হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১৫

0
954

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১৫
#রাউফুন

সাত সাতটা দিন কে’টে গেছে মাইজিনের দেখা মেলেনি। না কোনো টেক্সট না কোনো কল এসেছে মাইজিনের নাম্বার থেকে। বরং একাধারে তুলিকাই একের পর এক কল করে গেছে তাকে। কিন্তু প্রত্যেকবার ফোন দিয়ে হতাশ হয়েছে। ফোন বন্ধ ছিলো সারাক্ষণ। চিন্তায় চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছে প্রায় তুলিকা। এই ক’দিনে তার চোখ মুখের করুন অবস্থা হয়েছে। কিন্তু তবুও অবুঝ মন পথ চেয়ে বসে থাকে তার অপেক্ষায়! তার চোখ যেনো এক অদৃশ্য কুয়ো। অনর্গল প্রিয় মানুষটার কথা ভেবে চোখের পানি পরেই যাচ্ছে। মাথায় নানান চিন্তা ভাবনা ভর করছে। মাইজিন কি তবে আর ফিরবে না? প্রিয়জন যদি পাশে থাকে মনে হয় সব সুখ একত্রে পাওয়া হয়ে গেছে কিন্তু এখন যেনো সবকিছুই বিষাদ। সে শুনেছে, ভালোবাসা তখনি সত্যি হয় যখন ভালোবাসার মানুষটি মনের মত হয়। সেকি মাইজিনের মনের মতো নয়? মাইজিন কি তাকে ভুলে গেলো? না হলে একদিনের কথা বলে সাতদিন থেকে মানুষটা লাপাত্তা কিভাবে হয়ে গেলো? নাকি কোনো বিপদে পরেছে মাইজিন? মাইজিনের যদি কিছু হয়ে যায় তখন কি হবে তার? সে কিভাবে থাকবে মানুষটাকে ছাড়া?

‘এই আপু তুমি এখনো মন খারাপ করে আছো?’

এখন সন্ধ্যা ছয়টা বিশ বাজে। সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। কিন্তু তারপরও আকাশের মৃদু মন্দ আবছা আলোই চারিপাশ ভরে আছে। তুলিকা, মিষ্টি, নুশা একটা পার্কে এসেছে বেড়াতে। নুশা হলো নতুন ভাড়াটিয়া। মিষ্টির বয়সিই মেয়েটা। নুশার মা কোথাও একটা গেছেন তুলিকা আর মিষ্টির কাছে রেখে। সেকি ভাব হয়েছে মিষ্টির সঙ্গে নুশার। নুশার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো তুলিকা।

‘নাহ কিছু না। তোমার কথা মতো এখানে তী আসলাম। তোমার মা যদি জেনে যান কি হবে ভেবে দেখেছো? চলো এখন উঠি!’

‘এই বুবুজান আরেকটু থাকি না?’

এরপর তিন জন মিলে বেঞ্চে বসে গল্প করতে থাকে। মিষ্টি জানে তার বুবুজানের মন ঠিক কতটা খারাপ। যদি পার্কে থেকে একটুখানি মন টা ভালো হয় তাতে ক্ষতি কি? থাকুক না আর কিছুক্ষন। তার মাইজিন ভাইয়ার যে কি হয়েছে কে জানে? মিষ্টি দেখলো পার্কের গেটের বাইরে একটা লোক মেশিনে হাওয়াই মিঠাই বানিয়ে সেগুলো বিক্রি করছেন। মিষ্টির খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

‘এই বুবুজান ওই দেখো হাওয়াই মিঠাই। চলো খাবো!’

‘হাওয়াই মিঠাই! এটা তো আমারও খুব ভালো লাগে মিষ্টি। এই তুলিকা আপু চলো না।’ বললো নুশা।

‘ঠিক আছে তোমরা এখানে বসো আমি কিনে আনছি। এখানেই থাকবে কিন্তু!’

‘আচ্ছা আপু।’

তুলিকা গেটের কাছে গিয়ে হাওয়াই মিঠাই দোকানিকে বললো, ‘কালার ছাড়া দুটো হাওয়াই মিঠাই বানান চাচা!’

‘আইচ্ছা আম্মাজান!’

গোলাপি রঙের হাওয়াই মিঠাই তার কাছে ভালো লাগে না। ওটা খেলে মুখের অবস্থাও বাজে হয়। তাই সে সাদাটা বানাতে বলে! সে আশেপাশে তাকালো। পার্কের মানুষজন এখন কমে আসছে আস্তে আস্তে। সে মাইজিনের দেওয়া শাড়ীটা নিজের ইচ্ছেতেই পরেছে। মাইজিন যাওয়ার পর প্রায় সাত দিন থেকেই এই শাড়ীটা বিকেল করে পরে ফেলে। যদি মাইজিন চলে আসে সন্ধ্যায়? সে তো মাইজিনকে বলেছিলো সন্ধ্যায় সে তাকে সারপ্রাইজ দেবে। এই শাড়ীটা নিজের ইচ্ছেতেই তো পরেছে সে। কিন্তু যার জন্য পরেছে সেই মানুষটার ই তো খোঁজ নেই। মাইজিন যাওয়ার পর সে খুবই ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে সে ঠিক কতটা ভালোবাসে মাইজিনকে। মাইজিন নামক আপাদমস্তক মানুষটার প্রতিই তার অন্য রকম এক মাদকতা কাজ করে। মাইজিন নামটাই কেমন নেশা আছে তাই না? শুনলেই ভেতর থেকে কেমন করে উঠে।

আশেপাশে যখন সে দেখতে ব্যস্ত তখন হঠাৎ দূরে একটা পরিচিত চেহেরা দেখতে পেলো। কিয়ৎক্ষন বিমুঢ়, স্তব্ধ, নিশ্চল, একই সাথে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইলো তুলিকা। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘মাইজিন!’ মাইজিন জেব্রা ক্রসিং দিয়ে হেঁটে আসছে। তুলিকা নিশ্চল পা জোড়া জোর করে এগিয়ে নিয়ে গেলো তার দিকে। চোখ মুছে মুচকি হেসে পেছন থেকে মাইজিনের হাত টেনে ধরলো৷ মাইজিন হাঁটা থামিয়ে দিলো৷ সামনের দিকে ফিরে ভ্রু উঁচু করে তাকালো তুলিকার দিকে। সে ভাবতেই পারছে না মাইজিনকে এখানে দেখতে পারবে সে৷ মাইজিনের দৃষ্টিতে একটা রক্তবর্ণ ভাব দেখা গেলো। তুলিকার হাসি হাসি মুখখানা চুপসে গেলো। মাইজিনের চোখ মুখে ছিলো অন্য কিছু। যাতে করে সেই দৃষ্টিতে ভয়ে আঁতকে উঠে ভেতর থেকে। মাইজিন তুলিকার হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে দিলো। এরপর আবার হাঁটা শুরু করলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো তুলিকা। মাইজিনের হাবভাব তার কাছে একদম অন্য রকম লাগলো। মাইজিন এমন ভাব করলো যেনো তুলিকাকে সে এর আগে দেখেইনি। চেনেই না।

তুলিকা দৌঁড়ে গিয়ে আবার তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে পরলো। মাইজিন তাকে এভয়েড করে অন্য সাইড দিয়ে চলে গেলো। তুলিকা চিৎকার করে ডাকলো তাকে কিন্তু মাইজিন কোনো রকম সাড়া না দিয়ে আপন মনে হাঁটা শুরু করেছে। অনর্গল চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসছে তুলিকার। মানুষটার হলো টা কি? সে আবারও মাইজিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

‘আমার সামনে থেকে সরো!’ শান্ত কিন্তু কড়াভাবে বললো মাইজিন।

‘নাহ সরবো না। আমি আপনাকে ডাকছি দেখছেন না? আপনি কেন এমন করছেন? একদিনের কথা বলে এক সপ্তাহ কে’টে গেছে মাইজিন। আপনি ফিরেন নি কেন? আর যখন দেখা হলো এরকম অদ্ভুত বিহেভিয়ারের মানে কি?’

‘আমার সামনে থেকে সরো। নইলে ভালো হবে না।’

‘কেন কি এমন করবেন আপনি?’ তুলিকা দুই হাত আড়া-আড়ি করে ভাজ করলো। তার ধারণা হলো কোনো একটা কারণে মাইজিন হইতো রেগে আছে তার উপির।

হঠাৎ মাইজিন ওর কালো হুডি দিয়ে ঢাকা মাথায় হায় ঢুকিয়ে মাথা চুলকালো। এমন কি সে অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করলো। দাঁত কিড়মিড় করছে সে। দেখে এমন মনে হচ্ছে যেনো সে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। তুলিকা পুরো শকড হয়ে যাচ্ছে মাইজিনকে এইভাবে দেখে। আঁচানক মাইজিন তুলিকার বুকের ঠিক উপরে ডান হাত দিয়ে জোরেশোরে একটা ধাক্কা দিলো।

‘সরো বলছি। কখন থেকে বলছি সামনে থেকে সরতে? সরো না কেন? রাস্তা ঘাটে পুরুষ মানুষ দেখলে মাথা ঠিক থাকে না হ্যাঁ?’

কথা শেষ করেই মাইজিন দ্রুত হেঁটে তার চোখের আড়াল হয়ে গেলো৷ দুইজনের হাবভাব নজর কাড়া হওয়াই যাতায়াতকৃত সকলে আড়চোখে তাদেরকে দেখছিলো। মাইজিন প্রস্থান করাই আবার সবকিছু স্বাভাবিক হলো। আরেকটু জোরে ধাক্কা দিলেই সে মেইন রোডের মাঝ খানে চলে আসতো। এই কি সেই মাইজিন যে তাকে একটাও কটু কথা বলতো না। চোখ রাঙানো তো দূর শক্ত গলায় একটা কথা পর্যন্ত বলতো না। মানুষটা তাহলে আজ কেন এরুপ আচরণ করলো? আজ সে কাকে দেখলো? এই মানুষটাকে যে তার একদম অন্য রকম লাগছে। সম্পুর্ন ভিন্ন একজন মানুষকে দেখছে সে আজ। তুলিকা চোখমুখ শক্ত করে শাড়ির আঁচল খামচে ধরলো। নাক, চোখ লাল হয়ে গেছে তার। এই বুঝি কান্নারা ছিটকে বেরিয়ে আসবে। আর সেই কান্নাকে আটকে রাখার চেষ্টা করলেও আটকাতে পারবে না।
একমুহূর্তের জন্য থমকে গেছে সে। অভিমান হয় রাজ্যসম। নয়নের তারা চিকচিক করে উঠে। এতটাই নিষ্ঠুর বুঝি মানুষটা? কি অবলীলায় বলে দিলো কথাগুলো। তাদের বিয়ের শুরু থেকে যে মাইজিনকে তুলিকা দেখেছে সে আজকের মাইজিনকে দাবিয়ে দিয়েছে। তার মানে কি সত্যিই শুরু থেকে সবটা মিথ্যে ছিল? সব ছলনা ছিল? রাগে-ক্ষোভে দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় নিজের পরনের শাড়ির দিকে। ইচ্ছে করছে এক টানে এটাকে খুলে ফেলে দিতে। আঁচল চেপে হাত মোচড়াতে থাকে সে।

‘আম্মাজান আপনের হাওয়াই মিঠাই নিবেন না?’

তুলিকার ধ্যান ভাঙে হাওয়াই মিঠাইওয়ালার কথায়। সে তার হাত থেকে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলো।

‘আম্মাজান ট্যাকা দিলেন না যে?’

‘ওহ হ্যাঁ দিচ্ছি চাচা!’

তুলিকা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেখলো পাঁচশো টাকার নোট। মাইজিন তো শুধু তাকে বড় নোট দিয়েছিলো সেদিন।

‘আমার কাছে যে পাঁচশো টাকার নোট ছাড়া ভাংতি টাকা নেই চাচা!’

‘এতো ট্যাকার খুচরা আমি কই পামু আম্মাজান?’

‘স্যরি চাচা। আমি অন্যদিন এসে যদি আপনার টাকাটা দিই তাহলে হবে? আমি বরং কাল এসে দিয়ে যাবো? এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে বাসায় যেতে হবে তো!’

‘আইচ্ছা আম্মাজান দিয়েন আপনে। আমি বিকেলে এইহানেই বসি।’

‘আচ্ছা।’

‘আম্মাজান আপনে কানতাছেন ক্যান?’

তুলিকা ঝটপট চোখ মুছে হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘না চাচা ক-কিছু না।’

বলেই চলে এলো সে। তার মনে চলছে তুমুল ঝড়। শরীরের বল যেনো ছেড়ে দিচ্ছে। কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে আলুথালু পায়ে সে পার্কের দিকে এগিয়ে গেলো। পার্কের বেঞ্চে মিষ্টি আর নুশা ভীষণ অধৈর্য্য হয়ে বসে আছে।

সে আবার ভাবনায় বিভোর হলো। এটা কি ছিলো? মানুষটা তাকে এভাবে ধাক্কা দিলো? তার কি হয়েছে? আর আচমকা এরকম ব্যবহার ই বা কেন করলো? সে মানতেই পারছে না কিছুতেই না। বক্ষস্থলটা যেনো খঞ্জন দিয়ে কেউ খোচাচ্ছে খুব বিশ্রি ভাবে। দগদগে ঘা হয়ে গেছে বক্ষস্থল টাই।

‘ওই বুবুজান এতো দেরি করলা কেন?’

‘এমনি। এই নাও হাওয়াই মিঠাই!’

নুশা আর মিষ্টি হাওয়াই মিঠাই নিলো। ‘আরে আপু তোমার জন্য নাও নি?’ বলল নুশা

‘নাহ আমি খাই না।

‘সেকি! বুবুজান তোমার তো খুব পছন্দ হাওয়াই মিঠাই! তাইলে নিলা না কেন?’

‘আজ থেকে আর কোনো পছন্দ রইলো না তোর বুবুজানের। বাসায় চল সাত টা বেজে গেছে।’

‘কি হয়েছে বুবুজান? এভাবে কেন কথা বলছো? তোমার চোখ-মুখের একি অবস্থা করেছো?’ বিচলিত হয়ে শুধালো মিষ্টি।

‘আজকে থেকে সব প্রিয় জিনিস অপ্রিয় হয়ে গেলো। প্রিয় জিনিস থাকতে নেই রে। প্রিয় জিনিস থাকলেই যে সেটা ধুলাই লুটিয়ে যায়। বড্ড অবহেলায় হারিয়ে যায়৷ বড্ড অবহেলায়!’

#চলবে

হীরকচূর্ণ মানে জানেন? হইতো অনেকেরই জানা আবার অনেকেরই অজানা। হীরকচূর্ণ মানে হলো কঠিন বি’ষ। ভালোবাসা নামক কঠিন বি’ষ দুই মানব মানবি পান করবে। যাকে বলে কঠিন বিষাক্ত ভালোবাসা। তাই তো গল্পের নাম হীরকচূর্ণ ভালোবাসা বুঝলেন? তো গল্পে কষ্ট তো থাকবেই!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here