#হৃদয়_মাঝারে[৬]
#হালিমা_চৌধুরী
বাড়িতে আসতে আসতে প্রায় সাতটা বেজে গেছে। বাড়িতে ডুকেই আমার শাশুড়ি অায়েশা বেগমের মুখোমুখি হলাম। আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। আয়েশা বেগম মুরতাসিম কে উদ্দের্শ্য করে বলে,
‘এই মেয়েকে বাড়িতে এনেছিস কি নাচ গান করার জন্য নাকি? বাড়ির বউকে গিয়ে বিয়ে বাড়িতে গান গাইতে পাঠিয়ে দিলি অথচ আমাকে একবার বললিও না!
আয়েশা বেগমের কথা শুনে উনার মুখে বিরক্তের চাপ ফুটে উঠে।
‘তোমাকে বললে তুমি যেতে দিতে আমাদের?’
চাঁদনীরর কথা শুনে আয়েশা বেগম খেপে গেলেন।
‘আমার অবাদ্য হয়ে তো আগেই গিয়েছিস এখন আমার মুখে মুখে তর্ক ও করছিস?’
‘তো কি করবো মা? তুমি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের কষ্ট বুঝো না কেনো?’
‘তো এই মেয়েটার কিসের কষ্ট? ভালো বাড়ির ছেলেকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করে নিয়ে…’
‘ব্যাস মা তোমার অনেক কিছু বলা হয়েছে দয়া করে আর কিছু বলবে না। সারাজীবন বাবা কে হাতের মুঠোই রেখেছো তুমি। তুমি কি বাবা কে ফাঁসাওও নি?’
উনার কথা শুনে আয়েশা বেগম ক্ষীপ্ত মেজাজে বলে,
‘আগে তো আমার মুখে মুখে তর্ক করতে না, তাহলে সব কি এই মেয়ের জন্যই হচ্ছে।’
বাড়ির সদর দরজা ফেরিয়ে আমার শশুর নিজাম চৌধুরী প্রবেশ করেন। উনি মুরতাসিম কে উদ্দের্শ্য করে বলে,
‘মুরতাসিম তুই বউমা কে নিয়ে অন্য বাড়িতে চলে যা। তুই তো ভালো একটা চাকরিও করিস তাহলে সমস্যা কোথাই?’
‘কিন্তু বাবা আমি তোমাকে আর চাঁদকে ছাড়া কিভাবে থাকবো?’
নিজাম চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
‘আমি আর কয়দিন বাচবো! মরার আগে চাঁদ টাকে যদি বিয়ে দিয়ে যেতে পারতাম তবে মরেও শান্তি পেতাম।’
‘তুমি একদম বেশি কথা বলবে না চাঁদনীর জন্য পাত্র তো রেডিই আছে। শুধু রিকি একবার দেশে আসলেই ওর কাছে আমি চাঁদনী কে দিয়ে দিবো।’
আয়েশা বেগমের কথা শুনে চাঁদনী দাতেদাত চেপে বলে,
‘আমি তোমার ওই বোনের ছেলেকে বিয়ে করবো না। আমি কি এতই পচে গেছি মা যে, তুমি আমাকে একটা বিবাহিত ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছো?’
‘ব্যাস অনেক হয়েছে তোমাদের নাটক। অনেক সহ্য করেছি। আমি ফারিহা আর চাঁদকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে চলে যাবো।’
মুরতাসিমেরর কথা শুনে আয়েশা বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। অায়েশা বেগম তেঁতে গিয়ে বলে,
‘চলে যাবে মানে! ছোটোবেলা থেকে যে তোদের আমি মানুষ করেছি তার কি হবে? ঊনিশ বছর ধরে আমি চাঁদনী কে বড় করেছি। রিকি ভালো একটা ছেলে টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি সব আছে ওর। ও বলেছে চাঁদনী কে বিয়ে করে আমাকে আর ওকে বিদেশ নিয়ে যাবে। তোদের মা থাকলে তোদের লাত্থি উষ্ঠা দিয়ে চলে যেতে। আমি দেখি তোদের কে মানুষ করেছি।’
‘সৎ মা সৎ মাই হয় আপন হয় না। তুমি যদি আমার আপন মা হতে না তাহলে আজ আর চাঁদনীর সাথে এমন করার চিন্তা করতে না।’
মুরতাসিমেরর কথা শুনে আমি চমকে উনার দিকে তাকাই। সৎ মা মানে আয়েশা বেগম উনার নিজের মা নই?
‘সব কিছু হয়েছে এই কালো মেয়ের জন্য। যেদিন থেকে বাড়িতে এসেছে শুধু ঝগড়া লেগেই আছে। আমি কি আর এমনি এমনি এই মেয়ে কে অলক্ষী বলি নাকি?’
‘মুখ সামলে কথা বলবে।ও কে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই তোমার এতো সমস্যা আসে..’
আমি মুরতাসিম কে থামিয়ে বলি,
‘আমার জন্যই যখন এতো তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে তাহলে আমিই এই বাড়ি থেকে চলে যাই। আর শুনুন মিসেস আয়েশা বেগম আজ আমি কালো বলে আপনি আমাকে অবোহেলা করছেন না একদিন এই কালো মেয়েকেই খুজে বেড়াবেন। আর আপনি আমাকে কালো বলেন আর যাই বলেন আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আমি আমার এই কালো চোহারা কেই ভালোবাসি।’
বলেই আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। এখানে থেকে আমার কাজ নেই। শুধু শুধু আমার জন্য কেনো একটা সুখী পরিবার ভেঙ্গে পড়বে! বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে আনমনে হাটছি। হাতে থাকা ফোনটা ক্রিংক্রিং শব্দে বেজে উঠে। তূর্য শিকদার কে ফোন দিতে দেখে আমি একটু অবাক হয়ে যাই।
‘ভাবি আপনার জন্য গুড নিউজ আছে। আমাদের নতুন মুভিটার গান আপনাকে গাইতে হবে।’
তূর্য শিকদারের কথা শুনে খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসে। এখন যদি উনি পাশে থাকতো তাহলে হয়তো আমার থেকে বেশি খুশি হতো। হঠাৎ একটা হাত সযত্নে আমার চোখের পানি আলতো হাতে মুছে দেয়। চোখ খুলে দেখি মুরতাসিম আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। উনাকে দেখে আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। পরক্ষনে নিজেকে সামলে বলি,
‘আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আমার জন্য আপনাদের পরিবারের উপর দিয়ে অনেক কিছু গিয়েছে। তাই আমি চাই না আর কোনো ক্ষতি হোক। এবার অন্তত আমাকে যেতে দিন।’
আচমকা মুরতাসিম আমাকে জড়িয়ে ধরে হু’হু করে কাদতে থাকে। উনাকে কাদতে দেখে আমি অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে গেলাম।
‘ তুমি নিজেরর স্বার্থ টাই বুঝলে ফারিহা? আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি আর তুমি নিজের উদ্দের্শ্য পূরন করে এখন চলে যেতে চাইছো?’
উনার কথা শুনে আমি একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলাম।
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমি সেটা জানো। আমি তোমাকে আর জোর করবো না। ভালো নাহয় নাই বাসলে অন্তত তোমার বর হিসেবে আমার কাছে কি থাকা যায় না?’
‘আমার জন্য আপনাদের সংসারে অশান্তি হোক সেটা আমি চাই না।’
‘আমি নতুন একটা বাড়ি কিনবো ঠিক করেছি। তুমি আর চাঁদকে নিয়ে থাকবো। চাঁদ যদি মায়ের কাছে থাকে তাহলে মা নির্ঘাত ওকে রিকির সাথে বিয়ে দিয় দিবে।’
‘কিন্তু বাবা মা?’
‘বাবা আবার মাকে ছাড়া আমাদের সাথে থাকবে না। আর মা কে বাবা আমাদের সাথে থাকতে দিবে না।’
আমি কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। কি বলা উচিত এখানে আমার জানা নেই। তাই নিশ্চুপ থাকাই ভালো। হঠাৎ কেউ একজন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তাকিয়ে দেখি চাঁদনী।
‘ভাবি তুমি আমাকে রেখে যেও না প্লিজ। আমি তোমার সাথে অনেক মিশে গিয়েছি আমি চাইলে আর তোমার থেকে সরে যেতে পারবো না।’
‘চাঁদ তোর ভাবি তোকে ছেড়ে যাবে না। কি ফারিহা আমি কি ভুুল বললাম নাকি?’
আমি মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দিই। আমি না বলার সাথে সাথেই চাঁদনী আর মুরতাসিম হেসে ফেলে।
‘চলো ভাবি আমরা এখন বাড়িতে গিয়ে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নেই। আমাদের আবার নতুন বাড়ি খুজতে হবে।’
‘কিন্তু এই রাতের বেলা কিভাবে বাড়ি খুজবেন?’
আমি মুরতাসিম কে প্রশ্ন টা করতেই উনি কিছু টা চিন্তিত হয়ে যায়।
‘আচ্ছাহ ভাইয়া আমরা তাহলে আজ রাত বাড়িতে থেকে কাল বের হবো।’
‘নাহ চাঁদ যেই বাড়িতে ফারিহাকে অপমান করা হবে সেই বাড়িতে আমি একমুহূত্বেও থাকতে চাই না। আমরা বরং এখান থেকেই তূর্য দের বাড়িতে চলে যাই।’
তূর্যের কথা শুনে চাঁদনীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
‘কিন্তু আপনি কিভাবে উনাদের বাড়িতে যাবেন? শিলা শিকদারের মাত্র বিয়ে হয়েছে তূর্য ভাইয়াও এখন ঝামেলায় আছে। আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি তূর্য ভাইয়া ফোন দিয়েছে।’
‘হোয়াট? কি বলেছে তুর্য?’
‘বলেছে উনার নতুন মুভির গান আমাকে গাইতে হবে।’
‘কনগ্রাচুলেশন ভাবিই!’
বলেই চাঁদনী আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি খেয়াল করলাম মুরতাসিমেরর মুখটা কিরকম শুকিয়ে গেছে।
‘কি হয়েছে আপনার? আপনি খুশি না?’
উনি কিছুটা রাগ নিয়ে বলে,
‘এতক্ষনে বলার সময় হয়েছে তোমার? আমি তো তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুভকামনা জানানোর আগেই চাঁদ জড়িয়ে ধরেছে।’
উনার কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে দিই। ভাই বোন দুজনেই পাগল। একজন ভাবি বলে তো আরেকজন বউ বলে!
চলবে…..
[খুব তাড়াতাড়িই গল্পটার ইতি টানবো। কেমন হয়েছে জানাবেন।]