#হৃদয়জুড়ে_তুমি
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ইহানের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন মান্নাত বেগম। ইহান নিজের মাকে চিনতে পারছে না! এমনকি নিজের নামটাও চিনতে পারছে না, মান্নাত বেগম অস্থির হয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন,
‘আমার ছেলের কি হয়েছে? ও এমন করছে কেন?’
ডাক্তার ইহানকে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি কি সত্যি কিছু মনে করতে পারছেন না মিস্টার ইহান খান? উনি আপনার মা।’
ইহান বোকার মতো তাকিয়ে রয় কিছু সময়। অতঃপর বলে ওঠে,
‘আমি কিছু মনে করতে পারছি না। আমি কে? কি আমার পরিচয়?’
ডাক্তার ইহানের ভাবগতিক দেখে আন্দাজ করতে পারে তার সমস্যা। তিনি বলেন,
‘আই থিংক, যে মাথায় আঘাত লাগার কারণে ওনার স্মৃতিশক্তি চলে গেছে।’
মান্নাত বেগমের মুখটা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করে। তিনি এমন কিছু আশা করেন নি। বিপরীত দিকে রায়হান খানও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন,
‘আপনি ঠিক বলছেন তো ডক্টর? মানে আমার ছেলে সত্যিই স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে। তাহলে ওর স্মৃতি ফেরানোর উপায় কি?’
‘ওনার অবস্থা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। আমি কিছু পরীক্ষা করতে দিচ্ছি শিওর হওয়ার জন্য। তারপর এই ব্যাপারে কি করা যায় সেটা বলতে পারব।’
সিমাও অন্য সবার সাথে এসেছিল ইহানের কেবিনে। এককোনায় চুপ করে ছিল সে। আচমকা ইহান সিমাকে বলে ওঠে,
‘তোমাকে কেন জানি আমার চেনা চেনা লাগছে। তুমি কি আমার কেউ হও?’
সবাই অবাক হয় ইহানের কথা শুনে। বিশেষ করে সিমা। সবাইকে আরো অবাক করে ইহান সিমাকে বলে,
‘তুমি আমার কাছে একটু আসবে?।’
সিমা কোন কিছু না ভেবে চলে আসে ইহানের কাছে। ইহান সিমার হাত ধরে বলে,
‘আমার কাছেই থাকো তুমি। আমার তোমাকে প্রয়োজন।’
মান্নাত বেগম নিজের ছেলের এমন ব্যবহার দেখে রেগে যান। একেই তিনি সিমাকে সহ্য করতে পারেন না, তার উপর যা সব হচ্ছে। তাই তিনি বলেন,
‘এই মেয়ে তুমি একদম আমার ছেলের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবে না। দূর হও বলছি।’
ইহান সিমার হাত শক্ত করে ধরে বলে,
‘না ও আমার থেকে দূরে যেতে পারে না। আমি ওকে দূরে যেতে দেবো না।’
অবস্থা বেগতিক দেখে ডাক্তার বলেন,
‘পেশেন্টের কান্ডিশন বেশি ভালো না। এই অবস্থায় ওনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে ওনার ক্ষতি হতে পারে। তাই আপনারা কেউ ওনাকে কোন বিষয়ে জোরাজোরি করবেন না প্লিজ।’
মান্নাত বেগম কিছু বলতে যাবেন তখন রায়হান খান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
‘অন্তত নিজের ছেলের ভালোটা বোঝার চেষ্টা করো। ডক্টর কি বললেন শুনলেই তো।’
মান্নাত বেগম আর কিছু বলতে পারেন না। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া এখন তার আর কিছুই করার নেই।
১৩.
দুই দিন পরেই কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ইহানকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইহান এখন সিমা ছাড়া আর কিছুই বোঝেনা। তার মতে, এখন তার সিমাকে ছাড়া সবাইকে অচেনা লাগে। তাই অন্য কারো সাথে থাকতে চায় না ইহান। ইহানের এই সমস্যার কারণে সিমা সর্বক্ষণ তার পাশাপাশিই থাকছে। যা মান্নাত বেগম ও ইনায়ার বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে।
সবকিছুকে ছাপিয়ে সিমা লেগে আছে ইহানের খেয়াল রাখার কাজে। হাসপাতালে অবস্থানকালীনও ইহানের দেখাশোনা সেই করেছে। কারণ ইহান তাকে ছাড়া কিছু বুঝছে না। এক মুহুর্তের জন্যেও সিমাকে চোখের বাইরে যেতে দিতে চায় না ইহান।
তার সব আবদার সিমার কাছে। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরেই ইহান সিমার কাছে আবদার করেছে তাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। সিমা তো প্রথমে কিছুতেই রাজি হয় না। কিন্তু ইহানও কোন কথা শুনতে রাজি নয়৷ তার একটাই কথা সে ঘুরতে যাবে ব্যাস। অবশেষে সিমাকে হার মানতে হয় ইহানের জেদের কাছে।
ইহানকে নিয়ে একটু বাইরে ঘুরতে যায়। ইহান সিমাকে সারা রাস্তায় বিভিন্ন প্রশ্ন করে বিরক্ত করে তবে সিমা ধৈর্য সহকারে সবকিছু সামলায়। সারাদিন বিভিন্ন যায়গায় ঘুরে তারা দুজনে মিলে। সিমা গাড়ি ড্রাইভ করতে পারত। ইহান অসুস্থ থাকায় তাই সিমাই গাড়ি ড্রাইভ করছিল।
অতঃপর ফিরে আসার সময় ইহান হঠাৎ করে বায়না করে সে আইসক্রিম খাবে। ইহান একটি আইসক্রিমের দোকান দেখিয়ে বলে,
‘আমি ওটা খাবো আমাকে এনে দাও।’
সিমা তখন কিছু একটা ভেবে বলে,
‘এখন তো অনেক রাত হয়েছে। আমাদের ফিরতে হবে। এত রাতে আইসক্রিম খাওয়া ঠিক হবে না। আপনার ঠান্ডা লাগতে পারে।’
ইহান তখন মুখটা বেজার করে বলে,
‘আমাকে এনে দাও প্লিজ। আমার ওটা খেতে খুব ইচ্ছা করছে।’
সিমা ইহানের নিঃসংকোচ এই আবেদন ফেলতে পারে না৷ তাই বলে,
‘আচ্ছা বেশ, আমি আইসক্রিম নিয়ে আসছি। তবে আপনি কিন্তু এখান থেকে এক পাও নড়বেন না। আমি এক্ষুনি যাবো আর এক্ষুনি আসব।’
ইহান খুশিতে একপ্রকার লাফিয়ে উঠল। ইহানের খুশি খুশি মুখ দেখে সিমাও অনেক আনন্দ পায়। ইহানকে বসিয়ে রেখে চলে যায় আইসক্রিম নিতে।
আইসক্রিম দোকানের সামনে গিয়ে সিমা বলে,
‘আমাকে দুটো চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম দিন।’
দোকানদার সিমার হাতে দুটো আইসক্রিম দিয়ে দেয়। সিমা আইসক্রিম গুলো নিয়ে বিল মিটিয়ে চলে আসে গাড়ির কাছে। গাড়িতে এসে ইহানকে না দেখে সিমা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ভয় এসে জমা হয় তার মনে। সিমা ইহানের নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায়না। দিশেহারা হয়ে আশেপাশে খুজতেও থাকে ইহানকে। কিন্তু ইহানের কোন খোজই সে পায়না।
১৪.
সিমা এখন বসে আছে পুলিশ স্টেশনে। রায়হান খান, মান্নাত বেগমও উপস্থিত সেখানে। ইতিমধ্যে তাদের কানেও ইহানের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবরটা গেছে।
সিমা পুলিশ অফিসারকে বলে,
‘আমার হাজবেন্ড ইহান খান, উনি বর্তমানে তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। আজ আমি তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে ছিলাম। ফেরার সময় উনি আইসক্রিম খেতে চাইলেন তখন আমি আইসক্রিম আনতে যাই। বাট ফিরে আসার পর তাকে আর খুজে পাইনা। অনেক খুজেছি কিন্তু কোথাও তাকে পাইনি। তাই নিরূপায় হয়ে আপনাদের কাছে আসলাম।’
পুলিশ সিমাকে আরো অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে। বিভিন্ন তথ্য নেয়। মান্নাত বেগম থানাতেই চটে যান সিমার উপর। সিমাকে দোষারোপ করে বলেন,
‘আমি জানি এই মেয়েই আমার ছেলের সাথে কিছু একটা করেছে। অপয়া মেয়ে একটা যবে থেকে আমার ছেলের জীবনে এসেছে তখন থেকেই আমার ছেলের জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছে। অফিসার আপনি এই মেয়েটাকে জেলে ঢোকান। আমি জানি ঐ মেয়েই আমার ছেলেকে লুকিয়ে রেখেছে।’
রায়হান খান বিরক্ত হয়ে বলেন,
‘আহ, মান্নাত। এসব কথা বাদ দাও। ওনাদেরকে ওনাদের কাজটা করতে দাও। আর সিমা তোমার থেকে এটা আমি আশা করিনি। যদি আমার ছেলেকে সামলাতেই না পারো তাহলে তার দায়িত্ব নিয়েছিলে কেন? এত কেয়ারলেস কেন তুমি? এখন তো আমারও এটা মনে হচ্ছে যে তুমি আমার ছেলের যোগ্য নও। তোমার সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেওয়া আমার জীবনের বড় একটা ভুল ডিশিসন।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨