১.
‘এই কালো মেয়েটাকে আমি বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবো না।’
বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর ঘোমটা তুলতেই কথাটা কর্ণগোচর হতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সিমা। সে জানতো আজ এমন কিছুই হতে চলেছে। তার বাবা যতই ধনী হোক না কেন তার মতো কালো একটা মেয়েকে কেন কেউ স্ত্রী হিসেবে মানতে চাইবে।
সবার সামনেই বিয়ের আসর থেকে উঠে দাড়ালো সিমা। অতঃপর তার বাবা সাজ্জাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলে,
‘তুমি খুশি হয়েছ তো আব্বু? আমাকে বিদায় করার খুব তাড়া ছিল না তোমার। আমি বলেছিলাম না, তুমি পারবে না। তোমার মেয়ে যে সুন্দর হওয়ার যুদ্ধে হেরে গেছে। তাই তাকে কেউ বউ হিসেবে চাইবে না।’
ভেতর থেকে কান্না এলেও নিজেকে সামলে নিলো সিমা। আর কত কাদবে সে? শুধুমাত্র গায়ের রং কালো হওয়ায় ছোট বেলা থেকে সবার কাছে কম অপমানিত আর লাঞ্চিত তো হয়নি। তাই এখন এসব তার গায়ে সয়ে গেছে।
সাজ্জাদ চৌধুরী কাতরভাবে তাকালেন নিজের বন্ধু রায়হান খানের দিকে। খুব আশা করে নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। তার ভরসা ছিল রায়হান যেমন ভালো মনের মানুষ তার ছেলেও তেমন হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তার ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল।
রায়হান খান নিজের ছেলে ইহানকে বোঝাতে গেলেন। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উলটো ইহানই বলল,
‘তুমি কেন আমাকে ঠকালে আব্বু? আমি শুধুমাত্র তোমার কথায় মেয়েকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি আমার জন্য বেস্টটাই চয়েজ করবে। এখন দেখছি তোমাকে বিশ্বাস করাই আমার ভুল হয়েছে।’
রায়হান খান বেশ ভড়কে গেলেন নিজের ছেলের এমন কথা শুনে। বললেন,
‘তুমি যেমন আমার উপর ভরসা করে ছিলে আমিও তেমনটাই করেছিলাম। আমার নিজের শিক্ষার উপর ভরসা ছিল। কিন্তু আজ তুমি প্রমাণ করে দিলে তুমি আমার শিক্ষায় শিক্ষিত হওনি। নিজের মায়ের মতোই হয়েছ। মানুষের গায়ের রং দিয়ে তাকে বিচার করছ।’
ইহান উপহাসের স্বরে বলল,
‘তুমি বাদরের গলায় মুক্তোর মালা ঝুলাতে চাইবে আর আমিও ঝুলে যাব। আমার মতো এত সুদর্শন আর স্মার্ট একটা ছেলে ঐরকম একটা কালো ভূতকে বউ হিসেবে মানব সেটা তুমি ভাবলেও বা কি করে? আম্মু ঠিকই বলে তুমি বাবা হওয়ার অযোগ্য। আমি এই বিয়ে কিছুতেই মানব না।’
রায়হান খান সবার সামনে নিজের ছেলের গালে চ’ড় বসিয়ে দিলেন এই কথার পরিপেক্ষিতে। ইহান ভীষণ অপমানিত বোধ করল। সাথে সাথে বেরিয়ে গেলো বিয়ের আসর থেকে। রায়হান খান তাকে আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলেন।
বিয়ে বাড়ির পরিস্থিতি হঠাৎ থমথমে হয়ে গেলো। মানুষ কানাঘুষো শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। কেউ কেউ সিমার জন্য হা হুতাশ করছে তো কেউ আবার তাকে নিয়ে উপহাস করছে। বিনা দোষে এসব পরিস্থিতি ভোগ করতে হচ্ছিল সিমার। সে তো এত কিছু চায়নি। কলেজে উঠে যখন একটি ছেলেকে নিজের মনের কথা জানিয়ে চরমভাবে অপমানিত হয়েছিল সেদিন থেকেই তো সিমা ভেবে নিয়েছিল জীবনে কখনো কোন আশা রাখবে না। কালো মেয়েদের যে আশা রাখতে নেই। তখন থেকে তো সিমা শক্ত করেছিল নিজেকে। অথচ আজ আবার একইভাবে তাকে অপমানিত হতে হলো। আবার একজন তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো সে কালো৷ তাই সে কারো ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না।
একেক লোকের একেক কথা আর সহ্য হচ্ছিল সিমার। কেউ কেউ তাকে সমবেদনা জানাচ্ছিল তো কেউ সমবেদনার নামে যেন তার কালো চেহারা নিয়ে উপহাস করছে। এসব দেখে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল সিমা। তাই সোজা নিজের রুমে চলে গেলো৷ বেনারসি শাড়িটা বদলে নিয়ে পিংক গ্রাউন পড়ে নিল। সিমা আয়নায় নিজেকে দেখে বললো,
‘আজ যদি আমি আগের সিমা হতাম তাহলে এতক্ষণ কেদে ভাসাতাম। কিন্তু না আমি আর কাদবো না। নিজেকে দূর্বল হতে দেবো না আমি। যা হয় হোক আমি নিজেকে নিয়েই খুশি থাকবো। বাইরের লোকের যতই সমস্যা থাকুক আমার আল্লাহর দেওয়া এই চেহারা নিয়ে কোন ক্ষোভ নেই। আমি নিজেকে ভালোবাসি, পছন্দ করি। আর কে আমাকে ভালোবাসলো কি না, পছন্দ করল কিনা তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’
২.
সাজ্জাদ চৌধুরী সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছেন। বিয়ে বাড়ি ইতিমধ্যেই ফাকা হতে শুরু করেছে। সবাই একে একে চলে গেলেও রায়হান খান এখনো রয়ে গেছেন। সাজ্জাদ চৌধুরীর পাশেই বসে আছেন তিনি। ক্ষমা চাইবেন নাকি শান্তনা দেবেন সেটা বুঝতে পারছেন না।
সাজ্জাদ চৌধুরী নিজেই রায়হানকে বললেন,
‘আমি বুঝতে পারছি তুই হয়তো গিলটি ফিল করছিস। দেখ আমি জানি এখানে তোর কোন দোষ নেই। আসল দোষটা ছিল আমার। মেয়েটা আমাকে বলেছিল ও বিয়ে করতে চায় না। আমিই জোর করেছিলাম। কি করবো বল। আমার আদরের মেয়ে। আমার কিছু হয়ে গেলে ওকে কে দেখবে সেই চিন্তা থেকেই,,,’
রায়হান খান সাজ্জাদ চৌধুরীর মাথায় ভরসার হাত রাখেন। মৃদু হেসে বলেন,
‘আমি তোর কষ্টটা বুঝি বন্ধু। ভাবির মৃত্যুর পর তো তুই একা হাতে দুই মেয়েকে মানুষ করেছিস। ছোট মেয়েটা তো মামার বাড়িতে পড়ে আছে, সিমাই তোর সব। জানিস সিমাকে দেখলে আমার ভাবির কথা খুব মনে পড়ে। শুধু ভাবির গায়ের রং নয় তার স্বভাবও পেয়েছে মেয়েটা। দেখতে যেমনই হোক ব্যবহার, মেধা সবদিক দিয়ে সেরা তোর মেয়ে। বুয়েট থেকে পড়াশোনা করেছে। আমার ছেলে হিরার মূল্য বুঝিস পারল না। কিন্তু দেখবি তোর মেয়ে নিজে একদিন সবাইকে তার মর্ম বুঝাবে। মিলিয়ে নিস আমার কথাটা।’
আচমকা সাজ্জাদ চৌধুরীর সেক্রেটারি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে নিচে এলো। সাজ্জাদ চৌধুরী নিজের সেক্রেটারিকে এভাবে আসতে দেখে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করেন,
‘কি হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
‘সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার। সিমা ম্যাডাম ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছেন। তিনি নাকি আজই এই বাড়ি থেকে চলে যাবেন।’
সাজ্জাদ চৌধুরী উঠে দাড়ান। রায়হান খানও তার সাথে উঠে দাড়ায়। সিমাও ততক্ষণে ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। সাজ্জাদ চৌধুরী নিজের মেয়েকে এভাবে দেখে প্রশ্ন করেন,
‘কোথায় যাচ্ছিস তুই এভাবে?’
সিমা কালক্ষেপণ না করে উত্তর দেয়,
‘শ্বশুর বাড়িতে।’
রায়হান খান প্রশ্ন করেন,
‘কেন মা? তুমি ওখানে গিয়ে কি করবে?’
‘কেন শ্বশুর আব্বা? বিয়েটা যখন হয়েছে তখন তো আমাকে ওখানে যেতেই হবে। আপনি নিজের স্ত্রীকে ফোন করে বলুন তিনি যেন আমাকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকেন।’
সাজ্জাদ চৌধুরী ভাবেন শুধুমাত্র তার একটি ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তার মেয়ের জীবন হয়তো এলমেলো হয়ে গেল। তাই তিনি বলেন,
‘তোকে কোথাও যেতে হবে না সিমা। আমি ভেবেছিলাম ইহান তোর সম্পর্কে সব কিছু জেনেই তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু এখন যা দেখলাম তারপর তোকে আর ওখানে পাঠানোর ঝুকি নিতে পারব না।’
সিমা অনেক আশা নিয়ে রায়হান খানের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘শ্বশুর আব্বা আপনি আব্বুকে বোঝান না। আপনি তো ওখানে থাকবেন আমার হেল্পিং হ্যান্ড হয়ে। তাহলে আমার আর টেনশন কিসের? বিয়ে যখন হয়ে গেছে তখন আমি নিজের অধিকার ঠিক বুঝে নেবো। আপনার ছেলে আর স্ত্রী দুজনকেই আমি বুঝিয়ে দিয়ে আসবো মানুষের গায়ের রং ম্যাটার করে না। আপনার স্ত্রী মানে আমার শাশুড়ি তো একটিবারও আমাকে দেখতে এলো না৷ বিয়েতেও এলো না এর কারণ কি?’
রায়হান খান উদাস হয়ে বলেন,
‘ও নিজের ভাইয়ের মেয়ের সাথে ইহানের বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি সেটা হতে দেইনি। ইহান আমার কথায় তোমাকে না দেখেই এই বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে। এই নিয়ে ক্ষোভ থেকে ও বিয়ের কোন আনুষ্ঠানিকতায় থাকে নি। তবে আমি ভাবিনি যে এভাবে তোমার গায়ের রং নিয়ে ইহান সমস্যা করবে। কারণ আমি ভেবেছিলাম ইহান আমার শিক্ষায় শিক্ষিত।’
সিমার এখনো মনে আছে রায়হান খানের স্ত্রী মান্নাত বেগম ছোটবেলায় একবার তাকে অপমান করেছিল তার রূপ নিয়ে। সেই অপমান আজও মনে আছে তার। তাই সিমা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই পরিবারে বউ হয়ে গিয়ে রেসিজম ঘুচিয়ে দিয়ে আসবে। তাই রায়হান খানকে বলে,
‘চলুন শ্বশুর আব্বা। আমাকে আমার শ্বশুর বাড়ি নিয়ে চলুন।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
#হৃদয়জুড়ে_তুমি
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি
>>আসসালামু আলাইকুম ফিরে এলাম নতুন গল্প নিয়ে। গল্পটা কেমন লাগল জানাবেন। আপনাদের রেসপন্সের উপর ভিত্তি করে পরের পর্ব দিবো ✨✨