#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৪
#রাউফুন
‘তুই ঠিক কি করতে চাইচিস তুলি?’
‘উফফ যা করতে চাইছি করতে দে না। শুধু যা যা বললাম করবি।’
‘ঠিক আছে।’ অসহায় বদনে বলে আশফি।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ যাও আশফি এবার লুকিয়ে পরো খাটের তলায়।’ বললো বড় ভাবি নীতি!
‘বড় ভাবি আপনিও? খাটের তলায় আমি ঢুকবো কিভাবে?’
‘তাইলে? তাইলে তুই পর্দার আড়ালে যাহ।’
‘ঠিক আছে! আল্লাহ এই মাইয়া যে কি করতে চাইছে! আল্লাহ রক্ষা করো। কোনো ভেজাল না হলেই হলো।’
‘হুশ হবে না৷ যাহ তো!’ দাঁত কেলিয়ে বলে তুলিকা।
‘ হ্যাঁ বিয়ে বাড়িতে এরকম হয়। এরকম কিছু না হলে কি বিয়ে বাড়ি জমে নাকি।’
‘ হ্যাঁ তাই না বড় ভাবি। আপনি যান তো! আপনার দেবরজি কে পাঠিয়ে দিন।’
নীতি চলে গেলো। তুলিকা দুই ঠোঁট চেপে ধরে হাসলো৷ আজকে দুলাভাই দেখবে শালীকা কি জিনিস হয়?
কিছুক্ষণ পরেই নীরব এলো। তুলিকা সুন্দর করে বিছানায় বসে ছিলো। এক হাত ঘোমটার আড়ালে শয়’তানী হাসি। নীরব আরেকটু এগিয়ে আসতেই তুলিকা সুন্দর মতো উঠে সালাম করলো।
‘আরে আরে সালাম করতে হবে না।’ ভদ্রতাসূচক বললো নীরব।
‘তা কি করে হয় সালাম করাটা তো নিয়ম!’
‘এই আপনি এমন লম্বা ঘোমটা টেনে আছেন কেন? আমার সামনে এতো লম্বা ঘোমটা দিতে হবে না।’
‘বাব্বাহ দুলাভাই আপনি তো বহুত ফার্স্ট!’ মনে মনে বলে তুলিকা।
‘বউ ঘোমটা দিয়ে থাকবে আর বর এসে ঘোমটা তুলবে। এটাই নিয়ম!’
‘ওহ আচ্ছা। আপনি ব’বসুন না!’ তুলিকা ভদ্র মেয়ের মতো খাটের এক কোণায় বসলো। নীরবের কেমন যেনো অদ্ভুত ঠেকছে। কথা গুলো কেমন যেনো দূর থেকে আসছে মনে হচ্ছে। নাকি আশফি আস্তে কথা বলছে বলেই এরকম মনে হচ্ছে? যায় হোক এখানে তো তারা দু’জন ছাড়া কেউ-ই নেই।
‘আপনি যে আমাকে পছন্দ করলেন তার প্রথম কারণটা কি?’
ভনিতা না করেই নীরব তার অনুভূতি ব্যাক্ত করলো।
‘জানেন আশফি আমি না কখনোই প্রে’ম করিনি। প্রথম বার যখন বাসায় ভাইয়া, ভাবি আপনার ছবি আমাকে দেখালো না? সেদিন আমি অনুভব করেছিলাম, প্রথম বারের মতো প্রেমে পরেছি! আপনার ছবি দেখার পর থেকে আমার ঘুম হয়নি। খেতে পারতাম না, বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় আপনার কথা মনে হলেই একা একা পা’গ’লে’র মতো হাসতাম। এটা নিয়ে বন্ধুরা কম জ্বালাতন করেনি। তখন বুঝেছিলাম আপনি আমার প্রথম অনুভূতি, প্রথম ভালোবাসার ফুল! আমি প্রে’মে পরেছি!’
‘নীরব আপনি বসুন না। দাঁড়িয়ে থাকবেন না।’ এদিকে পেট চেপে হাসছে তুলিকা।মনে হচ্ছে পেট ফেটে যাবে।পর্দার আড়াল থেকে আশফি কথা বলছে আর ফোসফোস করছে।
‘আচ্ছা লাইট বন্ধ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিচ্ছি!’
‘নাহ নাহ লাইট বন্ধ করবেন না।অন্ধকারে ভয় পাই আমি!’
‘ভয় কিসের আমি তো আছি!’
‘আগে ঘোমটা তুলতে হবে।তারপর লাইট বন্ধ!’
আশফি বুঝলো এরপর বেশি বাড়াবাড়ি হবে।তাই কথা না বাড়িয়ে এই কথায় বলে দিলো। তুলিকা তো ঘোমটার আড়ালে হেসে কু’টি’কু’টি হচ্ছে।
‘আপনার কথা গুলো কেমন যেনো দূর থেকে আসছে আশফি।’
‘ওসব কিছু না। ঘোমটা উঠান!’
নীরব আশ্চর্য হলো। আশফি কেমন লাজুক মেয়ে ওঁ জানে। প্রথম দিন যখন সামনা-সামনি দেখা হলো তখন তো আশফি এতোটা চঞ্চল ছিলো না। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মেয়ে থাকা মেয়ের এতোটা পরিবর্তন? এমন ভাবে কথা বলছে কিভাবে? সে বিলম্ব না করে ঘোমটা তুলতেই বড়সড় একটা চিৎকার দিলো।
‘তুলিকা আপনি এখানে আশফি কোথায়?’
হোহো করে হেসে উঠলো তুলিকা। পর্দার আড়াল থেকে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে এলো আশফি। ওঁদের কান্ড দেখে নীরব যা বুঝার বুঝে গেলো। তার সঙ্গে গেইম খেলা হচ্ছিলো এতক্ষণ আর সে কি ধরনের বড় বোকা। ততক্ষণে বাইরে থেকে বন্ধ করা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো নীতি। সেও পেট চেপে হেসে উঠলো হোহো করে।
‘টাকা দেন দুলাভাই। নাইলে যাবো না!’
‘উফফ আপনারা কি আমার হার্ট অ্যাটাক করানোর ধান্দায় ছিলেন? আল্লাহ কি সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার ঘটালেন! এরপর তো আমি টাকা দিচ্ছি না।’
‘ওকে তাইলে আমরাও যাচ্ছি না।’
‘আহা নীরব কার্পণ্যতা করিস না। তোর তো একটাই শালীকা!’
‘হুহ দেখতে ইনোসেন্ট শালীকার কি না এই রুপ? মানা যায়?’
‘হাহ টাকা ছাড়ুন না হলে সারারাত এভাবেই থাকুন।’
‘আচ্ছা বুঝেছি। কত টাকা দিতে হবে?’
‘আপনার মর্জি মতো দিন।তবে হ্যাঁ নিজের মান-সম্মানের কথা মাথায় রেখেই দিবেন। মানুষকে তো বলে বেরাবো না হলে আমার বান্ধবীর বর কিপটে!’
নীরব ওর মানি ব্যাগের সব টাকা দিলো। ততক্ষনে বাড়ির বয়জষ্ঠ মানুষ জন উপরে চলে এসেছে। শারমিন, শারমিনের মা, মাইজিনের মা শাপলা।
‘কি হয়েছে নীরব? রাত বিরেতে এমন চেঁচালি কেন?’
‘কিছু না খালা। আপনারা যান। আমরা একটু দুষ্টামি করছিলাম।’
শাপলা তুলিকাকে এখানে দেখেই বললেন, ‘এই মেয়েটা এখানে কি করছে? ওর হাতে এতো টাকা কেন? চুরি টুরি করলো নাকি?’
‘ওহ মাই গড খালা। এই মেয়েটা চুরি করতে এসে ধরা খাইছে মনে হয় নীরব ভাইয়ার কাছে। তাই ভাইয়া ওভাবে চিৎকার করেছে!’
এমন কথায় তুলিকার হাত থেকে টাকা পরে গেল নিচে। চোর অপবাদ দিলো শেষ পর্যন্ত? বান্ধবীর বাসর রাতে সে এমন মজা করবে আগেই ঠিক করেছিলো।
‘উফফ এই শারমিন তুই জীবনে ভালো হবি না তাই না? আর মা এটা কি ধরনের কথা? সব সময় বাড়তি কথাবার্তার মানেই হয় না। বিরক্তিকর!’ মুখ বিকৃত করে বলে মাইজিন।
‘আহা খালা আপনি না জেনে বুঝে এরকম কথা কেন বলছেন? আমিই দিয়েছি ওঁকে টাকা গুলো। শালীকাদের কিছু হক থাকে না সেটাই আর কি! ও একটু মজা করছিলো আমার সঙ্গে তাই আতঙ্কিত হয়ে চেঁচিয়ে ফেলেছি।’
‘আমিও ছিলাম ওর সঙ্গে খালা। একা ওঁকে দোষ দিবেন না! তুলিকা ওরকম মেয়েই নয়।’ কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলে নীতি।
‘হ্যাঁ তুমি আমাকে মানুষ চেনাবে এখন? এসব ধান্দাবাজ মেয়ে খালি টাকা হাতানোর ধান্দায় থাকে। জীবনে এতো টাকা দেখেছে? লোভি মেয়ে-ছেলে!’
‘মুখে লাগাম টানুন খালাম্মা। আমার বেস্টফ্রেন্ডকে নিয়ে একদম বা’জে কথা বলবেন না। আমিও ওঁদের সঙ্গে ছিলাম। আজ আমার এখানে প্রথম দিন। আমি কখনোই কাউকে অসম্মানজনক কথা বলতে চাই না। কিন্তু এখানে যদি আমার বেস্টফ্রেন্ডকে কেউ-ই কিছু বলে সেটা কিন্তু আমি সহ্য করবো না। বা ওমন কটাক্ষ মেনে নেওয়ার মতো মেয়েও কিন্তু আমি নয়!’
‘দেখলি নীরব? এই বউ তো প্রথম দিনেই আমাকে কথা শোনাচ্ছে। কই সাইমুমের বউ তো কোনো দিন মুখে মুখে তর্ক করে না। আর তোর বউ কি না প্রথম দিন এসেই আমাকে কথা শোনাচ্ছে!’
‘ঠিকই তো আছে খালা। আমার বউ তো আর অন্যায় কিছু বলেনি। আর আপনি এমনি এমনি একজনকে না জেনে চোর অপবাদ দিবেন এটা কোন ধরনের কথা? দিন দিন আপনার সভ্যতা দেখি মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে খালা!’
হায় হায় করে উঠলেন শাপলা। হাহুতাশ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে৷ তুলিকা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। আশফি তুলিকাকে আগলে ধরলো।
‘আহা বোন তুমি কেঁদো না। খালা একটু এরকমই। চড়া গলায় কথা বলেন। কিন্তু মন টা ভীষণ ভালো।’
‘ভাবি প্লিজ আজকে একটু তুলিকাকে আপনার সঙ্গে রাখবেন? আসলে নতুন একটা বাড়িতে এসে একটা আলাদা রুমে থাকাটা কেমন না?’
‘আরে আশফি তুমি চিন্তা করো না। তুলিকা তো আমার ছোট বোনের মতো! তাছাড়া মিষ্টিকে তো আমার রুমেই রেখেছি! আজকে সাইমুম অন্য রুমে মাইজিনের সঙ্গে থাকবে।’
ওঁদের রুম থেকে আসার আগে তুলিকা নীরবের হাতে টাকা গুলো দিয়ে বলে, ‘ভাইয়া এটা আমি নিতে পারবোনা। আমি শুধু একটু মজা করতে চেয়েছিলাম। সত্যিই এটা আমি নিতাম না বিশ্বাস করুন। আশুর সঙ্গে আমার আগে থেকেই এরকম নানান প্ল্যান করা ছিলো। তার মধ্যে এটা একটা। এরকম একটা মজা করতে চেয়েছিলাম অনেক আগে থেকেই। তাই আর কি এটা করা! আপনি কিছু মনে করবেন না হ্যাঁ ভাইয়া!’
‘আরে তুলিকা, বোন শোনো আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছো। খালার হয়ে আমি হাত জোর করে ক্ষমা চাইছি। এটা তোমার পাওনা। প্লিজ এটা ফিরিয়ে দিও না! বড় ভাই হিসেবে দিয়েছি নাও প্লিজ! যদি এটা ফিরিয়ে দাও তবে ভেবে নিবো তুমি আমাকে বড় ভাই হিসেবে মানোই নি!’
এই কথার পর তুলিকা কি বলবে ভেবে পেলো না।
তুলিকা আর নীতি বেরিয়ে এলো রুম থেকে।
মাইজিন মায়ের এরকম কাজে লজ্জায় মাথা নত করে আছে। ছিঃ ছিঃ একটা মেয়েকে না জেনে বুঝে এইভাবে ছোট করতে পারলো? অবশ্য এই মহিলার কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিই-বা আশা করা যায়। মাইজিন লজ্জায় প্রস্থান করলো সেখান থেকে। শারমিন মাইজিনের পেছন পেছন গেলো।
‘মাইজিন ভাই দাঁড়ান!’
‘তুই এখন আমাকে ডাকছিস কেন? যাহ ঘুমা!’
‘ওহো মাইজিন ভাই সব সময় এমন চড়াও গলায় কথা কেন বলেন? একটু ভালো ভাবে, ভালোবেসে কথা বলতে পারেন না?’
‘ভালোভাবে কথা বলবো তাও তোর সঙ্গে? তোর মতো ন্যাকার-ষষ্ঠীর সঙ্গে?যে কথায় কথায় গায়ে পরে তার সঙ্গে আমি ভালো ভাবে কথা বলি না। গট ইট?আর তুই ডিজার্ভ ও করিস না ভালো ব্যবহার!’
গটগট করে হেঁটে চলে গেলো মাইজিন।অপমানে দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো শারমিন।এর শেষ সে দেখেই ছাড়বে।
‘খালামনিকে বলে খুব জলদি তোমাকে আমার খাচায় বন্দি করার ব্যবস্থা করতে হবে।না হলে তো তোমাকে বাগে আনতে পারছি না।তোমার পুরো সম্পত্তির মালিকানা শুধুই আমার হবে।না হলে শারমিন কখনোই তোমার পেছনে ছুটতো না।এই সুন্দরী শারমিনের পেছনে ছেলেদের লাইন লেগে আছে হুহ্!’
#চলবে