#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-২৫
#Nishi_khatun
পরেরদিন সকালে দাইয়ান রিমশা কে সঙ্গে করে তাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। সকলে রিমশা কে দেখে খুশি হয়। যাই হোক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট না হলেই হলো। একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে অনেক সময় লাগে। তবে সম্পর্ক ভাঙ্গতে দু মিনিট সময় লাগে না।
রিমশা কে দেখে বাড়ির সকলে খুশি হলেও আড়ালে কেউ একজন অখুশি থেকে যায়।
আজ ইলমা নিজে ভাইয়ের পুরো রুমটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। সে জানতো তার ভাই কখনো এতো ভালো বউকে হেলাফেলায় হারাবে না।
দাইয়ান নিজে হাত ধরে রিমশা কে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। দাইয়ান বলে,”বউ আজ থেকে এই ঘরে সাজাবো আমরা আমাদের সারাজীবনের স্বপ্ন। নিজেদের একসাথে দেখা স্বপ্ন গুলোকে বাস্তবিক রুপ এখান থেকে না হয় পরিণাম পাবে?”
রিমশা লজ্জায় দাইয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে।
এরপর বেশ দুজনে দিন গুলো স্বপ্নের মতো কাটতে থাকে। রাতে দুজনে একসাথে কাউকে কিছু না বলে গ্রামের মেঠোপথে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ে। কখনো পুকুরপাড়ে বসে জ্যোৎস্না বিলাশে মগ্ন থাকে।
এভাবে দুই পাখির জোড়ার দিন যাচ্ছে।
এভাবে কিছুদিন পার হবার পর একদিন হঠাৎ রাইসার প্রসববেদনা শুরু হয়। দ্রুত তাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাইসা অনেক বছর পর বাচ্চা নেওয়াতে তার নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হচ্ছিল না।
তাই ডাক্তার তার সিজারিয়ান ডেলিভারি করে। দিরহামের ঘর আলো করে দুই কন্যা সন্তানের আগমন ঘটে। হ্যা রাইসা দুই যমজ কন্যার জননী হয়েছে।
দুই কন্যার কথা শুনে বাড়ির সকলে খুব খুশি।
রাইসা যখন তার বাচ্চাকে প্রথম দেখে তখন খুশিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
দিরহাম তখন রাইসা কে উদ্দেশ করে বলে,
“দেখো রাইসা আমারা এক রিদিকে হারিয়ে দুইটা রিদি পেয়েছি। ”
রাইসা কান্নারত অবস্থায় বলে,”আলহামদুলিল্লাহ্!
আমি আজকের পর কখনো রিদির জন্য মন খারাপ করবো না। আমি সব সময় মেয়ের জন্য দোয়া করবো। আমার মেয়েটা জেনো ঐ পারে ভালো থাকে।”
এদিকে চেয়ারম্যান সাহবে একসাথে দুই নাতনীর খুশিতে গ্রামের সকলের বাড়িতে মিষ্টি পাঠিয়ে দেয়।
কয়েকদিন রাইসা কে হাসপাতালে থাকতে হয়। হাসপাতাল বাড়ি থেকে বহু দূরে হওয়াতে রাইসা’র সাথে হাসপাতালে দিরহাম, রিমশা আর ইলমা ছিলো।
দাইয়ান প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসতো।
সকলে যখন সকালের নাস্তা খেতে ব্যস্ত তখন দাইয়ান রিমশা’র হাত ধরে তাকে টেনে করিডোরে নিয়ে আসে। পেছনে থেকে রিমশা কে জড়িয়ে ধরে কাঁধের উপর থুতনি রেখে ফিসফিস করে বলে,”ও বউ আমি বাবা কবে হবো? বড় ভাই দুই বারে তিন কন্যার বাপ হয়েছে। আর আমি বাচ্চা মেয়ের সাথে এতবছর প্রেম করেও এক বাচ্চার বাপ হতে পারলাম না। ও সখিনার মা! তুমি আমার মনের দুঃখ বুঝলে না।”
রিমশা’র এখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে।
এই লোকটা যখনতখন তাকে লজ্জায় লাল করে ছেড়ে দেয়। হাসপাতালে এসে এভাবে এমন কথা বলার মানে কি? নাহ উনি কোন দিন ও ঠিক হবার মানুষ না।
রিমশা আস্তে করে বলে,” ইন শা আল্লাহ!
আল্লাহ যেদিন চাইবে আপনি সেদিন বাবা হবেন।”
দাইয়ান বলে,
“আমার কেনো জানি মনে হয়, আমি বাচ্চার বাবা হতে পারবো না। হতো ভাইয়ার মতো বাচ্চাকে কোলে করে আদর করার ভাগ্য আমার হবে না।”
রিমশা দাইয়ানের উপর রেগে বলে,
“কী সব খারাপ কথা বলেন। এমন উল্টা পাল্টা কথা বলতে নাই। আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন।”
এরপর সকলে রাইসা আর বাবুদের নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। বাবুদের সাত দিন বয়সে তার দাদাভাই খুব ধুমধাম করে তাদের আকিকার অনুষ্ঠান করে।
আকিকার অনুষ্ঠানের দিন বাড়িতে অনেক মেহমান এসেছে। বড় ভাবীর বাবার বাড়ির লোকদের আপ্যায়ন করার দায়িত্ব রিমশা’র কাঁধে। বেচারি সেই সকাল থেকে না খেয়ে কাজ করে যাচ্ছে। হঠাৎ করে একটা সময় সে অতিথিদের জন্য পানির জগ কলপার থেকে ভরে নিয়ে যাবার সময় মাথা ঘুরেপড়ে যেতে লাগে।
রেহেনা বেগম চিৎকার দিয়ে ওঠে,”এই ইলমা তোর ভাবীকে ধর।”
ইলমা ভাবীর সাথে ছিলো বলে সে সাথে সাথে রিমশা কে জড়িয়ে ধরে।
রেহেনা বেগম এসে রিমশা’র উপর রাগারাগি করে। কাজ করতে বলেছে তবে নিজের জানের উপর জুলুম করে না। নিজের প্রতি খেয়াল রাখবে আগে তারপর অন্যদের চিন্তা করবে।
তখন রিমশা বলে,”আসলে মা! কিছুদিন ধরে শরীরটা দুর্বল লাগছে। হয়তো পেশার লো হয়ে গেছে। একটু বেশি বেশি শরবত আর ডিম দুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”
রিমশা’র মুখে এমন কথা শুনে রেহেনা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তিনি কিছু একটা সন্দেহ করে। দাইয়ান কে ডেকে কিছু একটা আনতে পাঠিয়ে দেয়।
কিছু সময়পর দাইয়ান একটা ছোট প্যাকেট এনে রিমশা’র হাতে ধরিয়ে দেয়। রিমশা প্যাকেট থাকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
তা দেখে রেহেনা বেগম রিমশা কে একপ্রকার ঠেলে বাথরুমে পাঠিয়ে দেয়। কিছু সময়পর বাথরুম থেকে বেড়িয়ে রিমশা সোজা তার শাশুড়ি মা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।
রেহেনা বেগম রিমশা’র কপালে চুমা দিয়ে বলে,
“এখন কোন কাজ করার দরকার নেই তোমার।
তুমি ঘরে যেয়ে বিশ্রাম করবে। আমি দাইয়ান কে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”
রেহেনা বেগম ছেলেকে রিমশা’র কাছে পাঠিয়ে দেয়।
দাইয়ান সামনে আসতেই রিমশা হাতের মুঠো খুলে দেখায় কাঠিতে রেজাল্ট পজিটিভ।
দাইয়ান খুশিতে কি করবে বুঝতে না পেরে রিমশা কে জড়িয়ে ধরে রাখে অনেক সময়। দাইয়ান তার অনুভূতি ভাষাতে প্রকাশ করতে পারছে না। সত্যি সে কয়েকমাস পর কন্যা অথবা পুত্র সন্তানের বাবা হবে। ছোট পিচ্চি হাত তাকে স্পর্শ করবে। দাইয়ান এতোবড় খুশির খবর শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়েগেছে।
এদিকে রেহেনা বেগম বাড়ির সকল কে এই খুশির খবর সম্পর্কে অবগত করেছে।
ঝর্ণা আর ইলমা রিমশা’র কাছে যেতে চাইলে রেহেনা বেগম তাদের নিষেধ করে দেয়। সে বলে,”ওদের দু জনকে একটু এখন একা থাকতে দাও। পরে অনেক সময় পাবে রিমশা’র সাথে গল্প করার।”
রুমে এসে দাইয়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে রিমশা। আজকে সত্যি তার বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে। হয়তো কাজের চাপ বেশি পড়েছে। তবে দাইয়ানের কাছে থাকলে সে এতোটা মানুষিক শান্তি অনুভব করে তার কাছে এই শরীরের দুর্বলতা কিছুই না। দাইয়ান রিমশা’র মাথায় হাত বু্লিয়ে দিতে থাকে। রিমশা কিছু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। রিমশা কে সুন্দর করে শোয়াই দিয়ে দাইয়ান বাহিরের কাজে মনোনিবেশ করে।
বাড়ির অনুষ্ঠানের পাঠ চুকে গেলে। সব কিছু ঠিকঠাক করতে বেশ সময় লাগছে দাইয়ানের।
দাইয়ান ব্যস্ত দেখে বিকালের দিকে ঝর্ণা আর ইলমা ভাবীর কাছে এসে তাদের অনাগত ভাগ্নেভাগ্নি কে নিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে।
রিমশার খুশি লাগছে আবার প্রচুর পরিমাণে লজ্জা লাগছে। বাহিরে গেলে সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকছে। অনুষ্ঠানের বাড়ি ছিলো বলে এমন পরিস্থিতিতে তাকে পড়তে হয়েছে। সবাই চলে গেলে তখন নিজেরা।
এদিকে রাইসা দিরহাম কে বলে,”রিমশা কে ডেকে পাঠাও! মেয়েটাকে অভিনন্দন জানানো দরকার!”
দিরহাম বলে,”দেখো বাচ্চাদের কোলে নিতে রিমশা আসবে।তখন অভিনন্দন জানাবে। অযথা অসুস্থ মেয়েটাকে তলব করলে কি না কি হয়েছে ভেবে ছুটে চলে আসবে। এসব মোটেই ভালো দেখাবে না। তখন ওর কিছু হয়ে গেলে কার কি হবে?”
রাইসা মন খারাপ করে চুপচাপ বসে ছিলো। সন্ধ্যায় রিমশা বাবুদের দেখতে আসে তখন রাইসা রিমশা কে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। রিমশা লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
রাইসা বলে,”ওরে আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা রে। এতো লজ্জা পেয়ে আর কাজ নেই। যাও এবার থেকে নিজের প্রতি যত্নবান হও।”
রিমশা লজ্জায় মাথা নিচু করে সম্মতি প্রকাশ করে।
রাতে যখন দাইয়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিলো! তখন দাইয়ান বলে,”রিমশা এতো সুখ আমাদের সহ্য হবে তো? কারো খারাপনজর পড়বে না তো আমাদের খুশিতে?”
রিমশা বলে,”আপনি আপনার এই ফালতু চিন্তা কবে বাদ দিবেন? এসব কথা বাদ দিয়ে অনাগত সন্তান কে স্বপ্ন দেখুন। তাকে কিভাবে মানুষের মত মানুষ রুপে গড়ে তুলবেন।”
দাইয়ান রিমশা কে আলিঙ্গন করে বলে,” কেনো জানি না।এসব খারাপ চিন্তা একাই চলে আসে। তবে সমস্যা নেই। এখন থেকে আমরা তিনজন। আমার।দায়িত্ব তোমার থেকেও দ্বিগুণ। এক তোমাকে দেখে রাখা আরেক অনাগত বাবুর মা কে সুস্ত ভাবে সন্তান জন্মদানের মানুষিকতা রাখতে সহায়তা করা।
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন)
”
”
”
চলবে……
#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-২৬
#Nishi_khatun
বর্ষাকালের পর প্রকৃতি যেমন রৌদ্রস্নান করে।
ঠিক সেভাবে নানারকম চড়াই উৎরাই পাড় করে।
রিমশা আর দাইয়ান তাদের অনাগত সন্তানের প্রতিক্ষায় সোনালি দিন গুলো পার করছে।
রেহেনা বেগম বাড়ির দুই বউ কে কোন কাজ করতে দেয় না। একদিকে বড় বউয়ের কোলে দুই বাচ্চা। রাইসা দুই বাচ্চাকে নিয়ে নাকানিচুবানি খাচ্ছে। অন্যদিকে রিমশা গর্ভবতী তার শারীরিক মানুষিক দুই দিকে পরিবর্তন হচ্ছে।
এ সময় রিমশা কে দিয়ে সংসারের কোন কাজ করানো উচিৎ মনে করে না রেহেনা বেগম।
দেখতে দেখতে রাইসা’র বাচ্চাদের আজ প্রায় চার মাস বয়স।
এদিকে রিমশা’র প্রেগনেন্সির পাঁচ মাস চলছে।
সারাদিন বাড়িতে শুয়ে বসে থাকতে রিমশা’র ভালো লাগে না। ধীরেধীরে রিমশা’র পেট হালকা ফুলে গেছে। এখন তাকে কাছে থেকে দেখলে বোঝা যায় সে গর্ভবতী। রিমশা’র আজকাল বাড়ির বাহিরে যেতে লজ্জাবোধ হয়। কেনো জানি তার মনে হয় সকলে ওর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে।
হয়তো তাকে নিয়ে অন্যরা কানাঘুষো করে।
দাইয়ান রিমশা’র এই সমস্ত লজ্জা পাওয়া দেখে খুব মজা নেয়।
সে রিমশা কে বলে,
“এই যে আমার বিবিজান! আপনি যে ভাবে রাস্তায় বাহির হলে লজ্জিতবোধ করেন, এতে আপনাকে দেখে আমার খুব হাসি পায় তা জানো?”
রিমশা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“আপনাকে বাবা ডাক শোনাবো বলে আমি এতো কষ্ট সহ্য করছি। আর আমার সমস্যায় আপনি মজা নিচ্ছেন?”
দাইয়ান বলে,”আরে বাচ্চা বউ এভাবে রেগে যাও কেন?
শুনবে তো আমার কথা! তুমি যেভাবে রিয়াক্ট করো তাতে মনে হয় সমাজে আর কোন নারীর বাচ্চা হয়নি। তুমিই প্রথম! আসলে তোমার এই আনইজি ফিল করার কোন মানে হয় না। প্রকৃতির নিয়ম এটা। একটা মানব সন্তান ১০ মাস তার মাতৃগর্ভে লালিত হয়ে নিদিষ্ট সময় ভূমিষ্ঠ হবে। তাহলে এই দশ মাস কি প্রতিটা গর্ভবতী মহিলা পুরুষদের দেখে লজ্জিত হয়ে ঘরের কোণায় মুখ লুকিয়ে রাখবে? নারীর এই ত্যাগ তো পুরুষদের জন্য। তাহলে তোমরা কেনো বাড়ির বাহিরে যেতে আনইজি ফিল করবে? তোমার দিকে যে এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাবে তার উচিৎ লজ্জিত বোধ করা। কোন গর্ভবতীর মহিলার না।”
রিমশা দাইয়ানের কথা শুনে লজ্জায় নুইয়ে পড়ে।
এই লোকটা তার জন্য যে কোন পরিস্থিতি খুব দ্রুত সহজ করে দেয়। আমি কোন কিছু মুখে প্রকাশের আগে সে আমার চেহারা দেখে বুঝে যায়। আচ্ছা, আমি কেনো তার মনের কথা বুঝি না?
দাইয়ান তখন হুট করে হালকা ফুলে ওটা পেটে টুপ করে নিজের ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে। হুটহাট দাইয়ানের করা এসব কর্মকাণ্ডে আজকাল বেশ লজ্জায় পরে রিমশা।
কেন যে মানুষটা তাকে এতো বেশি লজ্জায় ফেলে।
সে জানে তার এমন কাজে আমি খুব লজ্জাবোধ করি।
তবুও এসমস্ত কাজ উনি করবেই।
দাইয়ান তখন রিমশা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এতো লজ্জার কি আছে? আমি তোমার একমাত্র স্বামী।
আমি হুটহাট আদর সোহাগ না করলে কে করবে শুনি?”
রিমশা লজ্জায় আরো নুইয়ে পড়ে।
তখন দাইয়ান বলে,
“আরে শোন, তোমাকে তো বলা হয়নি!
আমি শহরে জবের জন্য একটা কোর্টে এপ্লাই করেছিলাম।
তারা আমাকে ডেকেছে। কয়েকদিনের জন্য তোমার কাছ থেকে দূরে যেতে হবে। তা-ই তোমার অনুমিত নিতে এসেছি। ”
হঠাৎ করে লজ্জা রাঙা মুখ কালো অন্ধকার ছেঁয়ে যায়।
রিমশা হুট করে বলে,
“আপনি না গেলে হয় না?”
রিমশা কে আলিঙ্গন করে বলে,”ধুর পাগলি। সারাবছর কি এই গ্রামে বেকার বসে থাকবো? নিজেদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করতে হবে না? তাছাড়া ভুলে যাও কেনো আমি একজন ব্যারিস্টার। আমি ইচ্ছা করলেই নিজের পেশাটা কে বিষর্জন দিতে পারি না।”
রিমশা কান্না জড়িত কন্ঠে বলে,
“আপনাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে।”
দাইয়ান রিমশা’র মাথায় হাত বু্লিয়ে দিয়ে বলে,
“মাত্র কয়েকদিনের বেপার। চাকুরীটা হয়ে গেলে,
আমি সেখানে তোমার থাকার ব্যবস্থা করে নিয়ে যাব।
তোমার কি মনে হয় তোমাকে ছাড়া আমি দূরে শান্তিতে
থাকতে পারবো?'”
এরপর রিমশা কে বলে সেদিন বিকালে দাইয়ান বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
এদিকে দাইয়ান কে ছাড়া এক মিনিট যেনো এক বছরের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। আসলে প্রাণের মানুষ একটু চোখের আড়ালে গেলে সেই দিন গুলো পার করতে খুব কষ্ট হয়। সময় গুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হতে থাকে। আর রাত্রি বেলায় ঘুমেরা লুকোচুরি খেয়াল মেতে ওঠে। দুষ্টু ঘুম গুলো পালিয়ে এটা বোঝাতে চাই, বারংবার তোমার কাছের লোকটা আজ সঙ্গে নাই। সে আছে বহুদূরে তুই ইচ্ছা করলেই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
দাইয়ান যাবার পর রিমশা সময়পার করতে ইলমা আর ঝর্নার সান্নিধ্যে আসে। এই দুইটা মেয়ের সাথে তার সময় ভালোই পার হবে। এদের সাথে আড্ডায় মগ্ন থাকলে কিছুসময় তো তার কথা মনে পড়বে না। এটাই মূলত রিমশা’র উদ্দেশ্য।
ওদের সাথে আড্ডা দেওয়ার এক পর্যায় রিমশা ইলমা কে প্রশ্ন করে- আচ্ছা গ্রামে যে সমস্ত খুন হয়েছে, সে খুন গুলো কে বা কারা করেছে তার কোন সুরাহ হলো?
ইলমা বলে,
-“শুনেছি পুলিশ তাদের সন্দেহের বশে অনেকে-ই থানাতে তুলে নিয়ে গেছিলো। তবে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তা-ই সকলকে ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো এই খুন গুলোর প্রকৃত আসামী ধরতে পুলিশ ব্যর্থ। শুনেছি এই খুনের মামলা অমীমাংসিত রেখে তারা কেস ক্লোজ করবে।”
তখন ঝর্ণা বলে,
-“আসলে খুনি অনেক চালাক। তা-ই তো এমন ভাবে খুন গুলো করেছে যেনো কেউ তাকে ধরতে না পারে। নয়তো খুনি খু-ন করে ধরা পড়বে না? একটা দুইটা না! পুরো ছয়টার বেশি খু-ন করেছে সে। তবুও আসল অপরাধী লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। শুধু খুনি হবে কেন? এমনিতে কত মানুষ নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করে তার কোন হদিস নাই।”
তখন হুট করে রিমশা ঝর্ণা কে প্রশ্ন করে,
“এই তোমার বোন মেরিনা’র কী অবস্থা?
সেদিন তোমার বোনের সব কথা শোনা হয়নি।
তাছাড়া মেয়েটা কে ঐ ভাবে না রেখে ভালো ট্রিটমেন্ট করাতে পারো না?”
মেরিনার কথা শুনে ইলমা আর ঝর্ণা দুজনে চমকে ওঠে।
ওদের মনটাও একটু খারাপ হয়ে যায়।
ইলমা দ্রুত বলে ওঠে,
“ভাবী তোমার দোহাই লাগে মেরিনা আপুর নামটা আর উচ্চারণ করিও না।”
রিমশা প্রশ্ন করে, “কেনে? সমস্যা কী?”
ঝর্ণা তখন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আমার আপু বেঁচে আছে সে কথা গ্রামের কেউ জানে না। এবাড়ির সদস্যরা ছাড়া বাহিরের কাকপক্ষীও জানে না। ”
রিমশা – কেনো তাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছ?
তখন ঝর্ণা বলে ওঠে,
–“পতিতালয় থেকে যদি একবার কোন মেয়ে ফিরে আসে।
সে যদি দুধে ধোয়া হয়! তবুও এ সামাজের মানুষেরা তাকে মেনে নিবে না। তার উপরের কতশত পুরুষেরা নির্মম ভাবে মেরিনা আপু কে ভোগ করেছিল তার ঠিক নেই। আপুকে যখন পাওয়া যায় তখন সে অর্ধমৃত। তার সে অবস্থা দেখে দিরহাম ভাই সামাজের লোকেদের কাছে জীবন্ত অবস্থায় তাকে মৃত ঘোষনা করে। এদিকে এসে মিথ্যা দাফনকাজ সম্পন্ন করে। অন্যদিকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। সেখানে আপু হিংস্র আচরণ করত। মেরিনা আপু নিজের সাথে হওয়া মানুষিক, শারীরিক অত্যাচারে খুব হিংস্র মানুষিক রোগীতে পরিণত হয়।”
ডাক্তার বলে, “তাকে পাবনা মানুষিক হাসপাতালে রেখে আসতে। সে উন্মদ পাগল হয়েগেছে। তাকে সুস্থ মানুষের আশেপাশে না রাখা উচিৎ। যদি বাড়িতে রাখতে চান তাহলে সকলের থেকে দূরে রাখবেন। নয়তো কারো সাথে খুব খারাপ কিছু করে বসতে পারে।”
এটুকু বলে নিজের চোখেরজল মুছে ঝর্ণা। তারপর আবারো বলে,
—“ভাবী জীবন্ত মানুষকে মৃত বানিয়ে রাখা এতো সহজ কাজ না। তবুও কিছু করার নাই! এক দিকে আপু পাগল অন্যদিকে আপু ধর্ষিতা। এই সুস্থ সমাজে তার কোন স্থান নেই। যে সমাজ একটা সুস্থ ধর্ষিতা মেয়েকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেয়না। সেখানে আমার আপু তো পাগল। তাকে কীভাবে বাঁচতে দিবে?”
মেরিনার কথা শুনে রিমশা’র চোখের জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রিমশা ভাবছে,”আমাদের সামাজের মানুষেরা এমন কেন? তারা পাপ কে ঘৃণা না করে পাপী কে ঘৃণা করে।
যে অন্যায় করে, সে মাথা উঁচু করে বাঁচে। আর যে ভুক্তভোগী হয়, তাকে সারাজীবন সামাজের কটু কথা আর নিজের সাথে হওয়া পাপের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়।”
ইলমা রিমশা’র কাঁধে হাত রেখে বলে,”ভাবী তুমি মেরিনা আপুর কথা ভেবে কষ্ট পেওনা। আপু যেভাবে আছে অনেক ভালোই আছে। সামাজের লোকেদের তিরস্কার শোনার থেকে দূরে নির্ভেজাল আছে। তার জন্য আমাদের ও কারো কোন কটু কথা শুনতে হয় না।”
রিমশা বলে,
–“একটা বাড়ির দুইটা মেয়ের সাথে ওরা অন্যায় করার আগে একটু চিন্তা ভাবনা করে নাই। মেয়েরা বাড়ির সম্মান,
তাদের সম্মান রাস্তায় বিলিন করার মানে হয় না।”
ঝর্ণা বলে,”ওরা অন্যের মান- সম্মান নষ্ট করেছে। তা-ই তো আল্লাহ ওদের পাপের যোগ্য শাস্তি দিতে কাউরে মাধ্যম হিসাবে পাঠিয়েছে। যে পাপ করে তাকে একদিন সে পাপের ফল ভোগ করতেই হয়।”
রিমশা তখন আফসোসের সুরে বলে,”ইশ রে আমি যদি একটিবার ঐ খুনির সাথে দেখা করতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলতাম না। সমাজের এতোবড় উপকার করার জন্য।”
ইলমা বলে,
— “দেখা গেলো তুমি খুশির ঠেলাতে ভালো বুঝে তাকে আলিঙ্গন করতে গেছো। এদিকে সে এতো গুলো খুন করেছে! সে সব খুনের নেশাকাটাতে না পেরে তোমাকে খু-ন করে দিল। তখন তুমি কি করবে? তাছাড়া এখন তুমি একলা না। তা-ই ঐ সব চিন্তা ভাবনা বাদ দাও।”
রিমশা অট্টট্ট হাসি দিয়ে বলে,
–“আমি শহীদ হয়ে যাব ঐ খুনির হাতে এমনটা ভাবতে যেওনা। তোমার ভাইয়া আছে না। সব সময় আমার প্রটেকশন হয়ে।”
(মন্তব্য করবেন সবাই)
‘
‘
‘
চলবে……