#হৃদয়ে_আগন্তুক
#ফরহাদ_হোসেন
#গল্প
পর্ব-৬
হাসান তার অফিস রুমে বসে কাজ করছে। সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে দরজার দিকে। এখন প্রায় মাঝ দুপুর। অথচ রূপা একবারের জন্যেও বের হয়নি। সে কি এখনো ঘুমুচ্ছে। হাসান একবার ভাবল ডেকে তুলবে কিনা। তারপর ভাবল, থাক—যখন ওঠার উঠুক।
রূপা দুপুর পর্যন্ত তার রুমের ভিতরেই থাকল। যদিও তার ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক আগেই। কিন্তু দুপুরের পরে তার প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হলো। সম্ভবত এতক্ষণ না খেয়ে থাকার জন্যে। সে রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে ঢুকল তারপর নিজে থেকেই এক কাপ চা বানিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়াল।
তিথিদের বাসার ব্যাকইয়ার্ডের একটা অংশ ঢালু হয়ে নীচে নেমে গেছে। নীচে নামার জন্যে আবার কয়েক ধাপের ইটের সিঁড়ি দেয়া আছে। রূপা প্রথম সিঁড়িটার উপরে বসে দূরের বাড়ি গুলির উপর দিয়ে লেকের দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিল।
কিছুক্ষণ পর হাসান এসে দাঁড়াল রূপার পাশে। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার শরীর ঠিক তো?’
রুপা বলল, ‘হ্যাঁ। কেন হাসান ভাই?’
‘না মানে এত দেরী করে বের হলে তাই ভাবলাম…’
‘এমনিই একটু মাথা ব্যথা করছিল।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রূপা আবার বলল, ‘আপনাদের বাসার ব্যাকইয়ার্ডটা খুব সুন্দর। এখানে বসে থাকতে বেশ লাগছে।’
‘হুমম।’
রূপা অবাক হলো। সাধারনত কেউ কোনো কিছুর প্রশংসা করলে উত্তরে ধন্যবাদ জানানো একটা সাধারন ভদ্রতা। কিন্তু হাসান কিছুই বলল না।
হাসান আর কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। রূপার মনে হলো হাসান কিছু হয়ত বলতে চায় কিন্তু বলছে না। সে বলল, ‘কাল আকাশের সঙ্গে এভাবে চলে যাওয়ায় আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?’
‘রাগ করবো কেন? তোমার উপর রাগ করার অধিকার কি আমার আছে?’
‘মানে?’
‘মানে তো সহজ রূপা, কারো উপর রাগ করতে হলে রাগ করার অধিকার তো থাকতে হবে, তাই না? তোমার উপর রাগ করার কোন অধিকার নিশ্চয়ই আমার তৈরী হয় নি!’
‘হলে করতেন?’
হাসান সে কথার কোন উত্তর দিল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাসান বলল, ‘আকাশের সঙ্গে তোমার কি কথা হলো?’
‘এক যুগ পরে দেখা হলে যে ধরণের কথা হয়, তেমনই। না চাইতেও পেছনের অনেক কথাই বলতে হলো। আমি কেন বিয়ে করি নি, পার্থকে এখনো ভুলতে পেরেছি কী না, ইত্যাদি।’
‘ও তোমাকে ভালবাসতো তাই না?’
‘কে?’
‘আকাশ!’
‘একথা আপনার মনে হলো কেন?’
‘কাল ওর চোখে যে আনন্দ আমি দেখেছি—তাতে করে নিশ্চিত বলে দেয়া যায় যে, সে তোমাকে খুবই পছন্দ করতো।’
‘হয়ত করত। আমরা খুব ভাল বন্ধু ছিলাম।’
‘হয়ত বলছ কেন? তুমি জানতে না?’
‘জেনেছিলাম—হঠাৎ করে ওর হারিয়ে যাবার অনেক পরে এবং সেটা পার্থর কাছ থেকেই।’
‘আকাশ বিয়ে করে নি?’
‘করেছিল, একটা মেক্সিক্যান মেয়েকে। কিন্তু বিয়েটা বেশিদিন টিকেনি। এখন সিঙ্গেল।’
‘ও!’
হাসানকে দেখে মনে হচ্ছে তাকে একধরনের অস্থিরতা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সে একবার রূপার পাশে গিয়ে বসল। তারপর আবার উঠে দাঁড়াল। সিঁড়ির দু ধাপ নীচে নেমে ঘুরে দাঁড়াল রূপার দিকে। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘রূপা তোমাকে আমার কিছু কথা বলা দরকার।’
রূপা থমকে গেল। তারপর আস্তে করে তাকাল হাসানের চোখের দিকে—একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে।
‘আমি জানি না আমি যা বলতে চাই, ঠিকমত বোঝাতে পারব কিনা। তবু চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই।’
হাসানের ভুমিকা রূপাকে দ্বিধায় ফেলে দিল। সে চুপকরে মুল কথা শোনার অপেক্ষায় রইল।
একটা দীর্ঘ বিরতি দিয়ে হাসান বলল, ‘তুমি একটা চমৎকার মেয়ে। যে কোনো ছেলেরই তোমার সঙ্গ ভাল লাগবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা বলতে দ্বিধা নেই তোমাকে আমারো ভাল লেগেছে—আমার কিছু অসংলগ্ন আচরনে তোমার কাছে মনে হতে পারে—আমি হয়ত তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছি। ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন।’
এটুকু বলে হাসান একবার রাস্তার দিকে তাকাল। তারপর আবার শুরু করল, ‘আমারো সব সময় ইচ্ছে করে তিথিকে নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াতে। সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখতে। কিন্তু অফিস, সংসার আর তিতলি’র বাইরে ওর জগতে আর কিছুই নেই—আর কিছুই ভাবতে পারে না। আমরা একসাথে শেষ কবে ঘুরতে গিয়েছি মনে নেই। কতবার ওকে নিয়ে মুভি দেখতে চেয়েছি—কখনই হয়ে উঠেনি।’
থেমে থেমে হাসান বলে চলল, ‘সাধারনত হাজব্যান্ডরা ব্যস্ত থাকে—স্ত্রীদের সময় দিতে পারে না, অথচ আমাদের হয়েছে উলটো। তাই তোমাকে নিয়ে যখন ঘুরতে বেরিয়েছি—আমার কাছে অন্যরকম মনে হয়েছে। অন্যরকম একটা ভাললাগা কাজ করেছে। ক্ষণিকের জন্য হলেও তিথির অভাব আমি বুঝতে পারিনি। আই অ্যাম সরি বাট আই মাস্ট কনফেস!’
রূপা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়—হাসান আসলে কি বোঝাতে চাচ্ছে।
হাসান আবার বলল, ‘তুমি হয়ত ভাবছ, এসব কথা আমি কেন বলছি? এগুলো কিন্তু কোনো অযুহাত নয়। নিজেকে স্বচ্ছ প্রমান করার কোনো চেষ্টাও নয়। তুমি স্মার্ট মেয়ে, আমি জানি তুমি জানো আমি কি বলতে চাচ্ছি। আমার কোন ব্যবহারে তুমি যদি কষ্ট পেয়ে থাকো, তার জন্যে আমি দুঃখিত। আই অ্যাম ট্রুলি সরি।’
রূপা কি বলবে ভেবে পেল না। সে চুপ করেই রইল।
‘তিথি অত্যন্ত ভাল মনের একটা মেয়ে। অসম্ভব কেয়ারিং-পুরো সংসার, তিতলির স্কুল-হোমওয়ার্ক সব কিছু ও একাই সামাল দেয়। মাসের একটা লম্বা সময় আমাকে বাইরে থাকতে হয়—সে একা মেয়েকে নিয়ে থাকে। একা হাতেই সব কিছু আগলে রেখেছে। ওর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমার কিছু ভুলের কারণে ও কষ্ট পাচ্ছে—’
হাসান আর কিছু বলল না। সে চুপ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল।
হাসানের কথায় রূপার মনটা একটু খারাপ হলো। এবার সে হাসানকে নিশ্চিত করার জন্য বলল, ‘আমি বুঝতে পেরেছি হাসান ভাই। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। বরং আমারই উচিত আপনাকে ধন্যবাদ জানানো—আমাকে সময় দেবার জন্যে। আমারো অনেক ভাল লেগেছে। সত্যিকার অর্থেই আমি ভাবতে পারিনি আমার সময়টা এত ভাল কাটবে। আপনারা দুজনেই আমার জন্যে যা করলেন—তার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ।’
রূপা উঠে দাঁড়িয়ে হাসানের পাশে দাঁড়াল। তারপর হাসানের হাত ধরে আস্বস্ত করার জন্যে একটা ঝাকি দিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ হাসান ভাই—থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভ্রিথিং।’
তিথি দেখল রূপা হাসানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
গত কয়েকদিনের বিক্ষিপ্ত ঘটনা, সব কিছু মিলিয়ে আজ সকাল থেকেই তিথির মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। অফিসে যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু কিছু দরকারী কাজ যে গুলো তিথিকেই করতে হতো তাই অনিচ্ছা সত্বেও সে অফিসে গেল। রূপাকে সময় দেয়া হচ্ছে না, এই ব্যাপারটা নিয়েও তার মন খারাপ। তাই ভাবল আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে দুই বান্ধবী মিলে জম্পেস আড্ডা দিবে। রূপাকে নিয়ে হাসানের বাড়াবাড়িটাও ওকে ভাবাচ্ছে। মনটা খচ-খচ করছে। কিন্তু হাসান তো এমন তরল চরিত্রের মানুষ ছিল না কখনই—সে তাকে চিনে। তারপরেও মানুষের মন বলে কথা।
তিতলিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে পৌছেই দ্রুত হাতের কাজ গুলো সেরে ফেলার চেষ্টা করল তিথি। কয়েকটা ক্লায়েন্টের ফোন কল ছিল—সে গুলো করল। কয়েকটি ইমেইল রিপ্লাই করল। দুটো টিকেট চেঞ্জের রিকোয়েষ্ট ছিল, সেগুলো করে ক্লায়েন্টকে নতুন কনফার্মেশন ইমেইল করতে করতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। তিথি ওর অফিস ম্যানেজারকে বলে লাঞ্চ ব্রেকে বাসায় ফিরে এলো।
ঘরে ঢুকে তিথি দেখল বাসায় কেউ নেই। হাসান নেই ওর অফিস রুমে। রূপার রুমও খালি। তিথি ভাবল হাসান হয়তো রূপাকে নিয়ে লাঞ্চ করতে বাইরে গেছে কেননা ফ্রিজে দু’দিনের পুরনো খাবার ছাড়া তেমন কিছুই নেই। খাবারের কথা মনে হতেই সে কিচেনে গেল। ফ্রিজ থেকে পুরনো খাবার বের করে গরম করার জন্যে মাইক্রোওয়েভে ঢুকিয়ে কিচেনের জানালা দিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে তাকাল এবং সঙ্গে সঙ্গে রক্ত শূন্য হয়ে গেল তার মুখ। তিথি সরে এসে ঘরের পেছনের কাঁচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আবার দেখল রূপা আর হাসানকে—হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। তিথি কাল বিলম্ব না করে বের হয়ে এলো তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকল, ‘হাসান!’
হাসান আর রূপা দুজনেই চমকে ঘুরে তাকাল। দেখল তিথি দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিয়ে দুজনেই অপ্রস্তুত ভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
(চলবে…)