#হৃদয়জুড়ে_তুমি
#পর্বঃ৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ইহান ও সিমা একসাথে বাড়িতে ফিরে আসে। ইহানকে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বাড়ি ফিরতে দেখে রায়হান খান খুব বেশি নিশ্চিত হন। তিনি সিমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন,
‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার ছেলেকে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য। আমার তোমার উপর বিশ্বাস ছিল যে তুমি এটা পারবে।’
সিমা মৃদু হেসে বলে,
‘সত্যিই কি আপনার বিশ্বাস ছিল? যদি থাকত তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে এটা বলতেন না যে, আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দেওয়া আপনার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।’
রায়হান খান অপরাধীর মতো মাথা নামিয়ে নেয়। সিমা হাসি বজায় রেখে বলে,
‘আমি আপনাকে দোষ দিবো না। আসলে নিজের স্বার্থে আঘাত হানলে সবাই নিজের আসল রূপ দেখায়। যাইহোক আপনার ছেলের কীর্তি আগে শুনুন। সে স্মৃতি হারায় নি, বরং আমাদের সাথে স্মৃতি হারানোর অভিনয় করছিল। কারণ কি জানেন? যারে আমাকে নিজের জীবন থেকে দূর করে দিতে পারে৷ সেইজন্যই এমন করেছিল আপনার ছেলে।’
রায়খান খান রাগী দৃষ্টিতে তাকান ইহানের দিকে। অতঃপর হুংকার দিয়ে বলেন,
‘সিমা যা বলছে তা কি সত্যি ইহান? তুমি কি সব অভিনয় করেছ?’
ইহান কিছু বলার আগে মান্নাত বেগম বলে ওঠেন,
‘হ্যা ও যা বলছে সব সত্য। তুমি খবরদার আমার ছেলেকে কিছু বলবে না৷ কারণ সব দোষ তোমার। তুমি কি ভেবেছিলে? হুঠ করে একটা কালো মেয়েকে বউ করে ঘরে আনবা আর আমার ছেলে তাকে মেনে নিবে। আমার ছেলের তো চয়েজ বলতে একটা জিনিস আছে।’
সিমা সবাইকে থামিয়ে দেয়। ইশারা করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,
‘আমি চাই না আপনারা আর কেউ এই বিষয়টা নিয়ে ঝামেলা করেন। আমি চলে যাব সবকিছু ছেড়ে। কারণ আমার কাছে সবার আগে রয়েছে আমার আত্মসম্মান।’
রায়হান খান ভাবনা চিন্তা করে বলেন,
‘তুমি কোথাও যাবে না৷ যতদিন না তোমার সাথে ইহানের ডিভোর্স হচ্ছে ততদিন তুমি এই বাড়িতেই থাকবে।’
সিমা জবাবে বলে,
‘আমরা আজই এই ব্যাপারে উকিলের সাথে কথা বলে এসেছি। আমাদের ৯০ দিন মানে তিন মাস একসাথে থাকতে বলা হয়েছে। তারমধ্যে যদি সবকিছু ঠিক না হয় তাহলে ডিভোর্স নিতে পারব। যদিও আমি জানি কিছু ঠিক হবে না কিন্তু আদালতের নিয়ম মানতে হবে। তাই আগামী তিন মাস এই বাড়িতেই থাকব। কিন্তু আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি কারো কাছে কোন অধিকার চাইব না। নিজের মতোই থাকব।’
ইহান বিরক্ত হয়ে গেছে এসবে তাই সে নিজের রুমে চলে যায়। ইহান চলে যাওয়ার কিছু সময় পর মান্নাত বেগমও চলে যান তার কানে কুমন্ত্রণা দিতে। রায়হান খান সিমার সামনে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
‘আমাকে ক্ষমা করে দিও সিমা। আমার জন্যই হয়তো তোমার জীবন নষ্ট হয়ে গেল।’
সিমা উত্তরে বলে,
‘আমি আপনাকে বা আপনার পরিবারের কাউকেই ক্ষমা করতে পারবো না। কক্ষনো না।’
১৭.
সিমা লক্ষ্য করছে দুইদিন থেকে ইনায়া বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের মতো আর নেই মেয়েটা। যদিও এই বাড়ির কোন ব্যাপারে আর সে না গলাতে চায়না। ইতিমধ্যে সে নিজের পেশায় নিযুক্ত হয়েছে। বেশ ভালো ভাবেই ইঞ্জিনিয়ারিং করছে।
সিমার এখন আর অন্য কোন বিষয়ে ভাবার সময় নেই। কিন্তু আজ রাতে সিমা একটি অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়। রাতে গরম অনুভব করায় ছাদে চলে গিয়েছিল সিমা। সেখান থেকে শুনতে পায় ইনায়া ফোনে কাউকে বলছে,
‘তুমি কবে আমার ফ্যামিলিতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে জিসান? তুমি জানো না সবকিছু যদি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে কত বড় বিপদ হবে।’
সিমার মনে কৌতুহল জন্ম নেওয়ায় সে মনযোগ দিয়ে তাদের কথোপকথন শুনতে থাকে। ইনায়া একসময় কাদতে কাদতে বলে,
‘আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছি, কারণ অনেক দিন থেকেই বিভিন্ন সিম্পটম দেখা যাচ্ছিল। আজ তো টেস্ট করে এই ব্যাপারে একদম শিওর হয়ে গেছি।’
সিমা একদম হতবাক হয়ে যায় ইনায়ার কথা শুনে। সমাজে কুমারী মেয়ের প্রেগন্যান্ট হওয়া কেউ ভালো চোখে দেখে না, এটা কোন ভালো কাজও নয়। বরং ভীষণ নিকৃষ্ট একটি ঘটনা। ইনায়া যে এত বড় অঘটন ঘটিয়েছে সেটা ভেবেই সিমার কেমন জানি লাগছিল।
ইনায়ার কান্নার গতি আরো বৃদ্ধি পায়৷ সে ফোনের বিপরীত দিকে থাকা মানুষটিকে অনুরোধ করে বলতে থাকে,
‘প্লিজ জিসান। এভাবে আমাকে অসহায় করে ছেড়ে দিওনা। ব্রেকআপ করো না। হ্যালো শুনতে পারছ,,,জিসান’
ফোন কে’টে দেয় জিসান। ইনায়া পরপর কয়েকবার কল করে কিন্তু জিসান আর রিসিভ করে না। একসময় ইনায়ার নাম্বার ব্লক করে দেয় জিসান। ইনায়া অসহায়ের মতো কাদতে থাকে।
এমন সময় সিমা এসে তার কাধে হাত রাখে। ইনায়া চমকে যায়। সিমাকে দেখে ইনায়া রাগী স্বরে বলে,
‘তুমি এখানে কি করছ? শুনেছ নাকি কিছু?’
‘আমি সব কথাই শুনেছি।’
‘এখন আর কি যাও সবাইকে গিয়ে সব কথা বলে দাও। আমার সর্বনাশ করতে পারলে তো তুমি অনেক খুশি হবে।’
‘সবাইকে নিজের মতো ভেবো না ইনায়া। তুমি আমার খারাপ চাইতে পারো বাট ট্রাস্ট মি আমি তোমার কোন ক্ষতি চাইনা। তবে তুমি যেই কাজটা করেছ সেটা অন্যায়। বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক করা এটা ভালো কাজ নয়৷ এখন বুঝতে পারছ তো সেটা?’
‘কি করব আমি? জিসানকে খুব ভালোবাসতাম যে। ওকে বিশ্বাস করে নিজের দেহ মন সব উজার করে দিলাম আর ও,,,’
‘নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করা মেয়েদের দায়িত্ব। যেটা তুমি করতে পারো নি।’
‘শোন তোমার জ্ঞান কেউ শুনতে চায়নি। আমার সমস্যার সমাধান আমি নিজেই করতে পারব।’
সিমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইনায়া নিজের রুমে চলে যায়।
১৮.
ইনায়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে তার গর্ভে থাকা বাচ্চাটি ন’ষ্ট করবে। তাই সে একটি হাসপাতালে এসেছে। ইনায়া যখন বাড়ি থেকে বের হয় তখন সে ফোনে কাউকে এই ব্যাপারে বলছিল। যা সিমার কানে আসে। তাই সিমা ইনায়ার পিছু নেয়। অতঃপর তার পিছন পিছন হাসপাতালে চলে আসে।
ইনায়া হাসপাতালে প্রবেশ করার আগেই সিমা তার হাত ধরে বলে,
‘আমি জানি তুমি এখানে কেন এসেছ। চলো আমার সাথে ফিরে চলো। এমনিই অনেক বড় একটা পাপ করেছ। এখন নিজের পাপের বোঝা আর বাড়ানোর দরকার নেই।’
ইনায়া ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে বলে,
‘তোমাকে আগেও বলেছি আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। আমি নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারব।’
‘আমি জ্ঞান দিতে আসিনি৷ তোমাকে ঠিক ভুলের পার্থক্য বোঝাতে এসেছি। দেখ তুমি যেটা করেছ সেটা তোমার ভুল। এই বাচ্চাটার তো কোন দোষ নেই। তাহলে ওকে কেন শাস্তি দেবে?’
‘তো কি করব আমি? বাবার নাম পরিচয়হীন এই বাচ্চাকে পৃথিবীতে এনে মানুষের হাসির পাত্র হবো? জিসান বলে দিয়েছে সে আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না।’
‘তুমি আমার সাথে এসো।’
সিমা ইনায়ার কোন কথা না শুনে তাকে নিয়ে গাড়িতে বসায়। অতঃপর তাকে একটা বস্তিতে নিয়ে যায়। ইনায়া জিজ্ঞেস করে,
‘এখানে কেন এনেছ আমাকে?’
সিমা কোন উত্তর না দিয়ে ইনায়াকে বস্তির ভিতরে নিয়ে যায়। বস্তির একটি পরিবারকে দেখায়। যেখানে একজন মা নিজে না খেয়ে তার তিন সন্তানের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছে। সিমা ইনায়াকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘দেখতে পাচ্ছো? এটাই হলো মাতৃত্ব। একজন মা নিজে না খেয়ে তার সন্তানদের খাওয়াচ্ছে। আর তুমি নিজের অনাগত সন্তানকে শে’ষ করতে চাইছ।’
ইনায়া এবার তার ভুলটা অনুধাবন করতে পারে। সিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘আমি আমার বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনতে চাই।’
সিমা খুশি হয়। এটাই তো চাইছিল সে। অতঃপর ইনায়াকে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। যেহেতু কোনকিছু লুকিয়ে লাভ নেই তাই রায়হান খান, মান্নাত বেগম, ইহান সবাইকে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হতে বলে সিমা। সবাই ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলে সিমা বলে,
‘আপনাদের সবাইকে একটি জরুরি কথা জানাতে চাই।’
মান্নাত বেগম মুখ গোমড়া করে বলেন,
‘কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো। আমার অনেক কাজ আছে।’
‘এই পরিবারে একটি নতুন সদস্য আসতে চলেছে। ই,,,’
সিমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই মান্নাত বেগম বলে ওঠেন,
‘তুমি আমার ইহানের বাচ্চার মা হতেই পারো না। ইহান তো তোমাকে কোনদিন স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। তুমি কি ভেবেছ অন্য কারো বাচ্চা পেটে ধরে আমার ইহানের নামে দোষ চাপিয়ে দেবে। এটা হবে না। দেখছ তো তুমি(রায়হান খানের দিকে ইশারা করে) কেমন মেয়েকে বাড়ির বউ করে এনেছ যার চরিত্রের ঠিক নেই!’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨