হৃদয়হরণী পর্ব ১৫+১৬

0
636

#হৃদয়হরণী
#কলমে সৌমিতা
#পর্ব-১৫

-পেখু ঘুম থেকে ওঠ,,দেখতো কটা বাজে,,,১১ টা বাজতে চলল,,(তীয়া)

-তীয়ার কথা শুনে পেখম দ্রুত গতিতে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে গেল,,আর যাওয়ার সময় বলল”বৌমনি একটু আগে ডাকবে তো,,,১২ টা থেকে ক্লাস আছে এবার আমি কি করবো”??

-আমি কি জানি,,, ডাইনিং রুমে আয় রেডি হয়ে,,সবাই অপেক্ষা করছে,,,(তীয়া)

-তীয়া বেশ তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে,তারপর আলমারি খুলে একটা জিন্স, শর্ট কুর্তি বার করে পরে নেয়,,,চুল গুলো ভেজার ফলে ছেড়ে দিয়ে ব‍্যাগে একটা ক্লীপ নিয়ে নেয়,,,তারপর ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়।

– গুড মর্নিং দাদুন আর ঠাম্মাম বলেই পেখম ওদের কাছে এগিয়ে আসে,,তারপর সবার সাথে কথা বলে পাশে তাকাতেই দেখে সোফায় আবির বসে আছে কি সব ফাইল নিয়ে পুলকের সাথে আলোচনা করছে,,,আবিরকে দেখে মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল আর মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা,,,,
______________________

-গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ফোঁটার বদলে যখন বৃষ্টির মোটা দানা দুজনকেই ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো ,তখনই তাদের হুশ ছিল না ,যে তারা ভারী বর্ষণের মধ্যে রয়েছে,,, কারণ তারা একে অপরকে দেখতেই ব‍্যস্ত,, একে অপরের চোখের ভাষা বুঝে নিতে ব‍্যস্ত,,, আবিরের যখন খেয়াল হয় তখন সে পেখমের দিকে তাকিয়ে দেখে বৃষ্টিতে ভিজে পেখমের শাড়ি পুরো শরীরে লেপ্টে আছে,,মাথা ভিজিয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পেখমের মুখ,ঠোঁট, চিবুক সব ভিজিয়ে শেষে টুপটুপ করে সেই জল গড়িয়ে পড়ছে শাড়ির কিঞ্চিত আঁচল সরে যাওয়া ওই বুকের খাঁজে,,শাড়িটা পাতলা হওয়ার দরুন তার প্রেয়সীর শরীরের প্রতিটা আকর্ষণীয় অঙ্গ এবং খাঁজ পরিলক্ষিত হচ্ছে যা আবিরের মাথা নষ্ট করতে সক্ষম,,মনের মধ্যে বিভিন্ন ইচ্ছারা মাথা চাড়া দিতে লাগলো,,এই দৃশ্য দেখে আবির কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো,,,তক্ষনাৎ নিজেকে সামলানোর জন্যে অন‍্যদিকে নজর দেয়,,,,

-আবিরের এই রকম আচরণ দেখে পেখম নিজের দিকে একবার তাকায়, আর সাথে সাথে শাড়ির আঁচল ঠিক করে সেটাকে নিজের শরীরের ভালো করে জরিয়ে নেই,,,আর তখনই আবির বলে ওঠে,,

-“আমি একদিন তার কাছে আবদার করে ছিলাম এই শাড়িটি যেন সে সবার সামনে না পড়ে,,,কারণ এই শাড়ি পরিহিত অবস্থায় আমি তাকে একান্তেই দেখতে চেয়েছিলাম,,, পুড়তে চেয়েছিলাম তার ওই রূপের আগুনে,,, আজ সে আমার আবদার রেখেছে,,, একান্তেই তাকে আমি আজ নিজের করে অনুভব করেছি,,,পুড়েছি তার ওই রূপের আগুনে,,, আর প্রকৃতি সেই আগুন নিভিয়ে দিয়েছে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে,,”

– আবিরের কথা শুনে পেখম লজ্জায় এদিক ওদিক তাকায়,,, ওর মনে হচ্ছে মাটি ফাঁক হয়ে যাক আর ও টুপ করে তার ভিতরে চলে যাবে,,এই লোকটা আজকে ওকে কথায় কথায় লজ্জা দিয়ে মেরেই ফেলবে,,,

-“সে কি জানে এই বৃষ্টি যে আরও সর্বনাশা হয়ে উঠলো আমার কাছে। আমার হৃদয়হরণীকে তো এখন আমার কাছে আবেদনময়ী করে তুলেছে এই বৃষ্টি। মাথার ভিতরে যত নিষিদ্ধ কার্য রয়েছে, সেই সব কার্যক্রম গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বারংবার,,নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা দায় হয়ে যাচ্ছে বারবার। আমি চাইনা তার সাথে কোনো ভুল কিছু করে ফেলি,,,এই সর্বনাশা পরিস্থিতি থেকে সে আমাকে মুক্তি দিক,,,চলে যাক সে এখন,,,”

-আবিরের প্রত‍্যেকটা কথায় পেখমের শরীর বারবার শিহরিত হচ্ছে,,, ওর কথার অর্থ বোধগম্য হতেই নিজে মনে মনে বলে ওঠে”এখানে আর থাকা যাবে না ,আমাকে চলে যেতে হবে”সুতরাং নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই চমকে ওঠে পেখম কারণ জোড়ে বিদ্যুৎ চমকায় আর তার সাথে বিকট শব্দ,, তাই আবির আবার পেখমের হাত ধরে টেনে এনে তাকে বুকের মাঝে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ,মাথায় ভালোবাসার পরশ দেয়,,, তারপর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে নেশাভরা কন্ঠে বলে ওঠে,,

-“এই বিশেষ মুহূর্ত প্রকৃতি দান করেছে আমাদের,, এইভাবে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মনে হয় আজ প্রকৃতিও চাইছে না”

-বলেই পেখমের মুখের উপরে পড়া অবাধ্য চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পেখমের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,,

“অনেক রাত হয়ে গেছে,,, এবার তোমার নীচে যাওয়া উচিত,,ভালো করে ফ্রেশ হয়ে নেবে,,আর হ‍্যাঁ একটা পেইনকিলার খেয়ে নেবে ,তা না হলে সারারাত ঘুমাতে পারবে না,,, তারপর পেখমকে ছেড়ে অন‍্যদিকে ফিরে বলে,,

-” আমি চাইনা তার ঘুম নষ্ট হোক,,,এবার সে যেতে পারে আর হ‍্যাঁ ব‍্যালকনির দরজা আর ঘরের জানালা খুলে রাখে জানো সে,,তার ওই ঘুমন্ত মুখটা না দেখলে আমার রাতে ঘুম আসে না,,”
__________________

-পেখু দাঁড়িয়ে আছিস কেন?? এই না বলছিলি দেরি হয়ে যাবে,,১২ টা থেকে ক্লাস আছে,,,(তীয়া)

-তীয়ার কথায় পেখম বাস্তবে ফেরে, নিজেকে সামলে বলে”হ‍্যাঁ বৌমনি আমার একটু দেরি হয়ে গেল,, তারপর একটা আপেল নিয়ে বলল”আমি আর কিছু খাবো না,,আসছি আমি,, বলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল,,,

-ওই দাঁড়া,,,মা দেখো পেখু না খেয়ে চলে গেল,,,ওর নাকি দেরি হয়ে গেছে,,,(তীয়া)

-ও ওই রকম,,, নিজে দেরি করে উঠবে,,আবার না খেয়ে চলে যাবে,, অন‍্যদিন টিফিন নিয়ে যায়, আর আজকে তো নিয়েও গেল না,,, সত‍্যি বাবা এই মেয়েকে নিয়ে আর পারি না(মনোরমা)
__________________________________________

-পেখম প্রায় দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে ট‍্যাক্সি বা বাসের জন্য,,, কিন্তু একটাও আসছে না দেখে ও বার বার ঘড়ি দেখছে এমন সময় পিছন থেকে গাড়ির হর্ণ শুনতে পায়,, পেখম পিছনে না তাকিয়ে একটু সাইডে সরে দাঁড়ায়,,, কিছুক্ষণ পরে আবার হর্ণের শব্দ শুনতে পায় ও সেটা ক্রমাগত ভাবে বাজতেই থাকে,,,তাই পেখম পিছন ফিরে তাকায়,, আর দেখতে পায় আবির গাড়ি থেকে নামছে,,,

-কখন থেকে হর্ণ দিচ্ছি তুই শুনতে পারছিস না পাখি??

-সরি আবির দা,,আমি ভেবেছি হয়তো অন্য কেউ,,,

-ঠিক আছে এখন গাড়িতে ওঠ,,,আমার মনে হয় না আগামী বিষ মিনিটেও তুই গাড়ি পাবি,,,বলেই আবির হাঁটা দিলো গাড়ির দিকে,,,, তারপর সামনের দরজা খুলে দিল,,, পেখম চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো,,তারপর আবির দরজা বন্ধ করে ,ঘুরে গিয়ে গাড়ির ওপাশের দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল,,,তারপর অভ‍্যাস বশত পেখমের সিটবেল্ট বেঁধে দিলো। এটা যেন তার কর্তব্য, দায়িত্ব ,অধিকার সব,,,,

-প্রায় মাঝ রাস্তা আসার পর আবির বলল”পাখি আমার অফিসের ব‍্যাগ টা দেখতো গাড়ির পিছনের সিটে আছে,,ওটা একটু খোলতো,,পাখি আবিরের কথা মতো ব‍্যাগ টা খুলল,,,আবির তখন বললো ওই টিফিন বক্সটা বার কর,,

-পেখম টিফিন বক্স বার করে বলে”আপনি সকালে খান নি আবির দা”??

-আমি তোর মতো না পাখি,,আমি সময়ের জিনিস সময়ে করতে পছন্দ করি,,, বক্সটা খোল,,আর ওতে যা আছে ফটাফট খেয়ে নে,,,

-না না আবির দা আমি খাবো না,,,খিদে নেই তেমন, আপেল আছে আমার কাছে,,,

-আমি কি তোমার কাছে থেকে হ‍্যাঁ কিংবা না শুনতে চেয়েছি,,,বক্সে যেগুলো আছে সেই গুলো চুপচাপ খেয়ে নাও,,,আমার অফিসে দরকারি মিটিং আছে,এই মুহূর্তে অযথা তর্ক করে নিজের মুড খারাপ করতে চাইছি না,,,

-আবিরের এই রকম ঠান্ডা ধমক শুনে পাখি চুপচাপ টিফিন বক্স খোলো,,এবং দেখে তাতে একটা ব্রেড আর চিকেন স্টু আছে,,ও মনে মনে বলল “এই গুলোতো আবির অফিসে থাকলে দুপুরে খায়। লোকটা আর যাই হোক নিজের খাওয়ার প্রতি ভীষণ সচেতন” ও তখন বলে ওঠে,,,

-হমমম আবির দা আমি একটা কথা বলি,,প্লিজ রাগ করবেন না,,, এইগুলো তো আপনার লাঞ্চের জন্যে কাকিমনি করে দিয়েছে,,, আমি না হয় কলেজ ক‍্যান্টিনে খেয়ে নেবো,,,

-আবির পেখমের দিকে কিছুক্ষণ চোখ গরম করে তাকিয়ে, তারপর শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে”সে কি জানে আমার প্রতি তার কনসার্ন দেখে মাঝে মাঝে নিজেকে আমি ভাগ‍্যবান মনে করি,,কিন্তু এখন আমার খাওয়ার থেকে তার খাওয়াটা বেশি জরুরি। সুতরাং কথা কম বলে খেয়ে নাও”।

-কলেজের কাছে চলে আসতেই আবির পেখমের সিটবেল্ট খুলে দেয়,,পেখম দরজা খুলে বের হতে নিলে,পিছন থেকে আবির বলে ওঠে,,

-“সে যেন চিন্তা না করে,,, মা কে ফোন করে আমি লাঞ্চ আনিয়ে নেবো,,,সাবধানে থাকবে,,এবং বাড়ি ফিরবে”।
___________________________________________

-পেখমের দাদুনের শরীর টা মাঝখানে আবার খারাপ হলো,,,অশোক, দেবেন্দ্র কে বলে বাড়িতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়েছে,,,কারণ আবিরের বক্তব্য এই বয়সে দাদুন কে বেশি নাড়াচাড়া না করানোই ভালো,,,এমনই একদিন সকালে পেখম নিজের ঘরে শুয়ে ছিল,, হঠাৎ ওর ঘরে মা আর বৌমনিকে দেখে উঠে বসে ও,,,

-কি ব‍্যাপার?? শাশুড়ি, বৌমা দুজনেই আমার ঘরে,,,কি মতলব??

-কোনো কিছু মতলব না ,,তোর দাদুন আজ সকালে হঠাৎ বললেন যে সন্ধ‍্যেবেলায় যেন তোকে ভালো করে রেডি করিয়ে দি,,,চার-পাঁচ জন আসবে তোকে দেখতে,,(মনোরমা)

-মনোরমার কথা শুনে পেখমের চোখ চড়ক গাছে উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে,, নিজেকে কোনো মতে সামলে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বৌমনির দিকে তাকালো,,ওর চাহনি দেখে তীয়া বলল,,

– আরে দেখতে আসছে শুধু,,, আর দেখতে আসলে বিয়ে হয়ে যায় না,,,

-ও মা আমি কিন্তু এখন বিয়ে করবো না,,আমার এখনো লেখা পড়া শেষ হয়নি,,,মানে আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছো,,,(কাঁদতে কাঁদতে)

-এই রকম কান্নার কি আছে দিদিভাই??(ঠাম্মাম)

-ঠাম্মাম ও ঠাম্মাম আমি এখন বিয়ে করবো না,,, তুমি একটু দাদুনকে বোঝাও না,,,

-দিদিভাই ওরা শুধু তোমাকে দেখতে আসবে,,,আর শোনো ছেলেকে পুরো রাজপুত্রের মতো দেখতে। আরে ছেলের দাদুর বাড়ি আমাদের বাড়ির পাশে ,,তাই আমাদের বাড়িতে দু-তিন বার এসেছে। ডাক্তার মানুষ,,, বিদেশে থাকে, কিন্তু ব‍্যবহার কি নম্র,,,ভদ্র।দেখবি তোরই পছন্দ হয়ে যাবে।(ঠাম্মাম)

-পেখম সবার কথার উপরে আর কিছু বলতে পারেনি,,,ওর বুকের ভেতর কেমন চিনচিন ব‍্যাথা অনুভব করলো ,,কষ্টের ব‍্যাথা, বিরহের ব‍্যাথা,,,তবে কি সত‍্যিই ওর সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে,,, আচ্ছা আবির দা যদি জানতে পারে,,,কি হবে তখন,,, ভেবেই আবার নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল পেখম,,,
__________________________________________

-ড্রয়িংরুমে সবাই বসে গল্প করছে,, প্রায় আধ ঘন্টা হয়েছে ছেলের বাড়ি থেকে সবাই এসেছে,,, ছেলে , ছেলের মা,বাবা,ঠাম্মা আর দাদু,,সেখানে উপস্থিত আছে পেখমের পরিবার ও অদ্বিতীয়ার পরিবার।

-সবাই হাসিখুশিতে থাকলেও অনুপমা ঠিক খুশি হতে পারছে না,,, আবিরের জন্যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,,, ছেলেটা যে পেখমের জন্য কতটা পাগল তা তিনি ভালো করেই জানেন,,,কিন্তু এদিকে তিনি কিছু বলতেও পারছে না,,কালকে যদি তিনি বিষয়টা জানতেন তাহলে কোনো মতেই আজকে এই বাড়িতে ছেলেপক্ষ আসতে পারতো না,,, হঠাৎ করেই তীয়া বিকেলে ফোন করে সব বলায় তিনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন, কিছুটা ভয় পাচ্ছিলেন আবিরকে নিয়ে,যখন শুনতো তীয়া আবিরকেও যেতে বলেছে,,,কিন্তু কারণ বলেনি,,,,অনুপমার মনটা সেই তখন থেকেই খারাপ,,, আর ভয় পাচ্ছেন ছেলে সব জানতে পারলে কি বলবে,,,

-এইদিকে তীয়া পেখমের আলমারি খুলে ভালো দেখে একটা শাড়ি বার করে পড়িয়ে দিলো,,পেখম হাজার বার বারণ করলেও শোনেনি,,,পেখম যে কি করে ওর বৌমনি কে বলবে বা বোঝাবে?? ওর এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে যে, যেই শাড়ি আর গহনা গুলো তুমি আমাকে পড়িয়ে দিচ্ছো বৌমনি এই গুলো সব ঐ মানুষটার দেওয়া,,,এই গুলো পড়িয়ো না,,মানুষটা দেখলে সহ‍্য করতে পারবে না,,,,,

-অবশেষে সময় হয়ে এল ছেলেপক্ষের সামনে যাওয়ার জন্য,,, মনোরমা একটা মিষ্টির ট্রে পেখমের হাতে দিয়ে বললেন” এই গুলো সব উনাদের হাতে সার্ভ করে দিবি,,তারপর সবাই কে হাত জোড় করে প্রণাম করবি”।

-ড্রয়িংরুমে পেখমের সাথে তীয়া আসলো,,,পেখম এখনো মুখ তুলো কাউকে দেখেনি,,সবাই কে মিষ্টি দিয়ে যেই ছেলেকে মিষ্টি দেওয়ার জন্য মুখ তুলে তাকালো ওমনি ও যেন একটা ঝটকা খেল ,,,পেখম অবাক ও বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে রইল ছেলের দিকে,,,আর তখনই ড্রয়িংরুমে প্রবেশ ঘটলো আবিরের,,,

চলবে,,,,,,

#হৃদয়হরণী
#কলমে সৌমিতা
#পর্ব-১৬

-বাইরে মেঘ করে আছে ,,,না হচ্ছে বৃষ্টি আর না হচ্ছে হাওয়া,,, চারিদিকে কেমন গুমোট হয়ে আছে,,,অসহ্য কর পরিবেশ, ভ‍্যাপসা গরম,কিছুই ভালো লাগছে আবিরের,,,এখন রাত প্রায় দশটা বাজে,,ঘন্টা খানেক আগে এই লেকের পাড়ে এসেছে ও,,,বিয়ারের বতলে শেষ চুমুক দিয়ে সেটাকে আছাড় মাড়ে ,আর সাথে সাথেই বিকট শব্দে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে সেই বতলের ভাঙা অংশ,,,,তারপর জোড়ে একটা চিৎকার দেয়। হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ে তক্ষনাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে আবির,,,, কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,,,,,,
_______________
-সদর দরজা দিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই সামনের পরিবেশ দেখে কোনো এক অজানা ভয়ে ওর পা দুটো ওখানেই থমকে গেল,,,সবকিছু বোধগম্য হলে চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এল, আপনাআপনি হাত দুটোও মুঠ হয়ে এল,,,,পেখম তখনও বিষ্ময় কাটিয়ে উঠতে পারে নি,,কেননা তার সামনে আর কেউ নয় ঋষি বসে আছে,,তবে কি ঋষির সাথে ওর দাদুন বিয়ে ঠিক করেছে,,,ওর মাথা ঘুরছে,মনে হচ্ছে এখনই পড়ে যাবে,,তখনই পিছন থেকে তীয়ার বলা কথা গুলো শ্রবণ হতেই ও চমকে উঠলো,,,দ্রুত দরজার দিকে তাকালো,,,,

-আরে দাদাভাই ভিতরে আয়,,ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন??(তীয়া)

-হমম চল(আবির)

-পেখমকে ঋষির মা নিজের পাশে বসতে বললেন তারপর তিনি পেখমকে দু একটা প্রশ্ন করে ঋষিরবাবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে” আমার তো আমার হবু বৌমাকে খুব পছন্দ হয়েছে,, আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হয়,,তারপর ঋষির বাবা পেখমের দাদুন আর বাবার উদ্দেশ্যে বলে” আমার তো মন চাইছে পেখম মা কে এখনই সাথে করে নিয়ে যায়।এবার আপনারা বলুন,,,

-পেখমের দাদুন পেখমের পরিবারকে জিজ্ঞাসা করে ঋষিকে তাদের পছন্দ হয়েছে কি না??

-তখন সবাই বলে হ‍্যাঁ আমাদের এই বিয়েতে কোনো অমত নেই।

-তাহলে শুভ কাজে আমরা দেরি করতে চাইছি না ভাই,,,ছেলে আমার এক মাস পরেই বিদেশে চলে যাবে,,,তার আগেই আমি এই বিয়েটা করিয়ে দিতে চাইছি,,,(ঋষির বাবা)

-তাহলে তাই হোক,,আমাদেরো কোনো আপত্তি নেই,, কিন্তু ওর পড়াশোনা??,(দেবেন্দ্র বাবু)

-সেই সব নিয়ে একদম ভাববেন না,, ও বিয়ের পরেও পড়বে,,,যতদূর পড়তে চাই আমরা পড়াবো,,,(ঋষির বাবা)

-আমরা আজকেই মেয়েকে আংটি পড়িয়ে আশীর্বাদ করে যেতে চাই,,,কি বলেন(পেখমের মা উদ্দেশ্যে ঋষির মা বলে)

– আমাদের কোনো সমস্যা নেই দিদি,,,আমার মেয়ের ভাগ্য ভালো যে ঋষির মতো এমন একটা ছেলেকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পাচ্ছে(মনোরমা)

-বিমলা যাও ঋষির জন্যে যে আংটি টা কিনে এনেছিলাম সেটা নিয়ে আসো,,,(নরেন্দ্র বাবু)

-বাবা তুমি আংটিও কিনে রেখেছো,,,(দেবেন্দ্র)

-হ‍্যাঁ, কারণ আমার বিশ্বাস ছিল তোরা ঋষিকে অপছন্দ করবি না,,, আর আমার দিদিভাই এত সুন্দর যে কেউ ওকে পছন্দ না করে থাকতেই পারবে না,,,

-আর সেটাই আমার কাল হয়ে এলো(কথাটা আবির বিড়বিড় করে বলল)

– বাবা আমি বলছিলাম কি একবার পেখমের কাছে থেকে জেনে নিন ওর এই বিয়েতে কোনো আপত্তি আছে কিনা??(তীয়া)

– কোনো আপত্তি নেই তীয়া,, আমি ওর মা,,,ওর সাথে আমার এই বিষয় নিয়ে অনেক আগেই কথা হয়ে গেছে,,,(মনোরমা)

-মুহূর্তের মধ্যে পেখম আর ঋষির আংটি বদল হয়ে গেল,,,বিয়ের ডেট ঠিক হলো দু সপ্তাহ পর,,,সবাই মিষ্টি মুখ করলো,,,

-এতক্ষণ যা হল পেখমের যেন তাতে কোনো রকম হেলদোল নেই,,,ও যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে,,,কাউকে কিছু বলতে না পারার কষ্টে নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে ওর,,,বারবার আড়চোখে আবিরের দিকে তাকাচ্ছে পেখম,, আর ততবারই আবিরের রক্ত-লাল চোখ দেখে ভিতরে ভিতরে দুমড়ে মুছরে যাচ্ছে ও।

-আবির তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন,,,বস এখানে,,, মা আবিরকে মিষ্টি দাও,,,পেখু যা ঋষিকে তোর ঘর আর ব‍্যালকনি দেখিয়ে নিয়ে আয়,,,(পুলক)

-তার দরকার নেই পুলক,,,কথা গুলো এখন জমানো থাক,,,পেখম তুমি যাও,,,এখন আমরা তিন বন্ধু মিলে আড্ডা দেবো,,(ঋষি)

-পেখম ওদের কথা মতো চুপচাপ উঠে গেল ,কারণ ও এখানে থাকতে পারছিলো না,,,দমবন্ধ লাগছিল,,,কান্না পাচ্ছিলো,,,,
____________________________________________

-অনুপমা তুমি আমাকে আগে কেন বলোনি,,, আবির বারণ করলো আর তুমি শুনে নিলে,,,(অশোক)

-আমি এত কিছু বুঝিনি,, রাত বারোটা বাজতে চললো ,,কিন্তু আবির এখনো বাড়ি ফিরছে না ,,,আমার ভীষণ ভয় করছে,,,তুমি কিছু করো,,,

-অনু তুমি জানো না তীয়া আর আবির এরা দুজন আমার কি,,,এদের যদি একটা টোকাও পড়ে গায়ে ওদের আগে ব‍্যাথা পায় আমি,,, আর আজ আমার ছেলের জীবনে এত বড়ো ঘটনা ঘটে গেল,, পেখম যদি দেবেন্দ্রর মেয়ে না হতো ,,আমি একবারের জন্যও ভাবতাম না,,দরকার পড়লে তুলে আনতাম নিজের ছেলের জন্য,,, কিন্তু ও আমার সবথেকে কাছের বন্ধুর মেয়ে,,আমি কি করে কি করবো ভেবে পারছি না,,,দেবেন্দ্র কে যদি আমি দু দিন আগে আবিরের জন্যে পেখমকে চাইতাম,,তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও আমাকে ফিরিয়ে দিতো না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে,,, ওরা যে একদিনের মধ্যেই পেখমের আশীর্বাদ করে যাবে ও বিয়ের ডেট ফিক্সড করবে কি করে জানবো,,,আর সব থেকে বড়ো কথা হলো মেসোমশায়,, উনি নিজের জীবন দিয়ে দেবেন তবুও নিজেকে কথায় অটুট থাকবেন,,, কথার খিলাপ করবেন না,,, এখন দেবেন্দ্র রাজি থাকলেও সব হাতের বাইরে,,,তুমি যদি আমাকে আগে একটু জানাতে,,,,,

-আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে কথা বলবো কিন্তু তার আগেই,,,(কাঁদতে কাঁদতে)

-হ‍্যাঁ তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল,,, আবিরের একটা ভুলের জন্য,,, আর আমি তেমন কিছু করতে পারবো না কারণ ওখানে আমার মেয়েটা আছে,,,আমি চাইনা ওর সংসারে কোনো অশান্তির সৃষ্টি হোক,,,,(ওদের কথার মাঝেই আবির বাড়িতে ঢুকলো,,,আবিরের অবস্থা দেখে অনুপমা কেঁদেই ফেললেন,,চুল গুলো এলোমেলো,, ইন করা শার্ট বেরিয়ে এসেছে,,, চোখ গুলো লাল আর ফোলা,,মাকে কাঁদতে দেখে আবির বলে ওঠে,,)

– আমি ঠিক আছি,,,খিদে নেই,, এখানে না দাঁড়িয়ে যাও ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো তোমরা,,,(বলেই উপরে চলে গেল,, অশোকের খুব কষ্ট হচ্ছে ছেলের এই রকম অবস্থা দেখে,,, ও মনে মনে ঠিক করলো এই নিয়ে দেবেন্দ্রর সাথে একবার কথা বলবে,,,দরকার পড়লে ভিক্ষা চাইবে পেখমকে নিজের ছেলের জন্য)
__________________________________________

-পেখম সেই কখন থেকে ব‍্যালকনিতে আবিরের জন্যে অপেক্ষা করছে,,, রাতে না খেয়েই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ও। মনোরমা জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল মাথা ব্যথা করছে খাবো না,,আসলে আজ ওর গলা দিয়ে ভাত নামবেই না।

-যেখানে প্রতিটা সময়ে ও আবিরকে অনুভব করেছে,,,সেখানে হঠাৎ ঋষিকে কি করে মেনে নেবে ওও,,,পারবে না মানতে,,,এইসব কথা ভাবার মধ্যেই দেখলো আবির ব‍্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে আছে,,, ও কিছু বলার সাহস পেলো না,,, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো আবিরের দিকে চেয়ে,,,,কিছুক্ষণ পরে দেখলো আবির চলে যাচ্ছে,, ও সাহস করে একবার ডাকলো “আবির দা”,,,,

-পেখমকে ব‍্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবির ঘরে চলে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই পেখমের ডাকে ওর পা দুটো থেমে যায়,, কিছুটা সময় পার করে পিছনে ফিরে তাকায়,,, আবিরের রক্ত লাল চোখ দেখে পেখমের চোখ জ্বালা দিয়ে ওঠে,,নিজেকে সামলে কিছু বলার আগেই, পেখমের অন্তর কাঁপিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় আবির বলে ওঠে,,,

– don’t you dare to talk to me পাখি,,,

-আবিরের এই রকম ক্রোধের সামনে কখনো পড়েনি পেখম,, তাই আজ মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,,, মুহূর্তের মধ্যে চোখ দুটো দিয়ে অঝরে ঝরতে থাকলো বারিধারা,,,, আর সাথে সাথেই ঝঙ্কার তুলে সেই গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠের অধিকারী বলে ওঠে,,,

– কখনোই আর এই সাহস প্রকাশ করো না পাখি,,,তুমি আমার অনুভূতি কে অপমান করেছো,,আমাকে অপমান করেছো,,তা না হলে পারতে না তাদের সামনে যেতে,,সবার মুখের উপর বলেই দিতে যে পারবে যেতে তুমি কোনো ছেলের সামনে,,আর না পারতে আমার দেওয়া শাড়ি গয়না পড়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে,,, এইগুলো পড়ার আগে তোমার একবারের জন্যেও কি আমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠেনি?? এখন আমার সত‍্যিই আফসোস হচ্ছে,, শুধুই মনে হচ্ছে নিজের অনুভূতির সাগরে আমি একজন ভুল মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম ভালোবা,,,,না না ভুল সব ভুল,,,সে কখনোই আমার ছিল না,,,(বলেই চলে গেল ব‍্যালকনি থেকে,,আর পেখম সে কান্নায় ভেঙে পড়ে ব‍্যালকনিতে বসে পড়ে)
__________________________________________

-পুলক ঘরে ঢুকেই দেখে তীয়া ব‍্যালকনির মোড়াতে বসে আছে,,, ও হাফ প্যান্ট আর একটা স‍্যান্ডো গেঞ্জি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। প্রায় আধ ঘন্টা পর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে তখনো তীয়া ঐ এক ভাবেই বসে আছে,,, তোয়ালেটা ব‍্যালকনির দড়িতে মেলে দিয়ে তীয়ার গায়ে হাত দিয়ে ডাকে,,,

-আচমকা পুলকের এই ভাবে ডাকাতে তীয়া চমকে ওঠে,,, ওকে চমকাতে দেখে পুলকের ভ্রু যুগল আপনাআপনি কুঁচকে গেল,,

-কি হয়েছে তীয়া?? তোমাকে এই রকম দেখাচ্ছে,,,

– না কিছু না,,, একটা হিসেব মেলাতে পারছি না পুলক,,

-কি আমাকে বলো,,,

– না কিছু না,,, শুনলে আপনি কি ভাবে রিয়‍্যাক্ট করবেন,,, আর আমি নিজেও জানি না আমার ধারণা ঠিক কি না,,

-তুমি যদি বিষয়টা আমাকে না বলো,তাহলে আমি জানবো কি করে,,,বলো আমি রিয়‍্যাক্ট করবো না কথা দিলাম,,,

-পুলক,,মানে ,আমার মনে হয়,,

-কি বলো,,

-পুলক আমার মনে হয় পেখু আর দাভাই একে অপরকে ভালোবাসে,,,

-তীয়ার কথায় কিছুটা অবাক হয়ে পুলক বলে” তোমার ধারণা ভুল,,আমার চোখের সামনে তো তেমন কিছু পড়েনি”

-কিন্তু আমার পড়েছে পুলক,,,আমাদের এত তাড়াতাড়ি পেখমের বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা উচিত হচ্ছে না,,,

-তোমার কথা মতে যদি ওরা একে অপরকে ভালোই বাসবে ,তাহলে আমাদের কেন বললো না,,আর আজ যেটা হলো ,,তখন কেন পেখু বা আবির কিছু বললো না??

– বলার মতো কি সত্যিই কোনো স্কোপ ছিল পুলক?? আমরা ভাবতে পেরেছি যে পেখুর বিয়ে আজকেই ঠিক হয়ে যাবে,,, বা দাদুন সব আগের থেকেই ঠিক করে রেখেছে,,,,,হয়তো ওরাও বুঝতে পারেনি,,,ও না না বুঝতে পারবে কি করে পুলক পেখম তো জানতোই না, ইভেন আমরাও জানতাম না যতক্ষণ না দাদুন বলেছে,,,

– এটা তো বড়ো একটা ভুল হয়ে গেল তীয়া,,, কারণ দাদুন ভীষণ একরোখা,,, সে যেটা একবার বলবে সেটা সে করবেই,,, এক্ষেত্রে আমি বা তুমি কিছুই করতে পারবো না যতক্ষণ না আবির বা পেখম কিছু বলছে,,,আর জানি না বলে কোনো লাভ আছে কি না,,, আমার তো পেখমের উপর রাগ হচ্ছে,,, ও কেন আমাকে বললো না একবার,,, ও যদি একটা বার আমাকে বলতো আমি কথা এতদূর এগোতেই দিতাম না,,,

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here