#হৃদয়ের_কথা
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
|৩|
দুপুরের সূর্যটা সরাসরি মাথার উপরে। গরমের জন্য গুমোট আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আশেপাশে লোকজন নিজেদের কাজে ব্যাস্ত। পরিবেশটা শিথিল নয়। সম্রাট কলেজের সামনে গাড়ি পার্ক করে নেমেছে। টিফিন পিরিয়ড চলছে তখন। ক্যান্টিনে মাঠে যতজন ছেলে মেয়ে ছিল সবাই হা করে দেখছে সম্রাটকে। তাদের ধারনায় সম্রাট কোন সেলিব্রেটির থেকে কম নয়। মাঠের একপাশে কৃষ্ণচূড়ার গাছ। গাছটার সৌন্দর্য যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তেমনি পুরো জাইগাটুকুতে পর্যাপ্ত ছায়া দিচ্ছে। পাশেই একজন মানবী হাত নেরে কাউকে কিছু বলছে। গরমে একটু বাতাসের জন্য বিরক্ত হয়ে বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে।ছোট ছোট চুল গুলো কানের কাছে আনছে। কিন্তু অবাধ্য চুলগুলো শুনলে তো? একটা ছেলে ক্রমশ তাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। সম্রাটের আর বুঝতে বাকি নেই মানবীটি কে। সম্রাট হাজার ক্রশদুর থেকে এক দেখায় বলতে পারবে কোনটা রিধিমা। কিছু একটা আন্দাজ করে হঠাৎ সম্রাটের কপালের রগ ফুলে উঠল। অফিসের সাদা ফ্লরাল শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে এগিয়ে গেলো। পরনে কালো প্যান্ট, ব্লেজার। গরমে কোটটা হয়তো গাড়িতে ফেলে এসেছে। হাতের পেশিগুলো ক্রমশ ফুলে রগ বোঝা যাচ্ছে। সামনে এগিয়ে যেতেই নীলি, জারিফা হা করে তাকিয়ে রইল। রিধিমা ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকিয়ে ভুল দেখার মতো আবারো সামনে তাকাতে যাবে সে চমকে উঠল। স্পষ্ট সম্রাটকেই দেখেছে। রিধিমা সম্রাটের এমন রাগ দেখে একবার রাফসানকে দেখে নিলো। নীলি, জারিফাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। উদ্দেশ্য কলেজের পিছনে গিয়ে বাচাঁ আর যদি বেচে যায় রাফসানকে সে দেখে নেবে। সম্রাট রাফসানের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রিধিমার পিছনে গেলো। অফিস থেকে ফিরেছে শার্টটা প্রায় ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। ব্লেজারটা শার্টের উপরে। ওর বলিষ্ট পুরুষালী শরীর আর বাহুর রোগের দিকে নীলি হা করে তাকিয়ে আছে। কাউকে কিছু না বলে সম্রাট ও দৌড়ে রিধিমাকে ডাকতে লাগল।
_ রিধিমা?? আই সেইড স্টপ!
সম্রাট ব্যস্ত ভঙ্গিতে দৌড়ে রিধিমাকে ডাকছে। রিধিমা পিছনে ফিরে সম্রাটকে আসতে দেখে আরো জোরে দৌড়। প্রাণপণে একটা দোয়া করছে রিধিমা আজকে ও যেন ভ্যানিস হয়ে যায়। ও জানে ওকে ধরতে পারলে সম্রাট আজ থ্রাপড়ে গাল লাল করে দেবে। আর যদি শোনে রাফসান ওকে প্রপোজ করেছে তবে তো মেরেই ফেলবে। ছেলেদের থেকে সবসময় দুরে থাকতে বলে ওকে সম্রাট। ইচ্ছে থাকা সত্বেও স্কুল প্রোগ্রাম, পিকনিকেও কম এটেন্ড করতে হয়
_ রিধিমা দিস ইজ টু মাচ! এখুনি দাড়া বলছি।
রিধিমা জানে সম্রাট অফিস থেকে সোজাসুজি এসেছে। ওর মাথা বিগড়ে আছে। দাড়ালেই বিপদ আবার না দাড়ালেও বিপদ। আজ কে বাচাবে ওকে এটা ভেবেই ওর হার্ট কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। দৌড়ে কলেজের পিছনের মাঠটাই তো চলে এসেছে এখন উপায় কি। চারিদিকে প্রাচীট সামনে হোস্টেল আর প্রিনসিপালের কোয়ার্টার আর পাশেই পদ্মপুকুর। পুরো পুকুর জুরে পদ্মফুলের বাহার। আর বিভিন্ন গাছপালা দিয়ে ঘেরা বাগান।
_ রিধিমা দিস ইজ ইয়র লাস্ট ওয়ানিং ইউ নো! ইউ কান্ট গো নো মর। ইফ আই ক্যান গেট ইউ,ইউ হ্যাভ টু পে আন্ডাসট্যান্ড??
এরচেয়ে ভয়ংকর কোন শীতল হুমকি জীবনেও শোনেনি রিধিমা। না চাইতেও শাস্তি কমানোর জন্য থেমে যায় রিধিমা। সম্রাট হাপাচ্ছে প্রচুর দৌড় করিয়েছে রিধিমা। সম্রাটের ইচ্ছে করছে পরপর দু চারটে থাপ্পড় দিতে কিন্তু সেটা না করে ওকে ধাক্কা দিয়ে পদ্মপুকুরে ফেলে দিলো। রিধিমা চোখ বন্ধ করে রেখেছে। প্রচণ্ড ভয়ে ওর হৃদয় ছলকে উঠেছে। তাই হাতের কাছে যা পেয়েছে আকড়ে ধরেছে। সম্রাট তো ওর হাত ওইভাবেই আকড়েঁ আছে যেনো ছেড়ে দিলেই দুরে চলে যাবে রিধিমা। রিধিমাও ভয়ে জরোসর হয়ে সমম্রাটের পেশিবহুল হাতটা আকড়ে আছে।সম্রাট এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও রিধিমার কান্নারত নেত্রপল্লবের কাপাকাপি সঙ্গে ঠোঁটের কাপাকাপির কম্পিটিশন দেখে ওর ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। যতটুকু রাগ ছিল সবটা উবে গেছে প্রিয়তমার এমন রূপ দেখে। সম্রাটের মন বারবার একটা ইচ্ছা পোষণ করছে যেন ওর ঠোঁট দিয়ে প্রিয়তমার ঠোঁটকে শান্ত করার। সম্রাট নিজেকে সামলে টান মেলে রিধিমাকে উপরে তুলল। রিধিমা সরাসরি সম্রাটের বুকের উপর এসে পড়ল। ভয়ে বেচারী ঘেমেনেমে একাকার। সম্রাট হাসতে হাসতে ওকে জরিয়ে নেয়। রিধিমা এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। সে ভাবছে হয়তো সম্রাট তাকে ছেড়ে দিয়েছে পদ্মপুকুরে। রিধিমাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছে সম্রাট। ওর ঠোঁটে ভালোলাগার হাসি। রিধিমা কান্নাকাটির সঙ্গে রীতিমতো কাপছেঁ। ওর হার্ট দ্রুতগতিতে লাফালাফি করছে।
রিধিমা শান্ত হচ্ছে না দেখে সম্রাট ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
_ ব্যাস হয়েছে রিলাক্স! কিছু হয়নি এইতো আমি ধরে ফেলেছি। ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি হুশশ।
রিধিমা একটু শান্ত হলে আবেশে জরিয়ে রইল সম্রাটকে। ফোপানিঁ ও কমে গিয়েছে। সম্রাট চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে রিধিমাকে। এই ছোট্ট শরীরটাকে ওর বুকে আগলে রাখতে পেয়ে খুশি প্রচণ্ড খুশী সমম্রাট। রিধিমাও অদ্ভুত কিছু অনুভব করছে যা আগে কখনো হয়নি।এমন অনুভূতি সৃষ্টির কারণ তার জানা নেই। তবুও ওর এভাবে থাকতে ভালো লাগছে। বেশকিছু ক্ষণ এভাবে থাকার পর সম্রাট ওকে ছেড়ে দিতে চাই কিন্তু রিধিমা জোর করে জরিয়ে রইল। একটুপর নিজেও যখন বুঝতে পারল সঙ্গে সঙ্গে সরে আসল।
_ সরি সম্রাট ভাই!
_ হুম এবার বল এভাবে ছুটে আসলি কেনো? থামতে বলছিলাম না?
_ আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম তাই।
_ ছেলেটি কে? কি বলছিলো তোকে? কেনো কথা বলছিলি ওর সঙ্গে?
_ ওও.. আসলে ও আম.. আমার সিনিয়র। এমনি কেমন আছি জিগ্যেস করছিল।
_ এমনি বুঝি অচেনা কেউ কেমন আছি জিগ্যেস করে? আর এভাবে তোতলাচ্ছিস কেনো সত্যি করে বল নাহলে সবার সামনে ওকে পেটাবো।
রিধিমা ভয়ে বলে উঠল,
_ না এমনটা করবা না ভাইয়া। আমি বলছি ও হচ্ছে রাফসান। আমাদের সিনিয়র। অনেক দিন থেকে পিছনে পড়ে আছে। কিছু দিন আগে প্রপোজ করেছিল। আমি এখনো কিছু বলিনি।
সম্রাট দপ করে জ্বলে উঠল। ওর অগোচরে রিধিমাকে এতোদিন ধরে ডিস্টার্ব করে আর ও জানে না।রাগে ভ্রু কুচকে বলে উঠল,
_ আগে বলিসনি কেনো?
_ তোমাকে বললে তুমি রাগ করতা। হয়তোবা রাগে ওকে মারতা তাই বলতে চাইনি! মাথা নিচু করে বলল রিধিমা
_ এখন ওরে কিছু বলবো না?
রিধিমা ভয় পেয়ে যায়। একটু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
_ আমাকে সেভাবে কিছু বলেনা ও। প্লীজ ওকে মেরো না ভাইয়া।
_ এতো চিন্তা ওই ছেলের জন্য?
রিধিমা বিরবির করে বলল,
_ একদমই না আমি শুধু বলছি একটা বাইরের ছেলের জন্য ঝামেলা করার কি দরকার।
এরমাঝেই নীলি আর জারিফা চলে আসল রিধিমা আর সম্রাটকে পদ্মপুকুরের দিকে দেখে। দুজনেই হাপাঁচ্ছে হঠাৎ জারিফা বলে উঠল,
_ এইভাবে দৌড়ে আসলি কেনো হ্যা? আমি তো ভয় পেয়ে গেছি হঠাৎ কি হলো?
_ তুই না আসলেই রিধি। কোথায় আমাকে হেল্প করবি তা না এমন দৌড় দেওয়ার কোন মানে হয়?~ নীলি
রিধিমা চুপচাপ মাথা নিচু করে ছিল। সম্রাট ওর দিকেই তাকিয়ে। এরমাঝে রাফসান ছেলেটা আসে।
_ কি হয়েছে রিধিমা তুমি ঠিক আছো?
সম্রাট এবার ভ্রু কুচকে রাফসানের দিকে তাকাল। রিধিমা তো ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে না জানি সম্রাট কি রিয়েক্ট করে।
রাফসান মেকি সুরে আবারো বলে উঠল,
_ জানো আমি কতো ভয় পেয়ে গেছিলাম? হঠাৎ কি হলো তোমার?
_ হে ব্রাদার ওর জন্য চিন্তা করার লোকের অভাব নাই। তোমার ওর জন্য চিন্তা করতে হবে না ইউ মে গো।
রাগে দাতে দাত চেপে বলল সম্রাট।অনেক কষ্টে রাগ কন্ট্রল করে আছে সম্রাট। আবার রিধিমার কথা ভেবে ওকে ছেড়ে দিতে চাইল কিন্তু ছেলেটা আবার বলে উঠল,
_ হু আর ইউ ব্রো? আমি কি তোমাকে চিনি?
সম্রাট ওর কলার ধরে কিছু বলবে তার আগেই রিধিমা বলে উঠল,
_ কাজিন! আমার বড় ভাইয়া হয়। তুমি এখান থেকে যাও প্লীজ।
ছেলেটি কিছু না বলে চলে গেলো। সম্রাট মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ কন্ট্রলের চেষ্টা করছে। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই ঠোঁটের কোনে শ্লেষ হেসে নীলিকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
_ নীলি তোমার না আমাকে কিছু বলার আছে? তো বলে ফেলো। আমার আবার এখন ইনাফ টাইম আছে।
সম্রাটের কথায় নীলির চোখমুখ চকচক করে উঠল, আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল,
_ জ্বী ভাইয়া অনেক কিছু বলার আছে।
রিধিমা অবিশ্বাস্য চাহনী দিয়ে তাকিয়ে রইল সম্রাটের দিকে। এতোকিছুর মধ্যে ও ভুলেই গেছিলো। সম্রাট যে মনে রেখেছে ও ভাবতে পারেনি। রিধিমা কিছু না বলে দাড়িয়ে রইল। ও ভেবেছিল সম্রাটের আগ্রহ থাকবে না। নীলি জারিফাকে ইশারা করলো রিধিমাকে নিয়ে যেতে। জারিফা সায় দিয়ে বলল,
_ রিধিমা চল আমরা কেন্টিন থেকে ঘুরে আসি। ওদের একটু স্পেস দেই চল।
রিধিমা কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে বলল,
_ কেনো আমি ও থাকি। নীলি কি বলবে আমি শুনবো।
_ তুই কিরে রিধি বলেছি না আমাদের আলাদা একটা স্পেস চায়। তুই কি কিছুই বুঝিস না রিধি?
নীলির কথায় অজানা ভয়ে বুক দুরুদুরু রিধিমার। সে যেতেই চাইছিল না। সম্রাট আর জারিফা বলায় বাধ্য হয়ে যেতে হয়। যাওয়ার সময় বারবার রিধিমা সম্রাটের দিকে তাকাচ্ছিল। সম্রাট তো নীলির সঙ্গে হেসে কথা বলায় ব্যাস্ত। রিধিমার মনে হচ্ছে কেউ ওর ভিতর থেকে হৃদয়টা চুরি করে ফেলতে চাইছে। কেনো জানি নীলি আল সম্রাটকে মেনে নিতে পারছিলোনা। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৃষ্ণচূড়া গাছটার শিখড়ে গিয়ে বসল। জারিফা তো আপন মনে কথা বলতে ব্যাস্ত এদিকে রিধিমার হঠাৎ চোখ ভারী হয়ে ওঠে। চোখ থেকে দু চার ফোট পানিও বেরিয়ে আসে। হঠাৎ জারিফা খেয়াল করে অতি ব্যস্ত হয়ে বলল,
_ কি হয়েছে রিধিমা কাদঁছিস কেনো সোনা? আমাকে বল?
চলবে ~
|