হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব-৩৪

0
633

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৩৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

ঘড়ির কাটা বারোটার ঘরে ছুঁই ছুঁই। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। রাস্তায় একটি কালো বিড়ালের মিঁউ মিঁউ ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। এমন সময় একটা লম্বাকৃতির কালো ছায়া খোদেজার রুমের বাইরে দেখা যায়। ছায়াটা খুবই আস্তে আস্তে দরজার কাছে এগোতে থাকে। ছায়াটা মূলত শুদ্ধ’র। পা টিপে টিপে মায়ের রুমে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে সে। খোদেজার রুমের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। রুমের লাইট বন্ধ। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুদ্ধ কিছু ঠাওর করতে পারে না। আরো একটু স্পষ্ট করে দেখার চেষ্টায় শুদ্ধ দরজার কাছে এগোতেই দরজা তার ধাক্কায় ক্যাত করে শব্দ হলে শুদ্ধ দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে আসে। শব্দ পেয়ে ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে ধারা। খোদেজা নির্লিপ্ত থেকে একটু জোরে জোরেই বলে,
‘ও কিছু না বউ। তুমি শুইয়া থাকো। মনে হয় কোন বিড়াল ছিল। আজকাল বড্ড জ্বালানি শুরু করছে।’

ধারা শুয়ে পড়লো। তারও একদমই ঘুম আসছে না। বারবার মন শুধু বাইরে যেতে চাইছে। বাইরের শব্দটা যে শুদ্ধ’র ছিল সেটা সেও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু শ্বাশুড়ির সামনে তো আর কিছু বলতে পারে না! তাই সে চুপচাপ শুয়ে রইলো। খোদেজার কথা স্পষ্টই শুনতে পায় শুদ্ধ। মা তাকে বিড়াল বলেছে রাগে দুঃখে শুদ্ধ খোদেজার দরজার সামনে গিয়ে শুধু পায়চারি করতে থাকে। ধারা একটু মাথা উঠিয়ে দেখতে নেয়। কিন্তু খোদেজার ঠান্ডা চোখের দৃষ্টি দেখে আবারো দ্রুত শুয়ে পড়ে। দরজার ওপাশে শুদ্ধ’র পায়ের খটখট শব্দ বাড়তে থাকে। খোদেজা বলল,
‘এমন হাঁটাহাটি কইরা লাভ নাই। বউরে আর পাবি না। বউ আমার কাছেই থাকবো। চুপ কইরা যাইয়া ঘুমায় থাক।’

শুদ্ধ হাঁটা থামিয়ে বলল,
‘আম্মা, এটা কিন্তু ঠিক না। তুমি আমার বউকে নিয়ে আসবা কেন? আমার বউ আমার কাছে থাকবে।’

‘এই কথা ঝগড়ার করার সময় খেয়াল ছিল না! একসাথে হইলে যখন তোমরা ঝগড়াই করবা তাইলে আলাদাই থাকো। বউ আমার কাছেই ঘুমাবো আর তুমি যাইয়া তোমার রুমে ঘুমাওগা।’

‘না তাহলে আমিও এখানেই ঘুমাবো। আমার একা একা ভয় লাগে।’

‘মাইর খাবি এখন। ছাব্বিশ বছর একলা একলা ঘুমাইছিলি কেমনে? এখন তোর ভয় লাগে! যা এদিক থিকা!’

শুদ্ধ মেঝেতে বসে পড়ে বলে, ‘না, আমি যাবো না। আমি এখানেই বসে থাকবো।’

খোদেজা নির্লিপ্ত স্বরে বলে, ‘তাইলে থাক সারারাত ঐখানেই বইসা৷ তোর যেমন ইচ্ছা।’

তারপর ধারার দিকে ফিরে খোদেজা বলে,
‘তুমিও কিন্তু আবার ও’র মতো কইরো না বুঝছো! চুপচাপ ঘুমায় থাকো।’

শ্বাশুড়ির হুকুম শুনে ধারা চটজলদি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কাঁথা মুড়ি দেয়। শুদ্ধ মুখ গোমড়া করে সেখান থেকে উঠে নিজের রুমে চলে আসে৷ অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। রাত আরও গভীর হয়। একসময় ধারা আস্তে আস্তে মাথা থেকে কাঁথা সরায়। একটু উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করে খোদেজাকে। খোদেজার চোখ বন্ধ। অপরপাশ ফিরে শুয়ে আছে সে। ঘুমে পুরো কাতর। ধারা আস্তে করে গা থেকে কাঁথা সরায়, একটু একটু করে উঠার চেষ্টা করে। ঠিক তখনই খোদেজার কাশির শব্দ শুনলে আবারও ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তারপর দেখে খোদেজার ঘুম ভাঙেনি। এমনিই ঘুমের ঘোরে কেশে উঠেছিল। ধারা আবারও আরেক দফা উঠার চেষ্টা করে। খুবই আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে পা ফেলে উঠে দাঁড়ায়। পা টিপে টিপে বিছানা ছেড়ে এগোতে থাকে। খোদেজা দরজার মুখোমুখি শোওয়া। ধারা শুয়েছিল তার বিপরীত পাশে। তাই স্বাভাবিকই ধারার খোদেজাকে অতিক্রম করেই যেতে হবে। অন্ধকারে খুব সাবধানে এগোতে থাকে ধারা। এমনসময় খোদেজা পাশ ফিরতেই ধারা দ্রুত মেঝেতে বসে পড়ে। আস্তে আস্তে মাথা উঠিয়ে দেখে খোদেজা ঘুমিয়েই আছে। তারপর খুবই ধীরে ধীরে দরজা ফাঁক করে বেরোতেই কার সাথে যেন হঠাৎ ধাক্কা খায়। অন্ধকারে দুজনেই চমকে উঠে। ধারা চিৎকার দিতে দিতেও থেমে যায়। শুদ্ধ মুখ চেঁপে ধরে৷ ধারা নিজেকে ধাতস্থ করে ফিসফিস করে বলে,
‘ওহ তুমি! আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।’
শুদ্ধও অভিমানের স্বরে বলে,
‘আসছো তাহলে! আমি তো ভাবছি আর আসবেই না। কি না কি একটু রাগারাগি হয়েছে তার জন্য তুমিও এভাবে মার সাথে চলে যাবা! আমার কথা একটুও ভাবলে না?’

ধারা মোলায়েম স্বরে বলল,
‘আমি কি ইচ্ছে করে গিয়েছি! মা ই তো আমাকে টেনে নিয়ে গেলো। আমারও তো যেতে ইচ্ছে করছিল না। ঘুমও আসছিল না এতক্ষণ।’

‘আর আমার বুঝি খুব ঘুম আসছিল! এজন্যই তো এখানে দশবার চক্কর দিয়ে ফেললাম।’

ধারা শুদ্ধকে সাবধান করে বলল, ‘আস্তে কথা বলো। মা আবার ঘুম থেকে উঠে যেতে পারে। আমাদেরকে একসাথে মা দেখলে আবারও রাগ করবে।’

‘এদিকে আসো।’ বলে শুদ্ধ ধারাকে বারান্দায় নিয়ে আসলো। দুজনে পাশাপাশি মেঝেতে বসলো। কেউ কোন কথা বলল না। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। দুজনেই চুপচাপ। ইতস্তত করতে লাগলো। কি বলবে না বলবে ভেবে পেলো না। শুধু আড়চোখে বারবার একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। একসময় শুদ্ধই নিরবতা ভেঙে আস্তে আস্তে বলতে লাগলো,
‘আচ্ছা সরি! আমারই ভুল হয়েছে। আমি আজকে তোমার সাথে খুব বেশি রাগারাগি করেছি তাই না!’

ধারা আস্তে করে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
‘না, ঠিকই আছে৷ তুমি তো আমার জন্যই চিন্তায় এমন করেছো। ভুলটা আমারই। আমিই তোমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলাম। আমার কোন ভাবে তোমাকে ইনফর্ম করা উচিত ছিল।’

শুদ্ধ জোর গলায় বলল,
‘আরে না। তোমার ভুল কিভাবে হয়? তুমি তো আর ইচ্ছা করে করোনি! তোমার কাছে তো আর ফোন ছিল না। জানাবে কিভাবে? তারপরে তো আমার ফোনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর যা করেছো ভালোই করেছো৷ সাম হাউ যদি আমি কোথাও আটকে যেতাম তাহলে তো তোমাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আমিই শুধু শুধু ওভাররিয়্যাক্ট করে ফেলেছি।’

‘না, ভুলটা আমারই। আমার জন্যই এতোকিছু হয়েছে।’

‘আরে না, আমার ভুল।’

‘না আমার ভুল।’

আবারও কথা তর্কে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে শুদ্ধ ধারা দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো৷ দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ সবকিছুই লুকিয়ে দেখছিল খোদেজা। ওদের মধ্যে সবকিছু আবার ঠিক হয়ে গেছে দেখে মুচকি হেসে আবার নিজের রুমে চলে যায় সে। খোদেজার উপস্থিতি তারা কেউই টের পায়নি। দুজনে নিজের মতো করেই কথা বলে যেতে থাকে। শুদ্ধ মৃদু হেসে মাথা চুলকে বলল,
‘কি যে করি না আমরা! আজকে কি ঝগড়াটাই না করলাম।’
ধারা মাথা নিচু করে স্মিত হেসে বলল, ‘হুম।’

শুদ্ধ বলল, ‘তবে যাই বলো, আমি প্রথম প্রথম তোমার সাথে অনেক চেচাঁমেচি করে ফেলেছি। আমার এটা ঠিক হয়নি। তোমার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লেগেছিল! কতো সবকিছু ঠিক রাখার চেষ্টা করি। তবুও সবকিছু জীবনে স্মুথলি যায়-ই না। ছোটখাট দুঃখকর ব্যাপার গুলো ঘটেই যায়।’

ধারা বলল, ‘ছোট ছোট দুঃখ জীবনে থাকা ভালো। কখনো পরিপূর্ণ সুখী হতে নেই। ঐ যে কথায় আছে না বেশি সুখ কপালে সয় না। সুখের পাল্লা বেশি ভারী হয়ে গেলে স্রোতের মতো দুঃখ জীবনের দিকে ধেয়ে আসে। প্রকৃতি ভারসাম্য পছন্দ করে। সুখের আধিক্য যতো বেশি হবে তাকে ঘাটতি করা দুঃখের পরিমাণ ততোই বড় হবে। আমার মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় শুদ্ধ। আমি খুব বেশি সুখী হয়ে গেছি। কিছু হবে না তো!’

শুদ্ধ হেসে ধারাকে হাত দিয়ে আগলে বলল, ‘ধুর! কিছুই হবে না। তুমি বেশি বেশি ভাবো। আমি আছি না!’

শুদ্ধ’র ভরসামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে ধারা বিচলিত মুখেই স্মিত হাসে। শুদ্ধ’র কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখে। আর মনে মনে কামনা করে এই সময় কখনোই না ফুরাক।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here