হৃদয়ে মেঘগলি পর্ব ১৩

0
610

#হৃদয়ে_মেঘগলি
|১৩|
লাবিবা ওয়াহিদ

উঠানে বেতের সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছে কাদের সাহেব। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে থাকা চোখ জোড়া কিছু মুহূর্ত পত্রিকায়, আবার কোণা চোখে ভেতরের দিকে যাচ্ছে। কপালে তার কয়েকটি ভাঁজ। ভাঁজগুলো দুশ্চিন্তার তা বুঝতে বাকি নেই। কান খাড়া করে রেখেছেন অনেকক্ষণ যাবৎ, কিন্তু আশানুরূপ সেরকম কথা-বার্তা, চেঁচামেচি কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এতে যেন কাদের সাহেবের দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। এমন সময় ভেতর থেকে কাদের সাহেবের স্ত্রী অর্থাৎ আনোশীর চাচী এলো। হাতে তার ধোঁয়া ওঠা চা। কাদের সাহেবের সম্মুখে রাখতেই তার মধ্যেও দুশ্চিন্তা দেখা গেল। আমতা আমতা করে বলল,

–“সব ঠিক আছে তো?”

কাদের সাহেব তেঁতে উঠলেন এ-কথা শুনে। চিবিয়ে চিবিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
–“সেটা তো আমার তোমার কাছে জিজ্ঞেস করার কথা!”

কাদের সাহেবদের বাড়িটা দো’তলা। দুই ভাই মিলে এই বাড়িটা বানিয়েছে। বাব, দাদার সম্পত্তি এই পুরো জমি। বাড়িটা অল্প জায়গায় করা হলেও চারপাশে খোলামেলা। গাছ-পালায় ছড়াছড়ি বাড়ির চারপাশ জুড়ে। বাড়ির সামনে বিরাট উঠান। সেখানে বসে প্রাক্তন শিক্ষক কাদের সাহেব রোজ পত্রিকা পড়েন, চা পান করেন, প্রকৃতির সাথে মিশে থাকেন। চাকরি থেকে অবসরে এসেছেন প্রায় দু’বছর হতে চলল। এই দু’বছরে গাছ-পালা, ফল-ফলাদির পরিচর্যা সে নিজেই করেছে। এতে তার একাকিত্ব বোধ হয় না।

বাড়িটার নিচ তলা আনোশীর বাবার এবং উপর তলা কাদের সাহেবের জন্যে। দুই ভাই কেউ কাউকে কষ্ট দিতে চাইত না বলেই লটারি করে তারা নিজেদের ফ্লোর নির্ধারণ করে নিয়েছে। এতে দুই ভাইয়ের মাঝেও কোনো রকম দন্ড নেই। ছোটো ভাই চলে যাওয়ার পর আনোশীও ঢাকা চলে গেল। নিচ তলা এতে পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটের ন্যায় হয়ে যায় অচিরেই।

চাচী ফিসফিস করে কিছু বলতে নিলে কাদের সাহেব আবার ধমকাল। বলল,
–“গলায় শক্তি নেই? ফিসফিস করছ কেন? আশেপাশে লোকজন আছে? কাকপক্ষী আছে? নেই তো! তাহলে ফিসফিস করে আমার বাড়া ভাতে ছাঁই কেন দিচ্ছ?”

চাচী মুখ গোমড়া করে ফেলল। কাদের সাহেব কেমন রেগে আছে সেটা তার নাকের ডগার লাল আভা দেখেই অনুমান করতে পারছে। এছাড়াও কাদের সাহেব খুব নীরব মানুষ। কিন্তু ক্ষেপে গেলে বা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় পড়লে সে ত্যাড়া জবাব দিতে অভ্যস্ত। এটা তার স্বভাবের মধ্যেই পড়ে। চাচী বেজার মুখে বলল,

–“আনোশী কী ছেলেটাকে দেখে ভুল বুঝবে?”

কাদের সাহেব এবার দমল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“এটাই তো চিন্তার বিষয়। ভাইয়ের বাড়িটা কেমন পরিত্যক্ত লাগছিল। মানুষজন চলাচল না করলে কেমন গুমোট হয়ে থাকে ঘর। এজন্যেই ভাবলাম ভাড়া দিয়ে দেই। দিলাম কিন্তু এই সময়েই আনোশী চলে আসবে বুঝতে পারিনি।”

–“বলি কী, আনোশী যেহেতু চলেই এসেছে সেহেতু তুমি ছেলেটাকে তাড়িয়ে দাও!”

এ কথায় কাদের সাহেব আবার তেঁতে উঠল। কড়া সুরে বলল,
–“বে-আক্কেলি কথা বলবে না। ছেলেটাকে আমার দরকার। এখন হাত থেকে ছুটে গেলে তো সমস্যা। তুমি চিন্তা করো না, আমি আনোশীকে আমাদের ঘরেই নিয়ে আসব। তাহলে কোনো সমস্যা হবে না!”

কাদের সাহেব এসব বলতে বলতেই চায়ে চুমুক দিতে যাচ্ছিল। আনোশী তাকে সেই মুহূর্তে ডাকতেই নাকে-মুখে চা ঢুকে গেল। এরপর কী ভয়ানক পরিস্থিতি। কাশতে কাশতে কাদের সাহেবের নাজেহাল অবস্থা। চাচী অস্থিরচিত্তে স্বামীর সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আনোশীও কিছু বলার সুযোগ পেল না।

দুপুরে আনোশীকে খাবারের জন্যে দাওয়াত দিয়েছিল কাদের সাহেব। এজন্যে আনোশী তাদের সাথেই বসে খাচ্ছে। কাদের সাহেবের মোট চারজন সন্তান। দুজন ছেলে আর দুটো মেয়ে। মেয়ে দুজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোটো ছেলে এবার অনার্সে পড়ছে। তাই আপাতত ছেলে, ছেলের বউ আর ছোটো ছেলেকে নিয়েই তার সংসার। কাদের সাহেব নীরবে খাচ্ছে। এবং কিছুক্ষণ পরপর আনোশীকে পরখ করে নিচ্ছে। আনোশী খাওয়ার শুরুর দিকে কিছু না বললেও মাঝামাঝি সময়ে কাদের সাহেবকে প্রশ্ন করল।

–“আমি বুঝতে পারছি না জেঠু, কেন তুমি পেইন গেস্ট রেখেছ?”

কাদের সাহেব থতমত খেয়ে জিভ দিয়ে অধর ভেজালেন। কোনোরকমে বললেন,
–“এভাবে হুদাই পড়ে থাকার চাইতে ভাড়া দিয়ে রাখাটা ভালো!”
–“আমি তো এখন এসে গেছি। আর পড়ে থাকবে না। তাতেও তুমি ভাড়া দিয়ে রাখবে?”

কাদের সাহেব তটস্থ হয়ে ইতিবাচক মাথা নাড়াল। আনোশী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দিল। চাচী আনোশীর পাতে তরকারি তুলে দিতে দিতে বলল,
–“তুমি বরং এক কাজ করো। আমাদের সাথে এখানেই থাকো। মিশুর রুমটা খালি পড়ে আছে। ওখানেই থাকতে পারবা!”

আনোশী সঙ্গে সঙ্গে নাকোচ করে দিল৷ বলল,
–“যতই ভাড়াটিয়া বসাও না কেন, আমি নিজের বাড়িতেই থাকব। আমাকে প্লিজ এই ধরণের প্রস্তাব করিও না চাচী।”

চাচীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। কী বলছে এই মেয়ে? একা একটা ব্যাচেলর ছেলের সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকবে? বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে চাচী। অবাক স্বরে বলল,
–“অবিবাহিত একটা ছেলের সাথে একই ফ্ল্যাটে থাকবি? মগের মুল্লুক নাকি?”

কাদের সাহেবও একই রকম হতভম্ভ! আনোশী এক লোকমা মুখে পুরে বলল,
–“একা কোথায়? তোমরা তো আছোই। ভাড়া যেহেতু দিয়েছ তোমরাই, আমার তো এতে সমস্যা নেই!”

কাদের সাহেব কথার আগা-মাথা বুঝলেন না। আবার আনোশীর সাথে সহমতও পোষণ করলেন না। তার স্ত্রীর কথা যথার্থ ছিল। একই ফ্ল্যাটে ছেলে-মেয়ে একসাথে থাকবে। এটা কী মেনে নেওয়ার মত? লোকে কী বলবে? মান-সম্মান একদম ধুলোয় মিশে যাবে। কিন্তু এদিকে আনোশীর মধ্যে কোনো রকম ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা অস্বাভাবিক নীরব। এত দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ কী করে খাবার গিলতে পারে? কাদের সাহেবের তো খাবার গলা দিয়ে নামছে না সঙ্গে ডায়াবেটিসও বোধহয় ধেই ধেই কমছে কিংবা বাড়ছে। নয়তো মাথাটা এরকম চক্কর দিয়ে উঠছে কেন?

—————————-
আনোশীর নাছোড়বান্দা সিদ্ধান্তের কাছে হার মেনে নেয় কাদের সাহেব। কিন্তু মেনে নেওয়া কী এতই সোজা? সে তৎক্ষণাৎ কল লাগালেন বড়ো ছেলে সিয়ামকে। এক্ষুণি মানে, এক্ষুণি-ই যাতে বাড়িতে চলে আসে। কোনো কথাই সে শুনবে না!

আনোশী ফ্ল্যাটে এসে তার বাবার রুমে না গিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজার সিটকিনি দিয়ে দিল। সদর দরজা ওভাবে খুলেই রাখল। যেন যখন তখন যে কেউ ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারে। আনোশী দরজা লাগিয়ে তার রুম ঝাড় দেওয়া শুরু করল। একে একে সব পরিষ্কার করে বেরিয়ে আসতেই ডাইনিং টেবিলে শিশিরকে ডিম ভাজা দিয়ে ভাত খেতে দেখল সে। শিশির খাবার চিবুতে চিবুতে একপলক আনোশীকে দেখল। সঙ্গে চমৎকার হাসি উপহার দিল। বলল,

–“আরেহ। বাড়িওয়ালী এখানেই থাকছে নাকি? তা একা একটা ব্যাচেলর ছেলের সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকতে অস্বস্থি হচ্ছে না?”

আনোশী হাতে ময়লা কাপড়গুলোর ঝুড়িটা শক্ত করে ধরে খুব গম্ভীর গলায় বলল,
–“তোমার ঘর এবং আমার ঘরের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব আছে। এই দূরত্ব বজায় রেখেই আমার পক্ষ থেকে আমি চলব। এবার সেই সাবধানতা তুমিও অবলম্বন করবে!”

শিশির খেতে খেতে বলল,
–“চিন্তা করবেন না, বাড়িওয়ালীর প্রেমে পড়ে জীবন নষ্ট করার পাত্র আমি নই। এখনো আমার অনেক দূর যাওয়া বাকি।”

আনোশী কোণা চোখে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“হ্যাঁ, সাবধান!”
আনোশী আবার যেতে নিলে হুট করে বলল,
–“খবরদার আমার বাবার রুমে সাবধানে চলাফেরা করবেন!”
–“চিন্তা করবেন না, ভদ্র পরিবারের সন্তান কখনো চোর হয় না। সে যতই অভাবে থাকি না কেন!”

আনোশী চলে গেল জামা-কাপড় নিয়ে বেরিয়ে। শিশির আপনমনেই বলতে লাগল,
–“কাঁদুনি মেয়েরা এত শক্ত খোলসে কী করে আবৃত থাকে? নামহীন ইনি যে শক্ত খোলসে বন্দী!”

মুহূর্তে-ই শিশিরের মধ্যে আনোশীকে নিয়ে কৌতুহল, আগ্রহ তাকে গ্রাস করল। কিছু তো আছে মেয়েটার মধ্যে।

রাতে খাবারের পরপরই সিয়াম এবং তার বউকে কাদের সাহেব নিচতলায় পাঠিয়ে দিল। এখন থেকে ওরা রাত এখানেই থাকবে। এ নিয়ে সিয়ামের বউ এতে খুব মনমরা হয়ে আছে। সে কীভাবে এখানে থাকবে? সবকিছু গুছিয়ে নিবে? হুট করে নিজস্ব পরিবেশ থেকে বেরিয়ে নতুন পরিবেশে থাকা সম্ভব? সিয়ামের বউ পীড়াপীড়ি করলেও সিয়াম বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে রাজি করিয়ে নিল। সিয়ামের স্ত্রী রীপা অবশ্য শ্বশুরকে সমীহ করে চলে। এজন্যে সে চাইলেও তার মতের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। ওদের নিচতলায় দেখে অবশ্য আনোশীর মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে আগের মতোই স্বাভাবিক। সব ঘটনা সে নীরবে মেনে নিচ্ছে যেন।

——————
শেহরিমের এঙ্গেজমেন্টের আগেরদিন থেকে দেখা গেল শেহরিম নিখোঁজ। তার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। শেহরিমের ফোনটা বন্ধ দেখে সকলে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে শেহরিমের মা আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ল। শেহরিমের রুম ঘাটতে গিয়ে একটা চিঠি পাওয়া গেল, সেখানে শেহরিম লিখেছে,

–“দুঃখিত বাবা-মা। এবারও নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাদের সিদ্ধান্ত মানতে পারলাম না। এই শহর ভীষণ রকম বিষাক্ত লাগছে। এজন্য আমি চলে যাচ্ছি সিলেট। এখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে সিলেটের কোনো এক হসপিটালে আমার ঠাঁই হয়েছে। সেখানেই বসতি গড়ব। আমাকে বাধা দিও না। কিছুদিন ফোন বন্ধ থাকবে। তাই তোমরা বেশি চিন্তা করিও না।”

এরকম চিঠি পেয়ে শেহরিমের বাবার গা রি রি করে উঠল অত্যন্ত রাগে। এমন মুহূর্তে এসে ছেলের এরকম কাজ মূর্খামি বৈ কিছুই মনে হলো না তার। এখন কন্যার বাবাকে সে কী জবাব দিবে? এসব দুশ্চিন্তা করতে করতে দুপুরের পরপর সেই মেয়ের বাবা কল দিল। মেয়েটার নাম পাপিয়া। পাপিয়ার বাবা কল করে জানাল পাপিয়ার হঠাৎ বদলি হওয়ায় তাদের এঙ্গেজমেন্ট এবং বিয়ের তারিখ আরও কয়েক মাস পিছিয়ে দিতে। পাপিয়ার এখনই সিলেটে পৌঁছাতে হবে। এ নিয়ে পাপিয়ার বাবা বারবার ক্ষমা চাইল শেহরিমের বাবার কাছে। এতে শেহরিমের বাবাও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। কোনো রকমে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

–“ব্যাপার না। ছেলে-মেয়েদেরও তো একটু স্পেস প্রয়োজন আছে!”

কিন্তু দেখা গেল শেহরিম সুস্থ ভাবে সিলেট পৌঁছাতে পারল না। সিলেটে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে শেহরিম নিজেই হাসপাতালের বিছানায় পড়ে গেল। যার সামান্যটুকু টেরও পেল না শেহরিমের পরিবার।

~[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ নজরে দেখবেন। অনেকদিন পর লিখেছি। কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here