‘আমার হবু বরের অবৈধ সন্তানের মা হতে চলেছে আমাদের বাড়ির ১৫ বছর বয়সী কিশোরী কাজের মেয়ে রুমি।’
তানিয়া রহমানের বিশ্বাসই হচ্ছে না,আফসানের মতো এতো ভালো ছেলে এই জঘন্য কাজ করবে।কতো সাধ করে ছোট বেলার বান্ধবী আশার ছেলের সাথে নিজের ছোট মেয়ে তুরের বিয়ে ঠিক করেছিলেন তিনি।আশার স্বামীর অর্থীক অবস্থা ভালো। উচ্চবিত্ত তারা, নিজেদের নিজিস্ব ব্যাবসা,বড় বাড়ি আছে। তাদের মত মধ্যেবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কাছে আর কি লাগে? এজন্যই তো এতো কাঠ খড় পুড়িয়ে তুরকে রাজি করিয়েছে। কিন্তু এখন কি হবে,কি জবাব দিবে মেয়েকে?
তানিয়া রহমান তুরের দিকে চেয়ে আছে।তুর সোফায় বসে আছে।তার পাশেই রুমি দাড়িয়ে।মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে তুরের মনে কি চলছে।মিন মিন করে বলল,
‘দেখ মা আমি বুজতে পারিনি ছেলেটা এমন হবে।’
তুর চোখ স্থির করে তাকিয়ে বলল,
‘এখন বুজতে পেরেছ তোমার আদরের আফসান কেমন? তোমার শান্তশিষ্ট ভদ্র আফসানের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে রুমির বিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করো।’
তুর বসা থেকে উঠে পড়ে নিজের ঘরে দিকে যায়।যাওয়ার আগে রুমির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।’
__________
তানিয়া রহমান রুমির দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘কবে থেকে চলছে এসব রঙলীলা?’
রুমি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘খালাম্মা আপনি তো সব জানতেন?’
‘তোর যে চরিত্রের সমস্যা আছে আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু এইটুকু বয়সে এতো দূর যাবি তা জানতাম না।ফক্কিনির বাচ্চা এসব আকাম কুকাম করছিস ভালো কথা তুরের বিয়ের আগে অবধি লুকিয়ে রাখতি।এখন আম ছালা ত আমার গেলো।কতো কষ্ট করে রাজি করেছিলাম জানিস?’
তানিয়া রহমান রুমির মাথার চুলের মু*ঠি ধরে এক নাগাড়ে এসব বলেই প্রস্থান করল।পিছে যদি এসব কেউ শুনে ফেলে।এখন সবদিকেই তাকে মেনেজ করতে হবে।
____________
ড্রয়িং রুমে ইলিয়াস মির্জা বসে পত্রিকা পড়ছে।একটু পর পাশে এসে স্বামীর কাধে মাথা দিয়ে বসলো আশা বেগম।তার পড়নে জর্জেট পাতলা ফিনফিনে শাড়ি।মুখে দামি প্রাসদনীর ছোঁয়া।শরীরে মুড়ানো স্বর্না অলংকার।ধবধবে ফর্সা শরীর যা ইলিয়াস মির্জার উইক পয়েন্ট।এমন রূপ দিয়েই তো সে ইলিয়াস মির্জাকে বসে এনেছে।
‘কি ব্যাপার আজ এতো খুশি লাগছে তোমায়?’
‘খুশি হবো না বলছো।ছেলে বিয়ে করাবো মনের মতো সুন্দরী মেয়ে আনবো।জেনো একবার দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।যেমন চেহারা ঠিক তেমন নামটাও বেশ সুন্দর ‘তুর’।’
‘তা তোমার গুনধর ছেলে কোথায় সে?’
স্বামীর কথায় মুখ কালো হয়ে গেলো আশা বেগমের।তিনি পুনরায় মুখে হাঁসি এনে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
‘এভাবে বলছ কেন, ও কি তোমার ছেলের মতো কাজ না করে সারাদিন বাহিরে বন্ধু ও মেয়ে নিয়ে ঘুরে? আমার ছেলে লাখে একটা, দেখছ না তোমার ব্যাবসা ঠিক কেমন সামলাচ্ছে।’
‘ভালো হলেই ভালো!’
বলেই ইলিয়াস মির্জা প্রস্থান করলেন সেখান থেকে।আশা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস দিলেন।তিনি তার নিজ পুত্রের আফসানেরর নামে সবকিছু চায়।ইলিয়াসের সৎ পুত্র নিষ্প্রভ জেনো কোনো কিছু না পায় সেজন্যই ত নিষ্প্রভের নামে স্বামীর কাছে উল্টাপাল্টা বলে কান ভাঙ্গায়।
_____________
আজ একটু অফিস থেকে তাড়াতাড়িই বের হয়েছে নিষ্প্রভ।কারণ আজ তার বন্ধু অনিকের ছেলের প্রথম জন্মদিন।সে উপলক্ষে বন্ধুর বাড়িতে উপস্থিত হতে হবে।তাদের সকল বন্ধুকেই ইনভাইট করা হয়েছে। এখন স্বন্ধ্যা!সবাই মনে হয় এতোক্ষণে উপস্থিত হয়েছে অনুষ্ঠানে।নিষ্প্রভের যাবার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না কিন্তু অনিক পই পই করে বলে দিয়েছে ,সে না গেলে কেক কাটাই হবে না।না পারতে যেতে হচ্ছে ছোট বাচ্চাটার বড় আনন্দের দিন আজ।অনিকের বাড়িতে যাবার আগে একটা শপে ঢুকলো বেবীর জন্য গিফট কিনতে হবে।সব কাজ শেষ করে অনিকের বাড়ি পৌঁছাতেই সব ফ্রেন্ড সার্কেল নিষ্প্রভ কে জড়িয়ে ধরলো।এদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছে যাদের সাথে অনেকদিন পর দেখা।আসলে ব্যাস্ততার কারণে সব কিছু সামলিয়ে আগের মত কারো তেমন সময় হয় না।রিয়াদ এগিয়ে এসে বলল,
‘কি হিরো অবশেষে আসলি?’
অনিক ফোড়ন কেটে বলল,
‘না এসে যাবে কোথায়? তুই জানিস ব্লাকমেইল করে এই বেটা কে আনতে হয়েছে!’
রিয়াদ হাসতে হাসতে বলল,
‘কি রে শালা তুই এখনো আগের মতোই আছিস।সব অনুষ্ঠানে ব্লাকমেইল করে তোকে নিয়ে আসতে হয় আগের মতোই।তবে একটা কথা মানতেই হবে এই সব কিছুর চাপ যায় বেচারা অনিকের উপর।’
অনিক অসহায় হয়ে বলল,
‘শালা এসব কিছুই না।তবে আমি চিন্তায় আছি,এই বেটা নিষ্প্রভকে সব অনুষ্ঠানে যে ভাবে আমায় ব্লাকমেইল করে নিয়ে আসতে হয়, না জানি বিয়ে করাতেও আমায় ব্লাকমেইল করতে হবে।’
অনিকের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। এতোক্ষণ নিষ্প্রভ চুপ করে ছিলো কারণ তাকে কথা বলার সুযোগ কেউ দেয় নি।এখন আর সহ্য না করে বলল,
‘থামবি তোরা।এসব ফালতু জোকস আমার সাথে করবি না।’
রিয়াদ একটু ভান করে নিষ্প্রভের থুতনি ধরে বলল,
‘ওলে বাবা লে কচি খোকা । তা খোকা তুমি বিয়ে করবে কবে?’
‘আবার!’
রিয়াদের কথা শুনে নিষ্প্রভ রেগে যেয়ে বলল।অনিক একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে নিষ্প্রভ এর কাধে হাত দিয়ে বলল,
‘নিষ্প্রভ রিয়াদ কিন্তু ঠিক বলেছে।আমরা সবাই বিয়ে করে একটা বা দুটো বাচ্চার বাবা হয়ে গেলাম আর তুই এখনো বিয়েই করলি না।বয়স তো আর কম হলো না।২৮ বছর পার হবে এখনো বিয়ে করলি না। তুই শুধু এক বার বিয়ে তে মত দে, আমরা তোর জন্য শহরেই সব চেয়ে সুন্দরী মেয়ে নিয়ে আসবো।’
নিষ্প্রভ একটু চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘প্রথমত আমি সুন্দরী মেয়ে চাই না।চেহারা আমার কাছে ফ্যাক্ট না, মন সুন্দর ও তাকে মায়াবী হতে হবে।যার পানে চেয়ে থাকলে আমি এক জীবণের সকল কষ্ট ভুলে যাবো।এমন মেয়ে এখনো পাই নি।যার সাথে আমার হৃদয়ের সন্ধিক্ষণ হবে।আর দ্বিতীয়ত, আমি আগে নিজে ভালো কিছু করতে চাই জেনো আমার জীবণ সঙ্গীনির সঠিক ভাবে দায়িত্ব নিতে পারি। শুধু বিয়ে করলেই হবে না,তাকে একটা সুস্থ পরিবেশ দিতে হবে, যা অই বাড়িতে থেকে দেওয়া সম্ভব না। তুই তো আমার সব কিছুই জানিস।’
নিষ্প্রভ এক নাগাড়ে কথা বলে তাকিয়ে দেখে সবাই তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
‘কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো তোরা।মনে হয় উজবুক দেখছিস!’
অনিক হঠাৎ করে ঝড়ের বেগে নিষ্প্রভকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আই এ্যাম প্রাউট অফ ইউ দোস্ত।’
নিষ্প্রভ অনিকের থেকে নিজে ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,
‘এভাবে কথায় কথায় জড়িয়ে ধরিস কেন বল ত।রিয়া কি জানে তোর এই সমস্যার কথা।’
‘চুপ শালা।’
রিয়াদ বলল,
‘অনেক হয়েছে তোদের বাঁদরামি এখন সবাই আয় বেচার চাচ্চু আমাদের এইটুকু বয়সে তোদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ডাইপার ভিজাইলো।’
সবাই একসাথে হেসে উঠে।
________
তানিয়া বেগম বান্ধবী আশা কে ফোন করলেন।তানিয়ার ফোন পেয়ে আশা ভীষণ খুশি হয়ে যায়।ফোন রিসিভ করে বলে,
‘ কি রে তানিয়া তোর আর দেরি সহ্য হচ্ছে না নাকি। একেবারে বিয়ে পাকা করতে ফোন দিলি?’
তানিমা বেগম কিছুটা বিরক্তের সহিত বলল,
‘বিয়ে পাকা নয় বরং ভাঙ্গতে ফোন দিয়েছি।’
‘মানে! তুই এসব কি বলছি?’
অনেকটা উচ্চস্বরে বিস্ময়কর কন্ঠে বলল আশা। তানিয়া বেগম কন্ঠে একটু জোর নিয়ে বলল,
‘যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি। তোর ছেলে আফসান আমার বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে লটরপটর করছে।সে এখন প্রেগন্যান্ট।’
‘শোন তানিয়া আফসান ছেলে মানুষ বয়স কম এই বয়সে এমন টুকটাক হয়,বিয়ে হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে আমি কথা দিচ্ছি।তুর এ বাড়িতে আসলে আফসান কি আর পদ্ম রেখে গোবরে মুখ দিবে বল? তুই বরং এ্যার্বশন করে বেপারটা ধামা চাপা দে।’
তানিয়া ধীর কন্ঠে বলল,
‘ব্যাপারটা এমন হলে ত হতোই। তুরের কাছে ধরা পরেছে,ও সব জেনে গেছে।তোর ছেলে এসব আকাম কুকাম করবে আর ধামা চাপা দিবো আমি?কতো কষ্ট করে মেয়েকে রাজি করিয়েছিলাম তোর ছেলের জন্য সব মাটি হয়ে গেলো।এখন যা করার তুই কর আমি এসবের মধ্যে নেই।’
আশা বেগম এবার একটু রেগে যায়। উচ্চস্বরে বলে,
‘এটা বললে তো এখন হবে না। ভুলে যাস না আমার থেকে তুই দশ লাখ টাকা নিয়েছিস এখনো ফেরত দেস নি।আর আমি চাইলে কিন্তু অতীত ফাঁস করতে পারি ভেবে দেখ তখন তুই তোর ছেলে মেয়ে ও স্বামীর কাছে মুখ দেখাতে পারবি তো?’
আশার কথা শুনে তানিয়া বেগম এর হাত পা কাঁপতে শুরু করে।মনে হয় এখন দেহ থেকে আত্মা বের হয় যাবে।সে কম্পনরত কন্ঠে বলল,
‘না তুই এটা কিছুতেই করতে পারিস না। আমি তোর ছোট বেলার বান্ধবী।’
আশা হাসতে হাসতে বলে,
‘আমি ঠিক ততোক্ষণ পর্যন্ত চুপ থাকবো যতোক্ষণ পর্যন্ত তুই আমার কথা শুনবি।’
তানিয়া চুপ হয়ে যায়।যতো কিছু হয়ে যাক না কেন ফেলে আসা দিন কিছুতেই সামনে নিয়ে আসা যাবে না।নয়তো বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে।
চলমান।
#হৃদয়ের_সন্ধিক্ষণ
#ফারিহা_খান_নোরা
#পর্বঃ১