#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_১৩
#মোহনা_হক
আয়াজের কথা শোনার পর রুয়াত আরহামের দিকে তাকায়। আরহাম দু’দিকে মাথা নাড়লো। এর মানে সে কিছুই শোনেনি। তৎক্ষনাত মোবাইলটা আরহামের কাছে দিয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বসে। আড্ডা ছেড়ে ওঠে চলে যায়। কখন যে মাথার কাপড় সরে গিয়েছে খেয়াল নেই। তুলি একবার খেয়াল করেছে রুয়াত কে। কিন্তু তার ছোট মাথায় এতো বড় বড় জিনিস ঢুকবে না দেখে আবার আড্ডায় মন দিয়েছে।
আরহাম আয়াজের সাথে কথা বলার জন্য বাসার বাহিরে চলে আসে।
-‘তুই কি এমন বলেছিস যে রুয়াত একদম ওঠে চলে গেলো।’
আয়াজ তো ভালো কথা’ই বলেছে। কিন্তু রুয়াত সবার মাঝ থেকে উঠে গেলো কেনো শুধুমাত্র আয়াজের এই কথায়?
-‘তেমন কিছু বলিনি। আজ কি বাসায় আসবে নাকি ওখানেই থাকবে?’
বেশ একটা ভাবসাব নিয়ে আরহাম বললো-
-‘বউ কে রেখে আসবো নাকি? মা বাবা চলে যাবে একটু পর।’
ভাইয়ের সাথে কথা বললেও আয়াজের সম্পুর্ণ দৃষ্টি ল্যাপটপের দিকে। একহাতে মোবাইলটা কানে ধরে রেখেছে।
-‘বউ কে নিয়ে একদিন বেড়াতে এসো।’
আরহাম হাসলো। বউয়ের জায়গায় শালীকা হবে। ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বললেও বুঝে ফেলেছে। আয়াজের ভাই একটু চালাক নাহলে হয় নাকি?
-‘এতো ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বলার কি আছে সোজাসাপ্টা বল যে তোমার শালীকা কে নিয়ে একদিন বেড়াতে এসো।’
-‘হয়েছে বেশি বকবক করছো। রাখছি আমি।’
কলটা কেটে দিলো আয়াজ। আরহাম হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে শুধু। সে তো ভালো কথাই বলেছিলো। ভেবেছিলো ভাইটা খুশি হবে কিন্তু তা নাহ্ উল্টো কিসব বলে কল কেটে দিলো। আরহাম যা বুঝলো আজকাল ভালো মানুষের দাম নেই। আয়াজ এভাবে না বললেও পারতো। আরহাম আর বেশিক্ষণ বাসার বাহিরে কাটালো না বাসায় চলে আসলো। ইনিমা যদি জানে আরহাম বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে তাহলে কেলেংকারী বাধিয়ে ফেলবে।
বারান্দায় একা বসে আছে রুয়াত। হাতে একটা খাতা। নোট গুলো মুখস্থ করছে। কিচ্ছুক্ষণ আগেই মায়া চৌধুরী আর ফজলুল চৌধুরী চলে গিয়েছেন। রুয়াত তাদের সাথে দেখা করে এসেই এখন পড়তে বসেছে। প্রায় দশটা বাজতে চললো। রুমে বসে ভালো লাগছিলো না বলে বারান্দায় এসে বসেছে। এখান থেকে সে জায়গাটা একদম স্পষ্ট যেখানে আয়াজ দু দুবার দেখা করেছে তার সাথে। আনমনে হেসে ওঠে রুয়াত। মানুষটার প্রতি তার খুব অভিযোগ ছিলো। যা কারও কাছে প্রকাশ করেনি আর আজ সে মানুষটার স্মৃতি জড়িয়ে হাসছে। আয়াজের প্রত্যেকটা কথা যেনো রুয়াতের শিরা উপশিরা কাঁপিয়ে তুলে। সে আয়াজের সামনে নিজের সব অনুভূতি লুকিয়ে রাখলেও একাকী থাকলে বসে বসে সে মুহূর্তগুলো স্মৃতিচারণ করে। আয়াজের প্রথম স্পর্শের কথা মনে পড়তেই বুকটা কেঁপে ওঠলো। মোবাইলে মেসেজের আওয়াজে ধ্যান ভাঙে তার। আয়াজের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। ‘সরি প্রেয়সী’ লিখাটা দেখে অবাক হয়। পরক্ষণেই মনে পড়ে তখন সে যে ওঠে চলে এসেছিলো কথাটি মনেহয় আরহাম বলেছে। মুখে অজান্তেই হাসি ফুঁটে ওঠলো রুয়াতর।
.
আজ রুয়াতের কলেজে বিদায় অনুষ্ঠান। দু’দিন ধরে আয়াজের সাথে কোনো রকম কথা হয়নি। এ দু’দিন আয়াজের পাগলামো, কথায় কথায় প্রেয়সী বলা, মুগ্ধতা ভরিয়ে বলা প্রেম বাক্য সবকিছুই রুয়াত কে প্রায় পাগল করে দিয়েছে। আয়াজের শূন্যতা যেনো রুয়াতের ভালোবাসা কে তীব্র করে দিয়েছে। ভেবেছিলো আয়াজ কে কল দিবে কিন্তু কিসব ভেবে আর দেওয়া হয়নি। প্রতিটি সময়ে আয়াজ কে মনে পড়েছে তার। জাফরি যখন কথা বলতো আয়াজের সাথে তখন রুয়াত ও বসে থাকতো। অনেক ব্যস্ততায় দিন কাটছে আয়াজের। জাফরির সাথেও বেশিক্ষণ কথা বলেনি। টানা দু’দিন পর আজ আবার আয়াজের সাথে দেখা হবে রুয়াতের।
নিমি আসবে রুয়াতের বাসায়। দু’জন একসাথে রেডি হয়ে তারপর কলেজে যাবে এখান থেকে। তাদের সবার ড্রেস কোড ছিলো কালো। সেই মোতাবেক নিমি ঠিক করলো সে আর রুয়াত একই রকমের শাড়ি পড়বে। ড্রেস ও পড়তে পারবে। কিন্তু নিমি চাচ্ছিল তারা দু’জন একই রকমের শাড়ি পড়ুক। তাই রুয়াত আর মানা করতে পারলো না। শাড়ি পড়ার অভ্যাস আছে তার। বেশ কয়েকবার ইনিমা আর মেহরুবা পড়িয়েছে তাকে। নিমি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসলো রুয়াতের বাসায়। কারণ যথাসময়ে আজ কলেজে উপস্থিত থাকতে হবে সবার। মেহরুবা দু’জন কে সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিলো। আর ইনিমা সাজিয়ে দিলো। বেশ সুন্দর লাগছে তাদেরকে। রেডি হওয়া শেষ করে তারা রওনা হলো কলেজের উদ্দেশ্যে। আজ যেনো কলেজ কে নতুন রূপ দেওয়া হলো। সবকিছুই বদলে ফেলা হয়েছে। রুয়াত আর নিমি তারা ভালো একটা জায়গা দেখে বসে পড়লো। প্রায় একঘন্টা বাদে আয়াজের আগমন ঘটে। কলেজের সব স্যার ম্যামরা মিলে বরণ করলো আয়াজ কে। রুয়াত উদগ্রীব হয়ে আছে আয়াজ কে দেখার জন্য। অস্থির হয়ে ওঠেছে সে। অনেক সময় পর আয়াজ স্টেজে আসলো। তার পিছনে অনেক ছেলে আরও বেশ কিছু নেতাও এসেছে সাথে। রুয়াত শুধু সাহেদ কে ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারলো না। যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে আছে। কতোগুলো মেয়ে স্টেজে আয়াজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে যারা উপস্থাপনা করবে পুরো অনুষ্ঠান। কিন্তু এদের কে রুয়াতের একদম সহ্য হচ্ছে না।
নিমির হাত ধরে চেপে বসে রইলো। নিমি অনেক্ক্ষণ যাবত দেখছে রুয়াত কেমন ব্যবহার করছে।
-‘রুয়াত তুই এমন করছিস কেনো?’
স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসে রুয়াত। নিমির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো-
-‘কই না তো।’
কথাটি বিশ্বাস হলো না নিমির। রুয়াত আসল কথা বলেনি তাকে।
-‘তুই আমায় সত্যিটা বলিস নি কিন্তু।’
ঘাবড়ে গেলো রুয়াত। নিমির পাল্লায় পড়ে সত্যিটা বলেই ফেললো। হা হয়ে আছে নিমি। তার কান যেনো জ্বলছে। আধও কি কথাটা সত্যি শুনেছে সে। নিমি একবার রুয়াতের কপাল চেইক করে। না ঠান্ডা আছে। নিমির এরূপ আচরণে বিরক্ত প্রায় রুয়াত।
-‘আশ্চর্য এমন করছিস কেনো তুই?’
ঠোঁট চেপে হাসি বন্ধ করলো। বান্ধুবী প্রেমে পড়েছে। তাও আবার রুয়াত।
-‘না এমনি একটু হাসি এসেছে। আসলে সরাসরি কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো।’
রুয়াত চুপ হয়ে বসে আছে। দৃষ্টি নিচের দিকে। নিজের কাজে নিজের এখন লজ্জা লাগছে। সে আসলেই কি ভালোবাসে? মাথা একদম ধরে গিয়েছে তার এটা ভাবতে ভাবতে।
-‘সব কথা শোনার পর তোর আসলে কি মনে হচ্ছে?’
নিমি তার গলাটা একটু পরিষ্কার করলো। এ কেমন মেয়ে ভালোবাসা পর বুঝতে পারছে না যে সে আসলেই ভালোবাসে কিনা!
-‘আমার মনে হচ্ছে তুই ওই যে স্টেজে বসে থাকা লোকটা কে ভালোবাসিস।’
রুয়াত চকিত নজরে তাকালো আয়াজের দিকে। এতোদিন আয়াজ পাগলামো করেছে এখন সে ও কি শামিল হবে? নিজের মন কে বিশ্বাস করতে পারছে না রুয়াত। দু’দিন আয়াজ তার কোনো রকম খোঁজ নেয়নি আর এই দু’দিনের মধ্যেই ভালোবেসে ফেলবে। নাকি আয়াজের জন্য জমে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে অনুভূতি গুলো বিশাল সমুদ্রের ন্যায় হয়ে গিয়েছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমা হলো রুয়াতের কপালে। ভিতরের সব কিছুতে যেনো উত্তাল ঝড় বইছে।
-‘আচ্ছা ওনি দু’দিন আমার কোনো খোঁজ-খবর বা কল, মেসেজ কিছু দেয়নি। আমি সারাক্ষণ শুধু ভাবতাম ওনি আমায় কল দিবে কিন্তু বরবারই ফল শূন্য এসেছে। অস্থির হয়ে থাকতাম আমি তার জন্য। এর মানে কি আমি তাকে ভালোবাসি? দু’দিনে কি সত্যিই ভালোবাসা যায়? আমি কেনো মানতে পারছি না?’
নিমি হতাশ চোখে তাকালো রুয়াতের দিকে। নতুন নতুন ভালোবাসলে যা হয় আরকি।
-‘তুই তাকে আগে থেকেই ভালোবেসেছিস হয়তো সেভাবে উপলব্ধি করতে পারিসনি। তোর মনে তার জন্য নতুন নতুন অনুভূতি জন্মেছিলো। কিন্তু তুই তখন বুঝিসনি। এই যে সে তোর কোনো খোঁজ খবর নিলো না তুই অস্থির হয়ে ওঠেছিস তার সাথে কথা বলার জন্য। এর মানে কি দাঁড়ায় তুই সত্যিই সত্যিই ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছিস। ওনার অনুপস্থিতিতে ভালোবাসাটা উপলব্ধি করতে পেরেছিস।’
রুয়াতে ক্ষ্যান্ত মন শান্ত হলো না। অস্থিরতা বেড়েই চলছে।
-‘তুই শুধু বল আমার কেনো মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে? ভালোবাসলেই কি এমন হয়?’
নিমি রুয়াতের মাথায় হাত দিয়ে বলে-
-‘শুন তুই লাজুক চুপচাপ একটা মেয়ে। অন্য কারও ক্ষেত্রে কি হয় আসলে জানি না। তুই তাকে ভালোবাসিস এটা তো বুঝতে পেরেছি। কাছ থেকে তাকে চিনতে পারিসনি। সে কেমন বুঝতে পারিসনি। যখন সে তোর থেকে একটু দূরে সরে গেলো তখন তোর ভিতর অস্থিরতা কাজ করলো। আর তুই একটা জিনিস সহজে মেনে নিতে পারিস না তাই তোর এমন হচ্ছে বোধহয়। তার সাথে তো তোর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তাহলে তো হারানোর কোনো চিন্তা নেই। আর তুই কথাটা মেনে নিতে পারলেই হলো। আর বিয়ের তো বেশি দেরি নেই এখন সব কিছু মেনে নিলে তোর জন্যই ভালো হবে। তোর বর্তমান কার্যকলাপে এটাই বোঝায় তুই তাকে ভালোবাসিস।’
রুয়াত মাথা নিচু করে বসে আছে। নিমির প্রত্যেকটি কথা তার কানে ভাসছে। বুক ধকধক করছে। যদি ভালোইবেসে থাকে তাহলে এমন হবে কেনো? সবাই তো চায় বিয়ের আগে তার মন পরিবর্তন হোক, আয়াজ কে বুঝুক, ভালোবাসুক তাহলে আজ কেনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। এখন যদি এমন হয় তাহলে ভবিষ্যতে কি হবে? বড় একটা শ্বাস নিলো। অতঃপর স্টেজে বসা শুভ্র পাঞ্জাবী পরিহিত আয়াজের দিকে তাকালো।
#চলবে…
[