হৃদয়ে মেঘগলি পর্ব ১৬

0
651

#হৃদয়ে_মেঘগলি
|১৬|
লাবিবা ওয়াহিদ

কাদের সাহেবের সাথে উঠানে বসে আছেন আনোশীর মামা। কাদের সাহেব চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মামার দিকে নজর বুলাচ্ছেন। মামা চা খেতে পারছেন না। কোনো এক ব্যাপারে বেশ দুশ্চিন্তায় ডুবে আছেন মনে হচ্ছে। কাদের সাহেব তার অবস্থা বুঝতে পেরে চা তার সামনের বেতে টি-টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,

–“দেখো। আমি আমাদের মেয়ের ভালোটাই চাইছি। আনোশী অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। নিজ চোখে দেখেছি আমার ভাইয়ের জন্যে মেয়েটাকে প্রতিদিন কাঁতরাতে। ভাইকে হারানোর পর মেয়েটাকে অনেক বেশি ভাঙতে দেখেছি বলেই সেই মুহূর্তে ওর বিয়ের কথা চিন্তা করিনি। সময় দিয়েছি মেয়েটাকে নিজের মতো করে বাঁচার। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? মেয়েটা আর কত একা থাকবে? ওরও তো ভবিষ্যৎ আছে। উপরওয়ালা কাউকেই একা পাঠান না। তার সাথে একজন সঙ্গী তিনি হাজার বছর আগেই ঠিক করে রেখেছেন। তার নিয়ম ঠেকানো আমাদের মধ্যে কার সাধ্যি?”

মামা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এসব সে নিজেও বুঝেন। আনোশী যেভাবে গাজীপুর চলে এসেছে এতে তারও মনঃক্ষুণ্ন হয়। দিন-রাত মনে হতো মেয়েটার সাথে কোনো অন্যায় করে ফেলেনি তো? মামা চায়ের দিকে স্থির নজর ফেলে বলল,
–“সেটা আমিও বুঝতে পারছি ভাইসাহেব। কিন্তু ছেলে, ছেলের পরিবার ভালো হবে তো?”

–“তা তো অবশ্যই। গাজীপুর, টাঙ্গাইল মিলিয়ে তাদের একটা গার্মেন্টস আর ফ্যাক্টরি রয়েছে। আর্থিকভাবে ছাড়াও পরিবার, পরিবারের লোকজনও গোছানো। ছেলে অবশ্য বেকার। বাবার ব্যবসায় হাত দিবে তো বোধহয় শীঘ্রই। আনোশীর চাইতেও বেশি বড়ো হবে না। হয় সমবয়সী হবে নয়তো এক দুই বছরের বড়ো হবে!”

কাদের সাহেবের মুখে এ-কথা শুনে মামা ভীষণ অবাক হলো। এত ছোটো ছেলে কী পারবে আনোশীকে সামলাতে? সংসারে মনোযোগ দিতে? কাদের সাহেব যেন মামার মনের প্রশ্নগুলো তার মুখ দেখেই পড়ে ফেললেন। হেসে বললেন,

–“আমারও এরকম প্রশ্ন জন্মেছিল। কিন্তু ছেলেটা খুব ধূর্ত! সাংসারিক মনোভাব তার আছে। এর চাইতেও বড়ো বিষয় হচ্ছে আনোশী সেই ছেলেটারই পছন্দ। বাকিসব তুমি রানা ভাইয়ের সাথে দেখা করেই বুঝে নিও। আমরা আমাদের আনোশীর খারাপ চাইব না!”

——————
আনোশী তার ঘর পরিষ্কার করছে। যেহেতু আজ শুক্রবার সেহেতু আনোশীর আজ বন্ধ। ঠিক এমন সময়ই পায়ে মাটি নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকেছে শিশির। কানে তার ফোন। বাগানে খালি পায়েই গিয়েছিল সে। বোধহয় জরুরি কল পেয়ে এদিক সেদিক না চেয়ে, কথায় ব্যস্ত হয়ে সোজা ঘরে ঢুকে গিয়েছে। এটা দেখে আনোশী হতভম্ভ। খুব কষ্টে ঘর মুছে প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। এমন পর্যায়ে শিশির আবার সব নষ্ট করে দিল। আনোশী রাগে-দুঃখে গরম চোখে তাকাল শিশিরের ঘরের দরজার দিকে। যেন এখনই চোখ দিয়ে ঝলসে দিবে শিশিরকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শিশির পাঞ্জাবি পড়ে ক্যামেরা সাথে ক্যামেরা সেটাপের যন্ত্রপাতি নিয়ে বেশ তাড়াহুড়ো নিয়ে বের হচ্ছে। আনোশী শিশিরকে দেখে কড়া কন্ঠে ডাক দিয়ে কিছু বলতে নিবে ওমনি শিশির এক হাতে কোনোরকমে জুতা পরতে পরতে বলল,

–“প্লিজ আনোশী পিছু ডাক দিবেন না। অলরেডি আমার লেট হয়ে গিয়েছে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আজ একটা প্রোগ্রামে ফটোগ্রাফির দায়িত্বে আমি আছি। শিট!”

আনোশীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিশির নিজেকে বকতে বকতে বেরিয়ে গেল। আনোশী কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলেও পরমুহূর্তে নিজের কপালে হাত ঠুকে শিশিরকে বকতে বকতে আনোশী আবার একই কাজ করে। শিশিরকে সে ছাড়বে না। শিশিরকে দিয়েও সে মেঝে মোছাবে বলে পণ করে নিল।

আনোশী কাজ করে উঠতেই কাদের সাহেব ভেতরে প্রবেশ করল। আনোশী তাকে দেখে সালাম দিতেই কাদের সাহেব মুচকি হেসে সালামের উত্তর দিতে দিতে সোফায় গিয়ে বসল। আনোশীও কাদের সাহেবের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। ঠিক তখনই আনোশীর মামাও হাজির হলো। আনোশী তাকে দেখে খুব খুশি হলো বোধহয়। মামাকে সালাম দিয়ে বলল,

–“আরে মামা! তুমি কখন এলে? এসো। এসে বসো!”

মামা কাদের সাহেবের পাশে গিয়েই বসল। আনোশী তাদের সাথে কথা বলতে নিলে কাদের সাহেব বলল,
–“আজ ভাবলাম আমরা এখানেই দুপুরের কাহ্বা সারি! কী বলো?”

আনোশী হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বলল,
–“হ্যাঁ! অবশ্যই। তোমরা বসো, আমি রান্না বসিয়ে আসছি।”,

আনোশী উঠে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। এখনো যোহরের আযান দিতে ঘন্টাখানেক দেরী। দুজনে যেই আলোচনা করতে আজ এসেছিল সেটা দুজনেই গিলে ফেলল। আজ এই মুহূর্তে আনোশীকে কিছু বলার সাহস হলো না তাদের। কাদের সাহেব মামাকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছে একদিন সময় সুযোগ বুঝে আনোশীকে নিজেই সব বুঝিয়ে বলবে। মামা মেনে নিল। রানা সাহেবের সাথে দেখা করে তার মনের ভীতি প্রায় অনেকটাই কমে গিয়েছে। ছেলের সাথে সে ফোনে কথা বলেছে। এতেই তিনি যা বোঝা বুঝে নিয়েছেন। আনোশীকে রাজি করিয়ে আরও ভালো করে তাদের পরিবার এবং ছেলে সম্পর্কে জানতে পারবে নাহয়।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া কাদের সাহেব আনোশীর কাছে-ই সেরে নেয়। রাতে শিশির ফিরে। ততক্ষণে সিয়াম, তার বউ এবং একমাত্র মেয়ে নিচে থাকতে চলে এসেছে। শিশিরকে তোয়াক্কা না করেই আনোশী ঘুমোতে চলে গেছে। শিশির ডিনার সেরে নিজেও রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আলগা চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। অন্ধকারে চট করে তার মুখ জুড়ে মোবাইলের রশ্মি বিস্তৃত হয়। শিশিরের ফোনে জ্বলজ্বল করছে আনোশীর নীরব কান্নার ছবিটা। ঢাকার সেই অনুষ্ঠানের ছবিটা। এটা সে ভেবেছিল ডিলিট করে দিয়েছে। কিন্তু পরে চেক করতে গিয়ে দেখে সে ছবিটা ডিলিট-ই হয়নি। পরে কী ভেবে আর ডিলিট করতে পারেনি সে। ফোনেই রেখে দিয়েছে।

আনোশীর সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার পর মনে হলো ছবিটা বৃথা যায়নি। শিশির আনমনেই আনোশীর ছবিটার দিকে চেয়ে শুধাল,
–“কাঁদুনে বাড়িওয়ালী!”

বলেই আপনমনে হাসল সে।
পরেরদিন সকাল সকাল আনোশী শিশিরকে দিয়ে পুরো বাড়ি না হলেও অর্ধেক মেঝে মুছিয়ে ছেড়েছে। এটা ছিল শিশিরের শাস্তি। শিশির এটুকুতেই হাঁপাচ্ছে। মেঝের একপাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

–“মেয়ে মানুষের কাজ আমাকে দিয়ে করানোর মানে কী?”

আনোশী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
–“যাতে করে বুঝো এক কাজ দ্বিতীয়বার করতে কেমন লাগে!”

–“আমার ঘাট হয়েছে। মাফ করেন!”

আনোশী মুখ ভেঙিয়ে নিজের রুমে চলে গেল রেডি হতে। স্কুলে আসতেই শুনতে পেল তিয়াসা প্রেগন্যান্ট। এ কথা শুনে আনোশী খুব খুশি হলো। তিয়াসাও এ-খুশিতে আনোশীকে নিয়ে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে এসেছে। আনোশী অবশ্য বারণ করেছিল। কিন্তু তিয়াসা শুনলে তো? তিয়াসা তার কথায় অটল। অগত্যা, আনোশী চুপ করে বসে রইলো।

খাবার অর্ডার দেওয়া শেষ হতেই হন্তদন্ত হয়ে শিশির এলো তাদের টেবিলে। আনোশী শিশিরকে দেখে তার চোখ কপালে উঠে যায়। শিশির এখানে কেন? কী করছে? তিয়াসা শিশিরকে দেখে মুখ জুড়ে কাঠিন্য ভাব ফুটালো। শিশির আনোশীকে না দেখেই তার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল,

–“স্যরি আপু। বেশি দেরী করে ফেলেছি?”

–“বেশি দেরী মানে? অবশ্যই অনেক দেরী করে ফেলেছিস তুই! তোকে বলেছি না স্কুল থেকেই আমাদের নিয়ে আসবি৷ কিন্তু তুই..”

–“আচ্ছা, আচ্ছা। স্যরি তো। আর হবে না!”

আনোশীর মাথা ভনভন করছে। গাজীপুরে আসার পর থেকে যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই শিশিরকে দেখছে। আপাদমস্তক শিশির যেন তার পিছু ছাড়ে না। ছেলেটা এক সময়ে এত এত জায়গায় থাকে কী করে? আর তিয়াসার সাথেই বা তার কিসের সম্পর্ক?

শিশির আনোশীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
–“বাড়িওয়ালীর সাথে তো আবার দেখা হয়ে গেল!”

তিয়াসা অবাক সুরে বলল,
–“তোরা একে অপরকে চিনিস?”

–“চিনব না? আমার বাড়িওয়ালী ইনি! আই মিন এই মিসের বাসায় ভাড়া থাকি!”

আনোশী অপ্রস্তুত হলো শিশিরের কথা শুনে। তিয়াসা বলল,
–“হায়রে। আনোশী, এটা হচ্ছে আমার ছোটো ভাই। শিশির।”

আনোশী অবাক কন্ঠে শুধু “ওহ” বলল। আসলেই পৃথিবী গোল। নয়তো একটা মানুষের আপন বোনের সাথেই বা কী করে আনোশীর এত ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে?

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওরা সবাই নিচে এলো। শিশির তিয়াসাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে বললে তিয়াসা দ্বিমত জানিয়ে বলল,
–“তোর দুলাভাই আসছে আমাকে নিতে। তুই বরং আনোশীকে নিয়ে বাসায় চলে যা। আনোশী, তুমি কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথেই ফিরবে। কোনো কথা শুনছি না!”

আনোশী তিয়াসা মেয়েটাকে মুখের ওপর না বলতে পারে না। এই মাসখানেকের পরিচয়ে তিয়াসাকে বোধহয় বড়ো বোনের জায়গায় বসিয়ে ফেলেছে সে। তাই এবারও অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিয়াসার চাওয়া মেনে নিল। ওরা ততক্ষণ অবধি দাঁড়িয়ে থাকল যতক্ষণ অবধি না তিয়াসার হাসবেন্ড এলো। যাওয়ার আগে তিয়াসা শিশিরের কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

–“দিনদিন খুব বদমায়েশ হয়েছিস তাই না? নিজে সময় কাটাতে তোর দুলাভাইকে সোজা ডেকে এনেছিস? কী ভেবেছিলি আমি বুঝি না? তোর প্রতিটা পদক্ষেপ আমার হারে হারে জানা আছে!”

শিশির তিয়াসার কথা শুনে হাসল। হেসে হেসেই বলল,
–“তোমায় চেয়ে ভালো আমায় আর কে চিনে আপু?”

তিয়াসা চলে গেল। শিশির একটা রিকশা ডাকতেই আনোশী সঙ্গে সঙ্গে বলল,
–“আমি কখনোই তমার সাথে এক রিকশায় উঠব না!”
–“তাহলে আর কী? হেঁটে চলুন তাহলে!”

আনোশী অবাক চোখে শিশিরের দিকে তাকাল। এতটা পথ হেঁটে যাওয়া সম্ভব? শিশির আনোশীর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,

–“হেঁটে না গেলে এক রিকশা করেই যেতে হবে। এই পথে রিকশা পাওয়া যায় না!”

আনোশী তাও যেতে চাইল না। কিন্তু শিশিরের পীড়াপীড়িতে রাজি হলো। দুজন এক রিকশাতে। এই মুহূর্ত হৃদপিন্ডের গতি বাড়িয়ে তোলার জন্যে যথেষ্ট।

~[ক্রমশ]

বিঃদ্রঃ আজ দুই পর্ব দিলাম। কেমন লেগেছে জানাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here