হৃদয়জুড়ে প্রেয়সীর আভাস পর্ব ২৯

0
682

#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_২৯ [প্রমাংশ]
#মোহনা_হক

বিপুল ভোটে এবারও জিতে গিয়েছে আয়াজ ত্বায়ীম চৌধুরী। আরেকবার এমপি হয়েছে। মাত্রই আরহাম কল দিয়ে জানায় ফলাফল পাওয়ার পর। সারাদিন রুয়াত খুব টেনশনে ছিলো। কাল রাতে মনেহয় আয়াজ এক ঘন্টার মতো ঘুমিয়েছে। সে শুধু আজকের দিনটার জন্য চিন্তায় ছিলো। বাড়িতে আবার উৎসবমুখোর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রুয়াত ও ভীষণ খুশি। বাসার সবাই খুব খুশি হয়েছে। হান্নান মজুমদার আর মেহরুবা সকালে চলে আসে। মায়া চৌধুরী অনেক অনুরোধ করেছে আজকের দিনটা তাদের সাথে কাটানোর জন্য। তাই মেহরুবা আর হান্নান মজুমদার চলে আসে সকালেই। সব ঠিক থাকলেও কেনো জানি রুয়াতের মন বারবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অজান্তেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে শুধু। এই মন খারাপের কোনো কারণ নেই।

আরহাম বাসায় এসেই চেচামেচি শুরু করে দিয়েছে রুয়াত দৌড়ে এসেছে। সাথে ইনিমা ও এসেছে। হাতে অনেকগুলো ফুল। রুয়াত ভেবেছে আয়াজ এসেছে। কিন্তু নাহ্ আরহাম এসেছে শুধু।

-‘বাসায় এসেই চেচামেচি শুরু করে দিয়েছো?’

আরহামের মেজাজ গরম আজ। কতো কষ্ট করেছে। সে খেয়াল কি ইনিমার আছে? শুধু কিভাবে ঝগড়া করবে সেটা নিয়েই ভাবে।

-‘কথা বলো না তো। গাড়ি থেকে মিষ্টি নামানোর ব্যবস্থা করো। আর রুয়াত মা কে ডাকে দাও।’

রুয়াত মায়া চৌধুরী কে ডেকে আনে। ছেলের এতো বড় একটা খুশির সংবাদ শুনে বিছানায় গেলো একটু আগে। চিন্তায় চিন্তায় কাটছিলো আজকের দিন। আবার আরহাম এসেছে শুনে নিচে আসে। সোফায় শরীর হেলিয়ে শুয়ে আছে আরহাম। মাগরিবের আযান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মেহরুবা নামাযে থাকাতে আর আসেনি। মায়া চৌধুরী আরহামের পাশে বসে।

-‘আয়াজ আসেনি? আর তোর বাবা কোঁথায়?’

কন্ঠে অস্থিরতা মায়া চৌধুরীর। একবার ছেলে কে একটু দেখতে চাচ্ছে। মনটা কাতর হয়ে আছে একটি নজর ছেলেকে দেখার জন্য। আরহাম শান্ত স্বরে বলে-

-‘বাবা আর আয়াজ পরে আসবে। তোমার ছোট ছেলেকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কতো মানুষ ওয়েট করছে। তাদের সাথে কথা বলেই চলে আসবে বাসায়। বাবা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। খেয়েছো দুপুরে তুমি?’

মাথা নাড়ায় মায়া চৌধুরী।
-‘পরিস্থিতি ঠিক ছিলো তো? আয়াজ কি মাথা গরম করেছে আজ?’

-‘নাহ্। সবকিছু ঠিকই ছিলো। তুমি টেনশন করো না আর।’

আরহাম তার মায়ের দুটো গাল ধরে হাসিমুখে কথাটি বলে। রুয়াত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। মেহরুবা আসে তাদের মাঝে। রুয়াতের পাশাপাশি দাঁড়ায়। আরহাম কথা বলে কিছু সময় মেহরুবার সাথে। যেহেতু সে অনেক সকালে বের হয়েছিলো তাই আর কথা হয়নি দেখাও হয়নি। ফজলুল চৌধুরী ও এসেছেন। মায়া চৌধুরী তার আসার পর পরই জিগ্যেস করে আয়াজ কেনো আসেনি? কিছু কাজ থাকার কারণে ফজলুল চৌধুরী চলে আসে। মুলত আয়াজ পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে। রুয়াতের অস্থিরতা বেড়েই চলছে। হাজারো ভয় এসে জমা হচ্ছে শুধু। চেয়েও সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে পারছে না। স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। শুধু মনেহচ্ছে কি যেনো হবে!

(*)

রাত আটটা বাজতে চললো। আয়াজের আসার নাম নেই। রুয়াত ইনিমা কে জিগ্যেস করছে কেনো আসছে না এখনো। ইনিমার সহজসরল উত্তর আজ খুব বেশি ব্যস্ত থাকায় আসতে পারছে না। নিচে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। রুয়াত উপরে বসে আছে আয়াজের রুমে। কারো হাসিঠাট্টা যেনো ভালো লাগছে না। তাই উপরে চলে আসে। আলমিরা থেকে শাড়ি বের করেছে। গাঢ় লাল রঙের শাড়ি। আয়াজের খুশিতে একটু খুশি করা যাক তাকে। আয়নার সামনে বসে নিজে নিজে সেজেছে। রুয়াত একবার আয়াজের কাছে কল দিয়েছে। সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলছে। তাই কল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ইনিমা রুমে এসে দেখে বোনের কান্ড। মুচকি মুচকি হাসে।

-‘আজ বরের জন্য সাজা হচ্ছে বুঝি?’

রুয়াত পিছন ফিরে চায় বোনের দিকে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। ইনিমা আরও সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে রুয়াত কে। মোটেও রুয়াতের শাড়ি পড়া হয়নি। কেমন জানি হয়েছে। ইনিমা আবারও সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দেয় রুয়াত কে।

-‘সুন্দর লাগছে খুব তোকে।’

হাসে রুয়াত। হঠাৎ বাড়ির হাসির শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। ইনিমা আর রুয়াত নিচে আসে। কয়েক সেকেন্ডের ভিতরে যেনো বাড়িটি নিরবতায় শুনশান আওয়াজ করছে। মায়া চৌধুরীর চোখ থেকে পানি পড়ছে। মেহরুবা চুপ করে পড়ে আছে। আরহাম আর ফজলুল চৌধুরী তাড়াতাড়ি করে কোঁথায় যেনো চলে গেলো।সবার এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কুচকায় রুয়াত। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি বোধগম্য হলো না তার। ইনিমা মায়া চৌধুরী কে জিগ্যেস করে-

-‘কি হয়েছে মা? বাবা আর আরহাম কোঁথায় গিয়েছে?’

মায়া চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। মেহরুবার সামনে হাটু গেড়ে বসে ইনিমা। তার মায়ের হাত ধরে। তিনিও একদম চুপ হয়ে আছেন।

-‘মা কি হয়েছে? কিছু তো বলো। চুপ থেকো না মা।
কিছু অন্তত বলো।’

মেহরুবা একবার তার ছোট মেয়ের দিকে তাকায়। থেমে থেমে বলে-

-‘আয়াজের এক্সিডেন্ট হয়েছে। বড় গাড়ি ধাক্কা মেরে দিয়েছে। সেখানেই গিয়েছে আরহাম আর ফজলুল সাহেব।’

সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি যেনো নেই রুয়াতের। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে৷ প্রথম যেবার আয়াজের এক্সিডেন্টের খবর শুনে সেদিন ও ঠিক এমন হয়েছিলো। মেহরুবা দৌঁড়ে আসে রুয়াতের কাছে। মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। ইনিমা সেখানটায় বসে আছে। মস্তিষ্ক যেনো থমকে গিয়েছে। মেহরুবা রুয়াত কে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বলে-

-‘আয়াজের কিছু হবে না। সে ঠিক ফিরে আসবে। এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না।’

পুরো কথাটি শ্রবণ হতেই না হতেই নিস্তেজ হয়ে যায় রুয়াতের শরীর। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। স্বামীর এমন খবর সহ্য করতে পারছে না। মায়া চৌধুরী এসে আঁকড়ে ধরে রুয়াত কে। চেষ্টা করছে জ্ঞান ফিরানোর। কোনো মতেই জ্ঞান আসছে না রুয়াতের।
.
চৌধুরী বাড়ির সামনে লাশের খাট। বাড়ি জুড়ে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যারা লোকটি কে শুভ কামনা জানানোর জন্য এসেছিলো এখন তারাই লাশ দেখে চলে যাচ্ছে। পুলিশের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। বাসার ভিতরে মাঝ বরাবর রাখা হয়েছে আয়াজের লাশ। একপাশে রুয়াত জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে। আরহাম বারবার তার বুকে আঘাত করছে। মায়া চৌধুরী জ্ঞান হারিয়েছেন ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে। মেঝেতে একপাশে বসে ফজলুল চৌধুরী অঝোরে চোখের পানি ফেলছেন। অবুঝ বাচ্চা জাফরি তার চাচ্চুর লাশের উপর মাথা রেখে কাঁদছে। রুয়াতের জ্ঞান আসার পর এমন বিকৃতি পরিবেশ দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। মেহরুবার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আয়াজের মুখ দেখে থমকে যায়। মুখের একপাশ থিতলে গিয়েছে। মুখটি ধরার পর তার হাত ও রক্তে ভরে যায়। সাদা পাঞ্জাবী রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। আয়াজের মুখটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। সকালের জলজ্যান্ত মানুষটা এখন নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে তার। ভিতর থেকে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে বারবার। সবার মুখে একটাই কথা ‘কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে এখনই স্বামী ছাড়া হয়ে যাবে।’ আয়াজের হাত ঘষে দিচ্ছে রুয়াত। নিজের কোলের উপর স্বামীর মাথা রেখে ইচ্ছেমতো অধর ছোঁয়ায়।

-‘একবার উঠুন না আয়াজ। আমার দিকে তাকান। চোখ খুলুন। আমি সহ্য করতে পারছি না আপনার এমন অবস্থা। কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন কষ্ট পাচ্ছি আমি। আপনি এভাবে শুয়ে আছেন কেনো? উঠুন আয়াজ উঠুন। আপনাকে এভাবে মানায় না। আপনার প্রেয়সী কষ্ট পাচ্ছে। ভালোবাসি তো আয়াজ আপনাকে। কেনো চোখ খুলছেন না বলুন তো? আপনার তো আজকে খুশির দিন তাহলে কেনো এভাবে শুয়ে আছেন? আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন আমি সেজেছি আপনার জন্য। একবার তাকিয়ে দেখুন।’

এসব কথা বলে চিৎকার করছে রুয়াত। আরহাম রুয়াতের কান্না সইতে পারছে না। ইনিমা রুয়াতের পাশে বসে। অপর পাশে আরহাম বসে। রুয়াতের মাথায় হাত দিয়ে বলে-

-‘ও আর চোখ খুলবে না রুয়াত। সে চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে। ওকে সুস্থ করে বাসায় নিয়ে আসতে পারিনি। আমায় ক্ষমা করো বোন। তার আগেই সে দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করে।’

আরহামের দিকে রুয়াত তাকিয়ে বলে-
-‘ভাইয়া আমি কিছু শুনতে চাই না। ওনাকে বলুন চোখ খুলতে। আমার কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। কষ্ট হচ্ছে আমার। ভাইয়া একটু বলুন ওনাকে চোখ খুলতে।’

ওড়না দিয়ে ইনিমা তার চোখের পানি মুছে নিচ্ছে। আয়াজের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছে না। সকালেও কি সুন্দর হেসেছিলো। এখনো চোখে ভাসছে। দূর থেকে সাহেদ কাঁদছে। স্যারের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে। তার ও এখন মন চাচ্ছে স্যারের সাথে না ফেরার দেশে চলে যেতে।

-‘এমপি সাহেব উঠুন। রুয়াত কাঁদছে। দেখুন না। একটু দেখুন। আজ আপনার সব পছন্দের খাবার রান্না করা হয়েছে৷ খাবেন না? আমিও খাইনি। আপনার জন্য বসে আছি। আমায় এভাবে কষ্ট দিবেন না আপনি। দয়া করে উঠুন।’

বেঘোরে কাঁদছে রুয়াত। মুখের সাজ চোখের পানিতে যেনো চলে গিয়েছে। মেহরুবা সেখান থেকে চলে আসে। এতো ছোট বয়সে মেয়েটা স্বামী হারা হলো। এ যেনো সহ্য করতে পারছে না। হান্নান মজুমদার দরজার এক পাশে বসে আছে। মেয়ের আর্তনাদে বুক ছিড়ে আসছে বারবার।

-‘আপু মা কোঁথায়? মা বলেছিলো ওনার কিছু হবে না। এখন মা কে জিগ্যেস করো তো কেনো উঠছে না ওনি? আয়াজ আপনাকে বলছি উঠুন। আর কতোবার বলবো আমি কষ্ট পাচ্ছি? আপনি দেখতে পারছেন না? কেনো সব বুঝেও চোখ বন্ধ করে আছেন? আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। দম বন্ধ হয়ে যাবে আমার।’

কিছু মহিলা এসে জোর করে আয়াজের থেকে রুয়াত কে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। রুয়াত আসতে চাইছিলো না। শুধু বলছে ‘ওনার থেকে আমায় নিয়ে যাবেন না। একা থাকতে পারবো না আমি। আয়াজ কে চাই আমার।’ রুয়াতের কথা যেনো কারো কানে যাচ্ছে না। একদিকে আয়াজের লাশ ধোঁয়া হচ্ছে। অন্যদিক দিয়ে রুয়াত কে তার লাল শাড়ি পাল্টে সাদা শাড়ি পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কানের দুল, হাতের চুড়ি, গলার স্বর্ণের চেইন খুলে ফেলা হয়েছে। বাড়ির সামনে আয়াজের লাশ রাখা হয়েছে কিছুক্ষণ পর নিয়ে যাবে। শেষবারের জন্য মায়া চৌধুরী তার ছেলে কে দেখে আসে। আর চাইলেও ছেলের মুখখানা দেখতে পারবে না। রুয়াত আবার জ্ঞান হারিয়েছে। এতো কম বয়সে এমন শোক সইতে পারেনি। আয়াজের লাশ নিয়ে গিয়েছে। রুয়াত ঘুমিয়ে আছে তারই বেডে। কালকেও রুয়াত কে কতো যত্ন করেছিলো আজ সেই মানুষটা চলে গিয়েছে তার প্রেয়সী কে একা ফেলে রেখে। রুয়াত কে বুকে জড়িয়ে কেঁদে চলছে ইনিমা। সে রুমেই অনেক মানুষ জন দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখের কার্ণিশে নোনাপানি। গড়িয়ে পড়ছে গাল থেকে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here