হৃদয়ের সুখ আপনি পর্ব ৯

0
625

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-০৯
#Nishi_khatun

বিকেলবেলা!
চেয়ারম্যান এবাড়ি থেকে একটু দূরে-ই আছে সুন্দর বড় সান বাঁধানো পুকুর। পুকুরপাড়ের চারপাশে নানারকম ফলের গাছ দিয়ে ভরা। মাঝেমধ্যেই বিকালবেলা তিনজন এখানে আসে আড্ডা দিতে। পুকুরপাড়টা অনেকটা নিরব! আশেপাশ দিয়ে লোকজনের চলাচল কম করে।

তিনজন আজকেও আড্ডা দিতে আসরের নামাজটা পড়ে চলে এসেছে। তবে আজকে তাদের আড্ডায় কোন প্রাণের উচ্ছাস নেই। রিমশা এক ধ্যানে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে আছে।

রিমশা হুট করে বলে ওঠে,
-“আচ্ছা কোন কাজের জন্য তো প্রকৃতি তাড়াহুড়ো করে না? আমরা মানবজাতি সব কাজে কেনো এতো তাড়াহুড়ো করি? জানো সবাই কাজে এতো তাড়াহুড়ো করি, তবুও আমাদের সব কাজে সফলতা আসে না। উল্টো অনেকসময় আমাদের ভালোর স্থানে খারাপ হয়।”

ইলমা রিমশা’র কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
-“ভাবী সবাই যদি এসব কিছু নিয়ে চিন্তা করতো তাহলে আমাদের সমাজের এতো করুণ অবস্থা হতো না। সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। এতোটা ব্যস্ত যে নিজের ভালো করতে যেয়ে তারা অন্যের ক্ষতি করতেও পিছপা হয় না।”

ঝর্ণা নিরবতা ভেঙ্গে বলে,”ভাবী তুমি ভাইয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছ তা-ই না? তোমার এতো কিসের কষ্ট! তোমাদের তো আর প্রেমের বিয়ে না। এটা একটা দূর্ঘটনার বিয়ে। যেখানে বিয়ের দিন থেকে ভাইয়ার সাথে তোমার সম্পর্ক নরমাল ছিলো না।”

রিমশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” আচ্ছা প্রেম ছাড়া বিয়ে করলে তার প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি হবে না এমনটা কে বলেছে তোমাকে? তুমি বিয়ে সম্পর্কে কতোটা জানো? বাচ্চা মেয়ে একটা, নাক চিপলে দুধ বেড়ুবে।”

ঝর্ণা লজ্জিত হয়ে আমতাআমতা করতে থাকে।

রিমশা ঝর্ণার হাত ধরে টেনে তার পাশে বসিয়ে বলে,
“জন্ম মৃত্যু বিয়ে এই তিন জিনিস মানুষের জীবনের সব থেকে বড় ঘটনা।
‘দুজনের মধ্যে পারস্পারিক ভালোবাসার জন্য বিবাহের চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই ।’
— ইবনে মাজাহ ১৮৪৭
বিবাহ একটি ইবাদাত। আবার ইজ্জত – আব্রু রক্ষা করার একটি হাতিয়ার ও বটে। মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা মনুষ্য জাতি সৃষ্টি করেছেন। তাদের মাঝে প্রেম, ভালবাসা, মায়া, মমতা, বিবেক, বুদ্ধি এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার গুণাবলি দিয়ে। নারী এবং পুরুষ এই দুটো জাতিকে তিনি এক অসীম মহিমায় (বিবাহের মাধ্যমে) একত্রিত করেন। একজন মানুষ তার লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাক পরিধান করে থাকে। রোদ, বৃষ্টি, ঠাণ্ডা ইত্যাদি বাহ্যিক উপাদান থেকে রেহাই পেতে পোশাকের প্রয়োজন।
ঠিক তেমন-ই বিবাহ, দুইজন মানুষকেএমনই ভাবে এক করে যে, তারা একে অপরের পোশাক এর ন্যায় হয়। একে অপরের দোষ, অন্যায় গুলোকে ঢেকে রেখে আগলে রাখে আজীবন। পোশাক বাহ্যিক সৌন্দর্য রক্ষা যা অন্যদের কাছে আমরা প্রদর্শন করি। কিন্তু বিবাহিত দম্পত্তি তারা পরস্পর পরস্পরের পরিধেয় এর ন্যায়।
বিয়েরপর আল্লাহ নিজে দায়িত্ব নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাস সৃষ্টি করেন। তাহলে আমার বিয়েটাতে কেনো স্বামীর প্রতি ভালোবাস থাকবে না?
সব সময় সব আমাদের কিছু সামাজিক ভাবে নয়,
কিছু সময় ধর্মিয় ভাবেও চিন্তা করা উচিৎ। ”

ঝর্ণা মাথা নিচু করে বলে,
“আচ্ছা ভাবী ভুল হয়েগেছে মাফ করে দাও।”

ইলমা তখন ঝর্ণার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,
“আমরা যদি নিজেদের মধ্যে মাফ-সাফ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকি তাহলে আমাদের একতা থাকবে তো?”

রিমশা বলে,”জানো জীবনটা কখনোই সুন্দর থাকে না। জীবনকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে হয়। তাছাড়া আমাদের সম্পর্কটা কি প্রথমেই এমন ছিলো? আমাদের সবাই কে সম্পর্ক টা সুন্দর ভাবে গড়ে নিতে হয়েছে। তবে আমার শ্বশুর বাড়ির সকলে অনেক সাপোর্ট করেছে। নয়তো এতোদিন এবাড়িতে থাকা সম্ভব ছিলো না।”

ইলমা বলে,
“জানো ভাবী আমার দাদাভাই আর দাদীমা অনেক পরহেজগার ছিলেন। তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন।
সাথে অন্যদের নামাজ পড়ার জন্য তাগাদা দিতেন।
আমাদের বাড়িটা প্রথম থেকেই মেয়েদের অনেক সম্মান করে। দাদাভাই আমার দুই ভাইয়ের জন্মের সময় এতোটা খুশি হয়েছিল না! যতোটা তিনি আমার জন্মের সময় হয়েছিলেন। মেয়ে আল্লাহর রহমত। বাড়িতে মেয়ে জন্মগ্রহণ করলে তারা খুব খুশি। আল্লাহ কন্যা সন্তানের রুপে তাদের বাড়িতে রহমত দান করেছেন। আমার জন্মের পর দাদাভাই অনেক দান করেন। ”

দাদীমা আম্মাকে সব সময় বলতেন,’রেহেনা তুমি সব সময় একটা কথাটা মাথায় রাখবে। তোমার দুই ছেলে বড় হয়ে যখন বিয়ে করে বাড়িতে বউ আনবে। তখন সেই বউ দুইটা কিন্তু কারো বাড়ির রহমত। তাদেরকে নিজের মেয়ে মনে করবে।
তুমি তাদের আদর ভালোবাস, সম্মান উপহার দিলে তারাও তোমাকে তোমার প্রাপ্য সম্মান দিবে। তারা কখনোই তোমাকে শাশুড়ি মনে করবে না। আমার আর তোমার সম্পর্কটা দেখেছো কেমন। আশা করি তুমিও আমার মতো আর্দশ শাশুড়ি হতে চেষ্টা করবে। কোন সময় নিজের সন্তানের প্রতি দুর্বল হয়ে বাড়ির বউয়ের সাথে অন্যায় করবে না। ঐ মেয়ে গুলো কিন্তু অন্যের নাড়ি ছেঁড়া ধন। তাদের পিতামাতা তোমাদের মতো আদরযত্নে সন্তান বড় করেছে।
তা-ই তো আম্মা শুরু থেকে তোমার প্রতি মেয়ের মতো সহানুভূতি দেখাচ্ছে। আমি জানি আম্মা আব্বা তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করছে, তোমারও সারাজীবন তাদের নিজের বাবা- মা মনে করে সম্মান করবে।”

রিমশা আফসোসের সুরে বলে,”ইশ রে! দাদাভাই আর দাদীমা যদি বেঁচে থাকতেন! তাহলে খুব ভালো হতো। তাদের থেকে অনেক কিছু শেখার ছিলো। কেন যে তাদের ভালোবাসার অংশীদার হতে পারলাম না।”

ইলমা বলে,
“ভাবী দু বছর আগে আমাদের বাড়িতে এক দূর্ঘটনা ঘটে।
যে দুর্ঘটনা দাদাভাই সহ্য করতে পারে না। ঘটনার মর্মান্তিকতা এতোটা গভীর ভাবে তাকে গ্রাস করে, যে সে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। দাদাভাই এর শোকটা দাদীমা কে প্রবল ভাবে আঘাত করে। সেই কারণে বছর পেরুতে না পেরুতে দাদীমা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। জানো ভাবী তাদের দু’জনের
এভাবে চলে যাওয়াতে বাড়ির সবাই অনেক ভেঙ্গে পড়ে।
এই সব ঘটনার সব থেকে বেশি প্রভাব পড়ে দাইয়ান ভাইয়ের উপর। কারণ….”

ইলমা আর কিছু বলবে তার আগেই ঐ দূরের মসজিদ থেকে মিষ্টি মধূর আযানের সুর ভেসে আসতে শুরু করে।

তিনজন দ্রুত আড্ডা ছেড়ে বাড়ির পথে রওনা করে।

রিমশা বলে,”আল্লাহ আমরা এতো সময় ধরে এখানে বসে আছি। ঐ দিকে বাড়িতে বড় ভাবীর এমন অবস্থায় সে একলা আছে। তাকে একলা রেখে আমরা মনের সুখে গল্প করছি। যেখানা আমাদের তাকে সময় দেওয়া দরকার ছিলো।
এমনিতে এ সময় তার মন মানুষিকতা বদলে গেছে অনেকটা।

ঝর্ণা বলে,”মেয়ে মানুষ মানে-ই ঝামেলা! একজন মেয়ে যদি বাড়ি মাতিয়ে রাখতে পারে! সেখানে তিনজন মেয়ে একসাথে আড্ডা দিতে বসলে তারা দিনদুনিয়া ভুলে যাবে এটাই নিয়ম।”

ইলমা- হ্যা! শয়তান এসে ঘাঁড়ে চেপেছিল। নয়তো বাড়িতে যে আজ আম্মা নেই! সে কথা কেমন করে ভুলে গেছি আমরা?”

একবুক ভয় বুকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে-ই দেখে সদরদরজার সামনে রেহেনা বেগম রাগী চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে।

রেহেনা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“এতো তাড়াতাড়ি ফিরে আসলে কেনো? কাল সকালে ফিরে আসলেই তো পারতে? ভাগ্যিস আমি রওনা দেওয়ার পর কি মনে করে বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। নয়তো আজ কতবড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো জানো? রাইসা মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে মেয়েটা নিজেকে কোনরকম পড়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে। তোমরা জান মেয়েটা কতো ভয় পেয়েছে? ”

তিনজন আর কোন কথা না বাড়িয়ে রাইসা’র (বাড়ির বড় বউ) রুমে ছুটে যায়। রিমশা রাইসা কে জড়িয়ে ধরে বলে,

-“ভাবী আপনি আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।
তবে আপনার অনুমতি নিয়ে যাওয়া একদম উচিৎ হয়নি। আজকে আপনার যদি কিছু হয়ে যেত? তাহলে সারাজীবনেও নিজেকে মাফ করতে পাড়তাম না।”

রাইসা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
“আরে তোমরা সবাই এভাবে কান্না করছো কেন?
আমার কিছু হয়েছে? উঁহু হয়নি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। দেখো আমি একদম ঠিক আছি। আর তাছাড়া তোমরা কি জানতে আমার শরীরটা আজকে হঠাৎ করে খারাপ হবে? গর্ভাবস্থায় এমনটা স্বাভাবিক বেপার। শুধু একটু সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হয় এই আরকি। এতে কান্নাকাটির কিছু নেই।”

এমন সময় দিরহাম সেখানে এসে উপস্থিত হয়।

দিরহাম কে দেখে তারা রুম থেকে প্রস্থান করতে উদ্ধত হয়,
তার পূর্বে রিমশা বলে,”ভাবী আজকের পর থেকে তোমাকে একটু একা ছাড়বো না। ছায়ার মতো সবসময় থাকবো তোমার সাথে দেখে নিও।”

রাইসা মুচকি হাসি উপহার দেয়। কিন্তু ঠোঁটের কোণায় হাসি থাকলেও চোখের কোণায় জল চিকচিক করছিল।

সবাই রুম থেকে প্রস্থান করতে-ই দিরহাম রাইসা কে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে ভালবাসার পরশ এঁকে দেয়। তারপর নিজে স্ত্রীর কে বুকের মাঝে ভালোবাসার আলিঙ্গনে মুড়িয়ে রাখে।

এরপর রাতে বাড়িতে কেউ আর কোন আলোচনা করে না। রিমশা নিজের রুমে এসে বিছানাতে শরীরটা এলিয়ে দিতেই, নিজের সম্পর্ক নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়।

যেখানে সুখের সাগরে ভাসার কথা ছিলো! সেখানে সে দুঃখের সাগরে ধাক্কাধাক্কি খাচ্ছে! এসবের জন্য সে কাকে দায়ী করবে? দাইয়ান কে? না কি বিপরীত মুখি পরিস্থিতি কে? আসলেই কি এসবের জন্য দাইয়ান আসল দোষী? হ্যা! দাইয়ান অন্যায়ের প্রতিকার করতে যেয়ে আমার সাথে বড্ড বেশি অন্যায় করেছে। দাইয়ান আমাকে সুখি রাখবে বলেছিল!
কিন্তু সে কথা রাখে নাই। তা-ই তো বাধ্য হয়ে তাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হচ্ছে। সে দাইয়ান কে ভালোবাসে তারমানে এই নয় যে, তার করা অন্যায়ের কোন প্রতিবাদ করবে না। নিজের বুকের উপর পাথার চাঁপা রেখেছিল এতোদিন। সবাই চোখে যা দেখে তা-ই বিশ্বাস করে! কানে যা শোনে তা-ই বিশ্বাস করে। আচ্ছা কখনো কেউ কেনো এসবের সত্যতার যাচাইবাছাই করে না কেন? এসব করার সময় কোথায় মানুষের? আমাদের সম্পর্কের গভীরতা আমরা-ই জানি।



চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here