#হৃদয়জুড়ে_তুমি
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি
সিমা নিজের যমজ বোনের ব্যাপারে জেনে তার সাথে দেখা করার আকুল আবেদন জানায় তার বাবা সাজ্জাদ চৌধুরীর কাছে। কিন্তু সাজ্জাদ চৌধুরী তার মুখের উপর বলে দেয়,
‘আমি চাইনা ঐ মেয়েটার সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে। ও যেখানেই আছে ভালো আছে। তাই তোমাকে ওকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।’
সিমা তার বাবাকে এই ব্যাপারে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সাজ্জাদ চৌধুরী নিজের জেদে অটল থাকেন। অগত্যা সিমা নিরাশ হয়ে নিজের রুমে চলে আসে৷ অতঃপর নিজের মায়ের ছবি হাতে নিয়ে বলে,
‘আম্মু, তুমি যদি আজ বেচে থাকতে তাহলে বোধহয় সবকিছু এমন এলোমেলো হতো না। আব্বু এত কথা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন। আমার নাকি একটা যমজ বোনও আছে। আচ্ছা আমি কোথায় খুজব তাকে? আব্বু যে আমাকে কিছুই বলতে চাইছে না।’
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে সিমা যে কখন গভীর ঘুমের মধ্যে আছন্ন হয়ে যায় সেটা সে নিজেও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। ঘুমের মাঝেই একটি স্বপ্ন দেখে সিমা। স্বপ্নে তারই মতো দেখতে একটি মেয়েকে দেখে৷ যে অনেক কষ্টে, অনেক অবহেলায় বড় হচ্ছে। স্বপ্নটি দেখামাত্র সিমার ঘুম ভেঙে যায়। নিজের বোনের জন্য দুঃচিন্তা এসে ধরা দেয় তার মনে। সিমা তখন চোখ বন্ধ করে বলে,
‘আল্লাহ আমি যেটা স্বপ্নে দেখেছি সেটা যেন সত্য না হয়৷ আমার বোন যেখানেই থাকুক সে যেন ভালো থাকে।’
✨
‘গাড়িটা আস্তে চালা সামিহা!’
নিজের তথাকথিত বাবার কথায় কর্ণপাত করে না সামিহা। উল্টো সে বলে,
‘আমি গাড়ি আরো জোরে চালাবো, যদি ভালো চাও তাহলে আমাকে আমার আসল পরিচয় বলো। আমি জানি, আমি তোমাদের আসল মেয়ে নই।’
‘তুই ভুল ভাবছিস সামিহা।’
‘ঠিক ভুলের বিচার করার মতো বুদ্ধি আমার হয়েছে। কাল আমি তোমার আর মায়ের সব কথা শুনেছি। তোমরা তো বলছিলে আমি তোমাদের আসল মেয়ে নই।’
‘আমরা কি তোকে কোন অবহেলা করেছি?’
‘এত কথা আমি শুনতে চাইনা। তুমি শুধু আমাকে আমার আসল পরিচয় বলো নাহলে আমি কিন্তু এক্সিডেন্ট করে দেব।’
‘ঠিক আছে। আমি বলছি তোকে সব। তুই আমার না, আমার বোন সুমাইয়ার মেয়ে। তোর জন্মের সময় তোর মায়ের মৃত্যু হয়েছিস সেই জন্য তোর বাবা তোকে অপয়া মনে করে আমাদের কাছে রেখে গেছে৷ আর হ্যা, তোর একটা যমজ বোনও রয়েছে। যে তোর থেকে কয়েক মিনিটের বড়।’
সহসাই গাড়ি থামিয়ে দেয় সামিহা। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে, অথচ তার শরীর ঘামছে। ফর্সা হাত বেয়ে গড়িয়ে পরছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সামিহা মিনমিনে স্বরে বলে,
‘তুমি আমার পাসপোর্ট ভিসার ব্যবস্থা করো৷ এক সপ্তাহের ভিতরেই আমি বাংলাদেশে যেতে চাই আমার রিয়্যাল ফ্যামিলির সাথে মিট করতে।’
১১.
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই রায়হান খান চড়াও হন ইহানের উপর। কারণ ততক্ষণে তিনি জেনে গেছেন সিমা গতরাতে এই বাড়ি ত্যাগ করে গেছে। রায়হান খান ইহানকেই এরজন্য দোষারোপ করেন। তিনি বলেন,
‘তোমার মতো কুলাঙ্গারের জন্য সিমা এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। তুমি মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ, যা মেয়েটা কোনভাবেই সহ্য করতে পারে নি। তাই,,’
মান্নাত বেগম নিজের ছেলের পক্ষ নিয়ে বলেন,
‘তুমি আমার ছেলেকে দোষ দিচ্ছ কেন? সব দোষ তো ঐ মেয়ের। আমরা তো কেউ ওকে চলে যেতে বলিনি। আমার ছেলেও বলেনি। ও যখন নিজের ইচ্ছাতে চলে গেছে তখন তো ভালোই হয়েছে। এমনিতেও ওকে আমাদের কারোরই পছন্দ নয়। শুধু তুমি পছন্দ করলে তো হবে না। সংসার তো আমার ছেলেকেই করতে হবে নাকি!’
রায়হান খান ভীষণ রেগে চান। তার চক্ষুদ্বয় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। তিনি হুংকার দিয়ে বলে ওঠেন,
‘আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা। ইহানের জন্যই সিমা এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এখন ওকেই সিমাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। যতক্ষণ না সিমা এই বাড়িতে ফিরছে ততক্ষণ ইহানেরও কোন যায়গা হবে না এই বাড়িতে।’
ইহানের সম্মানে লাগে তার বাবার মুখে এহেন কথা শুনে। তাই সেই রাগ থেকে ইহান বলে দেয়,
‘ঠিক আছে। আমিও থাকবো না এই বাড়িতে। চলে যাচ্ছি আমি।’
ইহান বাড়ি থেকে বের হতে গেলে মান্নাত বেগম তার পথ আটকে বলেন,
‘কোথাও যাবি না তুই। এটা তোর বাড়ি। এখানে তোর অধিকার আছে।’
ইহান নিজের জেদে অটল থেকে বলে,
‘না আম্মু। এই বাড়ি রায়হান খানের। উনি যখন আমাকে চলে যেতে বলেছেন তখন আমি আর এখানে থাকবো না।’
কথাটা বলেই হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ইহান। মান্নাত বেগম রায়হান খানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
‘এবার শান্তি পেয়েছ তো তুমি? একটা বাইরের মেয়ের জন্য নিজের ছেলেটাকে এভাবে বের করে দিলে বাড়ি থেকে।’
‘তুমি ভুল ভাবছ মান্নাত। আমি কাউকে বাড়ি থেকে বের করিনি। আমি শুধু ওকে শর্ত দিয়েছিলাম। এখন ও যদি সেটা না মানে তাহলে ওর এই বাড়িতে থাকতে দেবো না আমি।’
কথাটা বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ান রায়হান খান।
ইহান দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। রাগ তার মাথায় উঠে গেছে। একটা বাইরের মেয়ের জন্য তার বাবা যে তাকে এভাবে অপমান করল সেটা সে মানতেই পারছে না। অসাবধানতাবশত গাড়ি চালাতে গিয়ে আচমকা একটি পিলারের সাথে ধাক্কা খায় ইহান। তৎক্ষনাৎ তার মাথা বেয়ে তরল রক্তের স্রোত নামে।
১২.
বিয়ে একটি অদ্ভুত সম্পর্ক! এই সম্পর্কের মাধ্যমে দুজন অচেনা মানুষ চিরকালের জন্য এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সেই বন্ধনের টান থেকেই সিমা শত অপমানের পরেও ছুটে এসেছে হসপিটালে ইহানকে দেখার জন্য। রায়হান খান কল দিয়ে সিমাকে জানিয়েছেন ইহানের এক্সিডেন্টের ব্যাপারে। হাসপাতালে আসামাত্রই রায়হান খানকে দেখতে পায় সিমা। ছুটে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার ছেলে এখন কেমন আছে?’
রায়হান খান শান্ত কন্ঠে বলেন,
‘মাথায় বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে। তবে ওর লাইফ রিস্ক নেই। ডক্টর বললেন, ও এখন সেইফ জোনে আছে।’
কিছুক্ষণ পরেই সিমার কানে আসে কারো কান্নার আওয়াজ। মান্নাত বেগম ও ইনায়া কান্না করতে করতে এদিকেই আসছিল। সিমাকে এখানে দেখে ক্ষেপে যান মান্নাত বেগম। সিমাকে গালাগালি করে বলেন,
‘এই ডাই’নিটা কেন এসেছে এখানে? আমার ছেলের এক্সিডেন্ট করিয়ে কি ওর শান্তি হয়নি? এখন কি আমার ছেলেটাকে খেতে এসেছে?’
সিমার খুব খারাপ লাগে এমন কথা শুনে। রায়হান খান সিমার হয়ে প্রতিবাদ করে বলেন,
‘তুমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছ। যা হয়েছে তাতে সিমার তো কোন হাত নেই। দূর্ঘটনা তো আর বলে কয়ে আসে না। দোষ তোমার ছেলের। রাস্তায় উদ্ভ্রান্তের মতো গাড়ি চালাতে কে বলেছিল তাকে?’
ইনায়া বলে ওঠে,
‘তুমি এখানেও ভাইয়ার দোষ দেখছ আব্বু? দোষ তো এই মেয়েটার। ও বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল জন্যই তো তুমি ভাইয়াকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলে। আর তারপরই তো এসব হয়ে গেল।’
সিমার এবার একটু অপরাধবোধ অনুভব হয়। তার মনে হয় তার জন্যই বোধহয় সব হয়েছে। এমন সময় একজন নার্স এসে বলে,
‘আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।’
কথাটা শোনামাত্রই সবাই মিলে যায় ইহানের কেবিনের দিকে। সিমা দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকে। মান্নাত বেগম কেবিনে ঢুকে ইহানের সামনে গিয়ে বলেন,
‘তুই কেমন আছিস ইহান?’
সবেমাত্র ইহানের জ্ঞান ফিরেছে। সে মলিন চোখে মান্নাত বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনি কে? আর আমাকে ইহান বলে ডাকছেন কেন? আমার নাম কি ইহান?’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨