#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [৩৪]
জোছনা রাঙা রাত। আকাশে থালার ন্যায় চাঁদখানা তার আলোর রশ্নি জমিন বুকে ছড়িয়ে দিয়েছে। কী এক রোমাঞ্চকর মুহূর্ত, দমকা হাওয়া বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তরী জানালা মেলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে এই মুহূর্ত ভীষণ রকম উপভোগ করছে।
কানে তার ব্লুটুথ গোঁজা। সিদাতের কন্ঠস্বর শুনছে সে। বিয়ের পর থেকে সিদাতের শো-এর রেগুলার স্রোতা হয়ে গিয়েছে সে। যখনই মিউজিক, বাদ্যযন্ত্র কানে বিঁধত, সঙ্গে সঙ্গে কান থেকে ব্লুটুথ খুলে ফেলে সে। যদিও সিদাতের শো-তে ইদানীং বাদ্যযন্ত্র শোনা যায় কম। কেন তা তরীর জানা নেই।
সিদাতের কথাগুলো তার কাছে অন্যরকম ভালো লাগে। অনুভব-ই হয় না সিদাত তার পাশে নেই। মনে হয় সিদাত যেন তার সাথে নিঃশ্বাসের মতো করে মিশে আছে।
কয়েক মাস আগেও ভাবেনি এই ছেলেটা-ই তরীর ভাগ্যে আছে, এই ছেলেটার-ই অর্ধাঙ্গিনী হবে। আজও মাঝেমধ্যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এই ছেলেটাই তার বর, তার সবথেকে কাছের মানুষ।
তরী খেয়াল করেছে সিদাতকে ভেবে সে আনমনে হাসে, সিদাতের আশেপাশে থাকার জন্যে তার হৃদয় ব্যাকুল থাকে। সিদাতকে দীর্ঘক্ষণ দেখার পর তার হৃদয় সিক্ত হয়। অথবা সিদাতের ভাষায় ভালো লাগায় ভিজে যায়।
সিদাতের ভেজা হৃদয়ের সাথে মিশতে মিশতে ইদানীং তার হৃদয়টাও কেমন ভেজা, সিক্ত লাগে। এরকম আকাশ-পাতাল ভাবতে গিয়ে তরী আপনমনে হাসল।
দিয়া কিছুক্ষণ আগেই তার রুমে গিয়েছে। সাইফ সারাক্ষণ বিভিন্ন কাজে বাইরে থাকে। তাই যখন সাওফ ফিরে, দিয়াকে তাকে সঙ্গ দিতে হয়। সাঈদ সাহেব এবং ফিরোজা হজ করতে গিয়েছেন আজ প্রায় পাঁচ দিন হল।
তরী কী ভেবে তার গোপন সখটাকে উম্মুক্ত করল। স্কেচবুক, পেন্সিল নিয়ে বসল। চাঁদকে লক্ষ্য করে একটা একটি দৃশ্য স্কেচ করল।
চাঁদের চারিপাশে ধবধবে মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। চাঁদ মেঘকে সরিয়ে দিয়ে জমিনে নরম, শান্ত আলো ছড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তরীর অধরে লেপ্টে আছে অদ্ভুত হাসি।
কানে বেজে চলেছে প্রিয় পুরুষের কন্ঠস্বর, আর আনমনে প্রিয় মুহূর্তটি স্কেচ করে সংগ্রহ করছে তরী।
আজ বেশ রাত করেই সিদাত বাড়ি ফিরল। রুমে এসে দেখল তরী পেন্সিল, ইরেজার, স্কেচবুক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। সেগুলোর পাশেই জানালার দিকে মুখ করে সুখ ঘুমে তলিয়ে আছে তরী। জানালা ভেদ করে আসা নরম বাতাস তরীর মুখশ্রী ছুঁয়ে দিচ্ছে।
যার ফলস্বরূপ তরীর সামনের চুলগুলো মৃদু দুলছে। সিদাতের চোখ জুড়িয়ে গেল যেন এই দৃশ্য দেখে। রুমে আসার আগেই দিয়া বলেছিল,
–“তরীকে দেখলাম ঘুমিয়ে গেছে। এখনো কিছুই খায়নি মেয়েটা। দেখো তো উঠিয়ে খাওয়াতে পারো কী না! আর নিজেও আসো খেয়ে যাও।”
কিন্তু সিদাতের ইচ্ছে করল না, এই ঘুমন্ত নিকাব রাণীকে ডেকে তোলার। সে এই মুহূর্তে ঘুমন্ত অবস্থাতেই সুন্দর। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুন্দর।
কাউকে ভালোবাসলে বুঝি তাকে সবসময় সেরা লাগে? তার ঘর্মাক্ত, গুটি গুটি ব্রণ, বাম্পস এর দাগেও বুঝি তাকেই অসাধারণ লাগে, তাকেই আমার জীবনে চাই এরকম অনুভব হয়? সিদাতের মনে হয় তরী-ই তার জীবনে দেখা সেরা নারী, সেরা স্ত্রী। যাকে সিদাত প্রথম ভালোবাসার স্থান দিয়েছে, যাকে স্ত্রী রূপে পেয়েছে।
অবশ্যই মায়েরাও সেরা হয়। কিন্তু ওইযে, সকলেরই নির্দিষ্ট একটা অবস্থান রয়েছে। তাদের নিজেদের অবস্থান থেকে তারা সুন্দর, অমায়িক সুন্দর। একজন জননী রূপে, আরেকজন সহধর্মিণী রূপে।
সিদাত আলতো পায়ে জানালার কাছাকাছি গেল। স্কেচবুক শব্দহীন হাতে নিল। পৃষ্ঠা উলটে দেখল দুইটা স্কেচ। একটি চাঁদের আশেপাশে মেঘের আনাগোণা, অপরটি বিরাট চাঁদের মাঝে একটি তরী নদীতে ভাসছে।
দ্বিতীয় ছবিটি-ই সিদাতকে বেশি আকর্ষণ করল। মন বলল এই ছবিটার অর্থ আছে। সিদাত গভীর চোখে ছবিটা দেখল। হঠাৎ তার মাথায় দুটো এলোমেলো লাইন এল। সিদাত ছবিটি থেকে চোখ সরিয়ে তরীর দিকে তাকালো। ঘোর লাগা কন্ঠে আওড়ালো,
–“আকাশে চাঁদ, নদী কুলে প্রেমের তরী
অসংখ্য চন্দ্র বিলাসে
তরী জুড়ে হারাব, হারাচ্ছি আমি।”
সিদাতের হঠাৎ কী হলো জানা নেই। সে তরীর দিকে এগিয়ে তরীর দিকে ঝুঁকে কপালে অধর ছোঁয়াল। সেই ছোঁয়া দিতে গিয়ে সিদাতের সর্বাঙ্গ জুড়ে শীতল অনুভূতি ছড়ালো। বিছানাটা নীরবে গুছিয়ে সিদাত তরীর পাশেই শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে এক নজরে তরীকেই দেখতে লাগল।
আলতো হাতে তরীর লালাভ গাল ছুঁয়ে দিল। মেয়েটাকে সিদাতের হৃদয়ে বন্দি করে রাখতে ইচ্ছে করে। মায়াভরা মুখশ্রী, লালাভ গাল, চেহারার লাবণ্য সবটাই সিদাতকে অসংখ্যবার পিছলে পড়তে বাধ্য করেছে।
দিয়াকে সিদাত মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছে আজ তারা কেউ-ই খাবে না। এজন্য দিয়াও নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। সাইফ তখনো ল্যাপটপে ডুবে আছে। দিয়া আড়চোখে সাইফের এরকম ব্যস্ততা দেখে গাল ফোলাল। একপ্রকার রাগ করেই চোখ শক্ত করে শুয়ে রইল। সাইফকে দেখবেও না, কথাও বলবে না।
মিনিট দুয়েকের মাঝে সাইফ গায়ের পারফিউমের ঘ্রাণটা দিয়া খুব কাছ থেকে পেল। সেই ঘ্রাণ পেয়েও দিয়া ভ্রুক্ষেপ করল না। আগের ন্যায় নড়াচড়া ছাড়া শুয়ে রইল। হঠাৎ সাইফের শীতল স্পর্শ পেতেই দিয়া দূরে সরে যেতে চাইল। কিন্তু সাইফ তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
–“জামাইয়ের ব্যস্ততা সহ্য করতে পারো না? সহ্য করতে না পারলে পেট চলবে কী করে বউ?”
দিয়া তাও সাইফের থেকে ছোটার চেষ্টা করতে লাগল। সাইফ আবার বলল,
–“আহা, অভিমানী বেগম। এভাবে রাগছ কেন? এসেছি তো সব ব্যস্ততা ফেলে। তাও দূরে সরিয়ে দিবে?”
দিয়া এবারও জবাব দিল না। সাইফ হাল ছেড়ে বলল,
–“ওকে, কিচ্ছু বলতে হবে না। এভাবেই থাকো! ঘুমাতে দাও। নিজেও ঘুমাবা!”
বলেই দিয়াকে জড়িয়ে ধরে সাইফ চোখ বুজল। দিয়া চাপা স্বরে বলল,
–“ঘুমালে আমার ছেড়ে ঘুমান। আমার ভালো লাগছে না!”
সাইফ চোখ বুজেই বলল,
–“আরেকবার নড়াচড়া করলে কালকের ছুটি আমি ক্যান্সেল করে দিব কিন্তু বউ!”
দিয়া সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া বন্ধ করে দিল। সাইফ তবে কাল বাসাতেই থাকবে? মন জুড়ে ভালো লাগা ছেয়ে যায় দিয়ার। অধর বাঁকিয়ে হেসে সাইফের বাহুতে মুখ গুঁজে চোখ বুজল।
পরেরদিন সাইফ, সিদাত দুজনেই বাড়িতে। দিয়া এবং তরীরও আজ কোনো কাজ করা বারণ। খাবার আজ বাইরে থেকে অর্ডার করা হবে। আজ চারজন মিলে একসাথে সময় কাটাবে। আবার নিজেদেরকেও সময় দিবে। বাহির থেকে খাবার আসার পরপর চারজন ছাদের মেঝেতে বসে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
তরী অন্যদিকে ফিরে বসল। আর সিদাত বসল তরীর পিছেই। যার ফলস্বরূপ দুজনের পিঠ একই সংস্পর্শে। সাইফ সিদাতের মুখোমুখি বসায় তরীর মুখ দেখার কোনো রকম পন্থা নেই। তরী খুব সন্তুষ্ট সিদাতের উপর। সিদাত তার পর্দার ব্যাপারটা সেই প্রথম থেকেই খেয়াল রাখছে। সিদাত একদিন উচ্ছাসের সাথে বলেছিল,
–“আমি ভাগ্যবান আমার মূল্যবান নিকাব রাণীকে পেয়ে। মন থেকে দোয়া করি আমার মূল্যবান রাণীর মায়াবী মুখখানা আমি ছাড়া আর কোনো পরপুরুষ স্বচক্ষে না দেখুক।”
—————
রাতে সিদাত এবং তরী পাশাপাশি বসে চা খাচ্ছে। সিদাত হুট করে বলে ওঠে,
–“নিকাব রাণী!”
তরী অস্ফুট সরে বলল, “হুঁ!”
–“তোমার মনে অনেক প্রশ্ন তাই না? আমি এলকোহল খাই..”
তরী সিদাতের এ কথা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে সিদাতের চোখে চোখ রাখে। সিদাত আলতো স্বরে বলল,
–“একটা মিস আন্ডাস্ট্যান্ডিং হয়েছে তোমার। সেই মিস আন্ডাস্ট্যান্ডিং-টা আমি অনেকদিন যাবৎ দূর করতে চাইছিলাম, কিন্তু সময় সুযোগ হচ্ছিল না। সাথে কেন যেন বলতেও পারছিলাম না। শোনো তবে, আমি কখনো এলকোহল মুখে নেইনি। এটার থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতাম। কিন্তু সেদিন…”
বলেই সিদাত ধীরে ধীরে সেদিনের ঘটনা খুলে বলল। তরীর চট করে সেদিনের গুন্ডা লোকগুলোর কথাও স্মরণে আসে। কী বিপদজনক ছিল সেই রাত। ভাগ্যিস আল্লাহ্ সহায় ছিল, নয়তো সেই রাত কীভাবে তারা দুজন মেয়ে এই বিপদ থেকে রক্ষা পেত। সত্যি-ই মাবুদ পাশে থাকলে ভয় কিসের?
সব বলা শেষে সিদাত বলল,
–“ভাইয়া তখন মাত্র ইলেকশনে দাঁড়িয়েছে। এজন্য বিপক্ষ দল ভেবেছিল আমাকে ড্রাগ দিয়ে দুর্বল করবে। কিন্তু সত্যি-ই সেদিন আমি বেঁচে গিয়েছিলাম!”
তরী বড্ড নরম গলায় বলল,
–“রক্ষা করার মালিক আল্লাহ্। তার কাছে ক্ষমার পাশাপাশি শোকরিয়া আদায় করুন।”
সিদাত তাই করল। পরমুহূর্তে দুষ্টু হেসে বলল,
–“সেদিন থেকে তো ঠিকই ভাবছিলে, বড়োলোকের বিগড়ে যাওয়া মাতাল ছেলে তোমার জীবন অতীষ্ঠ করে রেখেছে। তাই না?”
তরী ধরা খেয়ে চুপ করে রইল। আগে যেমন তেমন ব্যাপারটা হলেও এখন সিদাত তার স্বামী। চাইলেও লাজ-শরম গিলে সেসব কথার স্বীকারোক্তি উচ্চারণ করতে পারবে না। এজন্য চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে পরল। সিদাত তরীর এমন নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া দেখে হো হো করব হেসে ওঠল। হাসি থামিয়ে হঠাৎ বলল,
–“নিকাব রাণী! তোমায় বুকে আবদ্ধ করতে চাইছি। আসবে আমার এই তুমিহীন বুকে? মাথা রেখে চোখ বুজবে?”
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]
#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [৩৫]
লাবিবা ওয়াহিদ
তরী বেশ কিছুদিন যাবৎ তার বাড়িতে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিন আকবর সাহেব মেয়ের জন্যে নিত্যনতুন সতেজ বাজার করে আনছেন। আর কামরুন নাহার মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না করছে। মোটকথা, তরীকে ছাড়া তাদের ফাঁকা, অপূর্ণ ঘর আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আকবর সাহেব ভীষণ খুশি মেয়েকে পেয়ে।
সাবিয়া এখন দাখিল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আরও চারটা পরীক্ষা বাকি তার। তাই সে চাইলেও পারছে না বোনের সাথে চুটিয়ে গল্প করতে। সাবিয়া দুঃখে জর্জরিত হয়ে বারংবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেও ঘুমানোর সময় ঠিক-ই বোনকে পায়। তরী ঘুমানোর আগে এবং ফজরের নামাজের পরপর সাবিয়াকে সঙ্গ দেয়। পড়াশোনার পাশাপাশি মানসিক ভাবেও সতেজ, স্বচ্ছল থাকা জরুরি।
রাতে সাবিয়া ঘুমিয়ে যাওয়ার পরপরই সিদাত কল দিল তরীকে। তরী কল রিসিভ করে সর্বপ্রথম সালাম দিল। সিদাত সালামের উত্তর নিয়ে বলল,
–“কেমন আছ?”
–“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি? অফিস থেকে ফিরেছেন?”
–“আমিও ভালো। কিছুক্ষণ আগেই ফিরলাম। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিচ্ছি!”
–“খাবেন না?”
–“বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। ভাবীকে ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছে করে না!”
তরী নীরবে শুনল। সিদাতও নিশ্চুপ হয়ে গেল। ফোনের দু’প্রান্তে দুজন নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে। সিদাত ম্লান গলায় বলল,
–“তোমাকে মিস করছি নিকাব রাণী!”
তরীর সর্বাঙ্গ শিহরিত হল সিদাতের বলা এই বাক্যে। কেমন মন নাড়িয়ে তোলার মত কন্ঠস্বর ছিল। তরী খুবই চাপা গলায় বলল,
–“একদিন এসে থেকে যান। বাবা আপনাকে আসতে বলছিল বারবার!”
সিদাত কিছু একটা ভাবল। ভেবে বলল,
–“দেখি, কী করা যায়। তবে আমি কিন্তু বলিনি ফিরে আসতে। যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারো!”
তরী চাপা হাসি দিল। সিদাতের ফিরে না আসার কথার মাঝেও অন্যকিছু শোনাচ্ছে। যেন সিদাত বলতে চাইছে,
–“এই তরী? আমি এখনই চলে আসি তোমাকে নিয়ে যেতে?”
তরীর ভাবনা আসলেই বাস্তবে রূপান্তরিত হল। সিদাত ফজরেই চলে এসেছে। তবে তরীর বাসাতে প্রবেশ করেনি। অনয়ের বাসাতে থেকেছে। তরী নামাজ শেষ করতেই ফোনের রিংটোন পেয়েছে। ফোন হাতে নিতেই দেখল সিদাত। তরী কল রিসিভ করতেই সিদাত বলে ওঠে,
–“সকালের নাস্তা নাহয় শাশুড়ি মায়ের হাতে খাব। এখন তুমি আমার জন্যে চা বানাও তো। চা বানিয়ে আমাকে ডাক দিও!”
তরী ভীষণ চমকালো সিদাতের এ-কথা শুনে। অবাক গলায় বলল,
–“মানে কী?”
–“আমি এখন অনয়ের বাসায় আছি। আমার ভেজা হৃদয় দুপুরের রোদের মতো তীক্ষ্ণতায় উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। এজন্যে তোমার সংস্পর্শে এসে আবারও আমার হৃদয় ভেজা, শীতল করতে এসেছি। চা টা আস্তে ধীরেই বানিয়ে এনো!”
সিদাত কল কেটে দিলে তরী আপনমনেই হাসল। অস্ফুট স্বরে বলল,
–“আসলেই পাগল হয়ে গিয়েছে!”
হঠাৎ পাশ থেকে সাবিয়া বলে ওঠে,
–“কে পাগল হল আপু? ভাইয়া?”
তরী তার সম্বিৎ থেকে ফিরে সাবিয়ার দিকে চাইল। সাবিয়া মিটিমিটি হাসছে। তরী অপ্রস্তুত স্বরে বলল,
–“ক..কই?”
–“কিছু তো একটা আছেই। ভাইয়া আসবে নিশ্চয়ই?”
সাবিয়ার দেওয়া খোঁচায় তরী খানিক লজ্জা পেল। তরীর লাজ রাঙা মুখ দেখে সাবিয়া হো হো করে হেসে দিয়ে বলল,
–“ভাইয়া আসলে আমাকে ডাক দিও আপু। আমি এখন ঘুমাতে যাচ্ছি!”
বলেই সাবিয়া ঘুমাতে চলে গেল। আর তরী সেখানেই মিনিট দুয়েক নীরবতা পালন করে রান্নাঘরে চলে গেল। কামরুন নাহার এখনো রান্না ঘরে ঢোকেনি। আকবর সাহেব ফিরবেন প্রায় ছ’টা নাগাদ। বাহিরে এখনো আলো ফোটেনি। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেই আকবর সাহেব ফিরবেন। তরী এই সুযোগে চা করে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে আসতেই দেখল অনয়ের ফ্ল্যার্টের দরজার সাথে হেলান দিয়ে সিদাত চোখ বুজে আছে।
তরীর উপস্থিতি টের পেতেই সিদাত চোখ খুলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তরীর চোখ জোড়া দেখে চওড়া হাসি দিল। যেন মরুভূমির শহরে ফুল ফুটেছে। অনয় তখনই গরম মাথায় দরজা খুলে সিদাতের উদ্দেশ্যে বলল,
–“শালার পুঁত! তোর এই বাজে, ঘাউড়া স্বভাব জীবনেও যাইবে না। একশোবার বলেছি আমার ঘুমের সময় এসে ডিস্টার্ব দিবি না। তুই যেই লাউ হেই কদু! আমা..”
তরীকে না দেখেই অনয় অনর্গল বলে যাচ্ছিল। যেই তরীকে নজরে এলো সে সঙ্গে সঙ্গে চুপসে গেল। সামান্য লজ্জিত অনুভবও করল। কীসব বলে ফেলেছে বন্ধুর বইয়ের সামনে। অনয় হাসার চেষ্টা করে আমতা আমতা করল,
–“আসসালামু আলাইকুম ভাবী। ভালো আছেন?”
তরী হতবাক হয়ে অনয়ের বলা কথাগুলোই ভাবছিল। অনয়ের মুখে হঠাৎ “ভাবী” ডাক শুনে তরী একটু অপ্রস্তুত এবং লজ্জিত হল। কেমন অদ্ভুত ভালো-লাগাময় অনুভূতি। তরী সালামের উত্তর নিয়ে হালকা কুশল বিনিময় করল অনয়ের সাথে। অনয় বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি। কোনোরকমে পালিয়েছে। সিদাত স্মিত হেসে বলল,
–“ছাদে যাই চলো। অনেকদিন একসঙ্গে সূর্যদ্বয় দেখা হয়নি!”
তরী ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে সিদাতের সাথে গেল। ছাদে আসতেই তরী হঠাৎ বলল,
–“অনয় ভাইয়া এত বিরক্ত হল যে? আপনি আমাদের বাসাতেই আসতে পারতেন।”
সিদাত হেসে দিল তরীর কথা শুনে। হাসি থামিয়ে বলল,
–“আরেঃ, এত সিরিয়াস কিছু না। ওকে জ্বালানোটা আমার অনেকদিনের রোগ। এই রোগ আমি সহজে ছাড়তে পারি না। এতদিন তুমি আমার কাছে ছিলে বিধায় রোগটা প্রকাশ্যে আসেনি। হঠাৎ মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠে।”
তরীও আলতো হাসল। সিদাতের দিকে চা এগিয়ে দিতেই সিদাত ভুরু কুচকালো। বলল,
–“বলেছি না সবসময় দুই কাপ চা বানাবে? আমি একা চা কেন খাব?”
তরী জিভে কামড় দিল। সিদাতের এটা অঘোষিত নিয়ম সে কিছুতেই একা চা কিংবা কফি খায় না। সে ভালোবাসা ভাগাভাগিতে বিশ্বাসী। তরী কিছু না বললেও সিদাত আবার বলল,
–“সমস্যা নেই, আবারও এক কাপে চা খাবো। দেখি, তুমি চুমুক দাও তো!”
তরী কঠিন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। আমতা আমত্ব করে বলল,
–“আমি কী করে..?”
–“হাসবেন্ডের কথা অমান্য করতে নেই। খাও তো!”
তরী চুমুক দিয়ে অল্প করে খেল। যদিও খেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু একঘেয়ে সিদাতকে এটা কী করে বোঝাবে? সে বুঝেও অবুঝ থাকার ভাণ করবে। তরীর চুমুক দেওয়া শেষ হতেই সিদাত কেড়ে নিল চায়ের কাপ। তরীর দেওয়া চুমুকের স্থানে অধরে ছুঁয়ে চুমুক দিয়ে মুখভঙ্গি অন্যরকম করে বলল,
–“আহ্! এই চায়ের তৃপ্তি একদম অমৃত।”
তরী লাজে লাল হয়ে গেল। দ্রুত সূর্যদ্বয়ে নজর ফেলল। সিদাত আড় চোখে তরীর দিকে চেয়ে চাপা হাসি দিল।
তরীরা এখন যেই এপার্টমেন্টে আছে সেটা সিদাতের বাবার-ই একজন পরিচিত বন্ধুর। সে ফ্ল্যাট ভাড়া দিবে বলে সিদাত-ই অনয়কে এখানে আসার জন্যে সাজেস্ট করেছিল। পরিবেশ, এলাকা দেখার পর আকবর সাহেব যখন বলেছিল তাদের জন্যে বাসা খুঁজছে, তখন অনয়ের মনে হচ্ছিল তাদের জন্যে এই নিরিবিলি, কোলাহল ছাড়া এলাকাই ভালো হবে। এজন্য চট করে সেও এই এলাকা এবং এই এপার্টমেন্ট সাজেস্ট করে৷ এখানের মাত্র এক দুইটা এপার্টমেন্ট-ই পুরোপুরি ভাড়া দেওয়া শুরু হয়েছে। বাকি কিছুর কনস্ট্রাকশন চলছে। এই কনস্ট্রাকশন গুলোর মধ্যে একটি সিদাতের বাবারও আছে। এছাড়া সে এদিকে আরও জমি কিনে রেখেছেন, যেগুলো পরবর্তীতে কাজ ধরার পরিকল্পনা রয়েছে। এই এলাকাটা ম্যাপ অনুযায়ী আবাসিকে পড়ে গিয়েছে। ফ্ল্যাট ভাড়ার পাশাপাশি এদিকটায় ফ্ল্যাটও বিক্রি করা হবে। আকবর সাহেবের এই নিরিবিলি এলাকা এতটাই পছন্দ হয়েছে যে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানে একটা ফ্ল্যাট সে কিনবেই।
সিদাত চা খেতে খেতে বলল,
–“জানো, নিকাব রাণী। আজ মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম!”
তরী ঘাড় বাঁকিয়ে চাইল সিদাতের দিকে। সিদাত শূন্য চোখে দূরে চেয়ে আছে। এই মুহূর্তে তরী কিছু বলার ভাষা পেল না। সিদাত আবার বলল,
–“মাকে দেখার পর আর ঘুমাতে পারেনি। ফজরের আগে আগে মায়ের কবর জিয়ারত করেছি, এরপর নামাজ পড়ে সোজা এখানে। তোমাকে দেখে আমি আমার চোখের শান্তিও খুঁজে পেলাম তরী!”
তরী মাথা নিচু করে ফেলল। সিদাত আবার বলল,
–“তুমি হচ্ছ আমার প্রেম তরী। আমার মনের ঘাটে এসে ভীড় করেছ। এরপর আমি তোমাকে আগলে নিয়েছি ভালোবাসা দ্বারা। আর তুমি আমায় উপহারস্বরূপ দিয়েছ একজন ছায়া, খুশি, মানসিক শান্তি।”
তরী হঠাৎ সিদাতের হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
–“আমি অসংখ্য বার আপনার হৃদয়ের ঘাটে গিয়ে পৌঁছাতে চাই।”
সিদাত তরীর দিকে তাকাল। সদ্য ওঠা সূর্যের নরম কিরণে তরীর মুখখানা জ্বলজ্বল করছে। সিদাত তরীর কপালে অধর ছোঁয়াল। এতে তরীর সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল সে। সিদাত হঠাৎ বলে ওঠে,
–“ভালোবাসি তোমায় নিকাব রাণী!”
——————
মেয়ে জামাইয়ের খবর পেয়ে কামরুন নাহার তড়িঘড়ি করে একা হাতে কয়েক পদের নাস্তা বানিয়ে ফেলল। সিদাত খাবার টেবিলে বসে আকবর সাহেবের সঙ্গে হাসি-মুখে কুশল বিনিময় করছে। আকবর সাহেব হেসে বলল,
–“তরীর মামা ঘন্টাখানেক আগে কল দিয়েছিল। তুমি এসেছ শুনে কী খুশি। বলল আজই নাকি চলে আসবে। তাই থেকে যাচ্ছ তো তুমি?”
সিদাত বারণ করল না। মানুষের মধ্যে থাকলে তার-ই ভালো লাগবে। সকলে একসাথে বসেই নাস্তা করল। খাওয়ার মাঝে আকবর সাহেব বারবার সিদাতের পাতে এটা ওটা তুলে দিচ্ছিল। সিদাত বারণ করলেও আকবর সাহেব শুনেনি। সকলে সিদাতকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কৌশলে সিদাতও তরীর পাতে এটা ওটা তুলে দিয়েছে। মাঝে দিয়ে তরীর হঠাৎ কাশি উঠেছিল। সিদাত পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বিচলিত কন্ঠে বলল,
–“পানিটা দ্রুত খেয়ে নাও!”
তরী পানি খেয়ে ঠিক ভাবে বসতেই সিদাত আবার বলল,
–“ঠিক আছ?”
তরী খাবারের থালায় চোখ নামিয়ে শুধু আলতো করে মাথা নাড়ল। সিদাতের এই যত্ন গুলো আকবর সাহেব, কামরুন নাহার উভয়েই লক্ষ্য করল। দুজনের ভেতরেই দমকা শান্তি ছুঁয়ে গেল। তৃপ্তি এবং স্বস্তিরে ভরপুর হল তাদের মুখশ্রী। মেয়ের জামাই মেয়ের প্রতি যত্নশীল হবে, এ-ই তো চাইত তারা। বোধহয় উপরওয়ালা তাদের এই ছোটো ছোটো চাওয়া গুলো পূরণ করেছে।
~[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।