হৃদয়ে মেঘগলি পর্ব ১০

0
633

#হৃদয়ে_মেঘগলি
|১০|
লাবিবা ওয়াহিদ

অনুষ্ঠানের পরেরদিন নীলের জন্যে একটা পার্সেল আসলো। বেশ কিছুটা বড়োসড়ো। নীল সেটা উলটে পালটে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“কোনো ডেলিভারি ম্যানকে দেখতে পাওনি?”

নীলের মা বললো,
–“না, পাশের বাসায় যাওয়ার জন্যে দরজা খুললাম। খুলে দেখি পার্সেল রাখা। বাক্সের চারপাশে নীল লেখা। এজন্যে মনে হলো তোর-ই। যাকগে সেসব কথা। আমি পাশের বাসায় গেলাম।”

নীলের মা চলে গেলে নীল আস্তে আস্তে পার্সেল খুলতে শুরু করলো। সে নিজেও জানে না কে পাঠিয়েছে। কাউকে সন্দেহের তালিকায় পাচ্ছে না। প্যাকেট খুলতেই নীল অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এটা যে আনোশীর শাড়ী। যেটা নীল আনোশীকে উপহার দিয়েছিলো। শাড়ীটা ভীষণ এলোমেলো। ভাঁজ ছাঁড়া। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শাড়ীটা কোনোরকমে ভরেছে বাক্সে। এর সাথে মিশে সাথে অসম্ভব রাগ। নীল কিছুটা আহত হলো।

শাড়ীর উপরের সাদা কাগজের চিরকুটটায় কম্পিউটার টাইপিং-এ লেখা। আনোশী যেন নিজ হাতে লিখতে ইচ্ছুক নয়। লেখাগুলোতে চোখ বুলালো নীল।
–“ভুল ঘরে এই শাড়ীটি চলে গেছিলো, আসল মালিকের কাছে পৌঁছে দিলাম। ভুলক্রমেও ভুল ঠিকানায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না।”

ইতিতে আর কিছু লেখা নেই। নীল হতাশ হয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। গতকাল তার হবু বউও যে অনুষ্ঠানে যেতে আবদার করবে কে জানতো? নীল তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো একদিন সময় সুযোগ বুঝে আনোশীকে সবটা বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু তার আগেই আনোশী যা বোঝার বুঝে গিয়েছে।

আনোশী স্কুলে গিয়ে একদম স্বাভাবিক আচরণ করলো। নিত্যদিনকার মতোই। তবে ভুলক্রমেও নীলের দিকে ফিরেও চাইলো না। এটুকু বাদে বাকিসব স্বাভাবিক। আনোশীর সাথে কথা বলার জন্যে নীল সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু ক্লাস নেওয়ার চাপে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। অবশেষে ব্রেক টাইম পেলো। নীল সময় বিলম্ব না করে আনোশীর সামনে চেয়ার টেনে বসলো। আনোশী তাও তাকালো না। নীল চাপা স্বরে বললো,
–“স্যরি আনোশী! আমি..”

আনোশী হাতের কাজ রেখে খুব তেঁজী চোখে চাইলো নীলের দিকে। সেই দৃষ্টি ভয়ংকর। যে কাউকে সেই দৃষ্টি দিয়ে ভষ্ম করে দেওয়া যাবে যেন। নীল এতে অপ্রস্তুত হয়। আনোশী গলার স্বর যতটা সম্ভব কমিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“আপনার এবং আমার সম্পর্ক শুধুমাত্র কলিগের। এর বেশি কিছু করতে আসলে আমি সিনক্রিয়েট করতে বাধ্য হবো মি. নীল।”

নীল অবাক হলো না আনোশীর এমন আচরণে। আনোশীর এরকম ব্যবহার করাটা স্বাভাবিক৷ তাই নীল আনোশীকে আবার বোঝাতে চাইলো। আনোশী সঙ্গে সঙ্গে উঠে বেরিয়ে গেলো। আর নীল অসহায়ের মতো আনোশীর চলে যাওয়া দেখলো।

———————–
রাইমা একপ্রকার বাধ্য হয়েই স্কুলে আসলো তাহানের প্রিয় শিক্ষিকাকে তাহানকে পড়ানোর প্রস্তাব করতে। সে বর্তমানে ওয়েটিং রুমে বসে আছে। পাশে তাহান। কিছুক্ষণ পর আনোশী আসলে তাহান খুব খুশি হয়ে আনোশীর কোমড় জড়িয়ে ধরে। উল্লাস ভরা কন্ঠে সালাম দিলো। আনোশী মুচকি হেসে রাইমার দিকে এবং রাইমা আনোশীর দিকে তাকালে দু’জনেই চমকে গেলো।

হতবিহ্বল হয়ে রাইমা উঠে দাঁড়ায়। আনোশী নিজেকে ধাতস্থ করে তাহানের উদ্দেশ্যে বললো,
–“তোমার আম্মু বুঝি?”

তাহান উপরে নিচে মাথা নাড়ায়। রাইমা তাহানকে বললো,
–“তাহান। তুমি মায়ের মোবাইল দেখো, আমি তোমার ম্যামের সাথে কথা বলছি!”

তাহান বাধ্য ছেলের মতো মায়ের কথা মেনে নেয়। ছেলেকে ভেতরে রেখে রাইমা আনোশীকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আনোশী তখনো স্বাভাবিক। রাইমা বললো,
–“কেমন আছো? জানা ছিলো না তুমি-ই তাহানের প্রিয় ম্যাম।”

আনোশী হেসে বলে,
–“ভালো। আমারও জানা ছিলো না আপনি তাহানের মা!”

রাইমা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“সেদিম বাড়ী যাওয়ার পর থেকে খুব জেদ ধরেছে তোমার কাছে তাহান পড়বে। তুমি নাকি ওর যত্ন নাও, মোটকথা তোমার ব্যবহার ওর মনে দাগ কেটেছে। এজন্যই আসলাম। কিন্তু এখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আর সম্ভব না।”

আনোশী হাসি বজায় রেখেই জবাব দেয়,
–“আপনার ধারণাই ঠিক আপু। সত্যি-ই আমার পড়ানো সম্ভব না। এছাড়া আমি টিউশনিও করাই না!”

–“হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি শেহরিমের জন্য-ই!”

আনোশী চুপ করেই রইলো। রাইমাও কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো,
–“জানি এখন এসব বলে লাভ নেই তবে কিছু কথা বলছি। আমার দেবরকে তুমি যা ভাবো বা ভাবছো তা কিন্তু সত্য নয়। কথায় আছে না, অনেক সময় আমরা চোখে যা দেখি তা সত্যি হয় না? তেমনই শেহরিমের ব্যাপারটা। তোমার চোখের সামনে সব ধোঁয়াশা। যদি বুদ্ধিমতী মেয়ে হয়ে থাকো তাহলে ব্যাপারটা একটু ঘেটে দেখো, অনেক সত্যি বেরিয়ে আসবে। আবার ভেবো না তোমাকে ফিরে আসতে বলছি। তুমি তোমার সিদ্ধান্ত নিতে স্বাধীন। এছাড়াও শেহরিমের বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক হয়ে গিয়েছে। বাবা জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন!”

আনোশী চুপচাপ শুনলো। তবে ধোঁয়াশার ব্যাপারটা নিয়ে একটু আগ্রহও অনুভব হচ্ছে। কপালে ভাঁজ ফেলে সেসব কিছুক্ষণ ভাবলো। কিন্তু অংকের উত্তরটা আসছে না। গোলমেলে হচ্ছে। রাইমা কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো,
–“তাহানকে তো কিছু বোঝানো যায় না, তুমি-ই নাহয় বুঝিয়ে দাও। তোমার কথা যদি শুনে?”

আনোশী বাস্তবে ফিরে ভেতরে চলে গেলো। নানান কথা বলে বোঝালো। কী সুন্দর তাহান বুঝেও নিলো। কথা দিলো জেদ করে মাকে আর কষ্ট দিবে না। মা যা বলবে তা শুনবে। আনোশী তাহানের কথা শুনে মুচকি হাসলো। ছেলেটা আসলেই ভীষণ ভালো, কী সুন্দর বুঝে গেলো।

—————
তাশুতি নোরাকে ঘুম পারিয়ে নিজেও শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রিয়াদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা বিছানায় এসে বসলো। তাশুতি রিয়াদকে দেখে মুচকি হেসে বললো,
–“কাল ঘুরতে নিয়ে যাবে দেখে নোরা কত খুশি হয়েছে জানো? খুব বেগ পোহাতে হয়েছে ঘুম পাড়াতে।”

রিয়াদ উত্তরে শুধু হাসলো। কিছুক্ষণ নীরবে নোরার দিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর নোরার কপালে চুমু খেয়ে শুতে শুতে বললো,
–“যাক, শেহরিমকে তাহলে রাস্তা থেকে সরালে!”

তাশুতি চমকে তাকালো রিয়াদের দিকে। শোয়া ভুলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রিয়াদ হাই তুলে তাশুতির দিকে তাকালো। তাশুতির অভিব্যক্তি দেখে হালকা করে হাসলো। শোয়া থেকে আবার উঠে বসলো। তাদের দুজনের মাঝে নোরা চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে। তাশুতি আমতা আমতা করে বললো,
–“কী বলতে চাচ্ছো?”

–“কেন বুঝোনি? তুমি কী ভেবেছিলে, আমি শেহরিমকে চিনতে পারিনি? আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে যার ঘরে গিয়েছো তাকে চিনবো না? তোমার বিয়েতে আমি স্বয়ং উপস্থিত ছিলাম। আনোশীর জন্যে প্রস্তাব নিয়ে আসার পরেও কিছু বলোনি দেখে চুপ ছিলাম। তুমি নিজ মুখে বলবে বলে। সাথে এরও অপেক্ষায় ছিলাম, তুমি আদৌ বোনের সাথে শেহরিমের বিয়ে হতে দাও কী না। পরে দেখি একি, কুচক্র করে শেহরিমকে সরিয়ে দিলে!”

বলেই রিয়াদ হাসতে শুরু করলো। তাশুতির গলা তখন শুকিয়ে কাঠকাঠ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তাশুতি আমতা আমতা করে বললো,
–“তুমি সব জেনেও চুপ ছিলে?”
–“হুম। তোমার কৃতকর্ম দেখার জন্যে৷ যদি সত্যি সত্যি আনোশীকে শেহরিমের হাতে তুলে দিতে তবে আমার সংসারে তোমার দিন প্রায় শেষ হয়ে আসতো। কিন্তু তোমার কপাল ভালো! আরেকটা তালাক তকমা লাগার হাত থেকে বেঁচে গেলে।”

–“খোঁচা দিচ্ছো নাকি হুমকি দিচ্ছো?”

–“কোনোটাই না। ঘুমাও তো।”

রিয়াদ শুয়ে পরলো। আর তাশুতির সব ঘুম কোথায় যেন উড়ে গেলো। সে সেভাবেই বসে রইলো। নড়াচড়া অবধি করলো না।

~[ক্রমশ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here