#হৃদয়ে_আগন্তুক
#ফরহাদ_হোসেন
#গল্প
পর্ব-৩
তিথির সামনে একজন ক্লায়েন্ট বসে আছে। সকাল থেকেই সে ব্যস্ত। অনেকক্ষণ থেকে ভাবছে হাসানকে একটা ফোন করা দরকার। তাকে বলতে হবে–ঘুম ভাঙ্গলে রূপাকে যেন ঠিকঠাক মত চা-কফি কিংবা নাস্তার ব্যবস্থা করে দেয়। তিথির নিজেরও খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছে। অথচ কলিং বেল টিপে কাউকে ডেকে যে এক কাপ কফি চাইবে তারও উপায় নেই। দেশটার নাম আমেরিকা। এখানে যার যার কাজ তাকেই করতে হয়। তার নিজের জন্যে এক কাপ কফি এখনো সে বানাতে পারেনি। ব্রেক রুমে যাবারও সময় পাচ্ছে না।
হাসান তার কনফারেন্স কল শেষ করে ল্যাপটপে একটা রিপোর্ট তৈরী করছিল। হঠাৎ সে শুনতে পেল, ‘গুড মর্নিং!’
হাসান ঘার ঘুরিয়ে দেখল রূপা দাঁড়িয়ে আছে। রূপা নাইটি ছেড়ে একটা হালকা তাঁতের শাড়ি পড়েছে। আকাশি রঙের শাড়িতে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে রূপাকে। হাসান বলল, ‘গুড মর্নিং! তারপর মিস রূপা, আমেরিকায় তোমার প্রথম রাত কেমন কাটল? ঘুম হয়েছে ঠিক মতো?
রূপা বলল, ‘শেষের দিকে হয়েছে একটু। পুরা রাত অবশ্য জেগেই ছিলাম।’
‘জেটল্যাগ। দু’একদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
রূপা চারিদিকটা একটু দেখে নিয়ে বলল, ‘আপনি অফিসে যান নি?’
‘এই তো আমার অফিস। আমার কাজের এই একটা সুবিধা, ইচ্ছে হলে বাসা থেকেই কাজ করতে পারি।’
‘আপনার কাজটা কি জানতে পারি? আই মিন কি করেন আপনি?’
হাসান হেসে দিয়ে বলল, ‘আমি কী করি সেটা ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন। তবে সবাই জানে আমি একজন কন্সালট্যান্ট।’
রূপার ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করতে কিসের কন্সালটিং করেন আপনি। অবশ্য তা না জিজ্ঞেস করে সে বলল, ‘ও আচ্ছা।’
‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবশ্য আমাকে ক্লায়েন্ট সাইটে গিয়েই কাজ করতে হয়। তবে প্রয়োজনে বাসা থেকেও অফিস করতে পারি। তিথি আগেই বলে রেখেছিল তাই এই সপ্তাহটা বাসায়ই আছি। সেটা একদিক থেকে ভালই হয়েছে–তোমাকে ডালাস সিটিটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে পারবো। তোমার সাথে অনেক গল্পও করা যাবে।’ এক নাগারে কাজের ফিরিস্তি দিয়ে হাসান জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি খাবে বলো।’
‘আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি সকালে তেমন কিছু খাইনা। শুধু চা হলেই চলবে। আমি নিজেই বানিয়ে নিতে পারবো। কোথায় কি আছে, শুধু দেখিয়ে দিলেই হবে।’
‘অসুবিধা নেই, আমেরিকায় তোমার প্রথম সকালের চা-টা না হয় আমার হাতেই খেলে।’
হাসান উঠে কিচেনে গেল। কাউন্টার থেকে একটা কাপ নিয়ে পানি ভরে মাইক্রোওয়েভে দিয়ে ২ মিনিট গরম করল। তারপর ২টা টি-ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে রূপাকে জিজ্ঞেস করল, ‘চিনি?’
‘এক চামচ।’
হাসান চিনি মিশিয়ে চা-টা রূপার দিকে এগিয়ে দিতেই বাসার ফোন বেজে উঠল। হাসান ফোন নিয়ে কলার আইডিতে দেখল তিথির অফিস নাম্বার। সে ফোন ধরতেই তিথি বলল, ‘কি করছো?’
‘এই তো রূপার জন্য চা বানাচ্ছিলাম।’
‘রূপা ঘুম থেকে উঠেছে?’
‘হ্যাঁ, উঠেছে।’
‘প্রোগ্রাম ঠিক আছে তো সব? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ওকে?’
‘ভাবছি ডাউন-টাউনে গিয়ে কয়েকটা মিউজিয়াম দেখাবো প্রথমে, তারপর হয়তো জাপানিজ গার্ডেনে যাবো।’
‘জাপানিজ গার্ডেন? ইস, আমি মিস করবো!’ তিথি আক্ষেপ করে বলল।
‘তাহলে থাক, উইকএন্ডে যাবো যেদিন তুমি থাকবে।’
‘না, না, সময় হলে আজই যাও। তোমার কি মনে হয়, তিনটার আগে ফিরতে পারবে? তিতলিকে আনতে হবে তো।’
‘তিনটার আগেই ফিরব।’
‘ঠিক আছে, রূপাকে দাও।’
হাসান ফোন নিয়ে এসে দেখল রূপা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জানালা দিয়ে দুরের লেকটার দিকে তাকিয়ে আছে। হাসান রূপাকে ফোন দিয়ে বলল, ‘তিত্থির ফোন।’
রূপা ফোন নিয়ে বলল, ‘হ্যালো।’
‘কিরে, ঘুম ঠিকমতো হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, হয়েছে।’
‘দেশে কথা বলেছিলি?’
‘হ্যাঁ, বলেছি। বলেছি সবকিছু ঠিক আছে, কোন অসুবিধা হয়নি। এই তিথি, তুই কখন আসবি?’
‘এই তো কাজ শেষ হলেই। আসতে আসতে ৬টা বেজে যাবে।’
‘একটু তাড়াতাড়ি আয় না।’
‘দেখি, চেষ্টা করবো। একটু হাসানকে দে।’
রূপা ফোন এগিয়ে দিল হাসানের হাতে। হাসান বলল, ‘হ্যাঁ, বলো।’
‘শোন, রূপাকে কিন্তু ভাল মত ট্রিট করবে। বাইরে লাঞ্চ খাওয়াতে ভুলো না। আর একদম কিপ্টেমী করবে না।’
‘ছি ছি এসব কি বলছো!’
‘বলছি, কারণ টাকা-পয়সা খরচের ব্যাপারে তোমার আবার একটু ইয়ে আছে কিনা তাই।’
‘ইয়ে আছে মানে? এই, ইয়ে আছে মানে কি?’
‘মানে কিছু না। আমি রাখছি।’
তিথি হাসতে হাসতে ফোন কেটে দিল।
হাসান কাজ থেকে আগেই ছুটি নিয়ে রেখেছিল। কাজেই দেরী না করে সে রূপাকে নিয়ে বের হয়ে পরল শহর দেখাতে। রূপাকে ডালাসের বেশ কিছু ল্যান্ডমার্ক ঘুরিয়ে দেখালো। ওরা অবশ্য গাড়ি থেকেই সব জায়গা গুলো দেখল। যদিও রূপাকে নামতে বলেছিল হাসান, কিন্তু রূপা নামতে চায় নি। সময় কম বলে রূপা বলল, কোথাও নামতে হবে না। তারচেয়ে বরং আমাকে জায়গা গুলোতে নিয়ে চলুন। গাড়ি থেকে দেখলেই হবে।’
হাসান প্রথমেই রূপাকে নিয়ে গেল প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি যেখানে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন সেখানে। সেখান থেকে একে একে রি-ইউনিয়ন টাওয়ার, ডেলে প্লাজা, পেরো মিউজিয়াম, আর্টস মিউজিয়াম, নাসের স্কাল্পচার সেন্টার, পাইওনীয়ার প্লাজার ক্যাটেল ড্রাইভ, ওয়ার্ল্ড এ্যাকুইরিয়াম, প্রেসবাইটারিয়ান চার্চ–কোন জায়গাই বাদ পড়ল না।
ঘুরাঘুরির ফাঁকে ফাঁকে ওদের মধ্যে অনেক কথা হলো। হাসান জানতে পারল রূপার জীবনের বেশ কিছু না জানা কথা। দুপুরের লাঞ্চ সেরে হাসান রূপাকে নিয়ে গেল ডাউনটাউন সংলগ্ন ক্লাইড ওয়ারেন পার্কে। গাড়ি থামিয়ে ওরা নেমে পড়ল। তারপর বসল একটা ছায়া ঘেরা বেঞ্চে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পুর্বের কথার রেশ ধরে হাসান জিজ্ঞেস করল, ‘একটা ব্যাপার আমার কাছে এখনো পরিস্কার না। পার্থ তোমাকে এভাবে ফেলে চলে গেল কেন? তোমাদের মাঝে কি আন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছিল না?’
পার্থের সঙ্গের রূপার সম্পর্ক ছিল অনেকদিনের। বিয়ে করার তারিখ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল তারপর হঠাৎ করেই পার্থ রূপার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে রূপা বলল, ‘তাতো বলতে পারবো না। ও কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেল তা যদি জানতে পারতাম, অন্তত নিজেকে কিছু একটা হলেও সান্ত্বনা দিতে পারতাম।’
হাসান আসলে বুঝতে পারছে না আর কি বলা যায় কিন্তু তার আরো জানতে ইচ্ছে করছে। কথা চালিয়ে যাবার জন্য সে বলল, ‘নিশ্চয়ই অনেক খারাপ সময় গেছে তোমার!’
‘পার্থ আমাকে ছেড়ে চলে যাবার পর আমার পৃথিবীটা একবারে শূন্য হয়ে পড়ে। আমরা তো আসলে আলাদা করে দু’টি মানুষ ছিলাম না। দুজন মিলে এক হয়ে গেছিলাম। ও চলে যাবার পর আমি এতোটাই ভেঙ্গে পড়ি যে এক সময় অসুস্থ হয়ে যাই। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়।’
‘সেটা তো খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু একটা পর্যায়ে সবকিছু তো মেনে নিতেই হয়।’
‘সে চেষ্টা কি আমি করিনি? কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার চারপাশের মানুষগুলো অনেক বাজে বাজে কথা বলতে শুরু করলো। পার্থকে ভালবেসে আমি যেন একটা মহা অন্যায় করে ফেলেছি। সবাই আমাকে অন্য চোখে দেখতে লাগলো। ভাবখানা এমন যেন আমি খারাপ টাইপের একটা মেয়ে।’
একটু থেমে রূপা আবার শুরু করল, ‘কাউকে ভালবাসলেই কি তার সাথে শরীরের সম্পর্ক হয়ে যায়? সেক্স ছাড়া কি সম্পর্ক হতে পারে না?’
রূপার গলা ভারী হয়ে এলো। সে চুপ করে থাকল। কিছুক্ষণ পর হাসান বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, অবশ্য তুমি যদি কিছু মনে না করো।’
রূপা হেসে দিয়ে বলল, ‘কিছু মনে করলে কি এত কথা আপনার সাথে শেয়ার করতাম। বলুন কি জানতে চান?’
‘তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে না কেন? বিয়ে হয়ে গেলে কিন্তু এত কিছুর ভিতর দিয়ে তোমাকে যেতে হতো না।’
‘বাসা থেকে একবার বিয়ে দেয়ার চেষ্টাও শুরু করেছিল। সেটা হয়েছিল আরো ভয়ংকর—অনেক অপমানের। আমার ফ্যামিলিকে অনেক আজে বাজে কথা শুনতে হয়েছে। আমার আগে একটা সম্পর্ক ছিল, আরো অনেক নোংরা কথা। আগে একটা সম্পর্ক থাকলেই কি কেউ নষ্ট হয়ে যায়?’
‘না, না তা হবে কেন?’
‘আচ্ছা, আপনি বলুন, মেয়েরা কি এতোই তুচ্ছ যে একটা মানুষকে ভালবাসলে সে নষ্ট হয়ে যাবে? তাই যদি হয়, তবে সেটা শুধু মেয়েদের বেলায় কেন? ছেলেদের বেলায় নয় কেন? কেন এমন বৈষম্য বলতে পারেন?’
হাসান কোনো উত্তর দিতে পারল না। রূপা আবার বলল, ‘প্রায়ই ভাবতাম, যদি কোথাও পালিয়ে যেতে পারতাম? একবার কোথাও যেতে পারলে দেশে আর ফিরে যেতাম না।’
‘তোমার সে ভাবনা কি এখনো বহাল আছে?’
‘মানে?’
‘মানে তুমি তো এখন মার্কিন মুল্লুকে চলে এসেছো। চাইলেই থেকে যেতে পারো।’
‘থেকে যেতে পারলে তো ভালই হতো।’
‘বাঁধাটা কোথায়?’
রূপা ঠিক বুঝতে পারল না কি বলবে। সে হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তিথি ঘড়ি দেখল প্রায় দু’টা বাজে। সে ভাবল হাসানকে একবার ফোন করে দেখি সে সময় মত যাচ্ছে কিনা তিতলিকে আনতে। ওর যে ভুলো মন। তিথি হাসানের মোবাইল ফোনে কল দিল, কিন্তু কোন সাড়া পেল না। সে আবার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রতিবারই ভয়েজ মেসেজে চলে যাচ্ছে। তিথি কিছুটা দুষ্টুমি আর কিছুটা চিন্তার মিশ্রনে ভয়েজ মেসেজ রাখল–‘কি ব্যাপার সারাদিন কোন খবর নেই যে? আমার বান্ধবীকে নিয়ে কি হারিয়ে গেলে নাকি? ফোন করছি–ধরছো না। ঘটনা কি হ্যাঁ? এনিওয়ে, কল মি হোয়েন ইউ গেট এ চান্স।’
তিথি চিন্তিত মনে ফোন রেখে দিল।
(চলবে…)