#হৃদয়_মাঝারে [৪]
#হালিমা_চৌধুরী
রুমে প্রবেশ করে দেখি মুরতাসিম কোথাও নেই। বেলকনিতে এসে দেখি উনি দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বলে,
‘তূর্য ফোন করেছে?’
‘হুম করেছে। বলেছে কালকে একটা অনুষ্ঠানে আমাকে গান গাইতে হবে।’
‘ভালো তো! তা এবার তুমি প্রস্তুত তো কালকে যাওয়ার জন্য?’
‘বলেছে যখন যেতে তো হবেই।’
‘হুম তাহলে তৈরি হয়ে থেকো। আমি যাই।’
মুরতাসিম চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আমি বাঁধা দিয়ে বলি,
‘কোথায় যাবেন?’
‘মাথা ব্যাথা করছে একটু ঘুমাবো?’
‘দেখুন আপনি এই রুমেই ঘুমান। আমার কোনো আপত্তি নেই তো। শুধু শুধু আপনার মায়ের কাছে আর আমাকে কথা শুনতে হবে না।’
‘মাকে বারণ করে দিবো তোমাকে কিছু না বলতে।’
বলেই উনি বেলকনি থেকে চলে যানন। আমিও উনার পিছন পিছন রুমে আসি। রুমে আসতেই দেখি উনার মা রুমে এসেছে।
‘মুরতাসিম বাবা তোর মুখটা এরকম শুকিয়ে গিয়েছে কেনো বাবা!’
উনি মাথা চে’পে ধরে বলে,
‘কিছু না মা মাথা ব্যাথা করছে একটু।’
আমার শাশুড়ি চিন্তিত কন্ঠে বলে,
‘সেকি বাবা! এই অসময়ে মাথা ব্যাথা করছে কেনো?’
উনি কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
উনার মা আমাকে দমকে বলে,
‘এই মেয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কি দেখছো দেখো না ছেলেটার মাথা ব্যাথা করছে। মাথা টা একটু মালিশ করে দিতে পারো না?’
আমি তীক্ষ্ণ দূষ্টি নিয়ে উনার দিকে তাকাই।
‘মাথা ব্যাথা না ছাই!’
উনার মা আমার দিকে জিঙ্গাসু দূষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘কিছু বলেছো নাকি?’
‘নাহ! আমি কি কিছু বলতে পারি নাকি?’
‘ঠিকাছে তুমি আমার ছেলের মাথা টা একটু টিপে দাও।’
‘না মা লাগবে না আমি ঠিক আছি।’
উনার কথা শুনে আমি দাতেদাত চেপে বলি,
‘ নাহ আপনার তো মাথা ব্যাথা আপনি কিভাবে ঠিক থাকেন? মা আপনি চিন্তা করবেন না আপনার ছেলের মাথা ব্যাথা কিছুক্ষন পর আর থাকবে না আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
আমার কথা শুনে উনি অদ্ভুত নয়নে আমার পানে তাকিয়ে আছে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে উনার মাথা টিপে দিতে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। উনার মা কিছুক্ষন থেকে চলে যান।
‘আমার মাথা ব্যাথা ভালো হয়ে গেছে তোমার হাতের ছোঁয়া পেতেই।’
‘ডং করবেন না। আপনার মায়ের কাছে তো এখনো ভালো হয়নি।’
‘ডং দেখানো টা মেয়েদের কাজ ছেলেদের না বুঝলে মেয়ে?’
উনার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। কত নামে ডাকে আমায়। কখনো নাম ধরে আবার কখন মেয়ে বলে। কখনো তো ডিরেক্ট তুই করেই কথা বলে!
‘আপনি এভাবে কথা বলেন কেনো?’
‘কিভাবে কথা বলি? আর শুনো কাল তোমার অনুষ্ঠানে গান গাইতে হবে তুমি গান কোনটা গাইবে সেটা সিলেক্ট করেছো?’
উনার কথা শুনে আমার মনে পড়লো আমি তো এখনো কোন গান গাইবো সেটাই ঠিক করি নি।
‘নাহ করি নি তো! অনেক গান আছে কোনটা রেখে কোনটা গাইবো সেটাতেই মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।’
‘আচ্ছাহ আমি একটা সিলেক্ট করে দিবো?’
‘পছন্দ হলে গাইবো বলেন।’
‘আমার খুব প্রিয় গান তোমার ও ভালো লাগবে। অনুষ্ঠান টা যেহেতু বিয়ের তাই গানটাও সেখানে স্যূট করবে।’
‘আরে গানটা বলুন না।’
‘দাড়াও আমি ফোন থেকে বের করে দিচ্ছি।’
বলেই উনি উনার ফোন নিয়ে গান টা খুঁজতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
‘দেখো তো পছন্দ হয় কিনা?’
উনি আমার সামনে একটা গান চালিয়ে বলেন।
‘হুম গান টা তো সুন্দর আছে। কিন্তু আমার গলায় এটা মনে হয় না মানাবে!’
‘আরে মানাবে। তুমি ফ্র্যাকটিস শুরু করে দাও।’
‘আচ্ছা দেখি।’
.
.
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই মুরতাসিম রেডি হতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আমি নিচে নেমে সবার জন্য চা বানিয়ে সবাইকে দিয়ে উনার জন্য কফি বানানোর জন্য আবার রান্না ঘরে চলে এলাম।
‘ভাবি তুমি এখনো তৈরি হওনি কেনো?’
‘আরে চাঁদনী এখনও সময় আছে। তুমি তৈরি হয়ে নাও।’
‘তুমি একটু আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো। আমাকে দেখছো না? আমি তৈরি হয়েই নিচে এসেছি। আমরা সবাই রেডি হয়ে গেছি তুমিই এখনো রেডি হওনি।’
চাঁদনীরর কথা শুনে আমি ওর দিকে তাকায়। ও একদম রেডি হয়ে নিচে এসেছে।
‘এই তো আমি তোমার ভাইয়ার জন্য কফি টা বানিয়েই রেডি হতে যাবো।’
‘আচ্ছাহ। তা তুমি কি শাড়ি পরবে?’
‘না চাঁদনী শাড়ি পরে কিভাবে নিজেকে সামলাবো?’
‘না তোমাকে শাড়ি পড়তেই হবে। নাহলে তোমাকে বিবাহিত লাগবে না। পরে তোমাকে সব ছেলে রা টেনে নিয়ে যাবে।’
চাঁদনীর কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে দেই। মেয়েটা পারেও বটে সিরিয়াস টাইমে মজা করতে।
‘আচ্ছাহ শাড়িই পরবো।’
‘ওকেই ভাবি।’
বলেই আমাকে চাঁদনী জড়িয়ে ধরে।
.
.
অনুষ্ঠানে পৌঁছাতে পৌছাতে প্রায় সাড়ে ১২ বেজে গেছে। মুরতাসিম আর চাঁদনী হাটঁতে হাঁটতে প্রায় অনেক সামনে চলে গেছে। আমি শাড়ির জন্য ভালো করে হাঁটতে পারছি না।
‘এই ফারিহা তাড়াতাড়ি আসো।’
চাঁদনীর কথা শুনে মুরতাসিম পিছনে ফিরে তাকায়।
‘এই তুমি এতো আস্তে হাটো কেনো?’
‘এই শাড়ি পড়ে হাটলে আস্তেই হাটতে হবে।’
মুরতাসিম আমার কাছে এগিয়ে এসে বলে,
‘পড়ে গেলে আমি ধরার জন্য আছি সুইটহার্ট। এতো আস্তে হাটলে তো ডিরেক্টর সাহেব তোমাকে বাছাই করার আগেই বহিষ্কার করে দিবে।’
‘এই না না আমি জোরে হাটছি।’
বলে তাড়াতাড়ি হাটতে নিতেই শাড়ির সাথে পা আঁটকে পড়ে যেতে নিতেই মুরতাসিম আমার কোমর জড়িয়ে ধরে।
‘ওয়াও! রোম্যান্টিক ব্যাপার স্যাপারে কেনো যে আমি কাবাব মে হাড্ডি হতে যাই।’
চাঁদনীর কথা শুনে আমার হুশ আসে। আমি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে উনার কাছ থেকে সরে পড়ি।
‘আপনি আমাকে ধরলেন কেনো?’
আমার কথা শুনে উনি সরু চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
‘তো তুমি পড়ে গিয়ে যখন হাত-পা ভাঙতে তখন তো তোমাকে আমারই কোলে নিতে হতো। অন্তত নিজে বাঁচার জন্য হলেও তোমাকে আমার ধরা দায়িত্ব ছিলো।’
উনার কথা শুনে আমি কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলি,
‘অদ্ভূত আপনি! সব কথাই এত মিথ্যে যুক্তি পান কোথা থেকে?’
‘আমার বউকে খুশি করার জন্য হলেও আমাকে মিথ্যে যুক্তি দেখাতে হবে। দাড়িয়ে আছো কেনো? চলো এখন।’
‘আপনিই দাড়িয়ে আছেন। হুদাই আমাকে বকাবকি করছেন।’
‘আচ্ছাহ চলো এখন।’
বলেই মুরতাসিম আমার হাত ধরে হাটা শুরু করে। আমিও উনার সাথে তাল মিলিয়ে হাটার চেষ্টা করি।
.
‘হেই মুরতাসিম ব্রো কেমন আছিস?’
‘এইতো ভালো আছি। তোর অনুষ্ঠানের কি অবস্থা?’
‘এইতো ভালোই। ভাবি যদি গান গায় তাহলে আরো ভালো হবে। আমার বোনের বিয়েতে আমার ইচ্ছে ছিলো অনেক বড় বড় শিল্পী দের আমন্ত্রন করা হবে। কিন্তু ভাবি যখন একজন শিল্পী তাই আমি আর কাউকে ডাকি নি।’
‘আচ্ছাহ আমি তার জন্য তোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো বলেছি তো।’
তূর্য শিকদার মাথা চুলকিয়ে বলে,
‘কৃতঙ্গ থাকা লাগবে না তোর বোনকে আমার হাতে তুলে দে এবার। তোর বোনের রাস্তা তো ক্লিয়ার করে ফেলেছিস তুই।’
আমি এককোনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে উনাদের খুনশুটি দেখছি। হঠাৎ তূর্য শিকদার আমাকে ডাক দেয়।
‘জ্বী স্যার কিছু বলবেন।’
‘এই ভাবি আমাকে একদম স্যার ট্যার ডাকবেন না। কিছুক্ষন পরেই কিন্তু আপনার ডাক পড়বে। তাই তৈরি থাকবেন।’
‘আচ্ছাহ ভাইয়া।’
সবাই সবার মত বিয়ে বাড়িতে আনন্দ করছে। আমি আর চাঁদনী একটা টেবিলে বসে আছি।
‘হেই লেডিস এন্ড জেন্টালমেন্ট। আজকে আমার একমাত্র বোন শিলা শিকদারের বিয়ে উপলক্ষে আমাদের একটা গান গেয়ে শুনাবে মিসেস মুরতাসিম চৌধুরী। সো মিসেস চৌধুরী আপনি প্লিজ স্টেজে চলে আসুন আর আমাদের বিয়ে বাড়িটাকে একটু হই-হুল্লোড়ে মাতিয়ে তুলুন।’
তূর্য শিকদারের কথা শুনে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। হঠাৎ আমার হাতটা কেউ শক্ত করে পরম স্নেহে আগলে ধরে। পাশে তাকিয়ে দেখি মুরতাসিম দাড়িয়ে আছে।
‘এতো নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই ফারিহা আমি জানি তুমি পারবে।’
উনার কথা শুনে আমার বুকের উপর থেকে মস্ত বড় একটা পাথর সরে গেছে। কখনো কেউ এভাবে আমাকে সাহস দেয়নি। প্রথমবার সবার সামনে সরাসরি আমার পারফরমেন্স দেখাতে হবে সেটা ভেবেই নিজেকে শক্ত করে দাড়িয়ে পড়ি স্টেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
চলবে……