#হৃদস্পর্শ সিজন ২ পর্ব ২৫
জামিয়া পারভীন তানি
২ টা দিন পর সুপ্তি চোখ মেলে তাকায়, পাশে একজন নার্স কে খেয়াল করে ইশারায় ডাক দেয়। নার্স খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়, যে মেয়ের বাঁচার সম্ভাবনা ছিলো না, সে-ই কিনা চোখ মেলে তাকায়। দায়িত্ব রত নার্স হিসেবে এর ক্রেডিট তো সেইই পাবে। তাড়াতাড়ি সুপ্তির কাছে গিয়ে জানতে কেমন আছে সে । সুপ্তি ইশারায় বুঝিয়ে দেয় ভালো আছে।
নার্স সুপ্তির মাস্ক খুলে দেয়, তখন সুপ্তি জিজ্ঞেস করে,
“ আমার বাবুটা কি ভালো আছে? ”
“ জ্বী আপা, বাচ্চা ভালো আছে। ওর মামার কাছে কেবিনে আছে। ডাকবো? ”
“ আর ওর বাবা!”
“ আছেন বোধহয়, আচ্ছা ডেকে দিচ্ছি। ”
বলেই মাস্ক টা সুপ্তির মুখে দিয়ে বাইরে চলে যায় নার্স।
কিছুক্ষণ পর সজীব সুপ্তির কাছে যায়, খুশিতে সুপ্তির হাত ধরে কেঁদে ফেলে। কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো,
“ আমার আদরের বোন, কতটা কষ্ট পেয়েছি জানিস!”
“ আমি ঠিক আছি ভাইয়া, আমার বাবু টা কে একটু দেখাবা!”
“ অবশ্যই দেখাবো, কিছুক্ষণ পর আনছি। একটু অপেক্ষা কর বোন ”
“ ওর বাবা কে একটু ডাকবে ভাইয়া।”
“ ওকে কি হবে? ভণ্ড একটা। ওর বৌয়ের জন্যই তো তোর এই অবস্থা। ”
“ দোষ তো আমার ও আছে ভাইয়া। আমিও ওকে কম জ্বালাতন করিনি। ”
“ কি বলছিস তুই?”
“ শিম্মির দোষ আছে, আমার থেকে কম না। তুমি ওকে একটু ডাকো প্লিজ। ”
সজীব একটু অবাক হয়ে যায়, কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“ ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। কাল ভোরে দেখা করিস। এখন একটু ঘুমা প্লিজ। ”
সুপ্তির কাছে কিছুক্ষণ পর সাইমা আসে। সুপ্তি হাত দিয়ে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“ ওর বাবার মতো ই হয়েছে একদম। ”
“ তবে চোখ দুটো তোমার মতো। ”
সুপ্তি একটু হাসলো। এরপর বললো,
“ তোমরা বাসায় গিয়ে এখন রেষ্ট করো, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। ”
“ হুম, সত্যিই আজ অনেক দিন পর ঘুমাতে পারবো। তোমার জন্য তোমার ভাই কতদিন ঘুমায়নি। আর বাবুর জন্য খবরদার মন খারাপ করো না। ওর খেয়াল রাখবো সব সময় ।” সাইমা একটু হেসে বললো।
কিছুক্ষণ কথা বলে সাইমা বাসায় চলে আসে, আর সজীব কেবিনে বাবুটার কাছে ঘুমায় রাত্রে৷ সাইমা বাসায় ফিরেই আলিফ কে ফোন দিয়ে বললো,
“ আসসালামু আলাইকুম। ”
“ ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভালো আছো?”
“ হুম, আলহামদুলিল্লাহ। যাই হোক, কাল একটু হসপিটালে আসিও। ”
“ সুপ্তি ভালো আছে তো!” একটু চিন্তিত গলায় বললো আলিফ। ”
“ ওর জ্ঞান ফিরেছে। কাল তোমাকে দেখতে চেয়েছে। ”
“ আলহামদুলিল্লাহ, সত্যিই বলছো! আমি খুব খুশি হয়েছি সাইমা। ”
“ বউ য়ের জন্য, নাকি দেখা করতে চেয়েছে সেই জন্য?”
“ জানি না! তবে সুপ্তির কিছু হোক সেটা কখনো চাইনা। ”
“ ভয়ে নাকি!”
“ তুমি কি মজা করছো! ”
“ মজা কেনো করবো? যেভাবে মন বদলাও তুমি?”
“ কেনো হিংসা হয়! আমি কাউকেই ভালোবাসি না। খুশি হইছো এবার?”
“ নাহহহ! ”
“ যাই হোক, রাখি। ভালো থেকো। আর তোমার সাথে আমার সম্পর্ক হয়তো কখনো ভালো হবেনা। তাই শুধুমাত্র ননদের হাজবেন্ড হিসেবেই কথা বলবে। কখনো ফাজলামো করবেনা আমার সাথে। ”
সাইমা রেগে যায় এবার,
“ কে ফাজলামো করছে তোমার সাথে? উল্টো রাগ দেখাচ্ছো কেনো? ”
“ রাগ করিনি , শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি। তোমাকে পাইনি বলে কোনো দুঃখ নেই। তবে শিম্মি কে মন থেকে ভালোবাসি। ”
“ আর সুপ্তি? ”
“ ও কে ভালোবাসি না, তবে ও আমার বাচ্চার মা। ওর সাথে থাকতে থাকতে একটা দুর্বলতা তৈরী হয়েছে । তাই ওকে ছাড়াও থাকতে পারবোনা। আর কিছু জানতে চাও!”
“ নাহহ, কাল দেখা হবে । আর তোমাকে পাইনি বলে আমার ও কোনো আফসোস নেই। স্বামী সন্তান নিয়ে অনেক সুখেই আছি। রাখলাম। ”
বলেই সাইমা লাইন কেটে দেয় ।
°°°
খুব ভোরে আলিফের ঘুম ভাঙে, মিষ্টি সকাল টা আজ অন্যরকম লাগছে। মিষ্টি রোদে কিছুক্ষণ বসে থেকে এক কাপ কফি পান করে । শিম্মির হাতের কোনো খাবার ই সেদিন থেকে খায়না বিধায় নিজেই বানিয়ে নিয়েছে কফি। একটা ভয় কাজ করছে মনে, সুপ্তি কি ফিরবে! তবুও খুশি মনে বারান্দা থেকে ঘরে আসে, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেয়। নিজেকে যেনো একটু আকর্ষণীয় দেখায় সেইজন্য ব্লু রঙের শার্ট এর সাথে জিন্স পড়ে নেয়। একদিন সুপ্তি একটা পারফিউম দেখিয়ে বলেছিলো পারফিউম এর সেন্ট টা দারুণ। সেটাই ইউজ করে আলিফ। একদম সুপ্তির মনের মতো করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে আলিফ। শিম্মি শুধু দূর থেকে দেখে আলিফের চলে যাওয়া।
আলিফ চলে যেতেই শিম্মি একজন কে ফোন করে।
আলিফ হসপিটালে এসেই আগে সুপ্তির কাছে যায়, সুপ্তির ঘুম মাত্রি ভেঙেছে। আলিফ কে দেখে মৃদু হাসে মেয়েটা। একটু হাসিতে সুপ্তি কে বেশ লাগছে আলিফের। এমনিতেই সুন্দরী মেয়েটা, অসুস্থ থেকে ও যেনো রূপের আগুন কমেনি৷ সুপ্তির পাশে গিয়ে বসে আলিফ।
সুপ্তি আগেই বললো,
“ ভালো লাগছে আপনাকে, তবে ভাববেন না আপনাকে ভালোবেসে ডেকেছি। ”
“ কেমন আছো? ”
“ যেমন রেখেছেন। ”
“ দোষ তো আমারই, যা শাস্তি দিবে মাথা পেতেই নিবো। ”
“ হুম, অবশ্যই শাস্তি পাবেন। ও আমাকে ইচ্ছে করে ফেলে দিলেও ও নিজেই হসপিটালে এনেছিলো বলেই হয়তো বেঁচে আছি। তাই ওকে ক্ষমা করে দিলাম। ”
“ ওকে কিছুই বলবেনা তুমি?”
“ নাহহ, কারণ ও আপনাকে খুব ভালোবাসে। সেইজন্য ওকে কিছুই বলবোনা। ”
“ এতে তোমার লাভ কি সুপ্তি?”
“ লাভ ক্ষতি বুঝি না, তবে একটা সিদ্ধান্ত জানাতে চাই। ”
আলিফ সব কথা শুনে মুখ মলিন করে বাসায় ফিরে আসে। সুপ্তি সুস্থ হলে সবাই মিলে একসাথে বসার কথা বলেছে সুপ্তি৷
°°°
এক সপ্তাহ পর,
সজীবের বাসায় সবাই এসেছে, শিম্মি আসেনি শুধু। সজীব সাইমার পাশে সুপ্তি বসে আছে ওর বাবু টা কে কোলে নিয়ে । আলিফ এক পাশে মাথা নীচু করে বসে আছে । সুপ্তি নীরবতা ভেঙে বললো,
“ তোমার সন্তান কে কি একবার ও কোলে নিবেনা!”
আলিফ খুশি হয়ে সুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়, সুপ্তি নিজে বাচ্চা টা কে আলিফের কোলে তুলে দেয়। আলিফ ইচ্ছে মতো বাচ্চা টা কে আদর করতে শুরু করে । আলিফের খুশি দেখে সুপ্তি বললো,
“ ওর নাম কি রাখবেন? ”
আলিফ সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো
“ তুমি যা রাখতে চাও। ”
“ শুনি আপনার পছন্দ। ”
আলিফ সাথে সাথে বললো,
“ সোহান রাখতে পারো, তোমার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে। ”
সুপ্তি মুখ ভেঙিয়ে বললো,
“ আসিফ রাখবো। দুজনের নামের অক্ষর ই আছে। ”
আলিফ অবাক হয়ে তাকায়, এই মেয়ে কি চায়! কিছুতেই বুঝে আসে না আলিফের। সুপ্তি আবার ও বললো,
“ আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসিনি, তবে আমি চাই না আমার আসিফ পিতৃপরিচয় হীন হয়ে বেড়ে উঠুক । তবে সিদ্ধান্ত একটাই, আপনার আর শিম্মির মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হবো না। আপনার ইচ্ছে হলে আসবেন, আমি আমার ভাইয়ের বাসাতেই থাকবো। চাইলে থাকতেও পারেন বাচ্চার কাছে তবে দিনের বেলায়। রাতে ও একা বাসায় থাকতে পারবেনা। ওর একা থাকতে ভয় লাগে, তবুও এতদিন আপনাকে জোর করেই আমার সাথে রাখতাম। ”
“ ও এতো ক্ষতি করার পর ও ওর চিন্তা করছো কেনো সুপ্তি? ”
“ কারণ আমি রেহানের কাছে বাচ্চা চাইতাম, বাচ্চা পেয়েও গেছি, হোক সেটা আপনার। তাই আপনার ভালোবাসা কে আপনার থেকে কেড়ে নিবোনা। ”
বাচ্চাটা আলিফের কোলে পরম মমতায় ঘুমাচ্ছে। কিভাবে সুপ্তির কাছে ওকে রেখে যাবে আলিফ! আলিফ বাচ্চা কে এক হাতে কোলে নিয়ে সুপ্তির পায়ে ধরে,
“ এতো টা নির্দয় হয়ো না তুমি। যেভাবে ছিলে সেভাবেই থাকবে। প্লিজ ফিরে চলো। ”
সুপ্তি পা ছাড়িয়ে নেয়, সাথে সাথে বললো,
“ পা ধরছো কেন? পাপ হবে আমার। উঠো প্লিজ। ”
সজীব অনেকক্ষণ ভেবে বললো,
“ শিম্মি মেয়েটা অন্যায় করেছে, তবে তার ভুল সে বুঝতে ও পেরেছে। যদি সুপ্তি যেতে চায়, অবশ্যই তোমার কাছে যাবে আলিফ। তবে সুপ্তি কে সময় দেওয়া উচিৎ। ও এখন তোমাকে ভাল না বাসলেও একসময় তোমাকে ভালবাসবে। তুমি না হয় ওর জন্য অপেক্ষা ই করিও। ”
সাইমা ও বললো,
“ সুপ্তি ওকেই ভালোবাসে সজীব। ও ফিরে যাবে ওর সংসারে। তবে ওর সময় প্রয়োজন। ”
আলিফ একটু হলেও আশার আলো দেখে, সুপ্তির হাত ধরে বললো,
“ তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো!”
সুপ্তি কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকে । আলিফ উত্তর না পেয়ে হতাশ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বললো,
“ নীরবতা ই কী সম্মতির লক্ষণ? ”
সুপ্তি বললো,
“ হ্যাঁ যাবো, তোমার সংসারে। তবে এখন না, আমি অসুস্থ খুব। ভাই ভাবীর কাছে থাকবো কিছুদিন। ”
আলিফের যা বুঝার বুঝা হয়ে গেছে, সুপ্তির হাতে চুমু দিয়ে বললো,
“ অপেক্ষায় থাকবো। ”
সুপ্তি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো, কারণ ফিরে যাওয়ার ভরসা সজীব ই দিয়েছে। হাজার হোক, সন্তান তার বাবাকে হারাক এটা সজীব চায় নি৷
°°°
আজ অনেক দিন পর সজীব প্রাণ খুলে হাসলো, বোন টা কে সুখী দেখে। সাইমা ও অনেক খুশি, স্বামীর সুখে। হটাৎ করে ই সজীব সাইমা কে কোলে তুলে নেয়, আর বলে,
“ আমার আরেকটা বেবি চায়, দিবে?”
সাইমা সজীবের নাক চেপে ধরে বললো,
“ দুইটা পেয়েও শান্তি পাচ্ছে না, আরোও চায়!”
দুজনেই হাসে অনেক্ক্ষণ।
°°°
শিম্মি বিছানায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, বেডের পাশে কতগুলো কাগজ দেখে ওগুলো হাতে নেয়। একটা চিঠির সাথে কিছু উইল, যেটাতে ওর বাবার সম্পত্তির সব টা আলিফের বেবির নামে করে দেওয়া। আর চিঠিতে লিখা,
“ ক্ষমা করে দিও প্রিয়তম, কেউ কেউ কখনো সুখী হয় না। সারাজীবন কষ্ট পেতেই পৃথিবী তে আসে। আমিও ভালোবাসা পেয়েও হারিয়েছি। ভেবো না আত্মহত্যা করবো, তবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।”
আলিফ শিম্মি কে জাগিয়ে দেয় চোখে পানি দিয়ে, কিছু না ভেবে বুকের মাঝে চেপে ধরে । কিছুটা নীরবতা, কিছুটা কান্না, দুটো হৃদয় কে স্পর্শ করে যায় ।
সমাপ্ত
গল্পটা দীর্ঘদিন পর শেষ করলাম। জানিনা কেমন হলো শেষ টা, আশা করবো জানাবেন কেমন লাগলো।