#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০২ |
অবশেষে বিয়ে সম্পন্ন হলো। নাফিসা রথিকে বসিয়ে দিয়ে ভাবীর সাথে দেখা করতে চলে গেলো। এদিকে রথি নাফিসার ফোন দেখছে। কিন্তু দশ মিনিটের মতো হয়ে গেলো নাফিসা আসেনি। রথি ফোন রেখে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো মানুষ মোটামুটি এদিকে কমে গেছে। তাই রথি নাফিসাকে খুঁজতে যেতেই পেছন থেকে কারো ডাক শুনতে পেলো।
-‘এই মেয়ে শুনো!’
নাশিদের ডাক রথির কান অবধি গেলো না। বিয়েবাড়ি বলে কথা, অন্যকাউকেও ডাকতে পারে। সে ভেবে রথি এদিক সেদিক নাফিসাকে খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতে লাগলো। নাশিদ বুঝলো রথি তার ডাক শুনতে পারেনি। তাই নাশিদ আরেকবার হাক ছাড়লো। এবার রথি কৌতুহলবশত পিছে ফিরে তাকালো এবং নাশিদকে দেখে কিছুটা চমকে উঠলো। নাশিদ রথিকে তার দিকে ফিরলে নাশিদ রথির দিকে এগোতে লাগলো। নাশিদ যতোই এগোচ্ছে ততোই আমার ভেতরের ধুকধুকানি বেড়েই চলেছে। আমার পা বারংবার আমায় বলছে,”চল এখান থেকে, চল চল চল।”
কিন্তু তাতেও যেন নড়তে পারছি না। পা দুটি বরফের ন্যায় জমে আছে। অবশেষে উনি আমারও হার্টবিট তীব্রতর ভাবে বাড়িয়েই সামনে দাঁড়ালেন এবং বিনা-বাক্যে বলে উঠলো,
-‘কে তুমি?’
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেমন অস্বস্তি ফিল হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঁপা গলায় বলে উঠলাম,
-‘র.রথি।’
-‘রথি? তা কোন নদীর রথি শুনি? কী কী বহন করলে আজ পর্যন্ত?’
ওনার কথায় আমি তাজ্জব বনে গেলাম। হতভম্ব দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকে বললাম,
-‘জ্বী?’
নাশিদ আমার কথার কোনরকম উত্তর না দিয়ে বলে,
-‘নাফিসার সাথে তোমার কী?’
তখনই নাফিসা চলে আসলো। নাফিসা পেছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে বললো,
-‘আমি রথির বেস্টি। তোকে বলেছিলাম না আমার বেস্টুর কথা? এই রথি-ই তো সেই!’
আমি তখনো চুপ। নাশিদ রথির পা থেকে মাথা অবধি দেখে চলে গেলো, কোন উত্তর না দিয়েই। ওনার হুট করে চলে যাওয়া দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। অতঃপর নাফিসার উদ্দেশ্যে বললাম,
-‘তোর ভাই এমন গোমড়ামুখো কেন? কিছু না বলেই চলে গেলো?’
-‘পুলিশ মানুষ এমনই হয় বোন। যাইহোক বাদ দে। এখন চল আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। এখনই ভাবীর বিদায় পর্ব শুরু হবে।’
-‘ও। তাহলে আমি আমার বাসায় চলে যাই? এখান থেকে তো বাসা কাছেই!’
-‘একদম না। আন্টি আমায় সাফ সাফ বলে দিয়েছে, তোকে যেন একা না ছাড়ি!’
-‘দেখ, তুই হচ্ছিস বরের বোন। আর তোর কিছু দায়িত্বও আছে, তুই সেসব না করে আমার পিছে পরে আছিস কেন বল তো? আমার কথা চিন্তা করিস না আমি যেতে পারবো!’
-‘নো ওয়ে! এই রাতে তোকে ছাড়বোই না। ঠিক আছে আমার দায়িত্ব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস তাইতো? ফাইন, আমি তোর সঙ্গে যাবো না তবে কেউ না কেউ তোর সাথে যাবেই!’
-‘ঠিক আছে আমি রাজি!’
হাসিমুখেই বললাম। সহজে রাজি হয়েছি কারণ, আমার সঙ্গে যেই যাক না কেন তাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি কিন্তু নাফিসাকে তো আর বুঝাতে পারবো না। তাই আমি এই পদ্ধতির অবলম্বন করছি। কিন্তু নাফিসা আমার সব আশায় পানি ঢেলে দিয়ে নাশিদের সাথে বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। আমার ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যাই। নাফিসার দিকে আসহায় চাহনি দিতেই দেখলাম সে মুখ চেপে হাসছে। নাফিসা আমার কানে ফিসফিস করে বললো,
-‘বান্ধুবি, তুমি যদি চলো ডালে ডালে তাহলে আমিও চলি পাতায় পাতায়। তুই কী ভেবেছিস আমি তোর ফন্দি বুঝি না? এখন ভাইরে গিয়ে বল, দেখি তোর কতো সাহস!’
আমি আর কী বলবো, চুপ করেই রইলাম। পুলিশম্যান আঙ্কেলের থেকে অনুমতি পেয়ে আমাদের দিকেই এলো। আবারও তার সাথে আমার দেখা। কীভাবে কী করবো বুঝতে পারছি না। তবে চুপ থাকাটাই স্রেয় মনে করলাম। নাফিসা আমাকে বিদায় দিতেই উনি সামনে যেতে লাগলেন আর আমি ওনার পিছে পিছে। আমাদের পথ আটকে অনেকেই এসে ওনার সাথে কথা বলেছে, উনিও তাদের সঙ্গে হেসেই ভাব-বিনিময় করেছে। আমার একটি বিষয় অদ্ভুত লাগলো যে উনি কোনকিছুকেই বিরক্তি হিসেবে নেননি। এতক্ষণে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন কিন্তু কই, তার মুখে তো কোনরকম বিরক্তির ছাপ দেখিনি। আমি হলে তো কখনই বিরক্ত হয়ে যেতাম। যাক এটা ভালো গুণ।
আমার ভাবনার মাঝে উনি বলে উঠলেন,
-‘তোমার ভাবনা শেষ হলে কী গাড়িতে উঠবে, মিস রথি?’
আমি কিছুটা নড়েচড়ে জলদি পেছন সিটের দরজা খুলতে গেলাম কিন্তু উনি আমায় থামিয়ে বললো,
-‘সামনে বসো।’
আমি চোখ বড় বড় করে ওনার দিকে তাকালাম। সামনে বসবো মানে কী? তখনই মনে পরলো, আমি তো কোন শেহজাদী নই আর উনিও কোনো ড্রাইভার নয়। ভাবতেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে চটজলদি সামনের সিটে বসে পরলাম। কেন যেন অনেক অস্বস্তি লাগছে, বড্ড অস্বস্তি লাগছে। উনিও কোনরকম কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসলেন এবং আমার থেকে বাড়ির ঠিকানা নিয়ে ড্রাইভিং শুরু করলেন। আমি চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। এও ভাবছি উনি তো পুলিশ, আমি যে সিটবেল্ট বাধিনি সেটা কী উনি খেয়াল করেছেন? কোণা চোখে নাশিদের দিকে তাকালাম। ওনার এদিকে কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ নেই ইভেন একবারের জন্যে তাকানোরও প্রয়োজনবোধ করেনি। সেজন্যই হয়তো খেয়াল করেননি। যাক আমি কিছুটা শান্তি পেলাম। এই সিটবেল্ট বাঁধলে আমার কেমন দম আটকে আসে। একবার নাফিসার সাথে লং ড্রাইভে গিয়েছিলাম। নাফিসা ড্রাইভ করছিলো আর আমি তার পাশেই বসেছিলাম। সেদিন সিটবেল্ট বাঁধার পর কতো যে ঝামেলা লেগেছিলো কী বলবো। আমি জানি না আমার ক্ষেত্রেই কেন এমন হয়?
মিনিটখানেক পার হয়ে গেলো। দুজনেই নিশ্চুপ। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম জীবন চাচার টং। এর মানে বাসায় প্রায় পৌঁছে গেছি। হঠাৎ ভাবীর কথা মনে হতেই ওনার উদ্দেশ্যে অস্ফুট সুরে বলে উঠলাম,
-‘গাড়ি থামান! জলদি!’
আমার আচমকা কথায় উনিও যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন যার ফলে উনি কষে ব্রেক কষলেন। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু সুরে বললেন,
-‘তোমার বাসা তো এটা নয়, তাহলে থামাতে বললে কেন?’
আমি ওনার কথার উত্তর না দিয়ে ডোর খুলে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললাম,
-‘এখান থেকে আমি নিজেই যেতে পারবো। এছাড়া এখান থেকে বাসা এক মিনিটের রাস্তা। ওইতো আমার বাসা দেখা যাচ্ছে।’
নাশিদ স্টেয়ারে হাত রেখে রথির ইশারা করা বাড়িটার দিকে তাকালো। বাড়িটা ৩ তলা বিশিষ্ট। এবার নাশিদের মনে প্রশ্ন আসলো, ওরা তো এতো গরিবও নয় তাহলে এসব ছেঁড়া শাড়ি পরে রথি বিয়েতে কেন আসলো? নাশিদের প্রশ্ন নাশিদের অন্তর্গহ্বরেই থেকে গেলো। রথি একটি ছোট্ট “ধন্যবাদ” দিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রথি বাসার গেট দিয়ে ঢুকা অবধি নাশিদ গাড়িতেই বসে রইলো। যখন রথি ভেতরে ঢুকলো তখনই নাশিদ গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলো। পুলিশ হিসেবে তার রেসপন্সিবিলিটি সম্পর্কে সে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করে। রাত করে কোন মেয়ে বিপদে পরলে অথবা তার সেফলি বাড়ি পৌঁছে দেয়াও একটা দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব থেকেই নাশিদ রথির কেয়ার করেছে।
রথি বাসায় ঢুকতেই ৩তলা বিশিষ্ট অট্টালিকায় না ঢুকে তার পেছনের ছোটখাটো টিনের ঘরের দিকে চলে গেলো। সেটাতেই সে এবং তার মা থাকে। আর তিন তলার বাড়িটাতে পুরোটা জুড়েই রথির বড় ভাই সাইফ এবং তার ভাবী থাকে। রথি বাসায় ঢুকতেই তার মা বলে উঠলো,
-‘তুই কী পাগল হ্যাঁ? ফোন ফেলে কে বাইরে যায় হ্যাঁ? আমার চিন্তা হয় না?’
তখনই সাইফের বাড়ির কাজের মেয়ে আমিনা এসে বললো,
-‘আপা, আপনারে ভাবী ডাকতাসে!’
~চলবে।
গ্রুপঃ লাবিবা’স স্টোরি ফিকশন?
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।