#হৃদয়ে_মেঘগলি
|১১|
লাবিবা ওয়াহিদ
তাশুতি রান্নাঘরে কাজ করতে ব্যস্ত। নোরা তাশুতির শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে খেলা করতে ব্যস্ত। তাশুতির শ্বাশুড়ি তাশুতিকে সেরকম পছন্দ করে না। এর একমাত্র কারণ তাশুতির গায়ে তালাক তকমা লেগেছে। রিয়াদ খুব কষ্টে বাবা-মাকে সামলে নিয়েছে। এদিকে তাশুতিও ডিভোর্সের পরপর বুঝেছে রিয়াদ ছাড়া তার কোনো গতি নেই। এজন্যে পা ধরে ক্ষমা চেয়ে রিয়াদকে মানিয়ে নিয়েছিল। শ্বাশুড়ি মানছিলো না দেখে রিয়াদ এবং তাশুতি একাই বিয়ে করে নেয়। এ জন্যে আজ অবধি মনে রাগ পুষে রেখেছে রিয়াদের মা।
তাশুতির সেবা-যত্নে রিয়াদের বাবা গললেও মা গলেনি। প্রায় রোজ ঘরের মধ্যে অশান্তি লেগে থাকত। তাশুতি প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছে সবকিছু সামলে নিতে। আগের চাইতেও বেশি চাপ এই সংসারে। আগের মতো এত শান্তিতে থাকতে পারেনি। রিয়াদদের মধ্যবিত্ত পরিবার৷ মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও তাশুতি মানিয়ে নিয়েছে। যখন নোরার আগমন বার্তা পেল তখন থেকেই শ্বাশুড়ি কিছুটা দমেছে। ধীরে ধীরে কিছুটা শান্ত হয়েছে। সেই থেকে এখন অবধি সেরকম কোনো ঝগড়া হয়নি। তাশুতি সেভাবেই চলছে যেভাবে শ্বাশুড়ি পছন্দ করে। মোটকথা, শ্বাশুড়ির কোনোরকম অভিযোগ করার সুযোগ দেয় না।
সবচেয়ে বড়ো কথা আনোশীকে নিয়ে৷ আনোশী এ বাড়ি ও বাড়ি সব বাড়ীতেই যেন দখল করে বসে আছে। তাশুতি বিরক্তিতে কপাল কুচকে আছে সকাল থেকেই। এই আনোশীর জন্যে-ই রিয়াদের থেকে এত কড়া কথা শুনেছে তাশুতি। তাশুতি বুঝে না, সব জায়গাতে আনোশীকেই কেন টানা প্রয়োজন? কী এমন বিশেষত্ব আছে তার মাঝে?
আনোশীকে নিয়ে তাশুতির সেরকম কোনো চিন্তা নেই। তবে শেহরিমের সাথে আনোশীকে ঘনঘন দেখলে তাশুতির ভেতরটা পুড়ে ছাঁই হয়ে যেত। অতীতের ক্রোধ এখনো বুকের এক কোণে জমে আছে। তার চাইতেও বড়ো ভয় ছিলো যদি শ্বশুরবাড়িতে জানা-জানি হয়ে যেত যে তার-ই প্রাক্তন স্বামী আনোশীর বর, এতে তাশুতিকে আরও ঘনঘন ঝামেলা সইতে হতো।
আনোশী তাশুতির অপছন্দের শীর্ষে অবস্থান করছে। তার একমাত্র কারণ, আনোশী তাশুতির আপন বোন নয়। তাশুতি যখন ছোটো ছিলো তখন কোথা থেকে আনোশী উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। তাশুতির থেকে আনোশী সবসময় আদর পেত বেশি। আনোশী কোনো ভাবে কাঁদলে তাশুতিকেই দোষারোপ করা হতো। বাবা আনোশীকে নিয়ে বেশি আহ্লাদ করত। যা তাশুতির সহ্য সীমানা বাইরে ছিল। আনোশী সবসময় ভালো রেজাল্ট করতো আর তাশুতি এভারেজ। এ নিয়েও মা শুধু বলত,
–“আনোশীর মতো একটু পড়াশোনা করলে কী হয়?”
বড়ো হয়েও আনোশী সব জায়গায় আলোচনায়। সকলের মুখে আনোশীর জিকির শুনতে শুনতে তাশুতি চরম বিরক্ত। গতকাল রাতের ঘটনায় তাশুতি নিজেকে কোনোরকম সামলে নিয়েছে। এতদিন অভিনয় করে গেছে। আর কত অভিনয় করবে? ক্লান্ত সে।
———————-
আনোশী ইমার্জেন্সি এক বাচ্চাকে নিয়ে হসপিটাল এসেছে। রিকশা থেকে পরে গেছে বাচ্চাটা। ছেলেটার বয়স আনুমানিক এগারো থেকে বারো। আনোশীর-ই স্টুডেন্ট। আনোশী কোনোরকমে এক চেম্বারের মধ্যে ঢুকতেই দেখতে পেল শেহরিম বসে আছে। শেহরিম এবং আনোশী দু’জনেই অপ্রস্তুত হয়। শেহরিম অবাক চোখে চেয়ে রয় আনোশীর দিকে। আনোশী নিজেকে ধাতস্থ করে শেহরিমের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ছেলেটাকে ভেতরে নিয়ে আসতে বলে। আহত ছেলে এবং তার মাকে দেখে শেহরিম নড়েচড়ে বসল। ছেলেটা মাথায় আঘাত পেয়েছে। শেহরিম নার্সকে তার চেম্বারে ডেকে এনে ছেলেটার মাথায় আগে ব্যান্ডেজ করল। তবে গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটা তার বাম হাত নাড়াতে পারছে না। নাড়াতে গেলেই চিৎকার করে উঠছে। শেহরিম তৎক্ষণাৎ ছেলেটিকে ইমার্জেন্সি এক্স-রে করতে বলল।
ছেলেটার হাত ভেঙেছে। শেহরিম খুব শান্ত হয়েই হাতে প্লাস্টার করে কিছু ওষুধের নাম লিখে দিল। এরপর কিছু নির্দেশনা, নিষেধাজ্ঞা বুঝিয়ে দিল। মহিলা আনোশীর দিকে চেয়ে বলল,
–“কী বলে তোমায় ধ্যন্যবাদ জানাব মা?”
আনোশী আলতো হেসে বলল,
–“কোনো ব্যাপার না। আপনি ওকে বাসায় নিয়ে যান। আমি সব পেমেন্ট করে দিবো!”
মহিলা বলল,
–“কী বলছ এসব? তা হয় নাকি?”
বলেই একপ্রকার জোর করে সব খরচের টাকা আনোশীর হাতে তুলে দিল। অতঃপর ওষুধপত্র নিয়ে মহিলা এবং বাচ্চা ছেলেটা চলে গেল। ওরা যেতেই আনোশী শেহরিমের উদ্দেশ্যে বলল,
–“আপনার ভিজিটিং পে কী নার্সের কাছে দিবো নাকি রিসিপশনে জমা দিবো?”
শেহরিম বলল,
–“ভিজিটিং পেমেন্টের দরকার নেই। হসপিটালের বিলও দেওয়ার দরকার নেই। সব আমি পে করে দিব। তুমি বাড়ি যাও!”
আনোশীর মুখ দেখে বোঝা গেল সে মোটেও এই প্রস্তাব পছন্দ করেনি। আনোশী থমথমে সুরে বলল,
–“এটা অসম্ভব!”
আনোশী এবার রিসিপশনের দিকে হাঁটা দিল। শেহরিম আনোশীর পিছু নিয়ে বলল,
–“কেন অসম্ভব আনোশী? তুমি জানো আমি তোমায় কতটা চাই? কেন আমায় জেনে-বুঝে দূরে ঠেলে দিচ্ছো?”
আনোশী পেছন ফিরে বলল,
–“এসব বলার দিন এখন নেই। আপনাকে কেন দূরে ঠেলে দিচ্ছি বুঝতে পারছেন না? আপনি আমার বোনকে ছেড়েছেন। তাকে ছেড়ে দেওয়ার পরপর তার বোনকে বিয়ে করতে এসেছেন। আমার দিক ভাবলেন না আমার পক্ষে পূর্বে দুলাভাই ভাবা লোকটাকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। অপ্রিয় হলেও সত্য আপনাকে আমি মন থেকে দুলাভাই মেনেছিলাম। আমি ওই ধাঁচের মেয়ে মানুষ নই যে কী না মুখ বুজে ভালোবাসা মেনে নিবে। আমি সবসময় আমার বিবেকের কথা শুনি। আপনার বিবেক বোধ থাকলে আপনিও আশা রাখছি আপনার এই প্রস্তাব নিয়ে আমার সামনে আসবেন না। সম্মান দিচ্ছি সম্মানটা অটুট থাকুক। এছাড়াও আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। আপনি আপনার নতুন জীবন সঙ্গীনিকে নিয়ে ভাবুন। নয়তো সে ঠকে যাবে।”
বলেই আনোশী হনহন করে রিসিপশনের দিকে চলে গেল। শেহরিম ব্যথিত নজরে আনোশীর যাওয়ার দিকে চেয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ মিনমিন করে আওড়ালো,
–“ভালোবাসা এত যন্ত্রণার কেন? যাকে আমি চাই সে আমাকে ভালোবাসে না। আর যাকে চাই না সে আমাকে চায়। এটাই কী তবে দুনিয়ার নিয়ম? ভুল ভালোবাসা কখনো সঠিক হতে পারে না?”
—————-
আনোশী বাসায় ফিরতেই দেখল মামী সোফায় বসে টিভি দেখছে। হাতে এক কাপ চা। আনোশীকে খেয়াল করতেই মামী কোণা চোখে আনোশীকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
–“চা দিবো?”
মামীর খেয়াল করাকে আনোশী পছন্দ করল। আলতো করে হেসে মামীর পাশে বসে বলল,
–“দাও।”
মামী নীরবে চা টি-টেবিলের উপর রেখে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর এক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে আসল। আনোশী বিনয়ী হেসে সেই চায়ের কাপ হাতে নিল। মামী বসতে বসতে থমথমে সুরে বলল,
–“খেয়ে উদ্ধার কর!”
আনোশী হাসল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে গভীর চিন্তায় ডুব দিল। অদ্ভুত, অগোছালো চিন্তা-ভাবনা মস্তিষ্কে বিচরণ করছে। যা আনোশী এড়িয়ে যেতে পারছে না। চাপা এক উত্তেজনা কাজ করছে। অনেকটা কৌতুহলও বটে।
আনোশী হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
–“আমি কী আদৌ তোমাদের আপনজনদের কাতারে পড়ি মামী?”
—————
তাশুতি নোরাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। আজ একদমই ঘুমাতে চাইছে না মেয়েটা। বারবার বলছে বাবা আসলে ঘুমোব। তাশুতির মেজাজও আজ ঠিক নেই। নোরার আবদার বি*ষের মতো লাগল। ধমকিয়ে উঠলো সে নোরাকে। নোরা তাশুতির ধমক শুনে মৃদু কেঁপে উঠে বিকট শব্দে কাঁদতে লাগল। নোরার কান্নাও খুব বিরক্ত লাগছে তাশুতির। নোরা ক্লান্তহীন কেঁদেই চলেছে। তাশুতির মাথা ভনভন করছে। এত ঝামেলা সে নিতে পারছে না। ঝামেলার উপর আবার তাশুতির কল বেজে ওঠে। নাক-চোখ কুচকে গেল তাশুতির। ফোনটা হাতে নিয়ে নাম না দেখেই রিসিভ করল। কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আনোশীর গলা শোনাল। আনোশী কোনো কথা ছাড়াই সোজা-সাপটা উত্তর দিয়ে বলল,
–“আমি তোমার আপন বোন নই আপু?”
তাশুতি এই মুহূর্তে এই ধরণের কথা শুনে নিজেকে আর দমাতে পারল না। নিজের সব ক্রোধ ঢেলে দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলতে লাগল,
–“না, তুই আমার বোন না। আমার বোনের কাতারেই পড়িস না। তুই রাস্তার মেয়ে। মামা তোকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলো। আর কিছু? খবরদার আমাকে আর কল দিয়েছিস তো। ফোন রাখ।”
বলেই খট করে কেটে দিল তাশুতি। কিছুতেই রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সে।
আনোশী বিমূঢ় হয়ে শুনল তাশুতির কথাগুলো। লাউড স্পিকার দেওয়া ছিল৷ তাই মামীও তাশুতির কথাগুলো শুনতে পেরেছে। যার মামীর শুকনো মুখটায় রাগ প্রকাশ পেলো। বিড়বিড় করে তাশুতিকে গাল মন্দ করল। তাতেও শান্তি পাচ্ছে না যেন!
আনোশী নীরব হয়েই বসে রয়। হাত ফসকে ফোনটা মেঝেতে পরে যায়। মামী ব্যস্ত হয়ে দ্রুত ফোনটা মেঝে থেকে হাতে তুলে নেয়। আনোশীকে ধমক দিয়ে বললো,
–“পাগল নাকি? এভাবে ফোন কেন ফেলে দিলি?”
আনোশী তখনো ঘোরের মধ্যে আছে। শূণ্য দৃষ্টিতে কোথাও চেয়ে আছে। মামী আনোশীর এই অবস্থা দেখে তপ্তশ্বাস ফেললো,
–“কোথাও না কোথাও হয়তো তোর এই অবস্থার জন্য আমি-ই দায়ী। সেদিন আমি আর তোর মামা যদি তোর মায়ের কাছে তুলে দিয়ে না আসতাম, তাহলে আজ তোর এই পরিণতি হতো না রে। কিন্তু মনুষ্যত্ববোধ আমাকে তোর মতো নিষ্পাপ মেয়েকে আঁধারী নির্জন রাস্তায়ও চুপচাপ দেখতে পারছিল না। খুব আফসোস হয় জানিস? যদি তখন তোর মামার সাথে আমার বিয়েটা হয়ে যেত তাহলে বোধহয় তোকে আমার মেয়ে করে লালন-পালন করতাম। কিন্তু ভাগ্য..”
আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললো মামী। আনোশী হঠাৎ কী ভেবে বলল,
–“আমি কিছুদিনের মধ্যে বাবার বাড়িতে যেতে চাই।”
মামী চমকালো আনোশীর কথা শুনে। অস্ফুট স্বরে বলল,
–“হঠাৎ এ-কথা কেন? আমি কী পর নাকি তোর এখানে থাকতে সমস্যা হচ্ছে?”
আনোশী মামীর দিকে খুবই শান্ত নজরে চেয়ে বলল,
–“আমার যাওয়াটা খুব জরুরি মামী। আমি ওখানেই থাকতে চাই।”
~[ক্রমশ]