#হৃদয়ের_কথা
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
|১১|
১৮.
হসপিটালের করিডরে বসে আছে মর্তুজা পরিবার। সবার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রিধিমাকে কেবিনে সিফ্ট করা হয়েছে। এক্সিডেন্ট গুরুতর হয়নি বলে মধ্য বয়োস্ক লোকটি চলে গেছে। চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকে শাখাওয়াত সাহেবের নাম্বার জোগাড় করেছে আবির। সবাই জানতে পেরে হন্তদন্ত করে ছুটে এসেছে হসপিটালে। সবার চোখ মুখের অবস্থা করুন। অন্যদিকে রিধিমাকে এমনভাবে দেখার পর থেকে ভিষণ ভাবে বিধ্বস্ত সম্রাট। সবাই কাদঁছে কিন্তু তার চোখমুখ শক্ত হয়ে রয়েছে। রিধিমার জ্ঞান ফিরেনি সবাই তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ডাক্তার শিহাব উদ্দিন নিষেধ করেছেন। সেই থেকে সকলে করিডোরে অপেক্ষা করছে। ইতিমধ্যে আবির ছেলেটি সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছেন। শাখাওয়াত সাহেব আর সারওয়ার সাহেব আবিরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আবির সবাইকে শান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। এদিকে সম্রাট মুর্তিমান হয়ে চেয়ে রইল কেবিনের দিকে। বারবার সম্রাট এসবকিছুর নিজেকে দোষী ভাবেছে। আজ সবটা তার জন্যই হয়েছে। ভিতরে যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে কিন্তু কাউকে দেখাতে পারছে না। সাহিল আর রাহুল এসে সম্রাটের কাধে হাত দেয় সম্রাটের ভাবাবেগ হলোনা। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে জানায় পেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে সবার মনটা ভালো হয়ে যায়। সবাই একসঙ্গে রিধিমার কেবিনে ঢোকে। রিধিমাকে সুপ খাওয়ানো হচ্ছে। নার্সটা ওষুধ খাইয়ে চলে যায়। রিধিমা পাথরের মুর্তির মতো চেয়ে রয় সবার দিকে। রুবায়াত বেগম কান্না করতে করতে মেয়েকে বুকে জরিয়ে ধরেন। সারওয়ার সাহেব প্রচন্ড দুঃখি হয়ে এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে সবাই এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ব্যান্ডেস পড়েছে রিধিমার কপালে। খুব সাবধানে কপালের ব্যান্ডেসটা ছুয়ে দেয় রাহুল। বোনকে ভিষণ ভালো বাসে। বোনের এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনে ভেঙে পরেছিল। অবশ্য বাসার সবাই ভেঙে পড়েছিল। ঘটনা শোনা মাত্র পাগলের মতো ছুটে এসেছে রাহুল,সম্রাট! কারো সাহস হচ্ছে না এই অবস্থায় রিধিমাকে বকার। বাহিরে কোথাও মেয়েটাকে চোখের আড়াল কখনো হতে দেয়না রুবায়াত বেগম। একটু আড়াল হয়েছে কি মেয়েটার এমন দুরন্ত পনার জন্য কতো বড় বিপদ হতে পারতো। মেকি রাগ দেখিয়ে মেয়েকে বকে দিলেন। রিধিমা শুকনো হাসি দিয়ে মায়ের বুকে লেপ্টে রইল। ফর্সা মুখশ্রীতে অজস্র ক্লান্তি। লাল হয়ে রয়েছে। দরজার পাশে সম্রাট কে দেখেও না দেখার ভান করে রইল। মানুষটাকে তার সহ্য হচ্ছে না। সম্রাট রিধিমার অভিব্যক্তি বুঝে ফেলে সন্তপনে পা ফেলে বাইরে চলে আসে।
১৯.
সন্ধ্যায় রিধিমাকে সহ সকলে বাসায় ফিরে আসে। ডাক্তার বলেছিল আরো একদিন রাখতে। রিধিমা যেদ ধরে বাসায় যাবে। কারণ হসপিটালে থাকলে সম্রাটের মুখোমুখি হতে হবে। বাসায় সম্রাট আসবেনা। এদিকে আবির মর্তুজা পরিবারের সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে চলে যায়। ছেলেটা বেশ গোছানো,ভদ্র! আসার পরপর রিধিমাকে ঘরে শিফট করা হয়। সবাই চলে যেতেই রিধিমার চোখ ভরে আসে। আজকে ভেবেছিল জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন হবে কিন্তু আজকের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন। যদি সম্ভব হতো আজকের দিনটাকে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুছে দিতো। সম্রাটকে সে ভালোবাসে। প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু তার এক তরফা ভালোবাসা ব্যর্থ হলো। এখন সে বুঝতে পারছে সম্রাট কেনো তাকে ভালোবাসেনি। জোর করে তো ভালোবাসা হয় না। সে কখনো সম্রাটের খারাপ চায় না। সম্রাট যাকে ভালোবাসবে বাসুক তার যায় আসবে না। সে এসব নিয়ে ভাববে না ভুলে যেতে চেষ্টা করবে তার এক তরফা ভালোবাসা। আদেও কি সম্ভব হবে?????
২০.
সম্রাট রিধিমাকে পাগলের মতো ফোন দিচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। ঐ ঘটনার পর সম্রাট চেয়েও কিছু এক্সপেলেইন করতে পারছে না। রিধিমা তাকে সুযোগ দেয়নি। কিছু শুনতেই চায় না সে।ভয়ংকর ভাবে ইগনোর করছে।তার উপর বাসায় ফেরার নিষেধাজ্ঞা। সে রুবায়াত বেগমের থেকে ঠিকই খোঁজ নিচ্ছে। রাহুল সাহিল মেধা তো আছেই খবর দেওয়ার জন্য। মর্তুজা বাড়ির সামনে বাইক নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে কিন্তু প্রবেশ করার সাহস নেই। বাবাকে অমান্য করেনি সে। এখান থেকে ফোন দিচ্ছে,টেক্সট দিচ্ছে কিন্তু কোন রেসপনস নাই। সম্রাট কি করবে ভেবে পায় না। আজকে তাকে সবচেয়ে অসহায় লাগছে।
২১.
প্রায় সপ্তাহ পরে কলেজে এসেছে রিধিমা। এক্সিডেন্টের পর থেকে বাড়িতেই রেস্ট নিচ্ছিলো। নীলি জারিফা তাকে দেখতে প্রতিদিন ছুটে গেছে মর্তুজা বাড়িতে। এমনকি তারা কলেজ ও যায় নি। রিধিমা না গেলে তাদের ও ভালো লাগে না। তাদের ফেন্ডশীপ বন্ডিংটা এতটাই মজবুত যে অবাক করার মতোই। বিয়েতে সম্রাটের ঘটনা টা কাউকে বলেনি রিধিমা। নীলি জারিফা জানলে কিভাবে নিবে সবচেয়ে বড় কথা রিধিমা কষ্ট পাচ্ছে দেখে তারাও কষ্ট পাবে তাই তাদের সঙ্গে ঐ ব্যপারে কথা বলেনি। বরং তারা সম্রাটকে নিয়ে কথা তুললে খুব স্বাভাবিক ভাবেই এড়িয়ে গেছে। এই রিধিমা যেন নতুন তারা চিনেইনা এই রিধিমাকে। কলেজে নীলি জারিফার বরাবরের মতো আড্ডায় ব্যস্ত ছিল। রিধিমা চুপচাপ নিরব দশর্কের মতো ভুমিকা পালন করে। নীলি জারিফা অনেকবার জানার চেষ্টা করেছে তার মন খারাপ কিনা কিন্তু কিছুই বলেনি। এরমধ্যেই ক্লাসের ঘন্টা বেজে যায় তিনজনে কৃষ্ণচূড়ার গাছটার কাছে বেঞ্চে বসেছিল। দ্রুত উঠে ক্লাসের জন্য যেতে থাকে। পথিমধ্যে সম্রাটকে কলেজে দেখে চমকে যায় তিনজন। সম্রাট রিধিমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু রিধিমা ওকে ইগনোর করে চলে যায়। এই সবটা দেখে নীলি জারিফা ভিষণ অবাক হয়। কারণ রিধিমা সম্রাটকে ইগনোর করেছে এটা তারা মানতেই পারছে না । সারাজীবন সম্রাট ভাই সম্রাট ভাই করা মেয়েটা কেমন পাল্টে গেছে ভেবেই একে অপরের দিকে চাওয়া চায়ি করলো। রিধিমা বুঝতে পেরে ওদের এই সম্পর্কে জিগ্যেস করতে নিষেধ করে। খুব দ্রুত হেঁটে ক্লাসে ঢুকে যায় তিনজন।
২২.
সম্রাট রিধিমার জন্য কৃষ্ণচূড়ার গাছটার কাছে অপেক্ষা করতে থাকে। ক্লাস শেষে তিনজনে বের হয়। নীলি জারিফা একে ওপরের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত থাকলেও রিধিমা ছিল চুপচাপ নির্বাক। মন খারাপ নিয়ে হেঁটে মাঠের মধ্যে চলে আসে। রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরে সম্রাটকে বেঞ্চের উপর বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। চারটা ক্লাস হয়েছে। ক্লাস শেষে সম্রাটকে দেখতে পাবে ভাবেনি কেউ। নীলি সম্রাটের তরফদারি করে বলে,
_’ রিধি! আমার মনে হয় একবার সম্রাট ভাইয়ার কথা শোনা উচিত তোর। তোর জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছে কেনো ভাইয়া? নিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ‘
জারিফা একি সুর মিলিয়ে বলল,
_’হ্যা রে একবার শুনে দেখ কি বলতে চায়। আমরা জানিনা তোদের মধ্যে ঠিক কি হয়েছে কিন্তু ভাইয়াকে কথা বলার একটা সুযোগ দিবি তো ঠিক না বল?’
রিধিমা সম্রাটকে এখানে দেখে যতটুকু রাগ করেছে। তার চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে নিজের বান্ধুবীদের সম্রাটদের তরফদারি দেখে। সে জোরেই বলে উঠল,
_’ওই অসহ্যকর মানুষটাকে নিয়ে তোদের তরফদারি করার ইচ্ছে থাকলে কর। কিন্তু আমার শোনার ইচ্ছে নেই। ফারদার আমার সামনে এগুলো বলবিনা যদি বলিস তোদের কারো সঙ্গে কথা বলবো না।’
অনেকটা জোরেই কথা গুলো বলে গেটে কাছে চলে যায় রিধিমা। আশেপাশের অনেক জন সহপাঠী তাদের কথা শুনেছে। তারা বেশ অবাক ও হয়েছে। রিধিমা,নীলি, জারিফার বন্ধুত্ব সবাইকে অবাক করে। এই তিন লেডি
মিলে গ্যাঙ্গ তাদের। তাদের কোনদিন একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া বা মতের অমিল হতে দেখেনি কেউ। অথচ আজ তাদের উচ্চ স্বরে ঝামেলা করতে দেখে অবাক হয় কয়েকজন। সেই সঙ্গে অবাক হয়েছে নীলি জারিফা। রিধিমা তাদের সঙ্গে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাজের। বিশেষ কোন কারণেও উচ্চ স্বরে কথা বলেনা। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় সম্রাটকে সে অসহ্যকর বলেছে। তারা ধরেই নেয় সম্রাটের সঙ্গে রিধিমার বিশাল কোন ঝামেলা হয়েছে। নাহলে যেগুলো কখনো হওয়ার না সেগুলো হচ্ছে কিভাবে?রিধিমা বাড়ির গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে। নীলি জারিফা সবটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সম্রাট সবটা দেখেছে,কিছুটা শুনেছে বাকিটা আন্দাজ করে নিয়েছে। সে নীলি জারিফার কাছে গিয়ে বলল,
_’মন খারাপ করোনা তোমরা। আমার উপর রাগটা তোমাদের দেখিয়েছে।’
বলে মলিন হাসল। সম্রাটের দৃষ্টি এখনো গেটের কাছে রিধিমার দিকে। নীলি জারিফা যেন বারবার অবাক হচ্ছে।
সম্রাটের মলিন চেহারা,উষ্কশুষ্ক চুল, চোখের নিচে হালকা কালো দাগ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘুমায় না ঠিক মতো।
জারিফা বলল,
_’ ভাইয়া আপনাদের মধ্যে কি হয়েছে জানিনা কিন্তু এই কয়েকদিন রিধিমাকে প্রচন্ড বিধ্বস্ত দেখেছি। এক্সিডেন্টের পর ওকে দেখতে গিয়ে যখনই ওর মন ভালো করার চেষ্টা করেছি বারবার ওর চোখের পানি দেখেছি। এতো জানতে চেয়েছি কিছু বলেনি। আপনাদের এভাবে দেখে আমার ভালো লাগছে না আপনারা প্লীজ নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলুন।’
নীলি বলল,
_’সম্রাট ভাইয়া যে রিধিমার মুখে সবসময় আপনার কথা শুনেছি সেই রিধিমাকে আপনার ব্যপারে কথা ইগনোর করতে দেখেই বুঝেছি বিরাট সমস্যা হয়েছে আপনাদের মাঝে। এখন তো পুরোপুরি শিয়র হলাম।’
সম্রাট কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। নীলি জারিফাকে বাই বলে গেটের বাইরে রিধিমার কাছে যেতে থাকে। রিধিমা গাড়ি আসা মাত্র গাড়িতে চড়ে বসে। সম্রাট চিৎকার করে ডাকল কয়েকবার কিন্তু রিধিমা পাত্তা না দিয়ে গাড়ি ছাড়তে বলে ডাইভার আঙ্কেলকে। সম্রাট দৌড়ে গাড়ি কাছে আসে তার আগেই চলে যায় সাদা হুন্দাই গাড়িটি। রিধিমা আড়চোখে গাড়ির মিররে সম্রাটকে দেখে চোখের পানিটা মুছে ফেলল। সম্রাট হাপাচ্ছে নিজেকে অসহায় ভাবছে।
রিধিমা বলে একবার চিৎকার করতে গিয়েও পারলো না। আশেপাশের বেশ কয়েকজন দেখেছে।
সে ভাবল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিধিমার সঙ্গে একবার
কথা বলা প্রয়োজন। পারছে না আর রিধিমার ভয়ংকর অবহেলা সহ্য করতে। রিধিমা তাকে ভুল বুঝে চরিত্রহীন ভাবছে সে কিভাবে সহ্য করবে? তার ভালোবাসা তাকে খারাপ ভেবে মুখ ফিরিয়ে নিবে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। সে ঠিক করে শাখাওয়াত সাহেবকে বলে বাসায় যাবে একবার।
~ চলবে