#হৃদয়_মাঝারে [২]
#হালিমা_চৌধুরী
আধাঘন্টা ধরে একটা রুমে বসে আছি আমি। আমার পাশেই সেই মেয়েটা বসে আছে। আনলিমিটেড বকবক করে যাচ্ছে।
‘আচ্ছাহ ফারিহা তুমি কেনো বিয়েটা করোনি?’
আমার পাশে বসা মেয়েটার প্রশ্ন শুনে আমি কিছুটা হকচকিয়ে যাই। মেয়েটা তা বুঝতে ফেরে বলে,
‘আচ্ছাহ বলারর দরকার নেই। দেখো এতো বকবক করার মাঝে আমি আমার পরিচয়ই দিতে ভুলে গেছি। শুনো ফারিহা তোমার একমাত্র ননদিনী আমি। আমার কিন্তু তোমাকে অনেকক পছন্দ হয়েছে। আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে ভাইয়ার থেকে কেড়ে তোমাকে নিয়ে যেতাম। আর তোমাকে আমি নাম ধরে ডাকি তুমি কিছু মনে করো না? আমার নাম চাঁদনী চৌধুরী আর, আমাকে তুমি চাঁদনী বলেই ডাকবে।’
বিনিময়ে আমি মুচকি হাসি। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝলাম চাঁদনী নামের মেয়েটা অনেক মিশুক। দেখতেও চাঁদের আলোর মতোই সুন্দর। হয়তো চেহারার সাথে মিল রেখেই চাঁদনী রেখেছে।
‘তুমি কিছুই বলছো না আমি একাই বকবক করে যাচ্ছি। আচ্ছাহ তোমার পুরো নাম কি?’
‘নুসরাত ফারিহা।’
‘অনেক সুন্দর নাম। দেখে আমার নাম কি রেখেছে চাঁদনী! অন্তত একটা ভালো নাম রাখতে পারতো তো!’
চাঁদনীর এই অভিমানী কন্ঠে বলা কথা শুনে আমি হেসে দেই। চাঁদনী বিষ্ময় ভরা নয়নে আমার পানে তাকিয়ে আছে।
‘তোমার নাম তোমার মতোই সুন্দর। আমার কিন্তু অনেক পছন্দ হয়েছে।’
‘এতক্ষন পর তোমার মুখ থেকে কথা বের হয়েছে! বাই দ্যা ওয়ে তোমার হাসিটা কিন্তু অসাধারন। ভাইয়া বোধহয় এই হাসির প্রেমেই পড়েছে।’
বিনিময়ে আমি আর কিছু বললাম না। আপাতত আমার মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরঘুর করছে।
‘আচ্ছাহ তোমার ভাইয়া সত্যিই কি আব্বু-আম্মুকে আঁটকে রেখেছে?’
আমার কথা শুনে চাঁদনীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। মিনমিনিয়ে বলে,
‘হলেও হতে পারে। ভাইয়া কিন্তু অনেক রেগে গেছে। হয়তো ওর রাগ সম্পর্কে তোমার এখনো ধারণা হয়নি তবে শিগরই হয়ে যাবে। রেগে গেলেও মাথা ঠান্ডা রেখে পরিকল্পণা করে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করে নেয়।’
চাঁদনীর কথা শুনে আমি চুপসে যাই। এখন তাহলে আমাকে বিয়েটা করতেই হবে!
‘আচ্ছাহ তোমার ভাইয়া আমার মতো একটা মেয়ের পিছনে কেনো পড়ে আছে? বিয়েটা করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই?’
‘আচ্ছাহ ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে বিয়েটা তরে নাও না প্লিজ। আমরা দুজন অনেক আড্ডা দিতে পারবো। প্লিজ প্লিজ।’
চাঁদনীর এরকম বাচ্চামো আল্লাদ শুনে আমি না হেসে পারিনি।
‘কিন্তু বিয়েটাতো ছেলে খেলা নয়।’
এরমধ্যেই রুমে মুরতাসিম প্রবেশ করে। চাঁদনী উঠে চলে যায়। উনি এসে আমার পাশে বসে। আমি দূরত্বে বজায় রাখার জন্য আরেকটু দূরে গিয়ে বসি।
‘তোমার বোন এসেছে। গিয়ে দেখা করতে পারো। আর তোমার বাবা-মা আপাতত আমার কাছে আছে। বিয়েটা হলেই তাদেরকে দেখতে পাবে।’
‘উনাদের কিছু করবেন না দয়া করে।’
‘তাহলে বিয়েতে রাজি তুমি?’
মুরতাসিমেরর কথা শুনে আমি আর কিছুই বলি নাই।
‘তোমার চুপ থাকাকেই কি আমি সম্মতি আছে ধরে নিবো?’
.
.
ড্রয়িং রুমে প্রায় পাঁচ-ছয় জন লোক বসে আছে। এদের মধ্যে চাঁদনী আর ওর আম্মুকে ছাড়া আর কাউকেই আমি চিনি না। আমার পাশে আমার বোন তিথী বসে আছে। অন্যপাশে চাঁদনী বসে আছে। কিছুক্ষনের মধ্যে মুরতাসিম আর একজন বয়স্ক লোক প্রবেশ করে ড্রয়িং রুমে। হয়তো হজুর হবে। বিয়ে পড়ানোর জন্যই এসেছে।
.
তিন কবুলের মাধ্যমেই আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এখন আমি আমার স্বামী নামক মানুষটার জন্য অপেক্ষায় আছি তার রুমে বসে। হঠাৎ দরজা খুলে উনি রুমে প্রবেশ করে। গুটিগুটি পায়ে হেটে এসে বেডের একপাশে বসে। আমার ঘোমটা টা সরিয়ে বলেন,
‘মাশা-আল্লাহ! আমার বউটাকে অনেক মায়াবী লাগছে।’
উনার মুখে এক চিলতে হাসি বিরাজমান। উনার কথা শুনে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে উনি আবারো বলে,
‘রাগী মেয়েটা এতো চুপচাপ কেনো? কি হয়েছে খুলো বলো আমাকে সমাধান করার চেষ্টা করবো।’
উনার এরকম সহজ ভঙ্গিতে কথা বলার ধরণ দেখে আমার এখন উনাকে খুন করতে ইচ্ছে করছে।
‘আপনি জানেন না কি হয়েছে? আমার জীবনটা নষ্ট করে এখন বলছেন কি হয়েছে খুলে বলতে! আশ্চর্য্য লোকতো আপনি!’
‘তোমাকে আমি বিয়ে করেছি বি’ষ তো প্রাণ করাই নি নাকি! এখন তুমি তোমার সব উইশ পূরণ করতে পারবে। এখানে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারবো। তুমি নিজেই ভেবে দেখো একা একটা মেয়ে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে?’
উনার কথা শুনে আমার ব্রু যুগল আপনা-আপনি কুচকে গেলো।
‘আপনি আমাকে কি বুঝাতে চাইছেন এখানে? মেয়েরা কেনো কিছু করতে পারবে না! মেয়েরা ছেলেদের থেকে কম কিসে? যে জীবনে কিছু করতে হলে ছেলেদের সাহায্য নিতে হবে!’
‘আমি তোমাকে সেটা বলতে চাইনি। একটা মেয়ে একটা ছেলের থেকে কোনো দিক থেকে পিছিয়ে নেই। কিন্তু আমাদের সমাজ সেটা মানতে রাজি নই। একটা মেয়ে কে যদি কোনো দিক থেকে একটু উন্নতি করতে দেখে তখন আমাদের সমাজ মেয়েটার নামের আগে দুশ্চরিত্রা ট্যাগ টা লাগিয়ে দেয়। তারা এটা বুঝে না উন্নতি শুধু ন’ষ্টা’মি করে হয় না হালাল ভাবেও করা যায়। তাই তো একটা মেয়ের পাশে হয় তার স্বামী নামক ছায়া থাকতে হয় নয়তো বাবা নামক ছায়া। তুমি যদি এখন ও আমাকে তোমার শত্রু ভাবে তাতে আমার করার কিছু নেই। হয়তো আমি তোমাকে বোঝাতে ব্যার্থ হয়েছি। তবে একটা কথা মনে রেখো “একতাই বল” হয়তো ছোট বেলা গল্প হিসেবে পড়েছো কিন্তু এখন জীবনে রিয়েলাইজ করতে পারবে।’
মুরতাসিমের কথা শুনে আমি একদম নিশ্চুপ হয়ে যাই। উনি যতো গুলো কথা বলেছেন সবগুলো সত্যি। আমি জোঁকের বশে হুট করেই বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এসেছি। কি করবো সেটাও আগে থেকে ভেবে রাখিনি। উনি যদি আমার পিছন পিছন না আসতো তাহলে এতক্ষনে আমি শিয়াল-কুকুরের খাদ্য হতাম।
‘কি ভাবছো এতো? আমার সাথে শেয়ার করতে পারো।’
‘কিছু ভাবছি না আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাবো আমি।’
উনি মুখটা ফ্যাকাসে করে বলে,
‘তুমি কি এখনও আমাকে মেনে নিতে পারো নি? নিজের স্বামী হিসেবে না হোক একজন বন্ধু হিসেবেও তো মেনে নিতে পারো!’
‘একটা ছেলে কখনো একটা মেয়ের বন্ধু হতে পারে না। আপনি আমার স্বামী আমি আপনাকে সেই রুপেই গ্রহণ করার চেষ্টা করবো। কিন্তু আমার কিছুদিন সময় লাগবে। বাট আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো আপনি তো বাবা-মায়ের সাথে অনেক মিশে গিয়েছেন তাহলে কিভাবে পারলেন আপনি তাদের সাথে এটা করতে?’
আমার কথা শুনে মুরতাসিম আমার দিকে হতাশ ভঙ্গিতে তাকায়।
‘আমি উনাদের সাথে কিছুই করিনি ফারিহা। আমি তো জাস্ট তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য এটা বলেছি। আমি চাইলে তোমাকে আরো অনেক রকম করে নিজের করে নিতে পারতাম কিন্তু তাতে তোমার সম্মান ন’ষ্ট হতো। তাই তো আমাকে এই মিথ্যে টা বলতে হয়েছে।’
উনার কথা শুনে আমি বলার মতো আর কিছুই খুজে ফেলাম না তাই চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বেডের একপাশে বসে আছি। উনি বেড থেকে উঠে বেডের উপর থাকা ফুল গুলোকে শরিয়ে দিচ্ছে। আমিও বেড থেকে নেমে বেডের উপর থাকা ফুলগুলো সরানোর জন্য হাত দিতেই উনি বলেন,
‘একদম হাত দিবা না ফারিহা গোলাপের কাটা ফুটবে তোমার হাতে।’
আমি উনার কথাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মত করে বেড থেকে ফুল সরাচ্ছি।
‘আউচচ।’
আমার চিৎকার শুনে উনি ফুল সরানো বাদ দিয়ে আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আছেন। উনি তাড়াতাড়ি আমার হাতের আঙ্গুল শক্ত করে চেপে ধরে। আমি ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠি।
‘একদম কথা কথা বলবা না। তোমাকে আমি আগেই বারণ করেছি! শুনেছ আমার কথা? এখন তোমার হাতের কি হবে? গোলাপের কাঁটা যে বিষাক্ত।’
উনার কথা শুনে আমি চুপচাপ দাড়িয়ে আছি। এখানে যদি আমি এখন কিছু বলতে যাই নির্ঘাত উনি একটা থাপ্পড় মেরে দিবে! এদিকে ব্যাথায় আমার আঙ্গুল শিনশিন করছে।
চলবে……
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]