#হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
#তাসনূমা_ফারেহীন
#অষ্টম_পর্ব
ভোর হতেই তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দিতে দেখে সোহান বেশ অবাক হলো।
সেখানকার সংশ্লিষ্ট লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলো, অপ্সরাকে অপহরণ করতে চাওয়া অপহরণকারী দলের প্রত্যেকেই নাকি ধরা পড়েছে। এবং তারা তাদের দোষও স্বীকার করেছে। তারা এটাও স্বীকার করেছে সোহান সম্পূর্ণ নির্দোষ।
সবকিছু সোহানের নিকট স্বপ্নের মতো বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। বাহিরে মিয়াজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সোহান অবাক হলেও মিয়াজকে কিছু প্রশ্ন করতে নিলে সোহান কিছু বলার আগেই মিয়াজ বললো,
– ‘আমি জানি তুই কী বলতে চাইছিস। কিন্তু আমি এসবেই কিছুই করিনি। আমাকেও এখানকার কতৃপক্ষ ডেকে এনেছে তোকে নিয়ে যাবার জন্যে। আমিও নিজেও বুঝতে পারছিনা এখানে কী হচ্ছে।’
খানিক বাদেই অপ্সরাকে দৌড়ে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে সোহানের অবাকের মাত্রা যেন আরো বেড়ে গেলো।
– ‘আরে অপ্সরা, তুমি এখানে!’
অপ্সরা বললো,
– ‘হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। তোমাকে ওরা দুষ্টলোক ভেবে এখানে বন্দি করে রেখেছিলো তাইনা?’
সোহান মুচকি হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি এখন সম্পূর্ণ মুক্ত।’
– ‘আমি গতকাল আন্টিকে বলেছি। যে তুমি ঐ পঁচালোকগুলোর মতো নও। তাইতো আন্টি আমাকে এখানে তোমার কাছে নিয়ে এলো।’
ওদের মাঝে আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথাবার্তা চললো। তারিন আড়ালেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সোহানের সামনে দাঁড়ানোর সাহস করতে পারছিলো না। সোহান তা বুঝতে পারে। দূর থেকেই তারিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ‘দূরে লুকিয়ে থাকার কোন দরকার নেই। আমি কারো উপর রাগ করেও নেই। তাই অনুশোচনায় করারও কোন প্রয়োজন নেই।’
তারিন আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। তার ভুলের জন্য তারিন বেশ লজ্জিত। অপ্সরার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর তারিন বললো,
– ‘অপ্সরা, চলো। অনেকটা দূর যেতে হবে আমাদের। এমনিতেই আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
অপ্সরা সোহানকে বিদায় জানালো। অপ্সরাকে নিয়ে তারিন সামনে আগাতেই মিয়াজ বললো,
– ‘তোর জেদ জিতে গিয়েছে। তারিন নিজে এসে তোকে ছাড়িয়ে দিয়ে গেছে। যদিও সে একবারের জন্যেও তোর দিকে তাকায় নি। তাকালে বুঝতো পারতো এই কয়েকদিনে ওরা তোর কী হাল করেছে। এবার, যাওয়া যাক?’
সোহান রহস্যময়ী মুচকি হেসে বললো,
– ‘অবশ্যই। যত দ্রুত সম্ভব আমি সেখানে যেতে চাই।’
সোহানকে মুচকি হাসতে দেখে মিয়াজও হাসলো। সোহান দ্রুত কদমে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।
বাড়ি ফিরে চারপাশের পরিবেশের পরিবর্তন দেখে বেশ অবাক হলো। পাশেই একজন লোককে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, তারিনদের পাশের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। কিন্তু আগের ভাড়াটিয়াদের কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারে কোন অজ্ঞাত কারণে তারা আজ সকালেই অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অথচ গতকালই ওদের সাথে তারিনের কথা হয়েছিলো, কই তখন তো তারা তাকে এই সম্পর্কে কিছু বলেনি!
তারিন উক্ত বিষয়ে আর মাথা ঘামালো না। এমনিতেও তার অনেক কাজ বাকি রয়েছে। নার্স না থাকায় অধরার দেখাশুনোও তাকেই করতে হচ্ছে। কয়েকদিনে ব্যবসার কাজেও মন দিতে পারেনি। তারিন কী কী করবে সবকিছু ভেবে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো।
অপ্সরা বাহিরে খেলতে গেলো। তারিন এদিকের সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। অধরার এখন অনেকটাই সুস্থ। শুধু কথা বলতে পারছেনা। অধরার অস্থিরতা দেখে তারিন দূর থেকে চোখের জল ফেললো। অধরার কষ্ট দেখে তারিনের নিজেরো বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু তারিপ অধরার সামনে তা প্রকাশ করলো না। তারিন জানে , এ মূহুর্তে তাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখে অধরা নিজেও আরো মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে।
সোহান এবং মিয়াজ বাড়ি এসে পৌঁছে গিয়েছে। নতুন বাড়িতে শিফট্ হওয়ায় গোছানোতে কিছুটা সময় লাগছে। সোহান সবদিক তদারকি করতে থাকে। এমন সময় দূর থেকে অপ্সরা ছুটে এলো সোহানের কাছে। পুলকিত নয়নে বললো, – ‘আরে বন্ধু তুমি? আমার সাথে খেলতে এসেছো বুঝি!’
সোহান অপ্সরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর আদুরে গলায় বললো,
– ‘হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে খেলা করতেই এখানে চলে এসেছি।’
সোহানের কথায় অপ্সরা উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো, – ‘তাহলে তো বেশ মজা হবে! আমি এবং বন্ধু মিলে আন্টির সাথে লুকোচুরি খেলবো।’
সোহান হেসে বললো, – ‘আচ্ছা বেশ। তোমার যা খেলতে ইচ্ছে হবে সেটাই খেলবো।’
সোহানের নানা কথায় অপ্সরা কখনো হেসে কুটিকুটি হয়, কখনো বা ভাবুক ভঙ্গিতে নানা রকম প্রশ্ন করে সোহানকে। সোহান একদৃষ্টিতে অপ্সরার মায়াভরা নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে তা দেখে! শিশুটির মুখে যেন এক প্রকার মায়া কাজ করে। খুব পরিচিত এক আপনজনকে যেন অপ্সরার মাঝে খুঁজে পায়। স্বল্প সময়ের মাঝেই অপ্সরাও সোহানের সাথে অনেক বন্ধুসুলভ হয়ে গিয়েছে।
হাতের কাজগুলো সেরে নিয়ে তারিন অধরার ঘরে গেলো। অধরা আগেই ঘুম থেকে উঠেছে, চোখ বুঝে শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম করছে এখন। তারিন নিঃশব্দে অধরার ঘরে প্রবেশ করলো। অধরার কপালে আলতো করে হাত বুলাতেই অধরা চোখ মেলে তাকালো। তারিনকে দেখতে মেয়ে মুখে কিঞ্চিত হাসির আভাস ফুটে উঠে অধরার ঠোঁটে।
তারিনের না-করা সত্ত্বেও অধরা জোর করে উঠে বসতে চাইলো। এভাবে সারাদিন শুয়ে থেকে অধরা প্রচুর বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। তারিন অধরাকে উঠে বসতে সাহায্য।
অধরা বালিশে হেলান দিয়ে বসলো। তারিন মুচকি হেসে বললো,
– ‘কেমন লাগছে এখন?’
অধরা ইশারায় ইতিবাচক মাথা নাড়লো। তারিন বললো,
– ‘বিরক্ত লাগলেও কয়েকটা দিন তোকে এভাবে শুয়েই কাটাতে হবে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ, সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে তোকে। শরীর প্রচুর দুর্বল হয়ে গেছে তোর। কোনপ্রকার পরিশ্রম করা চলবে না। আর দুঃশ্চিন্তা একদমি করা যাবে না। অপ্সরাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি ওকে চোখে চোখে রাখবো।’
অপ্সরার কথা মনে পড়তেই অধরার মুখের মুচকি হাসি যেন নিমেষেই মিলিয়ে গেলো। এক থাশ মলিনতা এবং ভয় এসে ভর করলো তার মুখশ্রীতে। যেন অধরা প্রাণপণে চেষ্টা করছে তারিনকে কিছু বলার। কিন্তু তার অপারগতা তার অসহায়ত্বের জানান দিচ্ছে।
অধরাকে অস্থির হতে দেখে তারিন তাকে শান্ত করতে বললো,
– ‘শান্ত হ অধরা। আমি জানি তোর প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। নিজের মনোভাব কারো কাছে প্রকার করতে না পারায় তুই প্রচুর কষ্টে আছিস। তবে চিন্তা করিস না। ডাক্তার তোকে সুস্থ করে তোলার সম্পূর্ণ চেষ্টা করছে।’
অধরা হতাশ ভঙ্গিতে একদৃষ্টে তারিনের পানে তাকিয়ে থাকে। তারিন অধরাকে খাইয়ে দিলো। তারপর ওষুধ খাইয়ে অধরাকে একটু ঘুমিয়ে নিতে বললো। শরীরের দুর্বলতা এবং ওষুধের প্রভাবে অধরা ঘুমিয়ে পড়লো।
তারিন অধরার ঘর থেকে বেরোতে যাবে তখনি তারিনের একটা কথা মনে পড়লো। নানা রকম দন্দ্ব, নানা প্রশ্নের উদ্বেগ ঘটে তার মনে। অধরা শেষবার সেন্সলেস হবার সময় রায়হানের নাম কেন বললো? এটা রায়হানের জন্য কোন বিপদের আভাস নয়তো? অধরা কি তবে সেই বিফদ সম্পর্কেই তারিনকে সতর্ক করতে চেয়েছিলো?
তারিন পেছন ফিরে অধরাকে কিছু বলতে যাবে তখনি দেখতে পেলো অধরা ঘুমিয়ে রয়েছে। তারিন মনে মনে বললো,
– ‘অধরাকে কী একবার ডাকবো? জানতে চাইবো অধরা কী বলতে চেয়েছিলো? রায়হানেথ কী সামনে কোন বড় বীপদ অপেক্ষা করছে? না…থাক! অধরাকে এখন ঘুম থেকে জাগানো ঠিক হবে না। ডাক্তার বলেছেন, অধরার এখন প্রচুর বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। সি নিড্ রেস্ট্। আমি বরং পরে অধরার থেকে জেনে নেবো।’
অধরার কাছে গিয়ে তারিন বললো,
– ‘অনেক রহস্য, অনেক সত্য লুকিয়ে রয়েছে তোর পেছনে। কিন্তু আফসোস! তুই চাইলেও আমায় তা বলতে পারছিস না। জানিনা, আমাদের এই লড়াই কবে শেষ হবে। জীবনযুদ্ধে লড়তে লড়তে আমি আজ সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে গেছি।’
তারিন নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অজান্তেই এক ফোঁটা চোখের জল তার গাল গড়িয়ে বেয়ে পড়লো। তারিন তা মুছে নিলো। অধরার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই তারিনের হঠাৎ অপ্সরার কথা খেয়াল হলো। অনেকক্ষণ যাবদ অপ্সরা বাহিরে রয়েছে। কিন্তু অপ্সরা তো এতক্ষণ বাহিরে থাকে না। আন্টিকে খুঁজতে ঠিকি গরে চলে আসে। কিন্তু অপ্সরা এখনো কেন ফিরছে না? অপ্সরার কোন বিপদ হলো না তো?
অজানা আশঙ্কায় তারিনের বুক কেঁপে উঠে। এক ছুটে চলে যায় বাড়ির বাহিরে। চারদিকে অস্থির হয়ে অপ্সরাকে খুঁজতে থাকে। তখনি তারিন সেখানে কারো কন্ঠস্বর শুনতে পায়। সাথে সাথেই সেখানে অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে তারিন।
চলবে…