“তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো, ছেড়ে দেবো না।
তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো, ছেড়ে দেবো না।”
হঠাৎ কারো ডাকে গায়ক মহাশয়ের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– ‘ইয়ার! আর ডাকার সময় পেলি না।’
– ‘না ডেকে উপায় আছে? পরশু ফ্লাইট আর তুই এখনো তোর প্রেয়সীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে গান গাইতে মগ্ন!’
– ‘এত বছর পর নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে দেখা করতে চলেছি। কিছুতেই তর সইছে না। তারিনও নিশ্চয়ই আমার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।’
– ‘কাজে মন দে। পরশু ফ্লাইট এখনো অসূচনা_পর্বনেক কাজ বাকি।’
দীর্ঘ পাঁচবছর পর সোহান দেশে ফিরেছে। তার চোখজোড়া যেন কাউকে খুঁজে চলেছে। চারদিকে চোখ বুলিয়েও কাঙ্খিত মানুষটিকে না পেয়ে একরাশ বিষণ্নতা যেন ভর করলোসূচনা_পর্ব মুখশ্রীতে। বন্ধুদের মন রক্ষার্থে এক প্রকার বাধ্য হয়েই ঘুরতে গেলো। কিন্তু মন যে তারিনের কাছে যাবার জন্য আকুল হয়ে আছে। কিন্তু ঘুরতে এসে এমন কিছুর সম্মুখীন হবে কখনোই ভাবতে পারেনি সোহান।
– ‘ছাড়ুন আমায়।’
– ‘যদি না ছাড়ি?’
– ‘একটি অপরিচিত মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এভাবে নিয়ে আসতে আপনার আত্মসম্মানে বাঁধছে না?’
– ‘অপরিচিত? হ্যাঁ অনেক বদলে গেছো তুমি। আজ সত্যিই তোমাকে অপরিচিত লাগে।’
– ‘আমায় যেতে দিন। রায়হান আশেপাশেই রয়েছে। যেকোন মুহূর্তে এখানে চলে আসতে পারে!’
– ‘বাহ্! মিস্ তারিন আজকাল ভয়ও পায়!’
– ‘তারিন কাউকেই ভয় পায় না। আমি চাইনা রায়হানের আমার সম্পর্কে কোন ভুল ধারণা কিংবা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হোক।’
– ‘এত ভালোবাসো রায়হানকে!’
– ‘প্রচুর! এতটাই যে জান পর্যন্ত দিতে রাজি।’
– ‘আর তোমার প্রথম ভালোবাসা? এত সহজেই ভুলে গেলে আমায়?’
তারিন প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তাকে। মুখে একরাশ ঘৃণা জড়ো করে বললো,
– ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো তোমায় ভালোবাসা।’
দ্রুত গতিতে সেখান থেকে প্রস্থান নিলো তারিন। সোহান একদৃষ্টে তারিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা চোখে পড়ে ঝাপসা করে দিলো দৃষ্টি। এক হাতে চোখ মুছে আবারো সেদিকেই তাকিয়ে থাকে সোহান। পাহাড়ি এলাকা তাই খুব একটা লোক সমাগম নেই। এতবছর পর তারিনকে দেখতে পেয়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। অন্য কারো বাহুডোরে তারিনকে দেখতে পেয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলো যেন। তারিনের অবহেলা সবচেয়ে বেশি পোড়াচ্ছে তাকে। তারিন কী করে ভুলতে পারলো তাকে? পাঁচ বছর কী সবকিছু এতটাই বদলে গিয়েছে?
সোহান এবং তারিনকে অনেকক্ষণ ধরেই দূর থেকে দেখছিলো রায়হান। সোহানের এভাবে তারিনকে জোর করে নিয়ে আসা এবং তবুও তারিনের সোহানকে কিছু না বলতে দেখে ভীষণ রাগ উঠছে তার। মনে মনে অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। ‘তারিন শুধু আমার! আমি তারিনকে কারো হতে দেবো না।’ বেশ রাগান্বিত কন্ঠে কথাগুলো বলে সেখান থেকে প্রস্থান নিলো রায়হান।
হোটেলে ফিরে বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে তারিন। এত বছর ধরে ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নেবার পর ভাগ্য পুনরায় তাকে তার ভালোবাসার সামনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু তারিন চেষ্টা করেও তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারলো না। একরাশ অভিমান বাঁধ সাধলো তার ভালোবাসার সামনে। তারিন নিজেও জানেনা সে কী করে সোহানকে কথাগুলো বলে এসেছে। অভিমান এবং ঘৃণা আজ তাকে এমন এক তারিনে পরিণত করেছে যে তারিন ইচ্ছে করলেও আর কখনো নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে পারবে না।
কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তারিন নিজেও জানেনা। অধরা, অপ্সরারা এখনো ফিরেনি। বৃষ্টিতে ভেজার ফলে জ্বরও উঠেছে। জ্বরের ঘোরে কেঁপে কেঁপে মাকে ডাকতে থাকে তারিন। এই সময়ে মাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো তার।
চোখ মেলার পর একটি অন্ধকার ঘরে নিজেকে এভাবে বন্দিদশায় আবিষ্কার করবে তা ভাবতে পারেনি সোহান। বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর নিজেকে মুক্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কোন লাভ হলো না। নিজেকে দড়ির শক্ত বাঁধন থেকে মুক্ত করার পূর্বেই সেখানে কারো আগমন ঘটে। বিদঘুটে হাসি দিয়ে সে বললো,
– ‘কেমন আছিস সোহান?’
– ‘রায়হান তুমি?’
– ‘যাক চিনেছিস তাহলে।’
– ‘আমাকে এভাবে বেঁধে রাখার কারণ কি জানতে পারি?’
– ‘কারণ তেমন কিছু না। পথ থেকে কাঁটা সরাতে চেয়েছি কেবল।’
– ‘মানে?’
– ‘তোকে সতর্ক করতে এসেছি। নিজের পথে আর কোনো বাঁধা রাখতে চাইনা আমি। আজকের পর আর কখনো যেন তোকে তারিনের ধারে কাছে না দেখি।’
– ‘তোমার হুমকিতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি কখনোই তারিনকে ছেড়ে যাবোনা। বিশেষ করে তোমার মতো দুমুখো মানুষের কাছে তো কখনোই না।’
– ‘তবে তোকেই পথ থেকে সরতে হবে এখন।’
– ‘পারলে সরিয়ে দেখাও।’
রায়হান খানিক হাসলো। সে পূর্বেই জানতো সোহান তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। সোহানের সেই নির্ভীক, স্পষ্টভাষী স্বভাব বরাবরই ছিলো। নিরবতা কাটিয়ে রায়হান বলে উঠলো।
– ‘তোকে তো পথ থেকে সরাবোই। তবে এখন না। আমার আর তারিনের বিয়ে অবদিই তোর হায়াত আছে। ততদিন পর্যন্ত যত স্বপ্ন দেখার দেখে নে। আমি আজ আসি। তারিনের জ্বর, যাই তারিনকে একটু দেখে আসি।’
রায়হান সেখান থেকে প্রস্থান নিলো। সোহান মুচকি হেসে বললো,
– ‘তুমি আমার কিছুই করতে পারবেনা রায়হান। আমার ভালোবাসার জোরই আমাকে বার বার বাঁচিয়ে দেবে।’
সকলের অগোচরেই হাঁটতে বেরিয়েছে তারিন। অধরা কিংবা অন্যকেউ তাকে দেখলে কখনোই একা বাহিরে যেতে দিতো না। ঘরে একা বসে বসে তারিন প্রচুর বোর হচ্ছিল। তাই সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে এলো বাহিরে। পাহাড়ের পরিবেশ। বেশ ভালোই লাগছিলো তার। আচ্ছা সোহান কোথায়? কালকের পর আর একবারো দেখা করতে আসেনি। হঠাৎ সোহানের কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে যায় তারিনের। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরতে যাবে তার আগেই ঘটে বিপত্তি। মাথা ঘুরে চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। ইচ্ছে শর্তেও চোখ খুলা রাখতে পারছিলো না তারিন। চারদিকে সব ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। পাশেই অনেক বড় খাদ। একবার সেখানে পড়লে বেঁচে ফিরবে কিনা সন্দেহ। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে এলো।
ভাগ্য ভালো রায়হান সময়মতো এসে তারিনকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো। নয়তো আজ অনেক বড় বিপদ হতে পারত। ডাক্তারকে পুনরায় ডাকা হলো। বারণ করার পরেও এভাবে বাহিরে যাওয়াটা তারিনের মোটেও উচিত হয়নি। জ্বর এবং শরীর দুর্বল থাকায় এমনটা হয়েছে। ডাক্তারকে বিদায় জানিয়ে রায়হান তারিনকে বুঝাতে থাকে। এভাবে কাউকে না জানিয়ে যেন আর কখনো কোথাও না যায়। অন্তত যেন তাকে জানিয়ে যায়। ঘুরতে এসেও ঘরে বসে থাকাটা খুবি বিরক্তিকর। তবুও তারিনের নিজের খেয়াল রাখা উচিত। খাবার খেয়ে তারিন পুনরায় ঘুমিয়ে পড়লো।
– ‘লোহার শক্ত শিকল দিয়েও আমায় আটকে রাখতে পারতেনা, এতো সামান্য দড়ির বাঁধন মাত্র!’
চিরকুটটি পড়ে প্রচন্ড রেগে যায় রায়হান। সোহান তার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। সাথে একটি চিরকুটও ফেলে রেখে গেছে। তবে রায়হানের রাগের চেয়ে ভয় হচ্ছে বেশি। সোহান যদি তারিনকে তার থেকে কেড়ে নেয়? পাঁচ বছর ধরে গড়ে তোলা স্বপ্নকে হোহান এক নিমেষেই ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে তা কিছুতেই হতে দেবে না রায়হান। প্রথমে ভেবেছিলো সোহানকে সে বিয়ে অবদি এখানেই আটকে রাখবে। কিন্তু নাহ্ এবার সোহানকে পথ থেকে সরাতেই হচ্ছে! ‘নিজের মৃত্যু তুই নিজেই ডেকে আনলি সোহান! এবার আর তোর নিস্তার নেই।’
– ‘কেউ কী করে কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে। বিদেশে আসার পর সে একবারো তোর সাথে কথা বলেনি। তুই একের পর এক নম্বর বদল করে তাকে কল করে গেছিস আর সে তোকে বার বার ব্লক করে গেছে! তবুও তোর ভালোবাসা একটুও কমেনি।’
– ‘তারিন এমন নয়, মিয়াজ। তারিন আমাকে প্রচুর ভালোবাসে। কিন্তু বর্তমানে সে আমার উপর অভিমান করে আছে। আর সেই অভিমানের পাহাড় কয়েকবছরে বিস্তর আকার ধারণ করেছে। আমাকেই সেই অভিমান ভাঙ্গাতে হবে। তখন দেখবি তারিন আমায় আগের মতোই ভালোবাসবে।’
– ‘এত অপমানের পরেও তুই আজো তাকে ভালোবাসিস!’
– ‘সত্যিকারের ভালোবাসার সমাপ্তি হয়না মিয়াজ। আমি তারিনকে সত্যিকারের ভালোবেসেছি। হাজার অবজ্ঞা করলেও আমার হৃদমাঝারে সর্বদা তারিনই থাকবে। আজ শেষবারের মতোন আমি তারিনের কাছে গিয়ে নিজের ভালোবাসার কথা জানাবো। আজকের পরও যদি তারিন আমায় ফিরিয়ে দেয় তবে আমি আর কখনো তারিনের সামনে এসে দাঁড়াবো না।’
বন্ধু মিয়াজকে বিদায় জানিয়ে সোহান বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু মাঝপথে রায়হানের সাথে দেখা হয়। রায়হানের সাথে তার দলের সদস্যরাও রয়েছে। তাদের মুখাবয়বে স্পষ্ট রাগ প্রকাশ পাচ্ছে। যেন কাউকে অনেকক্ষণ ধরেই খুঁজে চলেছে। সোহানকে দেখে তার দিকেই তারা এগিয়ে আসতে থাকে। সেদিনের পর থেকে প্রতিনিয়ত সোহানকে মারার সুযোগ খুঁজছে রায়হান। আজ যেন সেই কাঙ্খিত সুযোগের দেখা মিলল। এখন চারপাশে তেমন কোন লোকসমাগম নেই। দল পল নিয়ে নির্বিঘ্নে সোহানকে শেষ করার উত্তম সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করবে না রায়হান। তলোয়ারের সাহায্যে সোহানকে আঘাত করার পূর্বেই একটি তরুণীর হাত তার লক্ষ্যে বাঁধ সাধে। রায়হান অগ্নিদৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকায়। তার কাজে বাঁধা দিয়ে মেয়েটি যে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছে তা তার অগ্নিদৃষ্টিতেই প্রকাশ পাচ্ছে।
চলবে…
#হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
#সূচনা_পর্ব
#তাসনূমা_ফারেহীন