হৃদপিন্ড পর্ব ৩০

0
487

#হৃদপিন্ড
#জান্নাতুল নাঈমা
#পর্ব-৩০

কনকনে শীতের মৌসুমে রাতে পিকনিক খাওয়ার মজাই আলাদা। তন্নি,আর সুপ্তির আবদারে খন্দকার বাড়িতে ছোট করে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে।
এগারোটার দিকে সুপ্তি তাঁর দাদীর কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো। খাওয়া -দাওয়া শেষে ছাদের মাঝখানে কাঠ দিয়ে আগুন তৈরী করে সকলেই চারদিকে বসে পড়লো।

— তোরা গল্প কর আমি সুপ্তি কে শুইয়িয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ি গিয়ে। তুমিও চলো ওরা গল্পগুজব করুক, ছেলে মেয়ের মাঝে না থাকাই ভালো এখন। তন্নি তুই আর বেশী রাত জাগিস না
কিন্তু আধঘন্টার মাঝেই নিচে চলে যাবি তোরাও বেশী রাত জাগিস না।

সায়রী বললো, — মা আপনি আমায় দিন আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে। আপনারা গিয়ে শুয়ে পড়ুন।

— আহ বৌ মা আমার নাতনীটা কে কি আমার কাছে একদিন রাখতে ইচ্ছে হতে পারেনা??
তুমি সারাদিন অনেক খাটাখাটনি করেছো এখন একটু রেষ্ট করো।

বাবা,মা চলে যেতেই তন্নি বললো,
— আমারো খুব ঘুম পাচ্ছে তোমরা থাকো আমি যাই।
হাই তুলতে তুলতে তন্নি চলে গেলো। সারাদিন আজ অভ্রকে টাইম দিতে পারেনি সে তাই দ্রুত রুমে গিয়েই ফোন করলো অভ্রকে।

চাদর মুড়ি দিয়ে আগুনের এপারে বসে আছে সায়রী। দিহান ওপারে দুজনই চুপচাপ।
চারদিকের নিস্তব্ধতা বড্ড বাজে লাগলো দিহানের।
তাঁর ওপর বুড়িটাও বেশ চুপচাপ দুপুর থেকে।
নিরবতা ভেঙে বলেই ফেললো — কিরে বুড়ি কাজের প্রেশার কি বেশী পড়ে গেছে যে বোবা হয়ে গেছিস।

সায়রী এক পলক চেয়ে আবারো দৃষ্টি আগুনের দিকে স্থির করলো।
যা দেখে দিহান হকচকিয়ে গেলো।

— কি ব্যাপার বুড়ি বলাতেও কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
হয়েছে টা কি??

সায়রী দুপুড়ে তাহিয়ার বলা কথা গুলো ভাবছে।
মায়ের মতো শাশুড়ী তাঁর কাছে অনেক বড়সড় একটা আবদার করে ফেলেছে। তা নিয়েই মুড অফ তাঁর ।

— কিরে কথা বলবি নাকে আগুনের মাঝে মুখটা ঠেশে ধরবো কোন টা।

— ধর না,,,নিষেধ তো করিনি। যে আগুন বুকে জ্বলছে, যে আগুনে মন পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে গেছে সেই আগুনে এই দেহ জ্বালিয়ে দিতেও আমি প্রস্তুত।

দিহান রেগে গেলো ভীষণ ভাবে ওঠে গিয়ে সায়রীর পাশে বসলো। হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে হুমকির স্বরে বললো সত্যি করে বল কি হয়েছে নয়তো এই আগুনে সত্যি ঠেশে ধরবো। তারপর আমার মেয়ে মা হারা হবে আমি আরেকটা বিয়ে করে নিবো।
সৎ মা তোর মেয়ে কে কতোটা ভালোবাসবে তা আমি জানি না একদমে কথা গুলো বলেই থামলো দিহান।

সায়রী রাগে, ক্ষোপে দিহানের গলা চিপে একদম নিচে শুইয়িয়ে ফেললো।
— এটাই তো পারবি তোরা, কাপুরুষ বেঈমান।
এইজন্যেই আমি বিয়েটা করতে চাইনি তোদের ছেলে দের আমার চেনা আছে। সায়রীকে ভালো লাগে না তাই না অন্য নারীর স্বাদ গ্রহন করতে ইচ্ছে হয়েছে তাইনা।

দিহান সায়রীর হাতটা শক্ত করে চেপে ছাড়িয়ে নিলো। হাতদুটো নিজের হাতে আবদ্ধ রেখেই বললো,
— মেরে ফেলবি নাকি,বিধবা হওয়ার শখ জাগছে,আমার মেয়ে কে বাবা হারা করবি??
আর অন্য নারীর স্বাদ,,,ঘরনীর স্বাদই গ্রহন করতে পারলমানা আবার পর নারী বেশীই ভেবে ফেলেছিস।

কথাটা শোনা মাএই সায়রী কাঁদতে শুরু করলো,,, দিহান ওভাবে শুয়েই সায়রীকে একহাতে বুকে জরিয়ে নিলো।

— কেনো পাগলামো করছিস সায়ু,,,
এই পৃথিবীতে সবাই ঠকায় না সায়ু।
আমাদের সম্পর্ক টা সবার আগে বন্ধত্বের তারপর স্বামী-স্ত্রী। আর সত্যিকারের বন্ধুত্বের কখনো শেষ নেই। কেনো ভয় পাচ্ছিস দোস্ত প্লিজ এভাবে কাঁদিস না তো ভালো লাগে না।

— তুই জানিস মা কি বলেছে??

— কি,,,

— ওনার নাতী চাই

দিহান হকচকিয়ে গেলো। কাশতে শুরু করলো।
সায়রী চট করে দিহানের ওপর থেকে সরে পিঠে হাত বুলাতে লাগলো।

কাশি থামিয়ে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে দিহান।
সায়রী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
— হাসছিস কেনো? আমি কি তোকে হাসির কথা বলেছি?

— তা নয় তো কি?? তুই তো বুড়ি তুই কি করে নাতি দিবি??
আবারো হাসতে লাগলো দিহান।

সায়রী রেগে ওঠে পড়লো, ছাদের অপর পাশে গিয়ে মনটা খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
দিহান হাসি টা থামিয়ে চুপচাপ গিয়ে দাঁড়ালো সায়রীর পাশে দূর আকাশে ছলছল করা চাদের দিকে চেয়ে এক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো — ভাবিস না সায়ু। মায়ের বয়স হচ্ছে, ছেলের বউ এর কাছে আবদার করে ফেলে এ নিয়ে তুই চিন্তা করিস না তো। নাতী লাগবে না নতনী তো আছেই।
যাক বাদ দে কিছুদিন পর তো ইমনদের বাড়ি বড় অনুষ্ঠান আমরা সকলই যাচ্ছি সুপ্তিও অনেক খুশি হবে বল।

সায়রী বেশ বুঝলো দিহান তাঁর মুড ঠিক করার জন্য প্রসঙ্গ পালটাচ্ছে। রাগ হলো ভীষণ দিহানের দিকে রক্ত লাল চোখে চেয়ে বললো,
–তুই কি শুধুই আমাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছিস দিহান??

— মানে কি বলছিস তুই??

— দয়া নয়তো কি, যদি ভালোবাসা থাকতো অবশ্যই ভালোবাসার মানুষ কে ভালোবাসতে ইচ্ছে করতো ছুঁতে ইচ্ছে হতো আর তুই এতোগুলো দিন ধরে আমার দিকে না ভালো লাগা চোখে তাকিয়েছিস।
আর না সেভাবে স্পর্শ করেছিস। আমি তো ভালোবাসা খুঁজে পাইনি তাহলে তো এটা দয়াই,,,
— “নারী মন বড়ই রহস্যময়ী ”
বাঁকা হাসলো দিহান।
সায়রী অন্যদিক ঘুরে চোখের পানি ফেলছে।

— তোকে আমি ছুঁই না কারন তুই আমাকে ভালোবাসিস না। তুই আমাকে মন থেকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করিস নি।
আর তোর দিকে আমি সেভাবে তাকাই না কারন তোকে দেখলে মায়া টা বেড়ে যাবে । সকল বাধ্যতা ভুলে গিয়ে তোকে একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হবে।
তোর মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে চাই না সায়ু।
কিছু ভালোবাসা নীরব থাকাই শ্রেয়।
“এই পৃথিবীতে ভালোবাসার অনেক ধরন আছে।
ভালোবাসার অনেক সংজ্ঞা আছে।
ভালোবাসা প্রকাশ করার অনেক মাধ্যম রয়েছে।
আবার অনেক অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্পও রয়েছে”।
“আমার ভালোবাসা প্রকাশিত হয়েও অপ্রকাশিত”
“তুই আমার কাছে হিমালয় পর্বতের মতো
আমার জীবনের,মনের অনেক উচ্চ স্তরে তোর বাস”
“যা আমি দূর থেকে দেখতে পারি, যার মুগ্ধতায় দূর থেকে মুগ্ধ হতে পারি। যাকে আমি কল্পনায় অনুভব করতে পারি”
শুধু খুব করে ছুঁয়ে দেখতে পারিনা।
“তুই যে ধরা,ছোঁয়ার বাইরে সায়ু। তোকে ভালোবাসার জন্য তাকাতে হবে না, খুব কাছে গিয়ে ছুঁতে হবে না। এসব ছাড়াও আমি ভালোবাসতে পারি সায়ু” তোকে আমি না আমার হৃদয় ভালোবাসে। তোর স্থান যে এইখানে বলেই বুকের বা পাশে হাত রাখলো।

সায়রী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না।
হামলে পড়লো দিহানের বুকে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। চিৎকার করে বলতে লাগলো, একবার কাছে এসে ভালোবেসে দেখ না,,, তোর এই বুকে একটু জায়গা করে দেনা। আমি যে ভালোবেসে ঠকেছি দিহান আমার যে খুব ভালোবাসা চাই।
যে ভালোবাসার ভীড়ে পূরনো ক্ষতর দাগটা আর চোখে পড়বে না। পূরনো ব্যাথাটা আর অনুভব হবে না।

— সায়ু চুপপ বাবা, মা শুনতে পাবে চুপ কর না।

— তুই আমায় ভালোবাসা দে দিহান ভালোবাসা দে বলেই ফুপাতে লাগলো।

দিহান মৃদু হাসলো দুহাতে আলতো করে দুগালে ধরে মুখ ওঠিয়ে বললো,
— দিবো কিন্তু আজ না, কাল আগে আমাকে শিওর হতে দে তুই যা বলেছিস ঠান্ডা মাথায় মন থেকে।

সায়রী ক্ষেপে গেলো । বুকে কিল, ঘুষি দিতে দিতে বললো,
— তোর কি আমাকে পাগল মনে হচ্ছে পাগল ভাবছিস আমায় ।

দিহান হাসতে হাসতে হাতটা শক্ত করে চেপে বুকে জরিয়ে নিলো সায়রীকে। মাথায় আলতো করে কিস করে বললো,– ভালোবাসি।

সায়রী বুকে মুখ গুঁজে চোখের পানি ফেলতে লাগলো।
ফজরের আজান কানে ভাসতেই ঘুম আলগা হয়ে গেলো মুসকানের। ইমনের উপস্থিতি টের না পেতেই বুকটা ধক করে ওঠলো। চোখ খুলতেই নদীর মুখটা দেখতেই মনে পড়ে গেলো সবটা। সে তাঁর মায়ের আপন বড় বোনের বুকের মাঝে আবদ্ধ রয়েছে। তাঁর আপন জন যার গা থেকে মা মা গন্ধ পাচ্ছে সে। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে ওঠলো। এ বাড়ি এ বাড়ির মানুষ গুলো কেউ তাঁর পর নয় সবাই তাঁর আপন জন। তাঁর মায়ের শেকড় যে এখানেই। এতো দিন জানতো ইমন ছাড়া তাঁর আপন বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই কিন্তু কালকের পর সে জেনে গেছে তাঁর আরো আপন জন রয়েছে তাঁকে কেউ আর অসম্মান, অপমান করবে না এ বাড়ির আর পাঁচ জন মানুষের মতোই তাঁর ও অধিকার রয়েছে এ বাড়ি এ বাড়ির মানুষ গুলোর ওপর। আর এসব সে পেয়েছে শুধু মাএ ইমনের জন্য।
আল্লাহ তায়ালা কে অনেক অনেক শুকরিয়া জানিয়ে ওঠে পড়লো সে।

— কিরে ঘুম আলগা হয়ে গেছে এখুনি। সবে তো পাঁচ টা বাজে।

— আসলে ফুপু আমি এমন সময়ই ওঠি যতো রাতেই ঘুমাই না কেনো আজান দেওয়ার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যায়।

— ফুপু মানে আমি ফুপু আমি ইমনের ফুপু বলে তুই ও ফুপু বলবি?? একদম না মামনি বলে ডাকবি আমায়,,, তুই তো আমার আরেকটা মেয়ে তাহলে ফুপু কেনো বলবি।

মুসকান লজ্জা পেয়ে গেলো। মাথা নিচু করে বললো আচ্ছা ।
নদী মুচকি হাসলো।

— এখুনি ওঠে কি হবে আরেকটু ঘুমিয়ে নে তো।

— আর ঘুমাবো না নামাজ টা পড়ে নেই। তুমি পড়বে না??

— নদী হেসে ফেললো চোখ দুটো চিকচিক করছে তাঁর দুগালে ধরে কপালে চুমু একে বললো আমার লক্ষী মেয়েটা। আচ্ছা আমিও পড়বো।

— আচ্ছা আমি ও ঘরে যাই ওখানে জায়নামাজ আছে তোমাকেও একটা দিয়ে যাই।

— না আমার কাবার্ডেও আছে অনেক পুরোনো সেটাই হবে। তুই গিয়ে পড়ে নে।
,
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনতেই ইমন বিছানা ছেড়ে ওঠে দরজা খুলে দিলো।
মুসকান চুপচাপ রুমে প্রবেশ করলো, ইমন সিটকেরি লাগিয়ে দিয়ে আবারো বিছানায় চলে এলো।
ঘুম ধরেছে ভীষণ সবে চোখ টা বুজেছে অমনি মুসকান এসে বললো,

— শুনুন,,, আজান দিয়েছে চলুন একসাথে নামাজ আদায় করি।

ইমন কপাল কুঁচকে তাকালো। এমনিতেই মাথা গরম আছে ঘুম হয়নি সারারাত তাঁর ওপর সে যা করে না তাই নিয়ে আবারো ঘ্যান ঘ্যান শুরু করছে।

— ঘুমাতে দাও। বার বার এক কথা বলতে ভালো লাগে না। নিজের কাজ নিজে করো।

— এটা মোটেই আমার একার কাজ না।

কড়া গলা কানে বাজতেই ইমন ভ্রু যুগল উঁচিয়ে বড় বড় করে তাকালো শুয়া অবস্থাতেই।

মুসকান এক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
–না মানে আপনি কেনো নামাজ পড়বেন না।
মুসলিম হয়ে নামাজ আদায় করবেন না এটা আমি মেনে নিতে পারি না। আজকে আমি ছাড়বোনা আপনাকে নামাজ পড়তেই হবে।

ইমন শুয়া থেকে ওঠে বসলো। রাগি চোখ, মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— সকাল সকাল আদেশ করতে এসেছো।

মুসকান নিজেকে শক্ত করে নিয়ে বললো,

— আদেশ না অন্যায় এর প্রতিবাদ করছি।
আপনিই তো বলেছেন যে অন্যায় করে আর যে অন্যায় সয় দুজনই সমান অপরাধী।
আর আপনি শুধু অন্যায় না পাপ করছেন।
আর স্ত্রী হিসেবে আমি এটা করতে দিতে পারিনা।

ইমন হকচকিয়ে গেলো। রাগটা খানিক কমে গেলো।
ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বললো,,

— তুমি গিয়ে পড়ে নাও দু’ঘন্টা পড় জাগিয়ে দিও।

— না আপনি নামাজ পড়বেন।
দেখুন আপনার মাঝে দুইটা বদ অভ্যাস আছে।

ইমন বড় বড় করে তাকাতেই মুসকান পিছন ঘুরে দাঁড়ালো। কথাটা বলা মাএই তাঁর হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে।
ইমন কথাটা শুনে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। বিছানা ছেড়ে ওঠতেই মুসকান এক ঢোক গিললো।

গম্ভীর স্বরে বললো, — কি বাজে অভ্যাস আমার??

— আআপনি ছাইপাস খান এটাও পাপ। আপনি নামাজ পড়েন না এটাও পাপ তাই এগুলা বদ অভ্যাস বলেই চোখ বন্ধ করে ফেললো।

ইমন মুসকান কে হেচকা টান দিয়ে নিজের সামনে নিয়ে এলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে চেয়ে বললো,
— লিসেন মুখ টা বেশী চলছে না??
চুপচাপ গিয়ে নিজের কাজ করো।

ইমনের রাগ দেখে মুসকান ইমনকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। বুকে মাথা চেপে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠলো।
ইমন যেনো এবার বাক রুদ্ধ ।
— এই মেয়ের হলোটা কি। ফুপু কি মুসকানকে পালটে পাঠালো?? নাকি ওকে ভূতে পেলো কোনটা??

মুসকান,,, কি হয়েছে? বোকার মতো কাঁদছো কেনো? পাগলামো করছো কেনো?

— আমি আপনাকে ভালোবাসি,,,
খুব ভালোবাসি আমি আপনাকে,,,

ইমন আবারো হকচকিয়ে গেলো।
“তাঁর মুগ্ধময়ী তাঁকে ভালোবাসে সে কথাটা কি সে জানে না নাকি ” এভাবে কেঁদে বলার কি আছে।

— হুম তো??

— আমি আপনার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই।

— হুম নিষেধ করলো কে??

— শুধু এই পৃথিবীতে নয়, মৃত্যুর পরও আমি আপনার সাথে থাকতে চাই। দুনিয়াতে নয় আখিরাতেও আপনাকে চাই।

ইমন নিশ্চুপ হয়ে গেলো। গভীর শ্বাস ছেড়ে নিজেও অনেক শক্ত করে জরিয়ে ধরলো মুসকান কে।
মুসকান ফুঁপাতে ফুঁপাতেই বললো,
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে কোথায় জায়গা দিবেন আমি জানি না, কিন্তু এই টুকু জানি তাঁর আদেশ,উপদেশ মেনে চলবো।
কিন্তু আমি একা না আমার স্বামীকেও তাঁর পথে নিয়ে যেতে চাই।
আল্লাহর রহমতে আমি খাঁটি একজন মানুষ পেয়েছি। যিনি কিনা ভুলেও কখনো একটা মিথ্যা কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেন না। সবসময় সৎ পথে চলেন। সবাইকে বিপদে আপদে সয়াহতা করেন।
তাঁর মাঝে সব গুনই তো রয়েছে শুধু দুটো দোষ
এক নামাজ পড়েনা দুই নেশাপানি খায়।
আর এই দুটো জিনিস যদি আমি পাল্টাতে না পারি তাহলে একসময় যেমন এটা আপনার ক্ষতি করবে ইহকালে পরোকালেও আপনাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।

“শুধু একালে নয় পরকালেও আমি শুধু আপনাকে চাই ”
“প্লিজ আপনি আমার এই আবদারটা রাখুন ”
আপনার কোন প্রকার ক্ষতি যে আমি সহ্য করতে পারবো না।
দাদী বলেছে আপনি উপরওয়ালার ওপর ও অভিমান করেছেন। কিন্তু এটা তো ঠিক না বলুন।
ভুল, খারাপ কাজ তো মানুষ করে তাহলে আপনি তাঁর দায় উপরওয়ালা কে কেনো দিবেন।
“যা হারিয়েছে তা ভেবে অভিমান না জমিয়ে যা পেয়েছেন তা নিয়েই কি শুকরিয়া আদায় করতে পারেন না”???

এমন কথা শোনার পরও কি চুপ থাকা যায়,,,
–সত্যি তো আমি মুসকানের মতো এমন একটা নিষ্পাপ প্রান পেয়েছি জীবনসঙ্গী হিসেবে এর জন্য তো উপরওয়ালা কে শুকরিয়া জানানোই উচিত।
হয়তো আমি শিশুকাল থেকে মা হারিয়েছি, মায়ের আদর ভালোবাসা পাইনি, অনেক রকম খারাপ পরিস্থিতি দিয়েও গেছি তবুও দিনশেষে এমন একটা খাঁটি জিনিস তো পেয়েছি।
” কিছু পাওয়া কিছু না পাওয়ার নামই তো জীবন”
ও যা বলছে তাতে কোন পাপ নেই,লোভ নেই স্বার্থ নেই। যদি স্বার্থ থেকে থাকে তা হলো ভালোবাসার।
যদি লোভ থেকে থাকে তা হলো ভালোবাসার।
এমন নিষ্পাপ, কোমল হৃদয়ের আবদার আমি কি করে না রাখি।
,
দুজনই একসাথে এই প্রথম নামাজ আদায় করলো।
নামাজ শেষে ইমন মুসকানের কপালে ভালোবাসার পরশ ছুয়িয়ে দিলো।
মুসকান বললো,,,

— আমি যখন ক্লাশ থ্রি তে পড়ি তখনি কোরান হাতে নিয়েছিলাম। মা আর আমি একসাথে নামাজ পড়তাম, কোরান পড়তাম। আমি মাদরাসায় পড়েছি ফাইভ অবদি। হুজুররাই বলেছে নামাজ না পড়লে কি কি শাস্তি হয় আর আপনি জানেন স্বামী- স্ত্রী একসাথে নামাজ পড়া সুন্নাত।

ইমন মৃদু হাসলো জায়নামাজেই হাঁটু ভাজ করে বসে মুসকানের কথাগুলো শুনতে লাগলো।
ওর কথা গুলোতে বাচ্চামি মিশে থাকে। মহামূল্যবান কথা বলছে তবুও ইমনের হাসি পাচ্ছে। পাবে নাই বা কেনো বাচ্চা মেয়েটা কখন থেকে তাঁকে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে। নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা করে বুঝিয়ে যাচ্ছে।

— আর জানেন আমাদের আরবি হুজুর কি বলেছিলো,,,

“মানুষকে দুনিয়ার সব গাফলতি থেকে মুক্ত রাখতেই প্রিয়নবি নামাজকে বেহেশতের চাবি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। পাশাপাশি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজকে রুটিন করে বিধান হিসেবে জারি করেছেন। যারা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো আদায় করবে; ওই ব্যক্তির দ্বারা কোনোভাবেই অন্যায়ের ওপর অটল ও অবিচল থাকার সুযোগ নেই”

আপনার দ্বারা এমনিতেও কোন অন্যায় হয় না।
শুধু নামাজ পড়েন না, ছাইপাশ খান।
আজ থেকে আর ওসব করবেন না কিন্তু।
বলেই ইমনের হাত দুটো চেপে ধরলো।

ইমন মৃদু হাসলো।

— ওকে ফাইন,,, অনেক হয়েছে অনেক বুঝিয়েছো বুঝেছি আমি। আর কোন কথা নয় ওকে।

— আপনি বলুন না আজ থেকে আমার সঙ্গে একসাথে নামাজ পড়বেন তো??
আমি আপনাকে কোরান পড়েও শোনাবো।

— আমি এই কথা দিতে পারছিনা মুসকান,,,
আমি কতোটুকু সময় পাই বলো??

— আচ্ছা দুবার তো সময় হবে এই দুবারই না হয় এক সঙ্গে পড়বো।

ইমন মাথা ঝাকালো। মুসকানের চোখ,মুখে হাসির ঝলক দিয়ে ওঠলো।
ইমন বাঁকা হেসে জায়নামাজ থেকে ওঠে পড়লো।
অল্পতেই মেয়েটা ভীষণ খুশি হয়ে যায় ভেবেই তৃপ্তির শ্বাস ছাড়লো।

মুসকান রুম ছেড়ে বেরুতে পা বাড়াতে নিতেই ইমন বলে ওঠলো।
— তখন হাসছিলে কেনো??

মুসকান থেমে গেলো পিছন ঘুরে বললো কখন??

ইমন চোখ বুজেই গম্ভীর গলায় বললো যখন ও রুমে গিয়েছিলাম।

মুসকান মুচকি হেসে বললো এমনি।

— এদিকে এসো,,,
বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো মুসকান।
ইমন চোখ খুলে তাকালো।
মুসকান লজ্জা পাচ্ছে বুঝতে পেরে ইশারা করলো পাশে বসতে।
মুসকান চুপচাপ পাশে বসতেই ইমন তাঁর হাত বাড়িয়ে পিঠ চেপে একদম নিজের ওপর ফেললো।
গাঢ় দৃষ্টি তে চেয়ে বললো,,,
–কেনো হাসা হচ্ছিল জানতে চাই আমি।

মুসকান লজ্জায় মিইয়ে গেলো। সে তো মজা করেই হেসেছে তা কি বলবে,,,

— কি হলো বলো কেনো হাসছিলে??

— এমনি মজা করে হেসেছি।

— তাই কি নিয়ে মজা পেলে৷

এবার যেনো ভয়ে মরি মরি অবস্থা।
কি করে বলবে সে তাঁকে দেখে মজা পেয়ে হেসেছে,
আমাকে ছাড়া আপনি যে একটা রাত ও কোথাও থাকতে পারেন না। তা তো আমি জানি, কিন্তু ওনাদের না আমি কিছু বলতে পারছিলাম আর না আপনি।

— কি হলো আমি কিছু জিগ্যেস করছি,,,

মুসকান চোখ দুটো বন্ধ করে বললো,
— আপনি তো আমাকে নিতেই গিয়েছিলেন।
কিন্তু মামনি তো আসতে দেয়নি তাই হাসি পাচ্ছিলো।

— হুম। মানে হলো আমাকে তুমি হাসির পাএ বানিয়েছো তাই তো। আমার ব্যাথা তে মজা পেয়েছো তুমি??

মুসকান চোখ তুলে তাকালো ইমনের মুখের দিকে।
যুগল ভ্রু জোরা কুঁচকে আছে, ছোট চোখজোরা আরো ছোট হয়ে তীক্ষ্ণ হয়ে আছে, ঘন কালো গাল ভর্তি দাঁড়ির মাঝে গোলাপী রাঙা ঠোঁট গুলো যেনো আরো কিছু বলতে চাইছে,,,
মিনমিনে স্বরে বললো,– আপনি ব্যাথা পেয়েছেন?

ইমন কিছু বললো না, কিছু অনুভূতি বলা যায় না শুধু অনুভব করা যায়। মুসকান তাঁর জীবনে আসার পর থেকে দীর্ঘ সময় চোখের আড়াল করতে পারেনি কখনো। বিয়ের আগে গভীর রাতে মুসকানের নিষ্পাপ মুখটার কথা মনে পড়লে,তাঁর পবিএ উপস্থিতি অনুভব করতে ছুটে গিয়ে কাজের ছুতোয় নিজের কাছে নিয়ে আসতো। বিয়ের পর একটা রাত আলাদা থাকার কথা তো সে ভাবতেও পারেনা।
পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে একটা রাত তাঁকে ছাড়তে হয়েছে। সব কি বলে বোঝানো যায় নাকি,,,

নিজের সাথে আরেক টু চেপে নিতেই মুসকান দুহাত ইমনের বুকে ভর করে ড্যাব ড্যাব করে মুখের দিকে চেয়ে রইলো। জানার তীব্র ইচ্ছে কিসের ব্যাথা পেয়েছে ইমন??
কিন্তু ইমন তো তাঁকে বলবে না শুধু বোঝাবে,,,
নিজের সাথে গভীরভাবে জরিয়ে কিছু গভীর স্পর্শ করলো। প্রতিটা স্পর্শ শুধু স্পর্শ নয় তাঁর তীব্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই মুসকান চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললো। কিছু বলার থাকলেও বলা হলো না, তাঁর ঠোঁট জোরা যে ইমনের দখলে।
হাত দিয়ে সরাবে তবুও পারলো না তাঁর হাত দুটোও ইমন নিজের একহাতে শক্ত বাঁধনে বেঁধে রেখেছে।

— দাদা ভাই ফুপু তোমাদের ডাকছে তারাতারি ওঠো।
ইয়ানার কথা কানে ভেসে আসতেই ইমন মুসকানের ঠোঁট জোরা আলগা করে দিলো। মুখের দিকে মোহময় চোখে চেয়ে হাত দুটোও ছেড়ে দিলো।

লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মুসকান কিছুক্ষন ঘন শ্বাস ছেড়ে ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে দরজার কাছে যেতে নিতেই ইমন বাঁধা দিলো। কাছে গিয়ে অগোছালো সামনে আসা চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে ইশারা করলো,এবার যাও।

,
লন্ডন থেকে একটা গ্যাং এসেছে।
তাঁদের বস জনি ইভান রিতিশার খুব কাছের বন্ধু।
জনি তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে একটা মিশনে। এটা সাকসেসফুল করতে পারলে মোটা অংকের টাকা পাবে সেই সাথে পেয়ে যাবে বাঙালী স্বাদ। এমন কথাই বলেছে রিতিশা যা ভেবে পৈশাচিক হাসি দিচ্ছে জনি সহ তাঁর পুরো গ্যাং।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here