#হৃদস্পর্শ (পর্ব ৭)
#লেখিকা: জামিয়া পারভীন তানি
• “ এখন কেমন আছো! ”
সাইমার জ্ঞান ফিরে পরের দিন কারণ, ওকে ব্যথা + ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিলো। অবশ্য মাথায় ব্যান্ডেজ করিয়ে ওষুধ নিয়ে বাসাতেই সাইমাকে এনে রাখা হয়েছিলো।
সাইমা আধশোয়া হয়ে বসতে চাচ্ছিলো, সজীব সেটাতে সাহায্য করে। সাইমা ক্ষীণ কণ্ঠে সজীব কে জবাব দেয়, “ একটু ভালো আছি। ”
সুপ্তি ঘরে এসে সজীব এর হাতে সাইমার জন্য স্যুপ দিয়ে যায়, সাইমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই চলে যায়। সাইমা খেতে না চাইলেও সজীব ওষুধ খেতে হবে বলে খাইয়ে দেয়। সজীব এর মন না চাইলেও সাইমার কেয়ার করে কয়েকটা দিন। কারণ সাইমার বারবার জ্ঞান হারানোর পর টেষ্টের রেজাল্ট অনুযায়ী সাইমা প্রেগন্যান্ট। বাসার অন্যদের সাইমার আচরণের খবর টা গোপন রেখেছে সজীব আর সুপ্তি। এটা জানাজানি হয়ে গেলে পরিবার এর অসম্মান হবে তাই।
• “ তুমি কি জানো তোমার কি হয়েছে?”
• “ বলো!”
• “ তুমি মানতে পারবে কি না জানিনা! কিন্তু এটাই সত্য আমাদের সংসার এ নতুন অতিথি আসছে। ”
• “ হুমম ”
• “ কি হুমম! তুমি জানতে! ”
• “ ধারণা করেছিলাম! কিছুদিন ধরে আমি সিক ফিল করতাম! ”
• “ জানাওনি কেনো? ”
সাইমা কিছু না বলে সজীবের কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
• “ এটা কি হলো!” সাইমার এমন আচরণ এ সজীব রীতিমতো শক খেয়েছে।
সাইমা তাও কিছু না বলেই শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর কাঁদতে থাকে।
• “ কি হলো! আমি কি বকেছি! নাকি মেরেছি! বোকার মতো কাঁদার কি হলো!”
• “ আমি জানি! কেউ নিজের মায়ের খুনীর সাথে ঘর করতে চাইবে না! এই বেবীর জন্যে তুমি আমাকে বের করে দাও নি! বেবী হয়ে গেলে আমাকে তাড়িয়ে দিবে!”
• “ তুমি কি ভবিষ্যৎ দেখতে পাও নাকি? কখন বলেছি তাড়িয়ে দিবো? ”
• “ সব কিছু বলার দরকার হয় না, বুঝে নিতে হয়! ”
• “ এসব পাগলামো বাদ দাও! রেস্ট নাও এখন! ”
সজীব বেরিয়ে আসে রুম থেকে, সাইমাকে তার পক্ষে মেনে নেওয়া খুব কষ্টের এখন। সত্যিই এই নিউজ না শুনলে হয়তো ওকে ডিভোর্স দিয়েই দিতো। না পারছে সাইমার সাথে ভালো ব্যবহার করতে বা ভালোবাসতে না পারছে তাড়িয়ে দিতে।
সাইমা নিজের অন্তঃর্দহনে নিজেই জ্বলে পুড়ে মরছে। সুপ্তি ভাইয়ের বউ কে সহ্যই করতে পারছেনা। আর সজল তো নতুন ভাবীর সাথে দেখাই করেনি।
দেখতে দেখতে আরোও তিন টা দিন কেটে যায়, খাবার টা এনে নিজেই খাইয়ে দেয়। আর রাতে শুধু পাশে এসে ঘুমায়। সাইমা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করেছে। নামাজ শেষ করে নিজের ভুলের জন্য প্রার্থনা করে, তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করে, তওবা করে।
সেদিন কামরুননাহার এর জন্য দোয়া মাহফিল করে। দোয়া শেষ হলে, সাইমা ঘরেই বসে ছিলো অনেক আত্মীয়রা নতুন বউ দেখতে আসে। কথা বলে যায়, সব শেষ এ সজীবের ফুপি সাইমার সাথে কথা বলে,
• “ কেমন আছো বউ! ”
• “ জ্বী ফুপি আলহামদুলিল্লাহ, আপনি? ”
• “ আলহামদুলিল্লাহ! সজীব এর সাথে কি সব ঠিক করেছো? ”
• “ সে আমাকে মেনে নিতে চায় না! এটা বুঝে গেছি ফুপি। ”
• “ হুমম, চিন্তা করিও না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
• “ দোয়া করেন। ”
ফুপি উঠে যায়, সজীব আর সুপ্তি এর ঘরে বসে কথা বলছিল তখন ফুপিকে দেখে সজীব বসতে বলে,
• “ বসবোই তো বাবা, আর তো আসা হবেনা মনে হয়। ”
• “ এসব কি বলেন ফুপি? আপনার ভাইয়ের বাড়ি, ভাইপো, ভাতিজি এখনও বেঁচে আছে। ” সজীব বলে।
• “ ফুপি বলেই তো মানিস না রে তোরা। বউ কে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছিস! ”
সুপ্তি একটু জোরেই বলে,
• “ ভাবী আমাদের মা কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে ফুপি! ওকে কিভাবে মেনে নিবো আমরা। তাও তো সজল কিছুই জানেনা। জানলে দুই ভাইয়ে হয়তো রাগারাগি হয়ে যেতো এখন। ”
ফুপি বুঝিয়ে বলেন,
• “ দেখ সুপ্তি, কেউ যদি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে যায়, তওবা করে। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। সে তো ভুল বুঝতে পেরেছে, মনে মনে অনুতপ্ত। কেনো ক্ষমা করবি না বল? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “হে মানুষ, তোমরা আল্লাহ্র কাছে তাওবা কর, নিশ্চয় আমি আল্লাহ্র কাছে দৈনিক একশত বার তাওবা করি।” [মুসলিম, ৪/২০৭৬, নং ২৭০২।]
মানুষ যখনই কোনো অন্যায় করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন দেন মর্মে ঘোষণা করেন, ‘আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি জুলুম করবে অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, সে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১১০)
তাই ক্ষমা করে দিস! তোরা সুখেই থাকবি।”
• ব“ ফুপি আমরা ওকে চলেও যেতে বলিনি! ওর সাথে ই থাকছি, যদি সে সত্যিকারের ভালো মানুষ হয় তাহলে তাকে মেনে নিবো। ”
• সুপ্তিও তাল মিলিয়ে বলে, “ হুম ফুপি, সে যদি অনুতপ্ত হয় তাহলে আমাদের মেনে নিতে প্রব্লেম নাই। ”
• “ শুনে খুশি হলাম রে, তোরা সব সময় হাসি খুশি থাক। মন থেকে প্রার্থনা করি। ”
একে একে সবাই চলে যায়, সাইমা ঘরে বসে বসে কাঁদছিলো। সুপ্তি সাইমা কে গিয়ে বলে,
• “ ভাবী, নিচে চলো, কয়েকদিন ধরে ঘরে বসে বোরিং হয়ে গেছো! ”
• “ সুপ্তি, আমাকে ক্ষমা করে দিও। ”
• “ হুমম, এখন চলো তো।
সুপ্তি হাত ধরে সাইমাকে বাইরে নিয়ে আসে, সাইমা এই বাড়িতে আসার পর শুধু ড্রইং রুম দেখেছিলো আর সজীব এর রুম। কিন্তু ওদের বাড়ি যে এতো বিশাল সাইমা দেখেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। সুপ্তি পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখায়। বাড়ি টা দোতলা, উপরে ৫ টা বড় বড় ঘর, সব গুলো তেই ঘরের মাঝে বড় খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, সোফা, সোফার টেবিল, বই রাখার র্যাক, সোকেশ দিয়ে সাজানো। সাইমা বুঝতে পারে সব গুলো ই বেড রুম। সুপ্তি নিচে নিয়ে যায়, সামনে বিশাল ডায়নিং রুম, পাশেই ড্রইং রুম। রুম দুটোতেই রয়েছে বিশাল ঝাড়বাতি। ডায়নিং টেবিল শ্বেত পাথরের তৈরী, পাশে একুরিয়াম পুরো দেয়াল ঘিরেই। অন্যপাশে বিভিন্ন রকম র্যাকে শোপিচ, দেয়ালে অনেক সুন্দর সুন্দর পেইন্টিং। গোটা বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়, কামরুন্নাহার কতো শৌখিন ছিলো। সুপ্তি ডাইনিং এর পিছনের দিকে নিয়ে যায়, বিশাল বড় সুইমিং পুল সেখানে। অবশ্য পানি রাখেনি, কারণ সবার মন খারাপ ছিলো এই কয়দিন।
• “ জানো ভাবী, আমার মন খারাপ হলেই আমি পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম। আম্মু এসে দেখলেই বুঝতো আমার মন ভালো নেই। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, আমি হেসে ফেলতাম। এই কয়দিন কথা বলার মানুষ ই পাইনি, খুব খারাপ লাগছিলো। এখন তুমি আছো, আমাকে হাসাতে পারবে তো!”
সাইমা কিছুক্ষণ সুপ্তির দিকে তাকিয়ে থাকে, কতো টা সহজসরল মেয়েটা, ওকে একদিন কটু কথা বলেছিলো সে। মনে পড়তেই ডুকরে কেঁদে উঠে, ক্ষমা চেয়ে নেয় সুপ্তির কাছে। একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকে। অনেক কথা বলে দুজনে, যেনো কতো দিনের চিরচেনা দুজন মানুষ।
°°°
• “ কি রে সজল, কয়দিন থেকে আমার ফোন ধরিসনি যে? ” সজল কয়েকদিনের মাথায় মাহিরার ফোন রিসিভ করতেই মাহিরা কথাগুলো শুনিয়ে দেয়।
• “ তুই কি না জেনেই আমার সাথে ফান করছিস? ”
• “ কেনো রে, বিয়ে করেছিস নাকি? ”
• “ মন ভালো নেই, আম্মুকে ছাড়া খুব অসহায় লাগছে। ”
• “ আন্টির কি হয়েছে? ”
• “ আম্মু আর নেই, তুই সত্যিই জানিস না!”
• “ ইন্নালিল্লাহ! এই কয়দিন এতো বার কল দিয়েছি এতো মেসেজ দিয়েছি। ফোন টাই তো অফ করে রেখেছিলিস তুই। কিভাবে জানবো, জানলে তো আসতাম। ”
• “ সরি, বাদ দে, কি বলতে ফোন দিয়েছিস সেটা বল?”
• “ অনেক মিস করেছি রে!”
• “ ঢং ”
সজল ফোন কেটে আবারোও অফ করে দেয়। মেজাজ টাই খারাপ করে দেয় এই মেয়েটা। কতো বার ইগনোর করে সজল ওকে, তাও ঘুরেফিরে ওকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করবেই।
°°°
সাইমা আজ এই প্রথম সবার সাথে খেতে বসে। সজলের সাথে ও কথা হয়, ছেলেটা ভালো ব্যবহার ই করেছে ওর সাথে। ডিনার সেরে রুমে আসে সাইমা, নামাজ শেষ করে, দোয়া করে, বেডে শুয়ে পড়ে। মাথা টা ঘুরছে খুব। শুয়ে যেতেই ঘুমিয়ে পড়। সজীব এসে দেখে সাইমা ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমন্ত সাইমা কে খুব মায়াময় লাগছে ওর কাছে। ফোন বের করে সাইমার প্রথম ছবিটা দেখতে থাকে। এতো সুন্দর মুখখানি দেখে সে প্রেমে পড়েছিলো। প্রথম বার যে ছবি দেখে প্রেম হয়, নিজেকে দেখে ই বুঝতে পারে। প্রথম দেখাতেই যেনো হার্ট বিট মিস করেছিলো, এতোটা সুন্দরী কোন মেয়ে হয়। যেভাবেই হোক ওকে নিজের করে পেতেই হবে। বিভিন্ন ভাবে চ্যাটিং করে সাইমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলো। সাইমা বাস থেকে নামার পর ক্লান্ত ছিলো, তখন সাইমা কে দেখে মনে হচ্ছিলো ফুল গাছ থেকে পেড়ে নিলে যেমন নুইয়ে পড়ে তেমন দুরযাত্রার জার্নি করে সাইমাও নেতিয়ে পড়েছে।
সাইমার ভাড়া বাসায় সজীব প্রথম নিয়ে যায়, সাইমা ফ্রেশ হয়ে আসলে সাইমাকে এতোটাই আবেদনময়ী লাগছিলো বলার বাইরে। সাইমার গভীর কালো চোখের গভীরে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো। তখনই প্লান করে নেয়, বৈধ ভাবে সাইমাকে পেতেই হবে। পুলিশের নাটক, বিয়ের নাটক সব ই সজীবের প্লান মতই হয়েছে। টাকা থাকলে যা হয় আর কি।
কিন্তু আজ সাইমা এতো কাছে তার অথচ মনে হচ্ছে দূর গ্রহের বাসিন্দা। ছুঁতে চাইলেও মনে হয় শক খাবে। রাগারাগি করতে করতে একে অন্যের চেয়ে অনেক দূরে চলে এসেছে ওরা।
সজীব সাইমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। সাইমার কান্নার আওয়াজ এ সজীবের ঘুম ভেঙে যায়। সাইমা জায়নামাজ এ বসে কাঁদছে আর প্রার্থনা করছে।
“ হে আল্লাহ, আমি আমার বিষাক্ত অতীত ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাই। আলিফ আলিফ করে অনেক ভুল করে ফেলেছি, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। আমি আলিফ কে ভুলে গিয়ে আমার বৈধ হাজবেন্ড এর সাথে সংসার করতে চাই। ক্ষমা করে দাও আমাকে, সজীবের সাথে সব সম্পর্ক ঠিক করে দাও। রহমত দাও আমার উপর। ” কাঁদতে কাঁদতে আরোও ধীরে ধীরে বিড়বিড় করে দোয়া করে।
সজীব সুন্দর করে সাইমাকে বলে,
• “ যদি তোমার বর্তমান তোমাকে না মেনে নেয় কি করবে? ”
সাইমা যেনো চমকে যায়, সজীবের দিকে হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
চলবে……