#হৃদস্পর্শ ( পর্ব ২৩)
#লেখিকা : জামিয়া পারভীন তানি
সাইমা অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, “ আলিফ ”
আফিয়া সাইমার দুই হাত ধরে বললো, “ হ্যাঁ আলিফ, আমার ভাই আলিফ, যার জন্য আমি আমার মায়ের ভালোবাসা পাইনি, যার জন্য বিয়ের পর ভালোবাসা পাইনি সেই আলিফ, যাকে তুমি মেরে ফেলেছো সাইমা!”
সাইমার দুইচোখ দিয়ে পানি পড়ছে! সত্যিই তাকে ভালোবেসে ছেলেটা পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। আফিয়া আরোও জোরে করে বলে,
• “ আজ তুমি বেশ সুখে আছো স্বামী সন্তান নিয়ে অথচ আমার ভাইটাকে মেরে ফেলেছো তুমি। ”
• “ আমার জন্য আলিফ মারা গেছে এটাই সত্যি, কি শাস্তি দিতে চান বলুন। সেটাই হবে। ”
• “ ন্যাকামি করোনা! যাই হোক,
যখন আমার ভাইকে গুলি করা হয়েছে শুনি তখন ভিতর থেকে প্রচণ্ড খারাপ লাগা শুরু হয়, আমি তাড়াতাড়ি ঠিকানা নিয়ে হসপিটালে যায়। ডাক্তার জানায়, আলিফ অনেক শক্ত, ভিতরে প্রাণ এখনো আছে। আমি আর দেরি করিনি ডক্টর কে ম্যানেজ করিয়ে মা কে ফোনে জানিয়ে আবার চলে আসি বিদেশে , ভাইকে শেষ বারের মতো বাঁচানোর চেষ্টা করতে। সুইজারল্যান্ডের ডক্টর রা অনেক চেষ্টা করে, এখনো চোখ খুলেনি। বেঁচে থেকেও মৃত, তাহলে ওকে মৃত ছাড়া জীবিত কিভাবে বলি। তিন টা বছর সে আইসিইউ তে আছে। ”
সাইমা আর সজীব দুজনেই আশ্চর্যের সাথে বলে উঠে,
• “ আলিফ এখনোও বেঁচে আছে! ”
একে অপরের দিকে তাকায়, এরপর সাইমা আফিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
• “ আমাকে ওর কাছে একটিবার নিয়ে যাবেন প্লিজ! ”
• “ আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। ”
সজীব তখন বললো,
• “ বলুন, এরপর কি হলো! ”
• “ আমি বুঝতে পারছিলাম না, কে হতে পারে আমার ভাইয়ের শত্রু!”
তো বিদেশে বসে দেশের খবর কিভাবে নিবো সেটাই প্লান করছিলাম। আমার হাজবেন্ড এর সাথে সব শেয়ার করি। ও ছাড়া এতো এতো এতো কিছু আমার একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ইশরাক আমাকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে…”
• “ ইশরাক কে? ” সজীব জিজ্ঞেস করে।
• “ ইশরাক আমার হাজবেন্ড, বাই দ্যা ওয়ে, আমরা দুজনই এখন গবেষণার কাজে আছি, তাই এই প্লান গুলো ভালোই করতে পেরেছিলাম। ”
• “ এরপর কি হলো!”
• “ আমি ইশরাকের কাছে সময় চেয়ে নিই, যতদিন না আমার ভাইয়ের শত্রু ধরা না পড়ে ততদিন যেনো আমাকে সময় দেয়।
ও আমার কষ্ট বুঝতে পারে, আর এতে হেল্প করেছে রেহান। অবশ্য এর জন্য রেহানকে নিজের চেহেরা বিসর্জন দিতে হয়। ”
সজীব আফিয়ার উদ্দেশ্য বলে,
• “ মানে! কিভাবে? ”
• “ রেহান আমার এক ব্যাচ জুনিয়র, কিন্তু ও আমাকে অনেক পছন্দ করতো। বড় বোন হিসেবে। একদিন একা একা ল্যাবে কাজ করার সময় একটা বোতলে ভুলক্রমে হাতের আঘাত লেগে পড়ে যায় দোতলা থেকে নিচতলায়। একটা আত্ম চিৎকারের শব্দে নিচে যায় । রেহানের গাল আর গলা পুড়ে গেছে , ভাগ্যিস দুর্বল এসিড ছিলো। নইলে রেহান মারা যেতো!”
• “ এরপর!”
• “ এরপর আর কি! রেহানের চেহেরা ভালো করার জন্য প্রয়োজন প্লাস্টিক সার্জারির, কিন্তু ওদের ওত টাকা ছিলো না। সুযোগ টা কাজে লাগাই আমি আর ইশরাক। রেহানের প্লাস্টিক সার্জারির ব্যবস্থা করে দিই এক শর্তে, আলিফের চেহেরা নিতে হবে। শুধু আলিফের চোখের মনিটা নিতে পারেনি রেহান। আলিফের খুনী কে ধরতে হবে, শাতি দিতে হবে, এটাই উদ্দেশ্য। ”
• “ তারমানে… ”
• “ হুম, আমি পাঠিয়েছিলাম। ও সব সত্যিই জানিয়েছে সাইমা! ”
সাইমা এবার বললো,
• “ এখন কি একবার নিয়ে যাবেন? ”
• “ আরোও কিছু বলার আছে সাইমা! ”
• “ বলুন…”
• “ রেহান সব আপডেট দিতো, অনেক করেছে সে। প্রথমে সাইমা কে খুঁজতে শুরু করে, অবশ্য ততদিনে সাইমা ঢাকা চলে এসেছিলো। সাইমাকে খুঁজতে গিয়ে একজনের প্রেমে পড়ে যায়, সেটা তোমার ছোট ভাইয়ের বউ সজীব । বিয়েও ঠিক হয়, কিন্তু মাহিরা বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসে। আর মাহিরাকে খুঁজতে গিয়েই দেখতে পায় সাইমাকে। সাইমার ধারে কাছে যাওয়া এতোটা সহজ ছিলো না, সেইজন্য ধোঁকা দিতে হয় সুন্দরী সুপ্তিকে, সুপ্তির ভার্সিটির প্রফেসর এর চাকুরী নিয়ে । ব্যাস বিয়েও হয়ে গেলো! বিয়েও হলো, সুপ্তিও হাতের মুঠোয় আর সাইমা। এরপর সব কিছু আমাকে জানায় রেহান। খুনী ধরা পড়ে প্রমাণ সাথে নিয়ে। রেহানের চাকুরী শেষ, ডেকে পাঠায়। এখন আর লাভ নেই, ভুলে যেতে হবে সুপ্তিকে সব কিছু। ”
সজীব বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, আফিয়ার কাছে অনুরোধ করে,
• “ এতোটা নির্দয় হবেন না প্লিজ, রেহানকে ছাড়া আমার বোন টা বাঁচবেনা। ”
• “ আপনি কি করে পারলেন আমার ভাইয়ের ভালোবাসা কে নিজের করে নিতে? এখন শর্ত একটাই, হয় আপনি আপনার বোনের স্বামী কে নিয়ে যান, স্ত্রী কে ডিভোর্স দিন। আর নয়তো সুপ্তির আরেকটি বিয়ে দিয়ে দিন, সুপ্তি সহ্য করতে পারবে কি না এটাই দেখার বিষয়। ”
সাইমা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা, কিভাবে সম্ভব অতীতের প্রেমের জং বর্তমান হাজবেন্ড কে ছাড়া, একটা মেয়েও আছে তাদের। সাইমা নিরুপায় হয়ে সজীবের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সজীব সাইমার হাত ধরে,
• “ আমার ভুল, আর জেদের জন্য তোমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছিলাম। এরপর তুমি রাগ করে ঝগড়া বাড়িয়েছো, পরিণতিতে আমি মা হারিয়েছি ! ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছো অনেক কিন্তু তাও দুরত্ব বেড়ে গিয়েছিলো। এখন আমি আমার বোন টাকে হারাতে পারবোনা সাইমা! ক্ষমা করে দিও। ”
সাইমার দুইচোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে, পারবেনা সাইমা , সজীবের দিকে তাকিয়ে থাকে করুণ দৃষ্টি তে।
আফিয়ার কথা মতো সজীব রেহান কে নিয়ে চলে যায়, সাইমা আফিয়ার কাছে থেকে যায়। মেঝেতে বসে কাঁদে অনেক সাইমা, কিছুক্ষণ পর আফিয়া এসে বললো
• “ উঠে পড়ো সাইমা, আলিফের কাছে যেতে হবে তো। ”
এতোদিন পরে আলিফ বেঁচে আছে শুনেও সাইমার হৃদয় আলিফের জন্য টান অনুভব করেনা। সমস্ত অনুভূতি সজীবের জন্য, খুব মিস করছে সজীব কে।
°°°
সজীব রেহান কে নিয়ে সুপ্তির কাছে আসে, সুপ্তি আবেগে ভাইয়ের সামনেই রেহান কে জড়িয়ে ধরে অনেক চুমু খায়।
কিছুক্ষণ পর সজীব সুপ্তি কে ডাক দেয়, সুপ্তি লজ্জায় মাথা নিচু করে বললো সরি ভাইয়া।
সজীব তখন বললো,
• “ আজ থেকে স্নেহার দেখাশোনার দায়িত্ব তোর। ”
• “ ভাবী কোথায়! ” সুপ্তি আশ্চর্যের সাথে বললো।
• “ রেহানের বিনিময়ে সাইমাকে হারিয়েছি, আর শোন। আজই দেশে ফিরতে হবে। ”
সুপ্তি কে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায় সজীব, খুব কষ্ট হচ্ছে ভালোবাসার মানুষ টা কে ফেলে যেতে। বোনের সুখের জন্য ভালোবাসা কে ছেড়ে দিলো সে। সম্ভব না ভুলে থাকা কিন্তু থাকতে হবে তাকে।
°°°
সাইমা আলিফের পাশে বসে আছে, আলিফের এই অবস্থা দেখে কষ্ট হচ্ছে খুব। আই সি ইউ তে আছে, আলিফের নাকে নল দেওয়া আছে, হাতে অনেক গুলো স্যালাইন পুশ করা। কোন রকম নিঃশ্বাস চলছে, বুক হালকা উঠছে আর নামছে। বুকের উপর অনেকগুলো সিরিঞ্জ পুশ করা, তারপরও সাইমা আলিফের বুকের বাঁ পাশে হাত রাখে। আলিফের মাথার উপর সাইমা মাথা রাখে, সাইমার চোখের পানি আলিফের কপাল গড়িয়ে আলিফের চোখে পড়ে।
কর্তব্যরত সিস্টার সাইমাকে সরিয়ে দেয়,
• “ What are you doing, The patient will be harmed on it.”
• “ sorry”
মনিটরে একটা সাউন্ড হওয়া শুরু করে, সিস্টার একটু চমকে যান। দীর্ঘ তিন বছর ধরে পেশেন্ট এর না হয়েছে উন্নতি না হয়েছে অবনতি। এমন শব্দ এর আগেও হয়নি । তাহলে কি পেশেন্ট মারা যাচ্ছেন!
চিন্তিত হয়ে তাড়াতাড়ি সাইমাকে বের করে দেয়, ডক্টর কে ডেকে আনে। আফিয়া নিজেও ভয় পেয়ে যায়, সাইমা কি আলিফকে মেরে ফেলার চেষ্টা করলো নাকি সেই ভয়।
ডক্টর অনেক্ষণ ভিতরে থাকেন,
বেরিয়ে এসে জানান, আলিফের অবস্থা আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছে । ডক্টর চলে গেলে আফিয়া সাইমার পায়ে ধরে,
• “ ও তোমাকে অনেক ভালোবাসে সাইমা, নিজের ভালোবাসা দিয়ে ওকে সুস্থ করে দাও। দয়া করো আমাদের প্রতি, তোমার জন্যই সব সম্ভব হয়েছে। এতো বছর পর ও রেস্পন্স করেছে, ভাইয়ের সুস্থতা চাই আমি। ”
সাইমা চুপ করে আছে, কিভাবে নিজের হাজবেন্ড আর বাচ্চাকে ফেলে দিয়ে পুরোনো প্রেমিক কে ভালোবাসবে।
চলবে ……
(
)