#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#রাউফুন
#পর্ব২৮
উদ্ভ্রান্তের মতো তুলিকা মাইজিনের নিকট ছুটে এসেছে। নাফিস আর সে মাইজিনকে ধরে হসপিটালের উদ্দেশ্য যেতে উদ্যত হয়েছে তখনই তারা দুজন থেমে যায় কারো গম্ভীর কণ্ঠে।
‘তাহলে তুমিই সেই মেয়ে যার কারণে আমার ছেলে আমাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে?’
গুটিগুটি পায়ে রৌফ সুলতান সামনে এলেন। তুলিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে উনার মুখো পানে। চেনার চেষ্টা করলো সে। কারণ তুলিকা এর আগে কখনোই তাকে দেখে নি। নাফিস ভ্রু কুচকে বলে, ‘এগুলো কি বলছেন আংকেল? ছেড়ে এসেছে মানে কি?’
‘কেন তুমি জানো না নাফিস? ওঁ তো এখন তোমাদের বাড়িতেই থাকছে তাই না?’
‘দেখুন আমাদের এতো সময় নেই যে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলবো। মানুষটা অসুস্থ তাকে নিয়ে হসপিটাল যেতে হবে। নাফিস ভাই চলুন আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে। উনার যে জ্ঞান ফিরলো না এখনো।’
‘এই মেয়ে আমার গাড়ি আছে চলো হসপিটালে পৌঁছে দিচ্ছি!’ আবারও গম গম গম্ভীর স্বর। রৌফ সুলতানের।
‘নাহ আংকেল আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। আমার বন্ধুকে আমার গাড়ি করেই নিয়ে যাচ্ছি। আপনার যদি ওঁকে নিয়ে চিন্তা হয় তবে আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন। কারণ একজন বাবাকে তো বারণ করতে পারিনা ছেলের সঙ্গে না যেতে!’
‘বেশি বাড়াবাড়ি করো না নাফিস। আমার ছেলে আমার গাড়িতে যাবে এটাতে সমস্যা কোথায় তোমার? আমার ছেলের উপর আমার কি ভালোবাসা নেই? সম্পুর্ন অধিকার আছে আমার তার উপর। সে অসুস্থ হলে আমি তাকে নিয়ে চিন্তিত হবো না?’
‘কিন্তু মাইজিন আমার গাড়িতেই যাবে আংকেল।’
‘হেই ইউ?’
‘আপনারা আপনাদের তর্ক পরে করবেন৷ আমার স্বামী এখন অসুস্থ। তার কোনো ক্ষতি আমি সহ্য করবো না। আর মিষ্টার সুলতান আপনার যদি এতোই ছেলের উপর ভালোবাসা থাকতো না? তবে উনাকে এতোটা কষ্ট পেতে হতো না ছোট থেকে৷ দিনের পর দিন মানুষটাকে সৎ মায়ের হাতে বেধড়ক মা’র খেয়ে বড় হতো না। একজন পুরুষ মানুষ হয়ে রান্না করে আপনার স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দিতে হতো না তিন বেলা৷ এতো ভালোবাসেন যে ছেলের অসুস্থতার সময় একবার বুকে জড়িয়ে ধরার সময় টুকু হয়নি আপনার। তার শরীর খারাপের সময় তার পাশে থাকার সময় পর্যন্ত হয়নি। সেসব কথা না হয় ছেড়েই দিলাম কিন্তু আজ? আজ তো পারতেন উনার খেয়াল রাখতে। সবাই এখানে উপস্থিত ছিলো শুধু আপনিই পরে এসেছেন। আজ কেন এসেছেন? আজকেও প্রয়োজন ছিলো না। নাফিস ভাইয়া চলুন দ্রুত!’
রৌফ সুলতান শক্ত চোখ মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ কি বললো এই মেয়েটা? এতো বড় সাহস তার মুখের উপরে এতো গুলো কথা বললো মেয়েটা? কি সব আবোলতাবোল বকে চলে যাচ্ছে। সৎ মায়ের মা’র খেয়েছে মানে টা কি? তুলিকার কথার কোনো কিছুই বোধগম্য হয় না তার। শুধু বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে তাদের যাওয়ার পানে।
মাইজিনকে ধরে গাড়িতে তুলে বসিয়ে দিলো তারা৷ তুলিকা তার মাথা ধরে তাকে জাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো ভাবেই মাইজিনের জ্ঞান আসছে না। হসপিটালে যেতেই মাইজিনকে ভর্তি করানো হলো ইমার্জেন্সিতে। অস্থির তুলিকা কেঁদে কে’টে একঁশা। কালকের ব্যবহারটা সে ভুলে উঠতে পারছে না। মনে পরলেই হৃদয় উতলে কাঁন্নারা ছিটকে বেরিয়ে আসছে।
‘আই প্রমিস ইউ। আর কোনোদিন এরকম করবো না মাইজিন। আপনি সুস্থ হয়ে যান শুধু, শুধু আপনি সুস্থ হয়ে যান। প্লিজ! আল্লাহ আমার স্বামীকে সুস্থ করে দিন। মানুষটার যদি কিছু হয়ে যায় আমি যে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না আল্লাহ্!’
মনে মনে নানান প্রলাপ করে যাচ্ছে তুলিকা। সে আর নিতে পারছে না।
‘ভাবি এতো কাঁদবেন না। মাইজিন ঠিক হয়ে যাবে।’
‘নাফিস ভাই উনি ঠিক হয়ে যাবে বলুন? কিছু হবে না উনার তাই না! দেখুন না কখন থেকে অজ্ঞান হয়ে আছে।’
‘ভাবি মাইজিনের কিচ্ছু হবে না দেখে নিয়েন। আল্লাহ এতো ভালো একজন মানুষের সঙ্গে খারাপ কিছু করবেন না।’
তম্বন্ধে ডক্টর বেরিয়ে এলেন। তুলিকা হন্তদন্ত হয়ে তার নিকটে এগিয়ে গেলো।
‘ডক্টর আমার হাসবেন্ড কেমন আছে? উনার কি হয়েছে?’
‘দেখুন আপনারা শান্ত হোন। উনি এখন ঠিক আছেন। উনার অনেক গুলো টেষ্ট করা হয়েছে আমাদের সন্দেহ অনুযায়ী। রিপোর্ট না দেখে আমরা আগেই কিছু বলতে চাইছি না। আপনারা উনার স্যালাইন শেষ হলে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। তিন- চারদিন পর উনার রিপোর্ট গুলো নিয়ে যাবেন!’
তুলিকারা সন্ধ্যায় মাইজিনকে নিয়ে বাসায় এলো। মাইজিন তুলিকার সঙ্গে কথা বলেনি এখনো। স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়টা ভীষণ ভাবে দাগ কে’টেছে তুলিকার মনে। পরক্ষণেই সে ভাবলো এটা সে ডিজার্ভ করে। না চাইতেও চোখের কোণ ঘেঁষে জলের রাশিরা গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার শাস্তি পাওয়াই উচিত। সত্যিই এটা সে ডিজার্ভ করে।
রাতের খাবার খাইয়ে দেওয়ার পর মাইজিনকে মেডিসিন খাইয়ে দিলো তুলিকা। মাইজিন নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে ছিলো তুলিকার আড়ালে। মেয়েটার মুখ একদিনেই শুকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সে না তুলিকাই অসুস্থ হয়েছে। মুখটা ফ্যাকাসে, র’ক্ত শুন্য লাগছে মেয়েটার। কিন্তু তার ভেতরে যে অভিমানের বাসা বেঁধেছে এটা থেকে বের হতে পারছে না কিছুতেই। মিষ্টি একবার এসে মাইজিনকে দেখে গেছে। কতক্ষণ গল্পও করে গেছে।
মাঝ রাতে মাইজিনের ঘুম ভেঙে যায় কারোর গুনগুনিয়ে কান্নার আওয়াজে। নিজের পায়ের কাছে ভারী ভারী অনুভব হয়। মাইজিন তার দুর্বল শরীরকে টেনে তুলে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। সে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে,
‘আরে তুলিকা আপনি জেগে আছেন এখনো? ক’টা বাজে?’
তুলিকা নড়েচড়ে বসে। কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে দৌঁড়ে ঝাপিয়ে পরে মাইজিনের বুকে।ডুকরে কেঁদে উঠে প্রিয় স্বামীর বুকে মাথা রেখে।মাইজিন হতবাক হয়ে গেছে তার এরকম কাণ্ঠে।কিম্ভূতকিমাকার, আশ্চর্য হয়ে তুলিকার মাথায় হাত রাখে। মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমানকে আর প্রশ্রয় দিতে পারে না সে৷ প্রিয়তমা স্ত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
‘হয়েছে অনেক হয়েছে। এবার শান্ত হও। কি হয়েছে এভাবে কান্না করছো কেন?’
‘আ’ম রিয়েলি স্যরি মাইজিন। আমি আপনার সঙ্গে কালকে ওইভাবে কথা বলতে চাইনি। ওই যে নুশার আম্মু আছে না? উনার সঙ্গে গল্প করার সময় কথায় কথায় উনি বলেন, “পুরুষ মানুষ হলো মেয়ে লো’ভী।
স্ত্রীকে ভোগ করা শেষ হলে বাইরের মেয়েদের দিকে নজর পরে। তখন আর ঘরের স্ত্রীকে মনে ধরে না। এই দেখুন না ভাবি নুশার আব্বু, আগে কথায় কথায় বউ, বউ করে মাথায় তুলে রাখতো। সব জিনিস প্রয়োজনের আগে হাতে এনে হাজির করে দিতো৷ কিন্তু এখন? এখন আমি তার দু-চোক্ষের বিষ। সহ্য করতে পারে না আমাকে। তার নাকি এখন আর আমাকে ভালো লাগে না। ভাবি আপনি মাইজিন ভাইকে চোখে চোখে রাখবেন, ওরকম ছেড়ে দিয়ে রাখবেন না। হাতে রাখার চেষ্টা করবেন! আকর্ষণ শেষ হলেই কিন্তু অন্য মেয়ের দিকে নজর যাবে!” তাই আমি ভেবেছিলাম আপনার থেকে একটু দূরে দূরে থাকলে আমার প্রতি আপনার আকর্ষণ কমবে না।’
‘হাইরে মেয়ে মানুষ। তাই তুমি আমার থেকে দূরে দূরে থাকার জন্য ওরকম করলে? আরে এতো দিনে আমাকে এই চিনলে? যায় হোক আমার বউয়ের জায়গা কেউ-ই কোনো দিন পাবে না। সো এসব চিন্তা মাথায় রাখার দরকার নেই। যতসব লেইম কথা বার্তা মাথায় ভর্তি করে রাখা তাই না?’
‘আর হবে না। আমাকে ক্ষমা করে দিন আপনি। আমি আর কক্ষনো আপনাকে কষ্ট দেবো না।’
আবার তুলিকা মাইজিনকে জাপটে ধরে৷ মাইজিন তার মুখ তুলে ধরে তার চোখ মুছে দিলো। তুলিকা আবারও তার বুকে ঘাপটি মে’রে বসে থাকে।
‘এই যে শুনো মেয়ে আর নিচে যাওয়ার দরকার নেই। এসব কিছু মহিলারাই তো মানুষের মন বিগড়ে দেই। আমার বউয়ের মতো ভোলাভালা মানুষ পেয়ে এটা সেটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।’
‘আর যাবো না। আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন তো?’
‘আরে আমি রাগ করিনি। তবে অভিমান হয়েছিলো বটে। এখন আর নেই।’
তুলিকা মাইজিনের পুরো মুখোশ্রীতে চুম্বন এঁকে দিলো। উন্মুক্ত বুকে চুমু একে দিয়ে নাক টানলো। না জানি রিপোর্টে কি আসে। বড্ড ভয় হচ্ছে তার। খুব আপন কিছু হারানোর ভয়ে অস্বস্তিতে বিমুঢ় হয়ে আসছে মন! বিষাক্ত কিছু জাপটে ধরছে তাকে। সে আরও কিছু টা জোরে আঁকড়ে ধরলো মাইজিনকে। মাইজিন আলতো হাসে। বলল, ‘আল্লাহ আস্তে আস্তে ধরো। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। এমন ভাবে ধরেছো নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’
তুলিকা তার কোলে বসে হাতের বাধন আরও জোড়ালো করলো। ওইভাবেই বসে থেকে তার বুকেই ঘুমিয়ে গেলো।
•
‘পাঁচশো টাকা দেন।’
‘আরে একটু আগেই কোচিং-এ যাওয়ার আগে তোমাকে পাঁচশো টাকা দিলাম।’
‘অতীতের কথা ভুলে যান। অতীত নিয়ে পড়ে আছেন বলেই আমাকে পটাতে পারেন না।’
মিষ্টির ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। নাফিস কোণা চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। পাঁচশো টাকা বের করে দিয়ে বলল, ‘এভাবে আর কত টাকা নিবা? শুধু পেছন পেছন ঘুরি বলেই রোজ টাকা নাও। বিয়ের পর কি আমাকে ফকির বানিয়ে বাটি হাতে রাস্তায় নামিয়ে দিবা?’
‘ওমা আপনার কি টাকা শেষ হলো নাকি? যদি হয়ে থাকে তবে ঘুরা বন্ধ করুন!’
‘হাহ্ এই নাফিসকে ফুতুর করা তোমার মতো বাচ্চা মরিচের কাম্য নয়।’
‘আপনি দিনে প্রায় দশ বার আসেন আমার পিছনে পিছনে। যদি দশবারই টাকা নিই আপনার বাটি হাতে নিতে সময় লাগবে না।’
‘মানে?’
‘মানে কিছুই না।এখনো সময় আছে পিছু ছেড়ে দিন আমার।না হলে সত্যিই ফুতুর হতে হবে আপনার!
‘এই জীবন থাকতে আর ছাড়ছি না তোমাকে!’
নাফিসকে নিজের পিছু ছাড়াতে সক্ষম হয়নি কোনো ভাবেই মিষ্টি। তাই এই পন্থা অবলম্বন করে নাফিসের হাড় মাংস জ্বালিয়ে কয়লা করে দিচ্ছে। নানান ভাবে জ্বালাতন করছে কিন্তু কোনো ভাবেই নাফিসকে তার পিছু আসা ছাড়াতে পারেনি। এই যে রোজ নাফিসের থেকে সকাল বিকেল পাঁচশো করে টাকা নিচ্ছে এগুলো আবার জমিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখেও দিচ্ছে যাতে করে সেগুলো আবার রিটার্ণ করতে পারে!
#চলবে