতে চাননি নয়তো জারিফ রাজি থাকলে পুত্রবধূ হিসেবে নিজের পছন্দ না হওয়া স্বত্বেও মুন্নিকে বউ করে আনতেন। জায়ান বলে,

“যেহেতু মুন্নি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে তাহলে চলে যাক। সত্যি সামনে তো ওর পরীক্ষা। তাছাড়া শুধু শুধু এখানে থেকে কস্ট না পাওয়ার থেকে দূরে গিয়ে কিছুটা ভালো থাকাটাও উত্তম। আমি তবে রাতের টিকিট কা*টি।”

“না! সকালের। সকালের টিকিট কা*টো ভাইয়া। আমি তার দৃষ্টির আড়ালেই চলে যেতে চাই। মানুষের মন তো! যদি আবার বেঁকে বসে!”

মুন্নি এই বলে দৌঁড়ে আবার গেস্টরুমে চলে যায়। জমিলা বেগমও উঠে যান মেয়ের পিছু পিছু। তামান্না দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে যা করতে চেয়েছিল তা হয়েছে কিন্তু খারাপও লাগছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ্,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here