হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২৭

0
1307

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#রাউফুন
#পর্ব২৭

মিষ্টির পেছনে ছুটছে নাফিস। এই সন্ধ্যায় মেয়েটা হেঁটে আসছে। কেন অটো ধরলে কি সমস্যা? আবার সে যদি হেল্প করতে চাই মেডাম আবার ক্ষেপে যাবেন। একেবারে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে তাকে এই বাচ্চা মরিচ। এইযে এভাবে সে রোজ রোজ তাকে ফলো করে, তার চোখ গরম করা চাহনি, কথার ঝাঝ, রাগী রাগী মুখ, মা’রকুটে হাতে মা’র সব সহ্য করছে এগুলো কি এমনি এমনি? তাকে বুঝতেই চাই না একদম। একটুও পটলে কি হবে? দোষের কি এখানে? হতে পারে তার একটু বয়স বেশি তাতে কি? একেবারে বুড়ো তো নয়!

‘ওগো মিষ্টি! শুনো!’

‘কি হয়েছে?’ মিষ্টি দাঁড়িয়ে পরলো।

‘এভাবে আর কত ঘুরাবে?’

‘কেন এতেই হাঁপিয়ে গেছেন?’

‘ উঁহু।’

‘তাহলে?’

‘তোমার পেছনে ঘুরা তো আমার দায়িত্ব। ছেলেটা কে তোমার পিছনে আসছিলো?’

‘সেসব জেনে আপনার কাজ কি?’

‘আমার অনেক কাজ। আমার বাচ্চা মরিচের পেছনে কেউ আসুক সেটা আমি সহ্য করবো ভাবছো? নাকি তোমার ওঁকে ভালো লাগে?’

‘অসম্ভব। হি ইজ আ’ স্কাউন্ড্রেল।’

‘হ্যাঁ সব ঝাঁঝ শুধু আমার সঙ্গে ওর সঙ্গে তো পারো না। আমাকে মারো কিছু বলি না। ওঁর উপর হাত চালালে ঐ ছেলেও মা’রঃবে দেখে নিও!’

‘আমাকে তাহলে জিমনাসিয়ামে ভর্তি হতে হবে। ওঁ মা’র’লেই আমি ডাবল মা’র’ব।’

‘কাউকে কিছু করতে হবে না। আমাকেই মে’রো!’

‘মারবোই তো।’

‘থাক দরকার নেই। আমাকে মারলে কিন্তু বিবাহ করতে হবে!’

‘আবার বিয়ে বিয়ে করছেন? কোনো পুরুষকে আমার বিশ্বাস নেই। টৌয়াইস চিটেড।’

‘টৌয়াইস চিটেড মানে? তোমাকে দুবার কে ঠকালো? আমার বাচ্চা মরিচ কে ঠকালো? একবার নাম বলো শুধু!’

‘আমাকে না আমার ফ্রেন্ডকে!’

‘ওহ আচ্ছা তাই বলো। আমি ভয় পেয়েই গেছিলাম!’

মিষ্টি জোরে হাঁটা দিলো। নাফিস তার সঙ্গে না পেরে দৌঁড়ে তার সাথে সাথে হাঁটছে।

‘ওগো আমার বাচ্চা মরিচ!’

‘আবার!’

‘স্যরি, স্যরি!’

‘হু! এবার সরুন কাছ থেকে। মানুষ আমাকে বাঁকা চোখে দেখছে!’

‘হেহ্ দেখলে দেখুক। আমি কাউকে পরোয়া করি নাকি!’

‘হ্যাঁ তা করবেন কেন? আপনাদের ছেলেদের তো আর কিছু না। বদনাম হলে হবে মেয়েদের।’

‘হবে না আমি তো তোমাকে বিয়েই করবো।’

‘কিন্তু আমি বিয়ে করবো না। এই আপনি যাবেন? অনেকক্ষন থেকেই আপনাকে সহ্য করছি!’

‘আচ্ছা আমি মরে গেলে তুমি কাঁদবে না?

‘নিশ্চই কাঁদবো। অনেক দিন কাঁদিনি!’

‘কিভাবে কাঁদবে, দেখাও।’

‘তার আগে আপনি মরে দেখান।’

‘এএএএহেহেহে!’

‘এই আমার বাচ্চা মরিচ শোনো! ❝বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী!❞

‘মানে?’

‘মানে আমি তোমাকে পটিয়ে,বিয়ে করেই ছাড়বো। যুদ্ধের ময়দানে নেমেছি যখন যুদ্ধ তো করতেই হবে।’

মিষ্টি সামনের দিকে ফিরে জোরে জোরে হাঁটা দিলো। কিছু দূর যেতেই নাফিসের কথা ভেবে মুখ টিপে হাসলো।


প্রচন্ড ক্লান্তিতে মাথা ধরে আছে মাইজিনের। মনে হচ্ছে মাথাটা ফেটে যাবে ব্যথায়। সে বাড়ি ফিরে সোজা ওয়াশরুমে গেলো। তুলিকাকে রুমে দেখা গেলো না। সে ঘরে থাকলে তো দরজা লক করা থাকতো না বাইরে থেকে।নিশ্চয়ই নুশাদের বাড়ি গেছে মিষ্টিকে নিয়ে। এদিকে মাইজিনের মাথা ব্যথা সহ্য হচ্ছে না। কোনো রকমে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। তুলিকা যখন আসলো তখন মাইজিনের সবে সবে একটু চোখ টা লেগে গেছিলো। তুলিকা আর মিষ্টি এক সাথে ঢুকলো। মিষ্টি পাশের রুমে চলে গেলো। মাইজিন তুলিকার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে চাইলো।

‘কখন আসলেন?’

‘এইতো একটু আগে।’

‘আমার কাছে একটু বসুন না তুলিকা!’

‘বসলে হবে না। রান্না করতে হবে তো।’

‘একটু বসুন!’ কাতর গলায় বললো মাইজিন। তার এই নিদারুণ আবদারকে খুব নিষ্ঠুর ভাবে প্রত্যাহার করলো তুলিকা। মুখের সামনেই কিছু কঠিন বাক্য ছুড়ে দিলো।

‘অফিস থেকে এসেছেন শুয়ে রেস্ট নিন মাইজিন। সব সময় ছোঁয়ার একটা বাহানা খোঁজেন। এখন আপনার পাশে বসব আর আপনি আমাকে উঠতেই দিবেন না। চিপকে ধরে থাকবেন। বার নানান ভাবে স্পর্শ করবেন৷ সব সময় এরকম ভালো লাগে না। আমিও মানুষ আমারও একটু স্পেসিফিক টাইম চাই। স্পেস চাই। সব সময় স্পর্শ করা চাই ই হ্যাঁ?’

‘আমি আমার কথার খেলাফ করে তোমাকে স্পর্শ করিনি তুলিকা! আমি প্রথম বার যখন তোমাকে স্পর্শ করি তখনও তোমার অনুমতিতেই স্পর্শ করেছিলাম। তোমার মনে আছে? রাস্তায় প্রথমদিন তোমাকে ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া টা? সেদিন কিন্তু তুমি আমার দেওয়া শাড়ীটা পরেছিলে। আমি সেদিন তোমাকে ওই ভাবে স্পর্শ করাটাও মিস করতে চাইনি। আমি যেভাবেই তোমাকে স্পর্শ করে থাকি না কেন সেটাই ছিলো শুধুই ভালোবাসা! আমার দেওয়া শাড়ী পরাটা তোমার অনুমতি ধরে নিয়েই স্পর্শ করি তোমাকে। মাইজিন সুলতান তার দেওয়া কথা রেখেছিলো। আর আজকে তুমি আমাকে এইভাবে বলতে পারলে? ওয়াও!’

তুলিকা অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে রাখলো। সে সত্যিই ওভাবে বলতে চাইনি মাইজিনকে। এখন নিজের উপরেই নিজে ক্ষেপে গেলো৷ কি রকম কঠিন কথা বলে ফেলেছে এখন বুঝতে পারছে। এভাবে বলাটা কি খুব জরুরি ছিলো? স্পষ্ট ব্যথাতুর চোখ- মুখ মাইজিনের।তার ব্যথিত মুখের পানে চেয়ে তার কষ্ট দ্বিগুন হারে বাড়লো। মাইজিন ভাঙা গলায় আবার বলল,

‘আমার স্পর্শে কি শুধুই কামনা খুঁজে পান তুলিকা? ভালোবাসা নেই? এতোটাই তিক্ত লাগে আমার ছোঁয়া! নিশ্চয়ই লাগে না হলে এমন তিক্তক বাক্য কেউ মুখে আনে! আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা, স্পর্শে, স্পর্শে ভালোবাসাটা কিছুই না? আসলে ভালোবাসার মানুষের কাছে যাওয়াটা কি অন্যায়?’

‘আ’ম স্যরি মাইজিন। আ’আমি আসলে*।’

‘বুঝেছি আমি। আপনি যান আমি এখানেই শুয়ে পরছি। আপনি যান মিষ্টির রুমে!’

মাইজিন মাথা ব্যথার কথাটা আর জানালো না তুলিকাকে। দাঁত দাঁতে কামড়ে মাথা ব্যথা সহ্য করলো। তুলিকা কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো অসহায় দৃষ্টিতে। নিজের মুখের কথাকেই এখন নিজের কাল বলে মনে হচ্ছে। কেন ওভাবে বলতে গেলো সে!ছিঃ! কতটা কষ্ট পেয়েছে মানুষটা। ওভাবে না বললেও পারতো সে। তুলিকা অন্য রুমে গেলে মাইজিন কোনো রকমে উঠে দরজা বন্ধ করা দিলো। তুলিকা থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে দেখলো। এর আগে মাইজিন কখনোই দরজা এভাবে বন্ধ করেনি। আর আজকে?

সকালে সাতটা বাজতেই মাইজিন অফিস চলে গেলো। মাথা ব্যথাটা কিছুটা কমেছে। তবে বুঝতে পারলো আবার ব্যথাটা উঠবে।

তুলিকা মাইজিনকে ডাকতে এসে দেখলো মাইজিন নেই। মিষ্টি স্কুলে যাওয়ার পর সে দরজা আটকে দিলো। রাতে সে খেতে ডেকেছে মাইজিন দরজা খুলে নি। সকালের খাবারও খেলো না মানুষটা। তার কথায় তীব্র অভিমান হয়েছে মানুষটার বুঝতে পারলো সে। খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারলো মাইজিনের কষ্টটা। মাইজিন এর আগে কখনোই এরকম করেনি। আর আজকে তার একটা ভুলের জন্য মানুষটা তিলেতিলে কষ্ট পাচ্ছে। তুলিকা নিজের গালেই সপাটে কয়েকটা থা’প্প’ড় দিলো।

সকালে উঠে রোজকার মতো রান্না ঘরে গিয়ে তাকে জ্বালাতন করেনি। হুটহাট গিয়ে চুমু দেইনি।অভ্যাস বশত সে খুবই মিস করছিলো মাইজিনকে। আজকে মাইজিন তাকে জ্বালাতনও করেনি ইভেন কথাও বলেনি। মাইজিন অফিস থেকে ফিরে কখনোই শুয়ে থাকে না। কাল শুয়ে ছিলো। নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছিলো মানুষ টার। সেজন্যই তাকে পাশে বসতে বলেছিলো। এটা একটাবার ভাবলো না সে মাইজিন কেন শুয়েছে? একটা বার জিজ্ঞেস করলো না মানুষটার খারাপ লাগছে কি না? সবটা ভাবলেই বুক ফে’টে কান্না আসছে তার। কেন সে ওমন ধারালো বাক্য ছুড়েছিলো মাইজিনের দিকে। কেন? সে মুখ চেপে কাঁন্না করে দিলো। মাইজিনের শুয়ে থাকা বিছানায় শুয়ে পরলো। হঠাৎ তার পিঠের নিচে শক্ত কিছু বাঁধলো। সে উঠে হাতে নিয়ে দেখলো একটা মেডিসিন।

‘কেফেডোন! এই ওষুধ? এই ওষুধ টা কিসের জন্য? এটা কি মাইজিন খেয়েছে? মানুষটার কি শরীর অনেক খারাপ ছিলো? আল্লাহ আমি কেন উনার সঙ্গে ওরকম করলাম।’

সে মাইজিন কে কল করলো দ্রুত। কিন্তু সে কল ধরলো না। সে না পেরে অস্থির হয়ে নাফিসকে কল দিলো।

‘ হ্যাঁ ভাবি বলুন! কোনো দরকার?’

‘ হ্যাঁ নাফিস ভাই কেফেডোন কিসের ওষুধ গো?’

‘সেকি ভাবি আপনি জানেন না? কাল রাতে আমিই তো ওষুধ দিয়ে এলাম। মাইজিনের প্রচন্ড মাথা ব্যথা ছিলো। ওষুধ টা মাথা ব্যথার।’

তুলিকা শব্দ করে কেঁদে দিলো। সে কি করে ফেলেছে এটা। কালকে রাতের ব্যবহারের জন্য ভেতরটা এখন আরও বেশি পুঁড়ছে। খাঁ খাঁ করছে ভেতরটা। অপরাধ বোধ সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো।

‘আরে ভাবি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে?’

‘ভাই আমাকে একটু আপনার বন্ধুর অফিসে নিয়ে যাবেন?’

‘এখন?’

‘ হ্যাঁ!’

নাফিসের অন্য একটা দরকারি কাজ ছিলো কিন্তু পরিস্থিতি অন্য রকম বুঝে রাজি হলো তাকে নিয়ে যেতে। তুলিকা যখন অফিস পৌঁছে যায় তখন ভীষণ ভীর দেখলো মাইজিনের ডিপার্টমেন্টের হেড অফিসে। সে ভীর ঠেলে ঢুকে দেখলো মাইজিন অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। কয়েকজন তার জ্ঞান ফেরানোই ব্যস্ত।তুলিকা চিৎকার দিয়ে গেলো তার কাছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here