হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব ৩২+৩৩

0
452

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [৩২]

দিন পেরিয়ে রাত হলো। মাঝে দিয়ে কেটে গেল আরও একটি বিষাদময় দিন। আত্নীয়-স্বজন এখনো অনেকেই রয়ে গেছে। আবার কিছু জন চলে গেছে। দ্বিতীয় দলে যুক্ত হবে আকবর সাহেব এবং তার পরিবার। তরীকে এখানে রেখে আজ তারা বিদায় নিবে। প্রয়োজনে কাল আবার আসবে। তবুও আর একদিনও থাকা সম্ভব না।

সাঈদ সাহেব জোর করেও রাখতে পারল না। আকবর সাহেব হাসি-মুখে জানায়,
–“আর আটকাবেন না ভাই। দরকার লাগলে আবার আসব। তবুও আজকের মত বিদায় চাচ্ছি!”

সাঈদ সাহেব হতাশ হলেন। তরী যখন জানতে পেরেছে তার বাবা-মা চলে যাচ্ছে তখনই সে মাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে কাঁদল কিছুক্ষণ। তার ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে কেমন! কামরুন নাহার চমৎকার মানুষ। তিনি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও বেশি না কেঁদে মেয়েকে বোঝাচ্ছেন। বলছেন এটাই জাগতিক নিয়ম। একজন মেয়ে সারা জীবন তার বাবা-মায়ের কাছে থাকতে পারে না। কিন্তু তরী একসঙ্গে দুটো শোক কিছুতেই নিতে পারছে না। হঠাৎ তরী কেমন অবুঝ হয়ে পড়েছে। কামরুন নাহার হার না মেনে ধৈর্য ধরে মেয়েকে বোঝাচ্ছে।

কামরুন নাহারের পরিবার মোটেও পুরোপুরি ধার্মিক না। সকলেই আধুনিক জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পছন্দ করত আগে থেকেই। কিন্তু কামরুন নাহার তাদের মতো পরিবারে একজন ব্যতিক্রমধর্মী মেয়ে হল। পর্দা, নামাজ-কালাম, তিলওয়াত, জিকির সবটাতে-ই সে ধীরে ধীরে ডুবে গেল। এতে অবশ্য সবাই বেশ সন্তুষ্ট ছিল। রাজিবের ইচ্ছে হল তার বোনকে তার সেরকম-ই নামাজ-কালাম করা ছেলের সাথে বিয়ে দিবে। সেই ছেলের আয় রোজগার কম হলেও তার কোনো সমস্যা নেই। কামরুনের মাও এতে সম্মতি জানায়। মাস ছয়েক পরপরই ঠিক এরকমই মনমতো এক প্রস্তাব আসল। ছেলে মোয়াজ্জেম। পাশাপাশি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। সেই ছেলেটাই আজকের আকবর সাহেব।

এত বছর পর আকবর সাহেবেরও এরকমই তীব্র এক ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মাবুদের পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল দেখেই তরী এরকম একটি পরিবেশে জড়িয়ে গেল। বিয়ে হল এক মিডিয়া পাড়ার ছেলের সাথে। সিদাতের তরফ থেকে প্রস্তাব আসার পরে আকবর নিজেই সিদাতের অফিস গিয়েছিল সিদাতের কার্যক্রম দেখতে। সিদাত তখনো জানত না যে আকবর সাহেব এসেছে। আকবর সাহেব নিজের পরিচয় গোপন করে সিদাতের কলিগদের থেকে টুকটাক জিজ্ঞেসও করেছে সিদাতকে নিয়ে। সিদাতকে নিয়ে সকলের ইতিবাচক কথা শুনলেও আকবর সাহেব স্বস্তি পাননি। এজন্যই সে বারণ করে দিয়েছিলেন।

আকবর সাহেব অবশ্য অফিসে ঢুকেছিল রাজিবের সাথেই। রাজিব-ই সিদাতকে কল করে জানিয়েছে সে অফিস যাবে, সিদাতের সাথে দেখা করতে। এজন্য সিদাত আগেই অফিসের ঢোকার মুখে সিকিউরিটি গার্ডদের ব্যাপারটা জানিয়ে রেখেছিল। রাজিবের সাথে সিদাতদের এত সুন্দর সম্পর্কের কারণ আকবর সাহেব জানে। সাঈদ সাহেব নিজেই জানিয়েছিল। সাত বছর আগে যখন জয়া এক্সিডেন্ট করে তখন রাজিব-ই নাকি তাকে হসপিটাল নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকেই তাদের মধ্যে পরিচিতি।

যখন সিদাত রাজিবের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তখনই আকবর সাহেব এসব করেছেন। শেষে গিয়ে সিদাত দেখতে পায় আকবত সাহেবকে। সাধারণ কুশল বিনিময়ের পরপরই তাদের বিদায় জানায় সিদাত। কারণ আকবর সাহেবের বাসায় যাওয়ার তাড়া ছিল।

আকবর সাহেব সিদাতের হাতে তরীর হাত তুলে দিল। ব্যথিত স্বরে বলল,
–“আমি বুঝতে পারছি এই সময়টা খুব কঠিন। তবুও আমার মেয়েটাকে, আমার রত্নকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। এত বছর আমি আমার মেয়েটাকে যেভাবে রেখেছি, তোমার কাছে অনুরোধ রইল তুমি আমার মেয়েটাকে নিজের সাধ্য মতো গুছিয়ে রেখ। আমার মেয়েটা অল্পতেই খুশি, অঢেল ধন-সম্পদের প্রয়োজন নেই তার। শুধু তরীর বক্ষ-ছায়া হয়ে থেক।”

তরী অধর চেপে ঝাপসা চোখে আকবর সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। সিদাত দু’হাতে তরীর হাত আগলে বলল,
–“আমি তরীর জন্যে বক্ষ-ছায়ার সঙ্গে একজন ভরসার মানুষও হব আঙ্কেল। আপনি শুধু দোয়ায় রাখবেন। আপনাকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিব না আমি। তরী আমার জীবনের অংশ।”

তরী মাথা নিচু করে ফেলল সিদাতের কথা শুনে। আকবর সাহেব ভরসা পেলেন। যেই ছেলে মায়ের জন্যে এতটা ভেঙে গুড়িয়ে গেছে সে নিশ্চয়ই পারবে তার মেয়েকে আগলে রাখতে। ছেলেটার মায়ের প্রতি ভালোবাসা অসীম। আকবর সাহেব তরীকে আগলে নিলেন। কিছুক্ষণ মেয়েকে সময় দিয়ে ওরা বিদায় নিল। যাওয়ার আগে সাবিয়া খুব কান্না-কাটি করেছিল। তার একমাত্র সঙ্গী, তার একমাত্র ভালোবাসার বোনকে ছাড়া তাকে একা থাকতে হবে। তরী বোনের এরকম কান্না দেখে নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি। দুই বোন একে অপরের প্রাণ ছিল। সেখানে দুজন আলাদা হয়ে গেল!

দিয়া তরীকে সিদাতের রুমে দিয়ে এল। সাঈদ সাহেব তার ম্যানেজারকে দিয়ে তরীর যাবতীয় প্রয়োজনীয় সবকিছু তরীর বাড়ি থেকে আনিয়ে নিয়েছে। বিয়েটা আয়োজন ছাড়াই হয়েছে। এতে আকবর সাহেবের কোনো সমস্যা নেই। কারণ জাকজমকপূর্ণ বিয়ের চাইতে কম খরচের বিয়ে ভালো। আয়োজন ছাড়া বিয়ে নিয়ে তরী বা সিদাতের মধ্যেও ভ্রুক্ষেপ দেখা যায়নি। এছাড়া পরিস্থিতিও এরকম হয়েছে যে বিয়ের আয়োজনের কথা কারো মাথাতেই বিরাট প্রভাব ফেলেনি।

তরী ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই দেখল সিদাত রুমের অন্য পাশে টি-শার্ট খুলছে। কী ভেবে পিছে ফিরে তাকাতেই সে অপ্রস্তুত হল৷ কোনো রকমে গায়ে শার্ট জড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,
–“দুঃখিত। বুঝতে পারিনি এই সময়েই চলে আসবে। আমি মোটেও তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইনি!”

তরী অবাক চোখে দেখল সিদাতের এরকম ব্যস্ত হওয়া দেখে। এখন তারা স্বামী-স্ত্রী। ঘরের মধ্যে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। তরী নিজেকে সামলে নিল। বুঝল সিদাতের এসব বলার কারণ। তবে মনে হলো তরীর চাইতে সিদাত দ্বিগুণ অবাক হল। তরীকে ভেজা চুলে এই প্রথম দেখল সে। রূপ যেন মেয়েটার চুইয়ে চুইয়ে পরছে। এই পবিত্র মুখটা, এই পবিত্র মেয়েটা তার স্ত্রী, ভাবলেই কেমন গা শিউরে উঠছে তার। পরমুহূর্তেই চোখ নামিয়ে ফেলল। মায়ের শূন্যতার পাশাপাশি হৃদয় জুড়ে অন্য রকম অনুভূতি বিচরণ করছে। সেই অনুভূতি অবশ্য ক্ষণস্থায়ী ছিল। সিদাত মাথা নিচু করে বলল,

–“আমি নিচে থেকে খাবার আনিয়ে নিচ্ছি। তোমার এখন রুম থেকে বেরুনোর দরকার নেই। এখানেই খেয়ে নাও। আমি নাহয় নিচে থেকে খেয়ে আসছি!”

সিদাতের কথা শুনে তরীর মন খারাপ হয়ে যায়। পরিবার থাকতে সে কেন একা খাবে? একা খাওয়ার অভ্যেস যে একদমই নেই তরীর। তবুও তরী মুখ ফুটে কিছু বলল না। কিন্তু সিদাত তরীর চেহারা জুড়ে থাকা বিষণ্ণতা কিছুটা আঁচ করতে পেরে ফ্যাকাসে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

–“বেশি চিন্তা করিও না তরী। তুমি বেশি মানুষদের মাঝে অস্বস্থি অনুভব করো। তাই আমি নিচে বাবাদের সঙ্গ দিয়ে শুধুমাত্র কয়েক লোকমা খাব। বাকিটা রুমে এসে তোমার সাথে বসে খাব। চলবে?”

মুগ্ধতায় তরীর দেহ জুড়ে প্রতিটি রন্ধ্র কেমন সুভাসিত হয়ে গেল। তরী তার ভালো লাগার রেশ কাটাতে পারল না। সিদাত তরীর কাছে এসে তরীর গাল আলতো ছুঁয়ে বলল,
–“তবে অপেক্ষা করো। আমি বেশি সময় নিব না।”

সিদাত প্রায় আধঘন্টা সময় নিল। এখনো আসেনি। তরী খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে সিদাতের অপেক্ষায়। তরী আগে দেখত তার বাবা বাড়ি না ফিরলে কামরুন নাহারও এভাবে খাবার নিয়ে বসে থাকত। অপেক্ষা করত আকবর সাহেবের। এই ছোটো ছোটো ভালোবাসা, অনুভূতি গুলো তরী খুব পছন্দ করে।

সাথে তরী মনে-প্রাণে মাবুদের নিকট ক্ষমা চাইছে সিদাতের সেই ভুলের জন্য। সিদাত ওই অখাদ্য জেনেই খাক কিংবা না জেনে, সিদাতকে যেন পরম করুণাময় মাবুদ তাকে ক্ষমা করে দেয়।

সিদাত আসল চল্লিশ মিনিটের মাথায়। এসে দেখল মাথার ওপরের সিলিং ফ্যানটা খুব অল্প গতিতে ঘুরছে। এসিটাও বন্ধ। বোধহয় তরী খাবার যাতে ঠান্ডা না হয় সেই চেষ্টাই করছে। সিদাত তরীর সামনে রাখা খাবারের প্লেটটি ঢেকে রাখা অবস্থায় দেখতে পেল। সিদাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাত ধুঁয়ে তরীর পাশে বসে। খাবারের প্লেট হাতে নিতে নিতে বলল,
–“বেশি দেরী করে ফেললাম বুঝি?”

তরী মাথা নিচু করে নেতিবাচক মাথা নাড়ায়। কেমন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে। সিদাত মুচকি হেসে এসিটা অন করে দিল। বলল,
–“আর কষ্ট করে গরম সহ্য করতে হবে না!”

–“কিন্তু আমার গরম লাগছিল না!”

–“তাই? এসো। আজ আমি তোমাকে খাইয়ে দিব।”

তরী ভীষণ অবাক হল। লজ্জায় আবৃত হয়ে বারণ করল। কিন্তু সিদাত শুনেনি। তরীকে খাইয়ে দিল এবং নিজেও খেয়ে নিল।

সবকিছু স্বাভাবিক হলেও রাতের অন্ধকারে সিদাত নীরবে চোখের পানি ফেলল। মা হারানোর শোক এত জলদি ভুলা সম্ভব? সিদাতের পাশে অর্থাৎ কিছুটা দূরত্বে শোয়া তরী সিদাতের নীরব কান্না টের পেল। তরী ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। সিদাতের কাঁধে কম্পিত হাত খানা ছুঁয়ে খুবই নরম, মৃদু গলায় বলল,
–“মায়ের কথা মনে পড়ছে?”

সিদাত ভাঙা গলায় “হুঁ” বলে তরীর হাতটা দু’হাতে জড়িয়ে নিল। যার ফলস্বরূপ তরী অর্ধেক বসা অবস্থাতেই রইল। এভাবে ঘন্টাখানেক কেটে যায়। তরীর পা ভয়াবহ রকম ঝিমঝিম করছে। সে না পেরে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঝিমঝিমের মাত্রাটা যেন খুব বেড়ে যায়। তরী সেই মাত্রাটা সহ্য করতে না পেরে কিছুটা সিদাতের দিকে হেলে পড়ল। মৃদু আওয়াজ বেরুল মুখ থেকে। সিদাত তরীর মুখে এরকম আওয়াজ শুনে কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠে বসতে চায়, কিন্তু তরী এতে বাঁধা দিয়ে বলল,
–“উঠবেন না। শুয়ে থাকুন। আমি ঠিক আছি!”

–“কী হয়েছিল? কোনো সমস্যা?”

তরী কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
–“এক ভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকায় পা গুলো একটু ঝিমঝিম করছিল।”

–“এখন?” সিদাতের চিন্তিত সুর।”

–“স্বাভাবিক হচ্ছে!”

–“এতক্ষণ বলো নি কেন?”

তরী আঁধারেই সিদাতের চোখ জোড়া খুঁজে বেড়াল। অনুমান করে সিদাতের দিকে চেয়ে বলল,
–“আপনার স্বস্থিতে ব্যঘাত ঘটাতে ইচ্ছে করেনি!”

তরীর এ-কথা শুনে সিদাত বিস্মিত হয়। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
–“বিয়ের আগে তো আমাকে পছন্দ করতে না, কঠিন কথা ছাড়া কিছু বলতে না। হঠাৎ পরিবর্তন?”

–“বিয়ে সম্পর্কটা আমার কাছে খুব দামী। তাই বিয়ের আগের সময় গুলোতে আমি কঠিন ভাবে থাকার চেষ্টা করেছি, যেন আমার এই সরলতা আমার স্বামী সবটা জুড়ে পায়। হয়তো আপনার সাথে সবটা মানিয়ে নিতে আমার একটু সময় লাগবে। তবে আমি এখন থেকেই চেষ্টা করছি, আপনার সাথে মেশার। আপনাকে বোঝার। যাতে আন্ডারস্ট্যান্ডিং-টা সহজ হয়!”

সিদাত মুগ্ধ হল। এরকম স্ত্রী পাওয়া সত্যি-ই তার জন্যে ভাগ্যের ব্যাপার। খুব কম মানুষের ভাগ্যেই বোধহয় এরকম স্ত্রী জুটে। যারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। সিদাত বোধহয় সেই ভাগ্যবান পুরুষদের খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছে। এরকম স্ত্রীর জন্যে সিদাত তার সাধ্যমতন সব কিছুই করতে রাজি। সিদাত অস্ফুট স্বরে বলল,
–“মা চলে যাওয়ার আগে আমাকে এক দারুণ উপহার দিয়ে গেছে। এই উপহারের সঠিক মর্যাদা আমি কী দিতে পারব?”

তরী কিছু বলল না, নীরবে হাসল। কিছুক্ষণ বাদে বলল,
–“তাহাজ্জুদের সময় হয়ে গিয়েছে। আসুন এক সাথে নামাজটা পড়ি। মাকে দোয়ায় রাখলে মনে শান্তি অনুভব করবেন!”

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। গগঠনমূলক মন্তব্যদের প্রত্যাশায় রইলাম।।

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [৩৩]

আজ জয়ার মৃ*ত্যুর চারদিনের মিলাদ পড়ানো হল। মাদ্রাসার বাচ্চাদের দিয়ে কুরআন পড়ানো হয়েছে, তাদের খাওয়ানো হয়েছে। এতিম খানার বাচ্চাদেরকেও খাবার পাঠানো হয়েছে। বলা বাহুল্য বেশ বড়ো আয়োজন করেছেন সাঈদ সাহেব। সব আয়োজন বাচ্চাদের এবং হত- দরিদ্রদের জন্য। আকবর সাহেবরা যাওয়ার পরদিন-ই দুই ভাই বুকে পাথর চেপে আয়োজনের ফর্দ এবং কাজে মশগুল হয়ে গিয়েছিল। তরী এবং সিদাতের সম্পর্ক দুই দিনে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। দিয়া এবং তরীর সম্পর্কটাও খুব দারুণ হয়েছে। দিয়ার একমাত্র সঙ্গী এবং তরী-ই। দিয়ার সব কাজেই তরী তাকে সাহায্য করে। ফিরোজা এখন একা একা থাকে। আবার দু’এক সময় বউদের কাজে সাহায্যও করে।

আত্নীয় স্বজন আবারও ভীড় জমিয়েছে আহমেদ ভিলা তে। আজ দিয়ার বাবা-মা, তরীর পরিবারও এসেছে। আকবর সাহেব মেয়েকে বারবার জিজ্ঞেস করেছে, এই বাড়িতে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কী না, সিদাত তার খেয়াল রাখছে কী না। তরী তার বাবাকে মুখ ফুটে শুধু এইটুকুই বলেছে,

–“সব ঠিক আছে বাবা। সকলেই খুব আন্তরিক।”

আর মায়ের কাছে টুকিটাকি কথা শেয়ার করেছে। সিদাত কী রকম, কেমন খেয়াল রাখছে, বাকিদের ব্যবহার সবটাই মাকে বলল। কামরুন নাহার সব শুনে আকবর সাহেবের সাথে ব্যাপারটা বললে আকবর সাহেব স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। মনে হল বুকে থাকা শক্ত ধাঁচের পাথরটি নেমে গেল।

রাতে আবার সকলে বাড়ির পথে রওনা হল। মানুষ জনে গিজগিজ করা বাড়িটা আবারও কেমন খালি হয়ে গেল। দিয়া সাইফের জন্যে কফি করে নিয়ে গেল। তরী ফিরোজার থেকে জেনে নিয়ে সিদাতের জন্যে চা বানাল। সিদাত চা এবং কফি দুটোই খায়। তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে। তরী দুই কাপ চা বানাল। এক কাপ হাতে নিয়ে বলল,

–“বাবাও বোধহয় এখন চা পিপাসায় ভুগছে। এজন্যে এক কাপ বেশি বানালাম!”

ফিরোজা আলতো হেসে বলল,
–“ঠিক বলেছ। তুমি গিয়ে সিদাতকে চা টা দাও। আমি তোমার বাবাকে চা দিয়ে আসছি!”

তরী ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। ফিরোজা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে চা নিয়ে গেল সাঈদ সাহেবের রুমের দিকে। দরজার সামনে এসে পা থামিয়ে ভেতরটা পরখ করে নিল। সাঈদ সাহেব আরাম দায়ক চেয়ারে বসে জানালা ভেদ করে অদূর আকাশে চেয়ে আছে। ফিরোজা হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিল। অতঃপর ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে চা টা সাঈদ সাহেবের কাছাকাছি রেখে নীরবে আবার ফিরে আসতে গেলে সাঈদ সাহেব খুবই নরম গলায় বলল,

–“আমাকে মাফ করে দিও, আমার বোকামীর আচরণে!”

ফিরোজা চমকালো সাঈদ সাহেবের কথায়। সাঈদ সাহেব হালকা নড়ে চড়ে পাশ ফিরে ফিরোজাকে পরখ করে নিল। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–“আমি এতদিনে উপলব্ধি করেছি, এসকল পরিস্থিতির পেছনে তোমার হাত নেই। তবুও নীরব, প্রকাশ্যে তোমাকে এতটা দিন অবহেলা, লাঞ্চিত করে গিয়েছি। তোমার অধিকার থেকে তোমায় বঞ্চিত করেছি। ভুলে গেছিলাম জয়ার মতই তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। তুমিও আমার স্ত্রী। শুধুমাত্র “দ্বিতীয় স্ত্রী” বলে তোমায় অবহেলা করতাম, কষ্ট দিতাম। কিন্তু স্ত্রী তো স্ত্রী-ই হয়। সকল স্ত্রীকেই সমান চোখে দেখতে হয়, যা আমি শ*তানের ধোকায় পড়ে ভুলে বসেছিলাম। বারবার মন বলতো আমি আমার জায়গায় ঠিক!”

সাঈদ সাহেব থামল। ফিরোজা কথার মাঝেই পিছে ফিরে তাকিয়েছে। তার চোখ-মুখে বিস্ময় ভরা। সাঈদ সাহেব পরপর দু’বার চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“সেই দুর্ঘটনার পরপরই বোধহয় জয়া আন্দাজ করেছিল তার হাসি-খুশির দিনগুলি অল্প সময়ের। সে না থাকলে আমি থাকব কী করে? এছাড়া ছেলে দুটোর কী হবে? এসব নানান চিন্তায় মগ্ন হয়ে জয়া নিজের বুকে পাথর চেপে বলেছিল, শুনছেন! আমি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত শোনাতে চাই। আপনি আবার বিয়ে করবেন। শুনেছিলাম নিজের স্বামীর পাশে নারী তার ছায়াকেও সহ্য করতে পারে না। কিন্তু সেখানে জয়া নিজেই তার সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে আমার এবং আমাদের ছেলেদের জন্যে এত বড়ো কাজ করল। তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দিল। হয়তো জয়া এই ভেবে স্বস্থি পাচ্ছিল, সে চলে গেলে আমার পাশে কেউ থাকবে, সে চলে গেলে আমাদের ছেলেরা মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে না। আসলে-ই তোমার বান্ধুবী আগে থেকেই তীর্যক বুদ্ধিমান। নয়তো দেখো, কীভাবে জীবনের হিসাব আগেই করে রেখেছিল। এও কী সম্ভব?”

ফিরোজার চোখ জোড়া ভিঁজে উঠেছে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে কম্পিত গলায় বলল,
–“আমার আপনার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। আপনার আচরণ যথার্থ ছিল।”

–“এই কথা বলে আমাকে আবারও অপরাধ বোধে ডুবিয়ে দিও না। তোমার অভিযোগ থাকা জরুরি, সঙ্গে অধিকারও। হয়তো সব চাওয়া এখনো পূরণ করতে ব্যর্থ। তবুও আমি অনুরোধ করছি, আমাকে আরও কটা দিন সময় দাও। আমি নিজেকে তোমার সাথে মানিয়ে নিই!”

ফিরোজা বুঝতে পারল সাঈদ সাহেব আসলেই অনুতপ্ত। তার এসব গ্লানি সে দূর করতে চাইলেও কোথাও একটা বাঁধা পাচ্ছে। জয়াকেও ইদানীং হারিয়েছে সে, মনের অবস্থা ভালো নেই। এজন্যে ফিরোজা সময় দিল। সাঈদ সাহেব এখন থেকে চেষ্টা করবে যতটা নরম সুরে ফিরোজার সাথে কথা বলা যায়!

———–
তরী রুমে গিয়ে দেখল সিদাত অনয়ের সাথে কথা বলছে। তরীকে নজরে পড়তেই সিদাত বলল,
–“অনয়, পরে কথা বলব।”

কল কেটে তরীকে নিয়ে বারান্দায় চলে এল। তরীর হাতে এক কাপ চা দেখে সিদাত থমথমে সুরে বলল,
–“আরেক কাপ কোথায়?”

তরী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
–“আমার এই সময়ে চা খাওয়ার অভ্যেস নেই। আপনি খেয়ে নিন!”

–“আগে অভ্যেস ছিল না এবার অভ্যেস করে নাও। এক কাপেই দুজন চা খাব!”

বলেই সিদাত চায়ে চুমুক দিল। তরীর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায় এ কথা শুনে। যেন মনে হচ্ছে অনেক অবাক করা কথা শুনল। তরীর অভিব্যক্তি দেখে সিদাত বলল,
–“এভাবে তাকাচ্ছ কেন? এক প্লেটে, এক হাতে ভাত খেতে পারলে কী এক কাপে চা খাওয়া যায় না? কাছে এসো। এক চুমুক দিয়ে যাও!”

সময় তার আপন গতিতেই চলতে শুরু করল। কারো মৃ*ত্যুতেই জীবন থেমে থাকে না। সে তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলতে থাকে। শোক ব্যথা ধীরে ধীরে ভুলিয়েও দেয় সে। দিব্যি তাদের নিত্য দিনে ফিরে যেতে হয়, ব্যস্ততায় জুবুথুবু হতে হয়। আজ জয়ার মৃত্যুর প্রায় দুই মাস। তরী এবং সিদাতের জীবনটা সেই প্রথম দিন গুলোর মতোই চলছে। তরী মানিয়ে নিবে বলে দুই মাস পার করে ফেলল, অথচ সে এখনো সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেনি। সিদাতের সাথে সবকিছু মানিয়ে নিতে পারেনি। তবে সিদাতের সাথে তরী অনেকটা সহজ হয়েছে। তরী প্রতিদিন সিদাতকে নামাজ পড়তে পাঠায়। ফজরের এলার্মে মাঝেমধ্যে তরী উঠতে না পারলে সিদাত তখন তাকে উঠিয়ে দেয়। তারা মুখে প্রকাশ না করলেও একে অপরের পূর্ণতা হয়ে গিয়েছে। কেউ কাউকে ছাড়া চলতেই পারে না। খুনশুটি, ভালোবাসা যেন তাদের জীবন জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। সিদাতের বিষাদে ভরা সময় গুলোতে তরী সিদাতের ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়াত। তাকে আশ্বস্ত করত, মন ভালো করার চেষ্টা করত। আবার তরীর মন খারাপ হলেও ঠিক তাই।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দুই মাসে তাদের একদমই কোনো রকম ঝগড়া হয়নি। আবার কখনো কখনো সিদাতের মায়ের জন্যে খুব মন খারাপ করলে হয় মায়ের রুমে গিয়ে একাকী বসে থাকত নয়তো মায়ের কবর জিয়ারত করে আসত।

মাঝেমধ্যে সিদাত তরীর জন্যে রান্না করে। আর তরী বলে দেয় কোনটা কীভাবে রান্না করতে হবে। কোন মশলা দিতে হবে ইত্যাদি। সেই খাবার খুব ভালো না হলেও মোটামুটি চলে যায়। সিদাত এগুলো সবাইকে সাথে নিয়ে খায়। পরিবারকে সাথে নিয়ে খাওয়া এবং সময় কাটানোর মজাই আলাদা। তরী এবং দিয়া যেন এই বাড়ির প্রাণ। এর মাঝে সিদাত এবং সাইফ হঠাৎ সিদ্ধান্ত জানায়, সাঈদ সাহেব এবং ফিরোজা খাতুন হজ করতে যাবে। হজের সম্পূর্ণ খরচ তারা দুই ভাই বহন করবে। সাঈদ সাহেব এবং ফিরোজাও এতে রাজি হল। মানসিক শান্তি মিলবে তাহলে।

তরী ফিরোজাকে ব্যাগ গোছাতে সাহায্য করছে। দিয়ার পরীক্ষা চলছে, বাড়িতে নেই সে। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমেই দিয়া তার পড়ালেখা জীবনের ইতি টানবে। তরী আজ ভার্সিটি যায়নি। বিয়ের পর তরীর পড়াশোনা থেমে থাকেনি। বিয়ের দশ-বারোদিন পর থেকে তরীকে ভার্সিটি দিয়ে আসে এবং নিয়ে আসে সিদাত। প্রতিবারই তারা ট্যাক্সি করে যাওয়া-আসা করত। পরের মাসেই সিদাত নিজের টাকা এবং সাইফের থেকে কিছু টাকা ধার করে প্রাইভেট কার কিনেছে। শুধুমাত্র তরীর জন্যে। তরী বাইকে অভ্যস্ত নয় এবং অস্বস্থিও অনুভব করে। এজন্যে সিদাত তার বাইকটা বিক্রি করে এই গাড়িটা কিনেছে। সিদাত যেদিন গাড়ি কিনে বাড়ি ফিরেছে সেদিন মুচকি হেসে বলেছিল,

–“এটা করে আমরা খুব দূর পর্যন্ত ঘুরে বেড়াব নিকাব রাণী!”

তরী ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে ফিরোজার উদ্দেশ্যে বলল,
–“আর কিছু বাকি আছে মা?”

–“না, তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। আর কাজ করতে হবে না। আমি বাকিটা সামলে নিব!”

তরী লাগেজের পাশে বসে বলল,
–“তা কী করে হয়? আজ রাতে তোমাদের ফ্লাইট, আর আমি হাত গুটিয়ে রুমে বসে থাকব? এটা হয়? আমি তোমার সাথে সময় কাটাব। কোথাও যাচ্ছি না!”

ফিরোজা হাসল তরীর কথা শুনে। তরী আবার মন খারাপ করে বলল,
–“তোমাদের ছাড়া খুব একা লাগবে!”

ফিরোজা হেসে বলল,
–“তাহলে আরেকজন আনার ব্যবস্থা করে ফেলো। যাতে করে আমরা ফেরার পর সুসংবাদ শুনতে পাই?”

তরী ফিরোজার এই কথার অর্থ বুঝতে পেরে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল। তার ভেতরটা কেমন ধুকপুক করছে তীব্র অনুভূতিতে। ফিরোজা তরীর এরকম অভিব্যক্তি দেখে উচ্চ স্বরে হেসে দিল। বলল,

–“পাগলি, এত তাড়া নেই। আগে নিজেকে গুছিয়ে নাও। পড়াশোনা শেষ করো। এরপর নাহয় আল্লাহ্’র হুকুমে একজন আসবে। দিয়াকেও একবার মশকরা করে বলেছিলাম। ওই মেয়েটাও লজ্জা পেয়েছে!”

তরী আড়চোখে অল্প করে তাকাল। তরীর মাথায় চট করে একটা প্রশ্ন আসল। ফিরোজার কোনো সন্তান নেই? সন্তান ছাড়া এতগুলো বছর কী করে পার করেছে সে? মা হওয়ার টান তো প্রতিটা মেয়ের মধ্যেই রয়েছে। তবে ফিরোজা খাতুন সেই টান ছাড়া কীভাবে টিকে আছে? তার কষ্ট হয় না?

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here